শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
আদি খণ্ড
------গ্রন্থারম্ভ-----
প্রথম তরঙ্গ
------গ্রন্থারম্ভ-----
প্রথম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরীদাস।।
জয় শ্রীস্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হরি অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরীদাস।।
জয় শ্রীস্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হরি অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
অথ মঙ্গলাচরণ।
হরিচাঁদ চরিত্রসুধা প্রেমের ভাণ্ডার।
আদি অন্ত নাহি যার কলিতে প্রচার।।
সত্য ত্রেতা দ্বাপরের শেষ হয় কলি।
ধন্য কলিযুগ কহে বৈষ্ণব সকলি।।
তিন যুগ পরে কলি যুগ এ-কনিষ্ঠ।
কনিষ্ঠ হইয়া হৈল সর্ব্বযুগ শ্রেষ্ঠ।।
এই কলিকালে শ্রীগৌরাঙ্গ অবতার।
বর্ত্তমান ক্ষেত্রে দারুব্রহ্মরূপ আর।।
যে যাঁহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।
ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার।।
হয়গ্রীব অবতার কপিলাবতার।
অষ্টাবিংশ অবতার পুরাণে প্রচার।।
মৎস্য কুর্ম্ম বামন বরাহ নরহরি।
ভৃগুরাম রঘুরাম রাম অবতরি।।
ঈশ্বরের অংশকলা সব অবতার।
প্রথম পুরুষ অবতার রঘুবর।।
নন্দের নন্দন হ’ল গোলোকের নাথ।
সংকর্ষণ রাম অবতার তাঁর সাথ।।
সব ঈশ্বরের অংশ পুরাণে নিরখি।
বর্ত্তমান দারুব্রহ্ম অবতার কল্কি।।
সব অবতার হ’তে রাম দয়াময়।
দারুব্রহ্ম দয়াময় কৃষ্ণ দয়াময়।।
পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণানন্দ নন্দের নন্দন।
সেই নন্দসুত হ’ল শচীর নন্দন।।
যে কালে জন্মিল কৃষ্ণ পূর্ণব্রহ্ম নয়।
পূর্ণ হ’ল যেকালে পড়িল যমুনায়।।
শচীগর্ভে জন্ম ল’য়ে না ছিলেন পূর্ণ।
দীক্ষাপ্রাপ্তে পূর্ণ নাম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য।।
তখন হইয়া পূর্ণ সন্ন্যাস করিলে।
আটচল্লিশ বর্ষ পরে মিশিলা উৎকলে।।
সকল হরণ করে তাঁরে বলি হরি।
রাম হরি কৃষ্ণ হরি শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।।
প্রেমদাতা নিত্যানন্দ তাঁর সমিভ্যরে।
হরিকে হরয় সেই হরিভক্ত দ্বারে।।
নিত্যানন্দ হরি কৃষ্ণ হরি গৌর হরি।
হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি।।
এই হরিচাঁদ লীলা সুধার সাগর।
তারকেরে কর হরি তাহাতে মকর।।
আদি অন্ত নাহি যার কলিতে প্রচার।।
সত্য ত্রেতা দ্বাপরের শেষ হয় কলি।
ধন্য কলিযুগ কহে বৈষ্ণব সকলি।।
তিন যুগ পরে কলি যুগ এ-কনিষ্ঠ।
কনিষ্ঠ হইয়া হৈল সর্ব্বযুগ শ্রেষ্ঠ।।
এই কলিকালে শ্রীগৌরাঙ্গ অবতার।
বর্ত্তমান ক্ষেত্রে দারুব্রহ্মরূপ আর।।
যে যাঁহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।
ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার।।
হয়গ্রীব অবতার কপিলাবতার।
অষ্টাবিংশ অবতার পুরাণে প্রচার।।
মৎস্য কুর্ম্ম বামন বরাহ নরহরি।
ভৃগুরাম রঘুরাম রাম অবতরি।।
ঈশ্বরের অংশকলা সব অবতার।
প্রথম পুরুষ অবতার রঘুবর।।
নন্দের নন্দন হ’ল গোলোকের নাথ।
সংকর্ষণ রাম অবতার তাঁর সাথ।।
সব ঈশ্বরের অংশ পুরাণে নিরখি।
বর্ত্তমান দারুব্রহ্ম অবতার কল্কি।।
সব অবতার হ’তে রাম দয়াময়।
দারুব্রহ্ম দয়াময় কৃষ্ণ দয়াময়।।
পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণানন্দ নন্দের নন্দন।
সেই নন্দসুত হ’ল শচীর নন্দন।।
যে কালে জন্মিল কৃষ্ণ পূর্ণব্রহ্ম নয়।
পূর্ণ হ’ল যেকালে পড়িল যমুনায়।।
শচীগর্ভে জন্ম ল’য়ে না ছিলেন পূর্ণ।
দীক্ষাপ্রাপ্তে পূর্ণ নাম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য।।
তখন হইয়া পূর্ণ সন্ন্যাস করিলে।
আটচল্লিশ বর্ষ পরে মিশিলা উৎকলে।।
সকল হরণ করে তাঁরে বলি হরি।
রাম হরি কৃষ্ণ হরি শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।।
প্রেমদাতা নিত্যানন্দ তাঁর সমিভ্যরে।
হরিকে হরয় সেই হরিভক্ত দ্বারে।।
নিত্যানন্দ হরি কৃষ্ণ হরি গৌর হরি।
হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি।।
এই হরিচাঁদ লীলা সুধার সাগর।
তারকেরে কর হরি তাহাতে মকর।।
পুনর্ব্বার অবতারের প্রয়োজন ও পূর্ব্ব পূর্ব্ব ভাগবত ও পুরাণ প্রসঙ্গ।
ত্রিপদী।
ত্রেতাযুগে সূর্যবংশে, এক বিষ্ণু চতুরাংশে,
হ’ল দশরথের নন্দন।
দ্বাপরেতে কারাগারে, জন্ম বাসুদেব ঘরে,
যশোদার হৃদয় রতন।।
যোগমায়ার প্রভাবে, মাতা দেবকীর গর্ভস্রাবে,
রোহিণী গর্ভেতে আকর্ষণ।
যোগমায়া আকর্ষণে, জন্মিলেন বৃন্দাবনে,
বলরাম নাম সংকর্ষণ।।
নন্দের নন্দন যেই, শচীসুত হ’ল সেই,
নিত্যানন্দ হৈল বলরাম।
সেই লীলা সম্বরণ, খেতর জন্ম ধারণ,
নিত্যানন্দ হৈল নরোত্তম।।
শ্রীঅদ্বৈত রামচন্দ্র, শ্রীনিবাস গৌরচন্দ্র,
তিন প্রভু প্রেম প্রচারিলা।
যে জন্যে এ অবতার, পশ্চাতে করি প্রচার,
ওঢ়াকাঁন্দি কৈল শেষ লীলা।।
যস্য পুত্র যস্য নাম, যথা হ’ল জন্মধাম,
করিলাম লিখিতে আশায়।
রসিক সজ্জন বিজ্ঞ, দেহ মোরে এই ভাগ্য,
মনোজ্ঞ নিষ্ফল যেন নয়।।
মানবকুলে আসিয়ে, যশোমন্ত সূত হ’য়ে,
জন্ম নিল সফলানগরী।
প্রচারিল গূঢ়গম্য, সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম্ন,
জানাইল এ জগত ভরি।।
ত্রিপদী।
ত্রেতাযুগে সূর্যবংশে, এক বিষ্ণু চতুরাংশে,
হ’ল দশরথের নন্দন।
দ্বাপরেতে কারাগারে, জন্ম বাসুদেব ঘরে,
যশোদার হৃদয় রতন।।
যোগমায়ার প্রভাবে, মাতা দেবকীর গর্ভস্রাবে,
রোহিণী গর্ভেতে আকর্ষণ।
যোগমায়া আকর্ষণে, জন্মিলেন বৃন্দাবনে,
বলরাম নাম সংকর্ষণ।।
নন্দের নন্দন যেই, শচীসুত হ’ল সেই,
নিত্যানন্দ হৈল বলরাম।
সেই লীলা সম্বরণ, খেতর জন্ম ধারণ,
নিত্যানন্দ হৈল নরোত্তম।।
শ্রীঅদ্বৈত রামচন্দ্র, শ্রীনিবাস গৌরচন্দ্র,
তিন প্রভু প্রেম প্রচারিলা।
যে জন্যে এ অবতার, পশ্চাতে করি প্রচার,
ওঢ়াকাঁন্দি কৈল শেষ লীলা।।
যস্য পুত্র যস্য নাম, যথা হ’ল জন্মধাম,
করিলাম লিখিতে আশায়।
রসিক সজ্জন বিজ্ঞ, দেহ মোরে এই ভাগ্য,
মনোজ্ঞ নিষ্ফল যেন নয়।।
মানবকুলে আসিয়ে, যশোমন্ত সূত হ’য়ে,
জন্ম নিল সফলানগরী।
প্রচারিল গূঢ়গম্য, সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম্ন,
জানাইল এ জগত ভরি।।
পয়ার।
কি ধন্য প্রভুর লীলা এই কলিযুগে।
সব লীলা হ’তে ধন্য হ’ল ভক্তিযোগে।।
দশরথ গৃহে জন্ম লইয়া শ্রীরাম।
ভূভার হরণ পূর্ণ ভক্ত মনস্কাম।।
বৈকুণ্ঠ নায়ক হরি হৈল লীলাকারি।
নন্দের নন্দন কৃষ্ণ গোলোক বিহারী।।
ভূভার হরণ ভক্ত মনোরম্য কারী।
ভক্তসঙ্গে প্রেমরস মধুর মাধুরী।।
তিন শক্তি একত্র হইয়া ভগবান।
দেবকীর বায়ুগর্ভে দুই শক্তি যান।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে মিমাংসা র’য়েছে।
যশোদার গর্ভে মহাবিষ্ণু জন্মিয়াছে।।
চারি শক্তি একযোগে হয় কৃষ্ণ লীলা।
ভাগবতে শুকদেব মিমাংসা করিলা।।
বহুত প্রমাণ লাগে সে সব লিখিতে।
অন্যান্য প্রমাণ গ্রন্থে র’য়েছে বলিতে।।
চৈতন্যচরিতামৃত তাহার প্রমাণ।
বহুযুগ গত পরে এল ভগবান।।
নন্দসূত ব’লে যাঁরে ভাগবতে গাই।
সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ চৈতন্য গোঁসাই।।
বহুত দ্বাপর কলি আসে আর যায়।
স্বয়ং এর অবতার তাতে নাহি হয়।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তর শেষ যেই কলি।
অবতীর্ণ ভক্তবৃন্দ লইয়া সকলি।।
যে দ্বাপরে অন্য শক্তি বিবর্জ্জিত হ’য়ে।
গোলোকবিহারী লীলা গোকুলে আসিয়ে।।
দ্বাপরের শেষ সেই কলির সন্ধ্যায়।
শ্রী গৌরাঙ্গরূপে প্রভু জন্ম নদীয়ায়।।
এই সেই কলি এই সেই অবতার।
অনর্পিত প্রেমভক্তি অর্পিল এবার।।
সেই ত গৌরাঙ্গ প্রভু এই কলিকালে।
অবতীর্ণ নদীয়াতে হরি হরি বলে।।
উৎকলেতে লীলা সাঙ্গ অল্পেতে করিল।
মনের কামনা বহু মনেতে রহিল।।
চৈতন্যচরিতামৃত মঙ্গলাচরণে।
প্রভুর মনের কথা লিখিল যতনে।।
দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর চারি রস।
চারিভাবে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ।।
আপনিও এই ধর্ম করিব যাজন।
ইহা দ্বারা করাইব ভক্তের শিক্ষন।।
সন্ন্যাস করিল প্রভু এই ধর্ম লয়ে।
রাগানুগা প্রেমভক্তি হাটে বাহুড়িয়ে।।
গৌড়িয়ার ভক্ত তার নাহি পায় লেশ।
শুদ্ধাচার সেবা ভক্তি নাম ভাবাবেশ।।
আটচল্লিশ বর্ষ মধ্যে প্রভু দিল ফাঁকি।
এই ত প্রতিজ্ঞা এক রহিলেক বাকী।।
কাশিতে বসিয়া সনাতনে শিক্ষা দিলা।
সনাতনে শিক্ষাকালে অনেক কহিলা।।
অকামনা প্রেম ভক্তি কেবলার রীতি।
আপনি বা তাহা কই পারিল বর্ত্তাইতি।।
কেবলার রীতি এই কৃষ্ণেতে ঐকান্তি।
তার আগে ভক্তি মুক্তি সকলি অশান্তি।।
কৃষ্ণগত প্রাণ হ’বে কৃষ্ণ সুখে সুখী।
কার দেহ লয়ে প্রভু মারে ঝাঁকি ঝুকি।।
কৃষ্ণতে অর্পিত দেহ এ দেহ কৃষ্ণের।
আছুক অন্যের কার্য্য নিজে হৈল ফের।।
হাত পা বাহির হ’য়ে সন্ধিকল ছুটে।
কচ্ছপ আকার হ’য়ে ক্ষণে পৈশে পেটে।।
যদ্যপি প্রভুর মনে থাকে কোন ভাব।
যা দেখিনু তা লিখিনু গ্রন্থের যে ভাব।।
তবে ত প্রভুর মনে কামনা রহিল।
অকামনা প্রেম ভক্তি কই পাওয়া গেল।।
কামনা রহিল আছে দৃষ্টান্ত তাহার।
অদ্বৈতের করে ধরি বলে বার বার।।
বৈকুণ্ঠাদ্যে নাহি যেই লীলার প্রচার।
শেষ যে করিব লীলা মোরে চমৎকার।।
তুমি আমি নিত্যানন্দ এই তিন জন।
করিব নিগূঢ় লীলা রস আস্বাদন।।
তুমি হ’বে রামচন্দ্র আমি শ্রীনিবাস।
দাদা নিত্যানন্দ হবে নরোত্তম দাস।।
শেষ লীলা তিন জন করিল আসিয়া।
প্রচারিল প্রেমভক্তি খেতর যাইয়া।।
নিগূঢ় ভজন লীলা করে তিন জন।
ভাগ্যবান ভক্ত যারা করে দরশন।।
তাদের ভজন গ্রন্থ পড়ে দেখ ভাই।
অকামনা প্রেমভক্তি তাতে বর্ত্তে নাই।।
উদ্দেশ্য থাকিল পুনঃ আসিয়া ধরায়।
ঐ প্রেম আস্বাদিবে তিন মহাশয়।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
সফলানগরী যশোমন্তের নন্দন।।
শচীর নন্দন যবে পড়ে পাঠশালে।
পড়ুয়ার সঙ্গে সদা হরি হরি বলে।
যে জন না বলে হরি কর্মসূত্রে মরে।।
ঠেঙ্গা ল’য়ে যায় প্রভু তারে মারিবারে।
সেই গিয়া করে সায় পাষণ্ড সঙ্গেতে।
মারিব মিশ্রের সূতে আইলে মারিতে।।
অন্তর্য্যামী ভগবান জানিলেন চিতে।
এরূপে না পারিলাম হরিনাম দিতে।।
একবার মাতাকে দিলাম পরিচয়।
গ্রহণের বেড়ি গড়ি দিল মোর পায়।।
স্বীয় পরিচয় তাহে দিবার কারণে।
উদয় হইনু হাত গণকের স্থানে।।
সে মোরে গণীয়া বলে নন্দের নন্দন।
এবে শচীসূত জীব উদ্ধার কারণ।।
কর্মসূত্রে বদ্ধ জীব না চিনিল মোরে।
গণিয়া দেখিয়া বলে একি হ’তে পারে।।
প্রভু কন তার পূর্ব্ব জন্মে কেবা আমি।
ঠিক করি গণনা করহ দেখি তুমি।।
গণক বলেন ছিলে অযোধ্যায় রাম।
কৌশল্যা-জননী পিতা দশরথ নাম।।
তুমি ছিলে রামচন্দ্র জগতের মূল।
ফিরে বলে এ গণনা হইয়াছে ভুল।।
বদ্ধ কর্মসূত্রে জীব উদ্ধারি কেমনে।
কাঙ্গাল হইব আমি তাহার কারণে।।
কেশ মুড়ি কড়া ধরি হইব কাঙ্গাল।
ঘরে ঘরে মেগে খাব হইয়া বেহাল।।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া পুরাইব মনস্কাম।
হাতে ধরি পায় ধরি দিব হরিনাম।।
কাঙ্গাল দেখিয়া মোরে দয়া উপজিবে।
চিত্ত দ্রবিভুত হ’য়ে হরিনাম ল’বে।।
মুকুন্দমুরারী আর নিত্যানন্দ ল’য়ে।
কহিলেন মনোকথা নিভৃতে বসিয়ে।।
পরে কহিলেন শচী মাতাকে কাঁদিয়া।
তাহা শুনি শচীরাণী অধৈর্য্য হইয়া।।
কহিলেন শচীমাতা বাছারে নিমাই।
ছেড়ে যদি যাও রাখিবার সাধ্য নাই।।
অনেক প্রলাপ মাতা করিল তাহাতে।
সান্ত্বনা করিল মাকে মধুর বাক্যেতে।।
শচী বলে তুমি যদি মোরে ছেড়ে যাবে।
এ ব্রহ্মান্ডে তবে আর মাতা কে মানিবে।।
এ সময় গৌরাঙ্গ করিল অঙ্গীকার।
তোমাকে ছাড়িতে মাতা শক্তি কি আমার।।
শোধিতে নারিব মাতা তব ঋণধার।
জন্মে জন্মে তব গর্ভে হব অবতার।।
ধর্ম সংস্থাপন আর জীবের উদ্ধার।
এরূপে লইব জন্ম আর দুই বার।।
তারপর শ্রীনিবাসরূপে জন্ম নিল।
নরোত্তমরূপে নিত্যানন্দ জনমিল।।
আর এক জন্ম বাকী রহিল প্রভুর।
এই সেই অবতার শ্রীহরি ঠাকুর।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।
পয়ার প্রবন্ধ ছন্দে রচিল তারক।।
কি ধন্য প্রভুর লীলা এই কলিযুগে।
সব লীলা হ’তে ধন্য হ’ল ভক্তিযোগে।।
দশরথ গৃহে জন্ম লইয়া শ্রীরাম।
ভূভার হরণ পূর্ণ ভক্ত মনস্কাম।।
বৈকুণ্ঠ নায়ক হরি হৈল লীলাকারি।
নন্দের নন্দন কৃষ্ণ গোলোক বিহারী।।
ভূভার হরণ ভক্ত মনোরম্য কারী।
ভক্তসঙ্গে প্রেমরস মধুর মাধুরী।।
তিন শক্তি একত্র হইয়া ভগবান।
দেবকীর বায়ুগর্ভে দুই শক্তি যান।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে মিমাংসা র’য়েছে।
যশোদার গর্ভে মহাবিষ্ণু জন্মিয়াছে।।
চারি শক্তি একযোগে হয় কৃষ্ণ লীলা।
ভাগবতে শুকদেব মিমাংসা করিলা।।
বহুত প্রমাণ লাগে সে সব লিখিতে।
অন্যান্য প্রমাণ গ্রন্থে র’য়েছে বলিতে।।
চৈতন্যচরিতামৃত তাহার প্রমাণ।
বহুযুগ গত পরে এল ভগবান।।
নন্দসূত ব’লে যাঁরে ভাগবতে গাই।
সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ চৈতন্য গোঁসাই।।
বহুত দ্বাপর কলি আসে আর যায়।
স্বয়ং এর অবতার তাতে নাহি হয়।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তর শেষ যেই কলি।
অবতীর্ণ ভক্তবৃন্দ লইয়া সকলি।।
যে দ্বাপরে অন্য শক্তি বিবর্জ্জিত হ’য়ে।
গোলোকবিহারী লীলা গোকুলে আসিয়ে।।
দ্বাপরের শেষ সেই কলির সন্ধ্যায়।
শ্রী গৌরাঙ্গরূপে প্রভু জন্ম নদীয়ায়।।
এই সেই কলি এই সেই অবতার।
অনর্পিত প্রেমভক্তি অর্পিল এবার।।
সেই ত গৌরাঙ্গ প্রভু এই কলিকালে।
অবতীর্ণ নদীয়াতে হরি হরি বলে।।
উৎকলেতে লীলা সাঙ্গ অল্পেতে করিল।
মনের কামনা বহু মনেতে রহিল।।
চৈতন্যচরিতামৃত মঙ্গলাচরণে।
প্রভুর মনের কথা লিখিল যতনে।।
দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর চারি রস।
চারিভাবে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ।।
আপনিও এই ধর্ম করিব যাজন।
ইহা দ্বারা করাইব ভক্তের শিক্ষন।।
সন্ন্যাস করিল প্রভু এই ধর্ম লয়ে।
রাগানুগা প্রেমভক্তি হাটে বাহুড়িয়ে।।
গৌড়িয়ার ভক্ত তার নাহি পায় লেশ।
শুদ্ধাচার সেবা ভক্তি নাম ভাবাবেশ।।
আটচল্লিশ বর্ষ মধ্যে প্রভু দিল ফাঁকি।
এই ত প্রতিজ্ঞা এক রহিলেক বাকী।।
কাশিতে বসিয়া সনাতনে শিক্ষা দিলা।
সনাতনে শিক্ষাকালে অনেক কহিলা।।
অকামনা প্রেম ভক্তি কেবলার রীতি।
আপনি বা তাহা কই পারিল বর্ত্তাইতি।।
কেবলার রীতি এই কৃষ্ণেতে ঐকান্তি।
তার আগে ভক্তি মুক্তি সকলি অশান্তি।।
কৃষ্ণগত প্রাণ হ’বে কৃষ্ণ সুখে সুখী।
কার দেহ লয়ে প্রভু মারে ঝাঁকি ঝুকি।।
কৃষ্ণতে অর্পিত দেহ এ দেহ কৃষ্ণের।
আছুক অন্যের কার্য্য নিজে হৈল ফের।।
হাত পা বাহির হ’য়ে সন্ধিকল ছুটে।
কচ্ছপ আকার হ’য়ে ক্ষণে পৈশে পেটে।।
যদ্যপি প্রভুর মনে থাকে কোন ভাব।
যা দেখিনু তা লিখিনু গ্রন্থের যে ভাব।।
তবে ত প্রভুর মনে কামনা রহিল।
অকামনা প্রেম ভক্তি কই পাওয়া গেল।।
কামনা রহিল আছে দৃষ্টান্ত তাহার।
অদ্বৈতের করে ধরি বলে বার বার।।
বৈকুণ্ঠাদ্যে নাহি যেই লীলার প্রচার।
শেষ যে করিব লীলা মোরে চমৎকার।।
তুমি আমি নিত্যানন্দ এই তিন জন।
করিব নিগূঢ় লীলা রস আস্বাদন।।
তুমি হ’বে রামচন্দ্র আমি শ্রীনিবাস।
দাদা নিত্যানন্দ হবে নরোত্তম দাস।।
শেষ লীলা তিন জন করিল আসিয়া।
প্রচারিল প্রেমভক্তি খেতর যাইয়া।।
নিগূঢ় ভজন লীলা করে তিন জন।
ভাগ্যবান ভক্ত যারা করে দরশন।।
তাদের ভজন গ্রন্থ পড়ে দেখ ভাই।
অকামনা প্রেমভক্তি তাতে বর্ত্তে নাই।।
উদ্দেশ্য থাকিল পুনঃ আসিয়া ধরায়।
ঐ প্রেম আস্বাদিবে তিন মহাশয়।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
সফলানগরী যশোমন্তের নন্দন।।
শচীর নন্দন যবে পড়ে পাঠশালে।
পড়ুয়ার সঙ্গে সদা হরি হরি বলে।
যে জন না বলে হরি কর্মসূত্রে মরে।।
ঠেঙ্গা ল’য়ে যায় প্রভু তারে মারিবারে।
সেই গিয়া করে সায় পাষণ্ড সঙ্গেতে।
মারিব মিশ্রের সূতে আইলে মারিতে।।
অন্তর্য্যামী ভগবান জানিলেন চিতে।
এরূপে না পারিলাম হরিনাম দিতে।।
একবার মাতাকে দিলাম পরিচয়।
গ্রহণের বেড়ি গড়ি দিল মোর পায়।।
স্বীয় পরিচয় তাহে দিবার কারণে।
উদয় হইনু হাত গণকের স্থানে।।
সে মোরে গণীয়া বলে নন্দের নন্দন।
এবে শচীসূত জীব উদ্ধার কারণ।।
কর্মসূত্রে বদ্ধ জীব না চিনিল মোরে।
গণিয়া দেখিয়া বলে একি হ’তে পারে।।
প্রভু কন তার পূর্ব্ব জন্মে কেবা আমি।
ঠিক করি গণনা করহ দেখি তুমি।।
গণক বলেন ছিলে অযোধ্যায় রাম।
কৌশল্যা-জননী পিতা দশরথ নাম।।
তুমি ছিলে রামচন্দ্র জগতের মূল।
ফিরে বলে এ গণনা হইয়াছে ভুল।।
বদ্ধ কর্মসূত্রে জীব উদ্ধারি কেমনে।
কাঙ্গাল হইব আমি তাহার কারণে।।
কেশ মুড়ি কড়া ধরি হইব কাঙ্গাল।
ঘরে ঘরে মেগে খাব হইয়া বেহাল।।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া পুরাইব মনস্কাম।
হাতে ধরি পায় ধরি দিব হরিনাম।।
কাঙ্গাল দেখিয়া মোরে দয়া উপজিবে।
চিত্ত দ্রবিভুত হ’য়ে হরিনাম ল’বে।।
মুকুন্দমুরারী আর নিত্যানন্দ ল’য়ে।
কহিলেন মনোকথা নিভৃতে বসিয়ে।।
পরে কহিলেন শচী মাতাকে কাঁদিয়া।
তাহা শুনি শচীরাণী অধৈর্য্য হইয়া।।
কহিলেন শচীমাতা বাছারে নিমাই।
ছেড়ে যদি যাও রাখিবার সাধ্য নাই।।
অনেক প্রলাপ মাতা করিল তাহাতে।
সান্ত্বনা করিল মাকে মধুর বাক্যেতে।।
শচী বলে তুমি যদি মোরে ছেড়ে যাবে।
এ ব্রহ্মান্ডে তবে আর মাতা কে মানিবে।।
এ সময় গৌরাঙ্গ করিল অঙ্গীকার।
তোমাকে ছাড়িতে মাতা শক্তি কি আমার।।
শোধিতে নারিব মাতা তব ঋণধার।
জন্মে জন্মে তব গর্ভে হব অবতার।।
ধর্ম সংস্থাপন আর জীবের উদ্ধার।
এরূপে লইব জন্ম আর দুই বার।।
তারপর শ্রীনিবাসরূপে জন্ম নিল।
নরোত্তমরূপে নিত্যানন্দ জনমিল।।
আর এক জন্ম বাকী রহিল প্রভুর।
এই সেই অবতার শ্রীহরি ঠাকুর।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।
পয়ার প্রবন্ধ ছন্দে রচিল তারক।।
অথ দণ্ডভঙ্গ- বিবরণ
এবে শুন দন্ডভঙ্গ নিগূঢ় কারণ।
দন্ড ভাঙ্গা ঘাট এবে আছে নিরূপণ।।
ভারতীকে কৈলা গুরু কাটোয়ায় আসি।
শ্রীগৌরাঙ্গরূপে প্রভু হইল সন্ন্যাসী।।
দন্ড কমণ্ডলু করে কটিত কপীন।
সন্ন্যাসী হইল পরে অতি দীন হীন।।
আর ত নিগূঢ় এক দেখত ভাবিয়া।
নিত্যানন্দ দন্ড ভাঙ্গে কিসের লাগিয়া।।
কেহ কহে নিত্যানন্দ পরম উদার।
সে কারণ দণ্ড খণ্ড করিল তাঁহার।।
কেহ বলে মহাপ্রভু সকল ত্যাজিল।
সব ত্যাজি কেন এই দন্ডটি রাখিল।।
তাহে ক্রোধ করি নিত্যানন্দ ভাঙ্গে দণ্ড।
কেহ কহে ছল করি ভুলায় ব্রহ্মান্ড।।
ভাগবত লীলামৃতে আছয় প্রকাশ।
চলিলেন মহাপ্রভু করিতে সন্ন্যাস।।
নিত্যানন্দ দণ্ড প্রতি বলে ওরে দণ্ড।
তোরে করি দণ্ড তুই বড়ই পাষণ্ড।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শূলিন্দ্র যাঁহার আজ্ঞাকারী।
সে কেন বহিবে তোরে হ’য়ে দণ্ডধারী।।
অবশ্য ভক্তের বাক্য নহে ব্যভিচারী।
এ সব সিদ্ধান্ত আমি শিরোধার্য করি।।
স্বয়ং এর কার্য্য এই আছে চিরধার্য্য।
এক কার্য্য অবিলম্বে বাড়ে বহু কার্য্য।।
দুই তিন অবিলম্বে এক কার্য্য হয়।
নিগূঢ় আস্বাদি স্বাভাবিক যে দেখায়।।
হেন মানি নিত্যানন্দের অসহ্য হইল।
সে কারণ প্রভু দণ্ড খণ্ড যে করিল।।
এ জন্য অসহ্য হ’লে নিত্যানন্দের মনে।
বৈরাগ্য করিতে আসি দণ্ড নিলি কেনে।।
অহৈতুকী প্রেমভক্তি প্রকাশিবি দেশে।
ব্রজরস আস্বাদিতে দণ্ড লাগে কিসে।।
নিজে না জানিলে ধর্ম্ন শিক্ষন না যায়।
এ মত সিদ্ধান্ত গীতা ভাগবতে গায়।।
ব্রজ বিনে জানিবিনে রাধা রস বই।
ন্যাসী হ’লি দণ্ড নিলি তা পারিলি কই।।
দণ্ড কমণ্ডলু ইহা সন্ন্যাসি বৈভব।
যোগী ন্যাসী তীর্থবাসী তেয়াগিয়ে সব।।
কহে ব্যাস সন্ন্যাস নাহিক কলিকালে।
তার মাঝে বৃথা কাজে দণ্ড কেন নিলে।।
দন্ড ভাঙ্গা ঘাট এবে আছে নিরূপণ।।
ভারতীকে কৈলা গুরু কাটোয়ায় আসি।
শ্রীগৌরাঙ্গরূপে প্রভু হইল সন্ন্যাসী।।
দন্ড কমণ্ডলু করে কটিত কপীন।
সন্ন্যাসী হইল পরে অতি দীন হীন।।
আর ত নিগূঢ় এক দেখত ভাবিয়া।
নিত্যানন্দ দন্ড ভাঙ্গে কিসের লাগিয়া।।
কেহ কহে নিত্যানন্দ পরম উদার।
সে কারণ দণ্ড খণ্ড করিল তাঁহার।।
কেহ বলে মহাপ্রভু সকল ত্যাজিল।
সব ত্যাজি কেন এই দন্ডটি রাখিল।।
তাহে ক্রোধ করি নিত্যানন্দ ভাঙ্গে দণ্ড।
কেহ কহে ছল করি ভুলায় ব্রহ্মান্ড।।
ভাগবত লীলামৃতে আছয় প্রকাশ।
চলিলেন মহাপ্রভু করিতে সন্ন্যাস।।
নিত্যানন্দ দণ্ড প্রতি বলে ওরে দণ্ড।
তোরে করি দণ্ড তুই বড়ই পাষণ্ড।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শূলিন্দ্র যাঁহার আজ্ঞাকারী।
সে কেন বহিবে তোরে হ’য়ে দণ্ডধারী।।
অবশ্য ভক্তের বাক্য নহে ব্যভিচারী।
এ সব সিদ্ধান্ত আমি শিরোধার্য করি।।
স্বয়ং এর কার্য্য এই আছে চিরধার্য্য।
এক কার্য্য অবিলম্বে বাড়ে বহু কার্য্য।।
দুই তিন অবিলম্বে এক কার্য্য হয়।
নিগূঢ় আস্বাদি স্বাভাবিক যে দেখায়।।
হেন মানি নিত্যানন্দের অসহ্য হইল।
সে কারণ প্রভু দণ্ড খণ্ড যে করিল।।
এ জন্য অসহ্য হ’লে নিত্যানন্দের মনে।
বৈরাগ্য করিতে আসি দণ্ড নিলি কেনে।।
অহৈতুকী প্রেমভক্তি প্রকাশিবি দেশে।
ব্রজরস আস্বাদিতে দণ্ড লাগে কিসে।।
নিজে না জানিলে ধর্ম্ন শিক্ষন না যায়।
এ মত সিদ্ধান্ত গীতা ভাগবতে গায়।।
ব্রজ বিনে জানিবিনে রাধা রস বই।
ন্যাসী হ’লি দণ্ড নিলি তা পারিলি কই।।
দণ্ড কমণ্ডলু ইহা সন্ন্যাসি বৈভব।
যোগী ন্যাসী তীর্থবাসী তেয়াগিয়ে সব।।
কহে ব্যাস সন্ন্যাস নাহিক কলিকালে।
তার মাঝে বৃথা কাজে দণ্ড কেন নিলে।।
শ্লোক
অশ্বমেধগবালম্বে সন্ন্যাসপলপৈতৃকম।
দেবরেণ সুতোৎপত্তি কলৌ পঞ্চ বিবর্জিতম্।।
অশ্বমেধগবালম্বে সন্ন্যাসপলপৈতৃকম।
দেবরেণ সুতোৎপত্তি কলৌ পঞ্চ বিবর্জিতম্।।
পয়ার।
মাধুর্যের মধ্যে নাই সন্ন্যাসের ধর্ম।
সন্ন্যাসীর ন্যাসযোগে ঐশ্বর্যের কর্ম।।
অকামনা শুদ্ধ প্রেম সভক্তি আশ্রয়।
দিবে জীবে আচরিবে তাহা কই হয়।।
ভক্ত পক্ষে সন্ন্যাস ঘৃণিত অকারণ।
তার লেশ বেশ কেন করিলি ধারণ।।
ব্রহ্মত্ব সাধুজ্য মুক্তি কৃষ্ণভক্তে দণ্ড।
হরিনামে পাপ ক্ষয় কহে কোন ভণ্ড।।
মুক্তিশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যে যারা ভক্তি নাহি চিনে।
হরিনামে পাপ ক্ষয় তারা ইহা মানে।।
মুক্তিকে যে তুচ্ছ করে ভক্তি করে সার।
পুণ্যকে না দেয় স্থান পাপ কোন ছার।।
হরিনামে প্রেমপ্রাপ্ত সাধুদের বাণী।
প্রেমরূপা আহ্লাদিনী রাধাঠাকুরানী।।
যেই নাম সেই হরি শ্রীমুখের বাক্য।
জীবে কেন মনে প্রাণে নাহি করে ঐক্য।।
নাম সুপ্রসন্ন হ’লে আহ্লাদিনী পাই।
বিশুদ্ধ পীরিতি ব্যাখ্যা আর বাক্য নাই।।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্ত্তি নৈষ্ঠিক ভজন।
তার কিসে গয়া কাশী আর বৃন্দাবন।।
বেহালের বেশ মাত্র দণ্ড যে ধারণ।
জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি এত আইল এখন।।
এত বাহ্য কহে যেই তার কেন দণ্ড।
এ কারণ নিত্যানন্দ দণ্ড কৈল খণ্ড।।
অন্তরে উল্লাস প্রভু বাহ্যে খেদান্বিত।
নিত্যানন্দ প্রেমে প্রভু হইল প্রতীত।।
এইভাব মহাপ্রভু দেখিল আচরি।
এ লীলায় প্রেম কই আচরিতে পারি।।
মহাভাবে দণ্ডভঙ্গ নিতাই মাতিল।
সে ভাব লইতে প্রভুর বাকী পড়ে গেল।।
এ কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
এ লীলায় করিলেন সে ভাব গ্রহণ।।
মাধুর্যের মধ্যে নাই সন্ন্যাসের ধর্ম।
সন্ন্যাসীর ন্যাসযোগে ঐশ্বর্যের কর্ম।।
অকামনা শুদ্ধ প্রেম সভক্তি আশ্রয়।
দিবে জীবে আচরিবে তাহা কই হয়।।
ভক্ত পক্ষে সন্ন্যাস ঘৃণিত অকারণ।
তার লেশ বেশ কেন করিলি ধারণ।।
ব্রহ্মত্ব সাধুজ্য মুক্তি কৃষ্ণভক্তে দণ্ড।
হরিনামে পাপ ক্ষয় কহে কোন ভণ্ড।।
মুক্তিশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যে যারা ভক্তি নাহি চিনে।
হরিনামে পাপ ক্ষয় তারা ইহা মানে।।
মুক্তিকে যে তুচ্ছ করে ভক্তি করে সার।
পুণ্যকে না দেয় স্থান পাপ কোন ছার।।
হরিনামে প্রেমপ্রাপ্ত সাধুদের বাণী।
প্রেমরূপা আহ্লাদিনী রাধাঠাকুরানী।।
যেই নাম সেই হরি শ্রীমুখের বাক্য।
জীবে কেন মনে প্রাণে নাহি করে ঐক্য।।
নাম সুপ্রসন্ন হ’লে আহ্লাদিনী পাই।
বিশুদ্ধ পীরিতি ব্যাখ্যা আর বাক্য নাই।।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্ত্তি নৈষ্ঠিক ভজন।
তার কিসে গয়া কাশী আর বৃন্দাবন।।
বেহালের বেশ মাত্র দণ্ড যে ধারণ।
জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি এত আইল এখন।।
এত বাহ্য কহে যেই তার কেন দণ্ড।
এ কারণ নিত্যানন্দ দণ্ড কৈল খণ্ড।।
অন্তরে উল্লাস প্রভু বাহ্যে খেদান্বিত।
নিত্যানন্দ প্রেমে প্রভু হইল প্রতীত।।
এইভাব মহাপ্রভু দেখিল আচরি।
এ লীলায় প্রেম কই আচরিতে পারি।।
মহাভাবে দণ্ডভঙ্গ নিতাই মাতিল।
সে ভাব লইতে প্রভুর বাকী পড়ে গেল।।
এ কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
এ লীলায় করিলেন সে ভাব গ্রহণ।।
ভক্ত-কন্ঠহার
আর এক সুবিচার অন্তরে জাগিল।
দণ্ড ভাঙ্গি কমণ্ডলু কেন না ভাঙ্গিল।।
উভয়ের ভাব তাহা উভয়ে জানিলা।
শেষ লীলা কমণ্ডলু ভেঙ্গে হ’বে মালা।।
লক্ষ্মীকে করিয়া ত্যাগ কমণ্ডলুধারী।
কমণ্ডলু ভেঙ্গে লক্ষ্মী বলাইবে হরি।।
প্রভুর হাতের কড়া মান্য রাখি তার।
কমণ্ডলু হ’বে তার ভক্ত-কণ্ঠহার।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
শুদ্ধ প্রেম বিতরণ জীবের কারণ।।
সু-বিশুদ্ধ প্রেমদান গৌরাঙ্গ-লীলায়।
সে প্রেম শোষিল প্রায় কলির মায়ায়।।
আদেশে গোলোকচন্দ্র নরহরি কায়।
রচিল তারকচন্দ্র ভেবে মৃত্যুঞ্জয়।।
দণ্ড ভাঙ্গি কমণ্ডলু কেন না ভাঙ্গিল।।
উভয়ের ভাব তাহা উভয়ে জানিলা।
শেষ লীলা কমণ্ডলু ভেঙ্গে হ’বে মালা।।
লক্ষ্মীকে করিয়া ত্যাগ কমণ্ডলুধারী।
কমণ্ডলু ভেঙ্গে লক্ষ্মী বলাইবে হরি।।
প্রভুর হাতের কড়া মান্য রাখি তার।
কমণ্ডলু হ’বে তার ভক্ত-কণ্ঠহার।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
শুদ্ধ প্রেম বিতরণ জীবের কারণ।।
সু-বিশুদ্ধ প্রেমদান গৌরাঙ্গ-লীলায়।
সে প্রেম শোষিল প্রায় কলির মায়ায়।।
আদেশে গোলোকচন্দ্র নরহরি কায়।
রচিল তারকচন্দ্র ভেবে মৃত্যুঞ্জয়।।
জম-কলি প্রভাব
গ্রন্থালোচনা
পুনঃ প্রেম প্রচারিতে হইল মনন।
সে কারণ হ’ল যশোমন্তের নন্দন।।
যদি বল গৌরাঙ্গের প্রেম তুচ্ছ নয়।
সে প্রেম শোষিবে কেন কলির মায়ায়।।
তার সাক্ষী ভাগবতে আছয় প্রমাণ।
রাজা পরীক্ষিত স্নান করিবারে যান।।
বৃষরূপে ছিল ধর্ম দাঁড়িয়ে তখন।
মুদ্গর লইয়া কলি ভেঙ্গেছে চরণ।।
হেনকালে বসুমতি সুরভী রূপেতে।
কেঁদে কেঁদে কহে ডেকে রাজা পরীক্ষিতে।।
অই কলি অই ধর্ম এই আমি ক্ষিতি।
রক্ষা কর বিপদে ধার্মিক নরপতি।।
কলিকে ধরিয়া রাজা চাহিল কাঁটিতে।
শরণ লইল কলি প্রাণের ভয়েতে।।
রাজা বলে না রহিবি মম অধিকারে।
চারি স্থান চাহি নিল কলি পরিহারে।।
স্বর্ণকার দোকান অপর বেশ্যালয়।
সুরাপান জীব হত্যা যে যে খানে হয়।।
চারিঠাঁই পেয়ে কলি পাইল আহ্লাদ।
ভাবে সর্বঠাঁই হ’ল আমার প্রসাদ।।
বেশ্যালয় যায় কেহ করে সুরাপান।
যদি কোন মহাজন সে পথে না যান।।
ব্যাসের কলম সাক্ষী বেশ্যা বলি কারে।
পঞ্চসঙ্গ করে নারী বেশ্যা বলি তারে।।
অনেকেই জীব হত্যা করিছে সদায়।
মৎস্য মৃগ পক্ষী সেকি জীব মধ্যে নয়।।
ধনবান হলে যাবে স্বর্ণকার ঠাঁই।
দোকান স্পর্শিলে কলি তাহা কি এড়াই।।
ইহাতেও কেহ যদি না ভুলে মায়ায়।
রসিকের ধর্ম দিয়া অনেকে মজায়।।
তার সাক্ষী শ্রীগৌরাঙ্গ ধর্ম যবে দিল।
চিত্রগুপ্ত ত্রস্ত চিত্ত খাতা ফেলাইল।।
মৌন হ’য়ে বসিলেন যম মহাশয়।
কাম ক্রোধ ষড়রিপু হইল উদয়।।
যার যার প্রাদুর্ভাব জানাইল তাই।
সবে কহে যম অধিকার যায় নাই।।
সে সব লিখিতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়।
সংক্ষেপে লিখিব কিছু শাস্ত্রে যাহা কয়।।
কাম বলে যমরাজ চিন্তা কি তোমার।
আমি ভরি দিব তব দক্ষিণের দ্বার।।
গ্রন্থালোচনা
পুনঃ প্রেম প্রচারিতে হইল মনন।
সে কারণ হ’ল যশোমন্তের নন্দন।।
যদি বল গৌরাঙ্গের প্রেম তুচ্ছ নয়।
সে প্রেম শোষিবে কেন কলির মায়ায়।।
তার সাক্ষী ভাগবতে আছয় প্রমাণ।
রাজা পরীক্ষিত স্নান করিবারে যান।।
বৃষরূপে ছিল ধর্ম দাঁড়িয়ে তখন।
মুদ্গর লইয়া কলি ভেঙ্গেছে চরণ।।
হেনকালে বসুমতি সুরভী রূপেতে।
কেঁদে কেঁদে কহে ডেকে রাজা পরীক্ষিতে।।
অই কলি অই ধর্ম এই আমি ক্ষিতি।
রক্ষা কর বিপদে ধার্মিক নরপতি।।
কলিকে ধরিয়া রাজা চাহিল কাঁটিতে।
শরণ লইল কলি প্রাণের ভয়েতে।।
রাজা বলে না রহিবি মম অধিকারে।
চারি স্থান চাহি নিল কলি পরিহারে।।
স্বর্ণকার দোকান অপর বেশ্যালয়।
সুরাপান জীব হত্যা যে যে খানে হয়।।
চারিঠাঁই পেয়ে কলি পাইল আহ্লাদ।
ভাবে সর্বঠাঁই হ’ল আমার প্রসাদ।।
বেশ্যালয় যায় কেহ করে সুরাপান।
যদি কোন মহাজন সে পথে না যান।।
ব্যাসের কলম সাক্ষী বেশ্যা বলি কারে।
পঞ্চসঙ্গ করে নারী বেশ্যা বলি তারে।।
অনেকেই জীব হত্যা করিছে সদায়।
মৎস্য মৃগ পক্ষী সেকি জীব মধ্যে নয়।।
ধনবান হলে যাবে স্বর্ণকার ঠাঁই।
দোকান স্পর্শিলে কলি তাহা কি এড়াই।।
ইহাতেও কেহ যদি না ভুলে মায়ায়।
রসিকের ধর্ম দিয়া অনেকে মজায়।।
তার সাক্ষী শ্রীগৌরাঙ্গ ধর্ম যবে দিল।
চিত্রগুপ্ত ত্রস্ত চিত্ত খাতা ফেলাইল।।
মৌন হ’য়ে বসিলেন যম মহাশয়।
কাম ক্রোধ ষড়রিপু হইল উদয়।।
যার যার প্রাদুর্ভাব জানাইল তাই।
সবে কহে যম অধিকার যায় নাই।।
সে সব লিখিতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়।
সংক্ষেপে লিখিব কিছু শাস্ত্রে যাহা কয়।।
কাম বলে যমরাজ চিন্তা কি তোমার।
আমি ভরি দিব তব দক্ষিণের দ্বার।।
শ্লোক
কা চিন্তা ভো মৃত্যুপতে অহং প্রকৃতি ভবান্।
শোষিতং শোষিতং প্রেম চৈতন্যং কিং করিষ্যতি।।
কা চিন্তা ভো মৃত্যুপতে অহং প্রকৃতি ভবান্।
শোষিতং শোষিতং প্রেম চৈতন্যং কিং করিষ্যতি।।
পয়ার।
শোষিব শোষিব প্রেম প্রকৃতি হইয়া।
কি করিতে পারে একা চৈতন্য আসিয়া।।
বলে কলি শুন বলি ধর্ম্ন নরমনি।
আমি দিব গৌরাঙ্গের সব ভক্ত আনি।।
ধরিব বৈরাগ্য বেশ মুখে রেখে দাড়ি।
ভেকধারী সাধু হ’য়ে ফিরিব বাড়ী বাড়ী।।
চৈতন্যের তত্ত্ব যাতে কেহ নাহি মানে।
শিখাইব এই তত্ত্ব সুযুক্তি বিধানে।।
যম-কলি প্রভাব এ গ্রন্থ বিরচিত।
জীব গোঁসাই সেই গ্রন্থ গোস্বামী লিখিত।।
নানা মত করি কলি জীব ভুলাইল।
শাস্ত্র ছাড়া মত কত কলি দেখাইল।।
মাতা পিতা না মানে না মানে গুরুজন।
নারী বাধ্য পিতা করে পুত্রে বিসর্জ্জন।।
আর দেখ গৌরাঙ্গের মত যত ছিল।
তাহার মধ্যেতে কলি কত মত দিল।।
গৌরাঙ্গের মত প্রায় লোপ হ’য়ে যায়।
নরোত্তম শ্রীনিবাস এসে এ সময়।।
দুই প্রভু শেষ লীলা করিল উজ্জ্বল।
মধুর মাধুর্য প্রেম প্রকাশি সকল।।
আবার হইল লোপ কলির মায়ায়।
গোস্বামীর ধর্ম বলি বিপথে লওয়ায়।।
প্রকৃতি হইয়া প্রেম করিল শোষণ।
চমকিত হইল যত সাধকেরগণ।।
বীরভদ্র প্রিয় শিষ্য চারিজন ছিল।
প্রতিজ্ঞা করিয়া তারা কহিতে লাগিল।।
যথাকার বিন্দু মোরা তথায় পাঠাব।
প্রকৃতির স্থানে বিন্দু কিছু না রাখিব।।
বনচারী অখিলচাঁদ সেবা কমলিনী।
হরি-গুরু এই চারি সম্প্রদায় জানি।।
পূর্ব পূর্ব মহাজন যে ধর্ম যাজিল।
বীরভদ্র সেই ধর্ম শিষ্যে জানাইল।।
প্রকৃতি আশ্রয় করি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হ’ল।
সে কারণ চারিজন প্রতিজ্ঞা করিল।।
আধুনিক সেই ধর্ম শুনিয়া শ্রবণে।
প্রকৃতি আশ্রয় লোভে শিক্ষাগুরু জানে।।
গৃহধর্ম ত্যাগ করি পচা গৃহী হয়।
করয় প্রকৃতি সঙ্গ ধর্ম নাহি রয়।।
বুঝিতে না পারে ধর্ম করে নারীসঙ্গ।
হাতে তালি দেয় কলি দেখিয়া সে রঙ্গ।।
বিধবা হইল কোন যুবতি রমণী।
গর্ভবতী হ’লে তারে ভেক দেয় আনি।।
পচাগৃহী শিষ্য করি রাখে যে তাহারে।
সেই গর্ভে পুত্র হ’লে সেবাইত করে।।
জাতিতে বৈরাগী তার হয় পরিচয়।
করতালি দেয় কলি দেখিয়া তাহায়।।
শ্রীগৌরাঙ্গ প্রভু যবে প্রেম প্রচারিল।
সভক্তি দুর্লভ প্রেম-জীবে শিক্ষা দিল।।
চরিং চিরাৎ যেই প্রেম ছিল অনর্পিত।
বিরিঞ্চি বাঞ্চিত প্রেম নামের সহিত।।
বিলাইল সেই প্রেম নামরসে মাখা।
তাহা দেখি চিত্রগুপ্ত ছেড়ে দিল লেখা।।
যমরাজ ছাড়ে ধর্মাধর্মের বিচার।
অবসর হ’য়ে কহে গেছে অধিকার।।
তাহা শুনি কলিরাজ ছয় রিপু লয়ে।
যম চিত্রগুপ্ত স্থানে উত্তরিল গিয়ে।।
কলিরাজ ডাকে মহামায়াকে স্মরিয়া।
মহামায়া এল কলি সপক্ষ হইয়া।।
কলি কহে ধর্মরাজ কেন অবসর।
চিত্রগুপ্ত লেখা ছাড়ে কেমন বর্বর।।
চিত্রগুপ্ত বলে খাতা রাখিব কি জন্য।
লেখা পড়া দু’টা মোর পাপ আর পুণ্য।।
পাপ গেল পুণ্য গেল লেখা গেল মোর।
এবে কি লিখিব যা বিধির অগোচর।।
যম কহে অধিকার গিয়াছে আমার।
পাপ পুণ্য শুন্য কার করিব বিচার।।
কলি কহে মম অধিকার যদি রয়।
তোমার এ অধিকার থাকিবে নিশ্চয়।।
লোভ কহে আমি লোভাইব সব সাধু।
প্রেমমধ্যে দেখাইব নারী মুখ বিধু।।
এককালে লোভাইব বৈরাগী সকল।
পঞ্চরসিকের ক্রিয়া দিয়া নারীকোল।।
গৌরাঙ্গের সঙ্গে হরি কীর্ত্তন ভিতরে।
নারী আর পুরুষ মাতাব একেবারে।।
দুইরূপ বৈরাগীর গৌড়িয়া বাতুল।
জাতি ল’য়ে দলাদলি ভুলাইব মূল।।
মদ কহে মাৎসর্য্য জন্মাব দম্ভসহ।
নামে প্রেমে মন মজা’তে নারিবে কেহ।।
কাম কহে বৈস গিয়া তব রাজপাটে।
তব অধিকার দিব প্রেম নিব লুটে।।
মহাজনী পথ বলি দেখাইব পথ।
চৈতন্যের মত ছাড়ি ডুবিবেক সৎ।।
শিবের চৌষট্টি নিশা দ্বাদশ পাগল।
ইহাদিগে লইয়া বলা’ব হরিবোল।।
পরাৎপর ব্রজরস প্রভু নিজ ধর্ম।
বেদাতীত গূঢ়ত্ব যা বিধির অগম্য।।
তাহা দেখাইয়া ভুলাইব কতগুলি।
নারী লুব্ধ করাইব মজা’ব সকলি।।
শ্রীনিবাস চৈতন্যের মত গোড়াইব।
তার মধ্যে অন্য অন্য মত চালাইব।।
সেই মত মাতাইব সকল জগৎ।
চৈতন্যের মত ছাড়ি ডুবিবেক সৎ।।
সংঘট ঘটাব মঙ্গল আর শনিবারে।
বার বার ‘বার’ বানাইব বারে বারে।।
বিল্ববৃক্ষ তুলসী মাহাত্ম্য লোপাইব।
হিজলিকা শড়াজিকা বার সাজাইব।।
চৈতন্যের মত বারে করিব আসক্ত।
মজাইব চৈতন্যের আত্মসুখী ভক্ত।।
মাধুর্য্যের ভক্তে মোর নাই অধিকার।
ঐশ্বর্য্য ভক্তের ভক্তি দিব ছারখার।।
রোগাভক্তি করাইয়া মাতাইব সব।
এদিকেতে করিব রোগের প্রাদুর্ভাব।।
মত প্রচারিয়া মোর মতে আকর্ষিয়া।
তোমার দক্ষিণ দ্বার দিব পোষাইয়া।।
হ্রদে দহে তড়াগে প্রয়াগ প্রচারিব।
কূপে গঙ্গা প্রচারিয়া তীর্থ বানাইব।।
কুলজার কুলাচার ধর্ম নষ্টাইব।
বিধিভক্ত নৈষ্ঠিকের ধর্ম ভ্রষ্টাইব।।
প্রচারি পৈশাচী সিদ্ধি সাধুত্ব জানা’ব।
ভূত ভাবি বর্ত্তমান তাহারে বলা’ব।।
কন্দর্পের দর্পে মোহাইব কতজন।
কিয়ৎক্ষণ মোহাইব মোহান্তের মন।।
কৃষ্ণভক্তি ছাড়ি পৈশাচিক মত ল’বে।
এতে তব অধিকার ক্রমেই বাড়িবে।।
তাহা শুনি যম বলে ধন্য ধন্য কলি।
যমদূত সবে নাচে দুইবাহু তুলি।।
কলি বলে ভক্ত মধ্যে বহুত পাষণ্ড।
বহিরঙ্গ ভক্ত যত সব হ’বে ভণ্ড।।
কূপজলে দেখা’ব আশ্চর্য্য বিভীষিকা।
লোক সংঘটন হবে নাহি লেখাজোখা।।
নদী পার নিব নাবিকের নায় নিয়া।
নাবিক ছাড়িবে কর্ণ অসাধ্য হইয়া।।
গোছাল রুধির ক্লেদ টিপ্পনী তরণী।
মুচির নৌকায় পার হইবে ব্রাহ্মণী।।
হাড়ি মুচি যবন ব্রাহ্মণ আদি করি।
যাতায়াতে ফেলাইব পথ রুদ্ধ করি।।
শ্রাদ্ধোৎসর্গ তণ্ডুল পরশে প্রেম শূন্য।
অজালোম পরশনে ভক্তি হয় চূর্ণ।।
অজারক্ত খাওয়াইব কূপজলে ধুয়ে।
যাজনিক ব্রাহ্মণেরে দোকানী বানায়ে।।
তাহার মিষ্টান্ন খাওয়াইব বাজারেতে।
যাতে ভক্তি লোপ হয় তব কল্যাণেতে।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে রয়েছে নিশানা।
পাপপূর্ণা বসুন্ধরা শস্য জন্মিবেনা।।
গাভী হবে দুগ্ধহীনা ফলহীন বৃক্ষ।
নদী-নদ খাল বিল ক্রমে হবে শুষ্ক।।
মারুতির ক্রোধ ছিল তাহা কোথা যাবে।
সেই শাপ মনস্তাপ অবশ্য ভূঞ্জিবে।।
মাতৃ পিতৃ ভাতৃ ভাত খাইবে যাচিয়া।
নরকে মজিবে ধর্ম পালিতে নারিয়া।।
রাবনের চেড়ি করে সীতাকে পীড়ণ।
তাহা দেখি কুপিলেন পবন নন্দন।।
সেইকালে আছাড়িয়া লইত জীবন।
তাহা না করিল শুনি সীতার বারণ।।
জন্মান্তরে তাহারা হইবে রোগযুক্ত।
তাহারা হইবে সব কূপতীর্থ ভক্ত।।
সধবা বিধবা সব ডুবা’বে সে কূপে।
এই দশা হবে হনুমান বীর কোপে।।
নৈষ্ঠিক প্রেমিক ভক্ত পদশিরে ধরি।
গৌরাঙ্গ হাটে গিয়া বলা’ব হরি হরি।।
না মানিবে শিব দুর্গা কৃষ্ণপ্রেমে বাম।
হরিনাম না লইবে বলি মরা নাম।।
এরূপ দুষ্কৃতি কর্মে ধর্ম কর্ম ক্ষয়।
বিস্তারি লিখিতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়।।
এরূপে বৈষ্ণব ধর্মে পড়ে গেল ত্রুটি।
সেহেতু ঘুচাতে বৈষ্ণবের কুটিনাটি।।
যুগে যুগে করে প্রভু ভূ-ভার হরণ।
দুষ্কৃতি বিনাশ আর ধর্ম সংস্থাপন।।
ব্যাসের কলমে আছে ভাগবতে শ্লোক।
স্বয়ং এর মুখ বাক্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক।।
শোষিব শোষিব প্রেম প্রকৃতি হইয়া।
কি করিতে পারে একা চৈতন্য আসিয়া।।
বলে কলি শুন বলি ধর্ম্ন নরমনি।
আমি দিব গৌরাঙ্গের সব ভক্ত আনি।।
ধরিব বৈরাগ্য বেশ মুখে রেখে দাড়ি।
ভেকধারী সাধু হ’য়ে ফিরিব বাড়ী বাড়ী।।
চৈতন্যের তত্ত্ব যাতে কেহ নাহি মানে।
শিখাইব এই তত্ত্ব সুযুক্তি বিধানে।।
যম-কলি প্রভাব এ গ্রন্থ বিরচিত।
জীব গোঁসাই সেই গ্রন্থ গোস্বামী লিখিত।।
নানা মত করি কলি জীব ভুলাইল।
শাস্ত্র ছাড়া মত কত কলি দেখাইল।।
মাতা পিতা না মানে না মানে গুরুজন।
নারী বাধ্য পিতা করে পুত্রে বিসর্জ্জন।।
আর দেখ গৌরাঙ্গের মত যত ছিল।
তাহার মধ্যেতে কলি কত মত দিল।।
গৌরাঙ্গের মত প্রায় লোপ হ’য়ে যায়।
নরোত্তম শ্রীনিবাস এসে এ সময়।।
দুই প্রভু শেষ লীলা করিল উজ্জ্বল।
মধুর মাধুর্য প্রেম প্রকাশি সকল।।
আবার হইল লোপ কলির মায়ায়।
গোস্বামীর ধর্ম বলি বিপথে লওয়ায়।।
প্রকৃতি হইয়া প্রেম করিল শোষণ।
চমকিত হইল যত সাধকেরগণ।।
বীরভদ্র প্রিয় শিষ্য চারিজন ছিল।
প্রতিজ্ঞা করিয়া তারা কহিতে লাগিল।।
যথাকার বিন্দু মোরা তথায় পাঠাব।
প্রকৃতির স্থানে বিন্দু কিছু না রাখিব।।
বনচারী অখিলচাঁদ সেবা কমলিনী।
হরি-গুরু এই চারি সম্প্রদায় জানি।।
পূর্ব পূর্ব মহাজন যে ধর্ম যাজিল।
বীরভদ্র সেই ধর্ম শিষ্যে জানাইল।।
প্রকৃতি আশ্রয় করি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হ’ল।
সে কারণ চারিজন প্রতিজ্ঞা করিল।।
আধুনিক সেই ধর্ম শুনিয়া শ্রবণে।
প্রকৃতি আশ্রয় লোভে শিক্ষাগুরু জানে।।
গৃহধর্ম ত্যাগ করি পচা গৃহী হয়।
করয় প্রকৃতি সঙ্গ ধর্ম নাহি রয়।।
বুঝিতে না পারে ধর্ম করে নারীসঙ্গ।
হাতে তালি দেয় কলি দেখিয়া সে রঙ্গ।।
বিধবা হইল কোন যুবতি রমণী।
গর্ভবতী হ’লে তারে ভেক দেয় আনি।।
পচাগৃহী শিষ্য করি রাখে যে তাহারে।
সেই গর্ভে পুত্র হ’লে সেবাইত করে।।
জাতিতে বৈরাগী তার হয় পরিচয়।
করতালি দেয় কলি দেখিয়া তাহায়।।
শ্রীগৌরাঙ্গ প্রভু যবে প্রেম প্রচারিল।
সভক্তি দুর্লভ প্রেম-জীবে শিক্ষা দিল।।
চরিং চিরাৎ যেই প্রেম ছিল অনর্পিত।
বিরিঞ্চি বাঞ্চিত প্রেম নামের সহিত।।
বিলাইল সেই প্রেম নামরসে মাখা।
তাহা দেখি চিত্রগুপ্ত ছেড়ে দিল লেখা।।
যমরাজ ছাড়ে ধর্মাধর্মের বিচার।
অবসর হ’য়ে কহে গেছে অধিকার।।
তাহা শুনি কলিরাজ ছয় রিপু লয়ে।
যম চিত্রগুপ্ত স্থানে উত্তরিল গিয়ে।।
কলিরাজ ডাকে মহামায়াকে স্মরিয়া।
মহামায়া এল কলি সপক্ষ হইয়া।।
কলি কহে ধর্মরাজ কেন অবসর।
চিত্রগুপ্ত লেখা ছাড়ে কেমন বর্বর।।
চিত্রগুপ্ত বলে খাতা রাখিব কি জন্য।
লেখা পড়া দু’টা মোর পাপ আর পুণ্য।।
পাপ গেল পুণ্য গেল লেখা গেল মোর।
এবে কি লিখিব যা বিধির অগোচর।।
যম কহে অধিকার গিয়াছে আমার।
পাপ পুণ্য শুন্য কার করিব বিচার।।
কলি কহে মম অধিকার যদি রয়।
তোমার এ অধিকার থাকিবে নিশ্চয়।।
লোভ কহে আমি লোভাইব সব সাধু।
প্রেমমধ্যে দেখাইব নারী মুখ বিধু।।
এককালে লোভাইব বৈরাগী সকল।
পঞ্চরসিকের ক্রিয়া দিয়া নারীকোল।।
গৌরাঙ্গের সঙ্গে হরি কীর্ত্তন ভিতরে।
নারী আর পুরুষ মাতাব একেবারে।।
দুইরূপ বৈরাগীর গৌড়িয়া বাতুল।
জাতি ল’য়ে দলাদলি ভুলাইব মূল।।
মদ কহে মাৎসর্য্য জন্মাব দম্ভসহ।
নামে প্রেমে মন মজা’তে নারিবে কেহ।।
কাম কহে বৈস গিয়া তব রাজপাটে।
তব অধিকার দিব প্রেম নিব লুটে।।
মহাজনী পথ বলি দেখাইব পথ।
চৈতন্যের মত ছাড়ি ডুবিবেক সৎ।।
শিবের চৌষট্টি নিশা দ্বাদশ পাগল।
ইহাদিগে লইয়া বলা’ব হরিবোল।।
পরাৎপর ব্রজরস প্রভু নিজ ধর্ম।
বেদাতীত গূঢ়ত্ব যা বিধির অগম্য।।
তাহা দেখাইয়া ভুলাইব কতগুলি।
নারী লুব্ধ করাইব মজা’ব সকলি।।
শ্রীনিবাস চৈতন্যের মত গোড়াইব।
তার মধ্যে অন্য অন্য মত চালাইব।।
সেই মত মাতাইব সকল জগৎ।
চৈতন্যের মত ছাড়ি ডুবিবেক সৎ।।
সংঘট ঘটাব মঙ্গল আর শনিবারে।
বার বার ‘বার’ বানাইব বারে বারে।।
বিল্ববৃক্ষ তুলসী মাহাত্ম্য লোপাইব।
হিজলিকা শড়াজিকা বার সাজাইব।।
চৈতন্যের মত বারে করিব আসক্ত।
মজাইব চৈতন্যের আত্মসুখী ভক্ত।।
মাধুর্য্যের ভক্তে মোর নাই অধিকার।
ঐশ্বর্য্য ভক্তের ভক্তি দিব ছারখার।।
রোগাভক্তি করাইয়া মাতাইব সব।
এদিকেতে করিব রোগের প্রাদুর্ভাব।।
মত প্রচারিয়া মোর মতে আকর্ষিয়া।
তোমার দক্ষিণ দ্বার দিব পোষাইয়া।।
হ্রদে দহে তড়াগে প্রয়াগ প্রচারিব।
কূপে গঙ্গা প্রচারিয়া তীর্থ বানাইব।।
কুলজার কুলাচার ধর্ম নষ্টাইব।
বিধিভক্ত নৈষ্ঠিকের ধর্ম ভ্রষ্টাইব।।
প্রচারি পৈশাচী সিদ্ধি সাধুত্ব জানা’ব।
ভূত ভাবি বর্ত্তমান তাহারে বলা’ব।।
কন্দর্পের দর্পে মোহাইব কতজন।
কিয়ৎক্ষণ মোহাইব মোহান্তের মন।।
কৃষ্ণভক্তি ছাড়ি পৈশাচিক মত ল’বে।
এতে তব অধিকার ক্রমেই বাড়িবে।।
তাহা শুনি যম বলে ধন্য ধন্য কলি।
যমদূত সবে নাচে দুইবাহু তুলি।।
কলি বলে ভক্ত মধ্যে বহুত পাষণ্ড।
বহিরঙ্গ ভক্ত যত সব হ’বে ভণ্ড।।
কূপজলে দেখা’ব আশ্চর্য্য বিভীষিকা।
লোক সংঘটন হবে নাহি লেখাজোখা।।
নদী পার নিব নাবিকের নায় নিয়া।
নাবিক ছাড়িবে কর্ণ অসাধ্য হইয়া।।
গোছাল রুধির ক্লেদ টিপ্পনী তরণী।
মুচির নৌকায় পার হইবে ব্রাহ্মণী।।
হাড়ি মুচি যবন ব্রাহ্মণ আদি করি।
যাতায়াতে ফেলাইব পথ রুদ্ধ করি।।
শ্রাদ্ধোৎসর্গ তণ্ডুল পরশে প্রেম শূন্য।
অজালোম পরশনে ভক্তি হয় চূর্ণ।।
অজারক্ত খাওয়াইব কূপজলে ধুয়ে।
যাজনিক ব্রাহ্মণেরে দোকানী বানায়ে।।
তাহার মিষ্টান্ন খাওয়াইব বাজারেতে।
যাতে ভক্তি লোপ হয় তব কল্যাণেতে।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে রয়েছে নিশানা।
পাপপূর্ণা বসুন্ধরা শস্য জন্মিবেনা।।
গাভী হবে দুগ্ধহীনা ফলহীন বৃক্ষ।
নদী-নদ খাল বিল ক্রমে হবে শুষ্ক।।
মারুতির ক্রোধ ছিল তাহা কোথা যাবে।
সেই শাপ মনস্তাপ অবশ্য ভূঞ্জিবে।।
মাতৃ পিতৃ ভাতৃ ভাত খাইবে যাচিয়া।
নরকে মজিবে ধর্ম পালিতে নারিয়া।।
রাবনের চেড়ি করে সীতাকে পীড়ণ।
তাহা দেখি কুপিলেন পবন নন্দন।।
সেইকালে আছাড়িয়া লইত জীবন।
তাহা না করিল শুনি সীতার বারণ।।
জন্মান্তরে তাহারা হইবে রোগযুক্ত।
তাহারা হইবে সব কূপতীর্থ ভক্ত।।
সধবা বিধবা সব ডুবা’বে সে কূপে।
এই দশা হবে হনুমান বীর কোপে।।
নৈষ্ঠিক প্রেমিক ভক্ত পদশিরে ধরি।
গৌরাঙ্গ হাটে গিয়া বলা’ব হরি হরি।।
না মানিবে শিব দুর্গা কৃষ্ণপ্রেমে বাম।
হরিনাম না লইবে বলি মরা নাম।।
এরূপ দুষ্কৃতি কর্মে ধর্ম কর্ম ক্ষয়।
বিস্তারি লিখিতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়।।
এরূপে বৈষ্ণব ধর্মে পড়ে গেল ত্রুটি।
সেহেতু ঘুচাতে বৈষ্ণবের কুটিনাটি।।
যুগে যুগে করে প্রভু ভূ-ভার হরণ।
দুষ্কৃতি বিনাশ আর ধর্ম সংস্থাপন।।
ব্যাসের কলমে আছে ভাগবতে শ্লোক।
স্বয়ং এর মুখ বাক্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক।।
শ্লোক
পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
পয়ার।
বৈষ্ণবের কুটিনাটি খণ্ডন কারণ।
সে কারণে অবতার পুনঃ প্রয়োজন।।
দ্বাপরেতে যদুবংশে অনেক হইল।
নিজবংশ ধ্বংস বাঞ্ছা কেন বা করিল।।
আপনি এলেন ভার হরণ করিতে।
ভাবিলেন আরো ভার হ’ল আমা হতে।।
যদি বল তারা সতী গান্ধারীর শাপ।
শ্রীকৃষ্ণ ভাবিল কেন মম বংশ পাপ।।
আপনি রাখিতে হরি ব্রাহ্মণের মান্য।
হৃদয় ধরিল ভৃগুমনি পদচিহ্ন।।
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সময়।
স্বহস্তে ব্রাহ্মণপদ শ্রীকৃষ্ণ ধোয়ায়।।
দুর্বৃত্ত যদু বালক কারে নাহি মানে।
অহংকারে মত্ত হ’য়ে না মানে ব্রাহ্মণে।।
শাম্বের পেটেতে কেন মুষল বাঁধিল।
কপালে সিন্দূর দিয়ে শাড়ী পরাইল।।
পথমধ্যে বসাইল নারী সাজাইয়া।
দুর্ব্বাসাকে কহে সবে কপট করিয়া।।
কহ মুনি এই গর্ভে হবে কি সন্তান।
দ্বিজে উপহাস করে এমন অজ্ঞান।।
কৃষ্ণ যারে মানে এরা করে অপমান।
প্রকারেতে অপমান হন ভগবান।।
ইচ্ছা ক’রে ইচ্ছাময় নাশিবারে বংশ।
দুর্ব্বাসা মুনির শাপে যদুকুল ধ্বংস।।
নিম্ববৃক্ষে কৃষ্ণ মরে মারিল অঙ্গদ।
সে তারা-সতীর শাপ এই স্থলে শোধ।।
গান্ধারীর শাপে যদি যদুবংশ ক্ষয়।
তবে কেন যদুবংশে বজ্রবীর রয়।।
যদি বল দুর্ব্বাসার শাপে হয় ক্ষয়।
ইচ্ছাময়ের ধ্বংস ইচ্ছা এর অগ্রে হয়।।
দেখিতে দেখার আছে অনেক দ্রষ্টব্য।
মূলে ভূ-ভার হরণ মারণ সুসভ্য।।
তিনযুগে পাষণ্ডীর মস্তক ছেদন।
কলিতে পাষণ্ডী সব নামাস্ত্রে দলন।।
ধন্য ধন্য অবতীর্ণ চৈতন্য নিতাই।
নাম দিয়া উদ্ধারিল জগাই মাধাই।।
সেই নাম প্রেমমধ্যে কলি প্রবেশিল।
প্রকৃতির স্থানে বিন্দু প্লাবিত হইল।।
এইসব কুটি-নাটি খন্ডন কারণ।
জীব উদ্ধারের জন্য হইল মনন।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
সফলানগরী যশোমন্তের নন্দন।।
সুযুক্তি বিধানে প্রভু অবতীর্ণ হ’ল।
হরিচাঁদ নামে যত ভক্তে শিক্ষা দিল।।
করিবে গৃহস্থধর্ম ল’য়ে নিজ নারী।
গৃহে থেকে ন্যাসী বাণপ্রস্থী ব্রহ্মচারী।।
ঋতুরক্ষা করিবেক জীব হত্যা ভয়।
কেহ বা পূর্ণ সন্ন্যাসি নিষ্কাম আশ্রয়।।
গৃহ ধর্ম গৃহকর্ম করবে সফল।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।।
পরনারী মাতৃতুল্য মি্থ্যা নাই কবে।
পর দুঃখে দুঃখি সচ্চরিত্র সদা রবে।।
অদীক্ষিত না করিবে র্তীথ পর্যটন।
মুক্তি স্পৃহা শূন্য নাই সাধন ভজন।।
এইভাবে করিবেন জীবের উদ্ধার।
একারণ হৈল যশোমন্তের কুমার।।
কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভাগবতের বচন।
যুগে যুগে করিবেন ভূ-ভার হরণ।।
সে কারণ- অবতার হৈল প্রয়োজন।
অবনীতে অবতীর্ণ পূর্ণব্রহ্ম হন।।
অগ্রে পাতকীর শিরোচ্ছেদ ধনু অস্ত্রে।
এ যুগেতে প্রেমদান হরিনাম মন্ত্রে।।
সব যুগে ভূ-ভার হরিল নারায়ণ।
এবে কৃষ্ণভক্ত আদি করিতে শোধন।।
কৃষ্ণভক্ত শৌচ আচরণ কুটিনাটি।
শুদ্ধ প্রেমভক্তি বৈষ্ণবেতে পড়ে ত্রুটি।
অনেক কারণে হ’ল এই অবতার।
জীবের উপায় শূন্য গতি নাহি আর।।
জীবোদ্ধার প্রেমদান প্রতিজ্ঞা পালন।
অন্নপূর্ণা শচী বাঞ্ছা করিতে পূরণ।।
নারদপুরাণে আছে নারদ সংবাদে।
নারদের কাছে হরি কহিলা আহ্লাদে।।
বৈষ্ণবের কুটিনাটি খণ্ডন কারণ।
সে কারণে অবতার পুনঃ প্রয়োজন।।
দ্বাপরেতে যদুবংশে অনেক হইল।
নিজবংশ ধ্বংস বাঞ্ছা কেন বা করিল।।
আপনি এলেন ভার হরণ করিতে।
ভাবিলেন আরো ভার হ’ল আমা হতে।।
যদি বল তারা সতী গান্ধারীর শাপ।
শ্রীকৃষ্ণ ভাবিল কেন মম বংশ পাপ।।
আপনি রাখিতে হরি ব্রাহ্মণের মান্য।
হৃদয় ধরিল ভৃগুমনি পদচিহ্ন।।
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সময়।
স্বহস্তে ব্রাহ্মণপদ শ্রীকৃষ্ণ ধোয়ায়।।
দুর্বৃত্ত যদু বালক কারে নাহি মানে।
অহংকারে মত্ত হ’য়ে না মানে ব্রাহ্মণে।।
শাম্বের পেটেতে কেন মুষল বাঁধিল।
কপালে সিন্দূর দিয়ে শাড়ী পরাইল।।
পথমধ্যে বসাইল নারী সাজাইয়া।
দুর্ব্বাসাকে কহে সবে কপট করিয়া।।
কহ মুনি এই গর্ভে হবে কি সন্তান।
দ্বিজে উপহাস করে এমন অজ্ঞান।।
কৃষ্ণ যারে মানে এরা করে অপমান।
প্রকারেতে অপমান হন ভগবান।।
ইচ্ছা ক’রে ইচ্ছাময় নাশিবারে বংশ।
দুর্ব্বাসা মুনির শাপে যদুকুল ধ্বংস।।
নিম্ববৃক্ষে কৃষ্ণ মরে মারিল অঙ্গদ।
সে তারা-সতীর শাপ এই স্থলে শোধ।।
গান্ধারীর শাপে যদি যদুবংশ ক্ষয়।
তবে কেন যদুবংশে বজ্রবীর রয়।।
যদি বল দুর্ব্বাসার শাপে হয় ক্ষয়।
ইচ্ছাময়ের ধ্বংস ইচ্ছা এর অগ্রে হয়।।
দেখিতে দেখার আছে অনেক দ্রষ্টব্য।
মূলে ভূ-ভার হরণ মারণ সুসভ্য।।
তিনযুগে পাষণ্ডীর মস্তক ছেদন।
কলিতে পাষণ্ডী সব নামাস্ত্রে দলন।।
ধন্য ধন্য অবতীর্ণ চৈতন্য নিতাই।
নাম দিয়া উদ্ধারিল জগাই মাধাই।।
সেই নাম প্রেমমধ্যে কলি প্রবেশিল।
প্রকৃতির স্থানে বিন্দু প্লাবিত হইল।।
এইসব কুটি-নাটি খন্ডন কারণ।
জীব উদ্ধারের জন্য হইল মনন।।
সে কারণ অবতার হৈল প্রয়োজন।
সফলানগরী যশোমন্তের নন্দন।।
সুযুক্তি বিধানে প্রভু অবতীর্ণ হ’ল।
হরিচাঁদ নামে যত ভক্তে শিক্ষা দিল।।
করিবে গৃহস্থধর্ম ল’য়ে নিজ নারী।
গৃহে থেকে ন্যাসী বাণপ্রস্থী ব্রহ্মচারী।।
ঋতুরক্ষা করিবেক জীব হত্যা ভয়।
কেহ বা পূর্ণ সন্ন্যাসি নিষ্কাম আশ্রয়।।
গৃহ ধর্ম গৃহকর্ম করবে সফল।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।।
পরনারী মাতৃতুল্য মি্থ্যা নাই কবে।
পর দুঃখে দুঃখি সচ্চরিত্র সদা রবে।।
অদীক্ষিত না করিবে র্তীথ পর্যটন।
মুক্তি স্পৃহা শূন্য নাই সাধন ভজন।।
এইভাবে করিবেন জীবের উদ্ধার।
একারণ হৈল যশোমন্তের কুমার।।
কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভাগবতের বচন।
যুগে যুগে করিবেন ভূ-ভার হরণ।।
সে কারণ- অবতার হৈল প্রয়োজন।
অবনীতে অবতীর্ণ পূর্ণব্রহ্ম হন।।
অগ্রে পাতকীর শিরোচ্ছেদ ধনু অস্ত্রে।
এ যুগেতে প্রেমদান হরিনাম মন্ত্রে।।
সব যুগে ভূ-ভার হরিল নারায়ণ।
এবে কৃষ্ণভক্ত আদি করিতে শোধন।।
কৃষ্ণভক্ত শৌচ আচরণ কুটিনাটি।
শুদ্ধ প্রেমভক্তি বৈষ্ণবেতে পড়ে ত্রুটি।
অনেক কারণে হ’ল এই অবতার।
জীবের উপায় শূন্য গতি নাহি আর।।
জীবোদ্ধার প্রেমদান প্রতিজ্ঞা পালন।
অন্নপূর্ণা শচী বাঞ্ছা করিতে পূরণ।।
নারদপুরাণে আছে নারদ সংবাদে।
নারদের কাছে হরি কহিলা আহ্লাদে।।
শ্লোক
কলৌ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষীকান্তো ভবিষ্যসি।
সন্ন্যাসগৌরবিগ্রহে সান্ত্বয়ে পুরুষোত্তমে।।
শাস্ত্র গ্রন্থ ভাগবত করি সারোদ্ধার।
রচিল তারকচন্দ্র কবি সরকার।।
পয়ার
অথ দারুব্রহ্মে গৌরাঙ্গ মিলন
কলৌ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষীকান্তো ভবিষ্যসি।
সন্ন্যাসগৌরবিগ্রহে সান্ত্বয়ে পুরুষোত্তমে।।
শাস্ত্র গ্রন্থ ভাগবত করি সারোদ্ধার।
রচিল তারকচন্দ্র কবি সরকার।।
পয়ার
অথ দারুব্রহ্মে গৌরাঙ্গ মিলন
নবদ্বীপ আসি গোরা জীব উদ্ধারিল।
পরে শ্রীপুরুষোত্তমে লীলা সম্বরিল।।
একদিন ভক্তগণ সঙ্গেতে করিয়া।
কীর্ত্তন করেন গোরা নাচিয়া নাচিয়া।।
মন্দিরের দ্বারে গিয়া ভক্ত গণ সঙ্গে।
জগন্নাথে বেড়িয়া নাচেন নানা রঙ্গে।।
নাচিতে নাচিতে প্রবেশিল শ্রীমন্দিরে।
প্রেমে মত্ত জগন্নাথে প্রদক্ষিণ করে।।
নাচিতে নাচিতে প্রেমে পুলকিত অঙ্গ।
জগনাথ মুখচন্দ্রে পশিল গৌরাঙ্গ।।
কীর্ত্তনান্তে গৌরবিনে সকলে অস্থির।
সবে বলে প্রভু কেন না হয় বাহির।।
অতি উৎকণ্ঠিত সবে উচাটন মন।
মন্দির ভিতরে সবে করিল গমন।।
কেহ বা বাহিরে কেহ মন্দির ভিতর।
সবে কাঁদে না দেখিয়া গৌরাঙ্গ সুন্দর।।
প্রভু না দেখিয়া সবে করে হাহাকার।
কেহ বা ধরায় পড়ে জ্ঞান নাহি আর।।
কেহ বা মূর্ছিত হ’য়ে পড়েছে ধরায়।
কেহ বা চৈতন্য পেয়ে করে হায় হায়।।
কেহ বা জগবন্ধুর পদধরি কয়।
কেহ জগবন্ধু জগবন্ধু সে কোথায়।।
কেহ ধরে হস্ত পদ কেহ ধরে কোল।
মোদের গৌরাঙ্গ কোথা বোল বোল বোল।।
একদৃষ্টে কেহ করে মুখ দরশন।
মুখমধ্যে দেখে তাঁর গেরুয়া বসন।।
বসনের কোণ ধরি টানিতে লাগিল।
অরুণ বসন তায় বাহির হইল।।
গৌরাঙ্গের ভক্ত যত জগন্নাথে কয়।
আহারে রাক্ষস তোরে কে করে প্রত্যয়।।
কে বলে ঈশ্বর তোরে কে করে বিশ্বাস।
গৌরাঙ্গ খাইলি ওরে দুরন্ত রাক্ষস।।
খাইলি গৌরাঙ্গ মন্দিরেতে পেয়ে একা।
ভাল যদি চাস তবে শীগৌরাঙ্গ দেখা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ লীলা সাঙ্গ শ্রীক্ষেত্র উৎকল।
রসনা রসনা ভরি হরি হরি বল।।
পরে শ্রীপুরুষোত্তমে লীলা সম্বরিল।।
একদিন ভক্তগণ সঙ্গেতে করিয়া।
কীর্ত্তন করেন গোরা নাচিয়া নাচিয়া।।
মন্দিরের দ্বারে গিয়া ভক্ত গণ সঙ্গে।
জগন্নাথে বেড়িয়া নাচেন নানা রঙ্গে।।
নাচিতে নাচিতে প্রবেশিল শ্রীমন্দিরে।
প্রেমে মত্ত জগন্নাথে প্রদক্ষিণ করে।।
নাচিতে নাচিতে প্রেমে পুলকিত অঙ্গ।
জগনাথ মুখচন্দ্রে পশিল গৌরাঙ্গ।।
কীর্ত্তনান্তে গৌরবিনে সকলে অস্থির।
সবে বলে প্রভু কেন না হয় বাহির।।
অতি উৎকণ্ঠিত সবে উচাটন মন।
মন্দির ভিতরে সবে করিল গমন।।
কেহ বা বাহিরে কেহ মন্দির ভিতর।
সবে কাঁদে না দেখিয়া গৌরাঙ্গ সুন্দর।।
প্রভু না দেখিয়া সবে করে হাহাকার।
কেহ বা ধরায় পড়ে জ্ঞান নাহি আর।।
কেহ বা মূর্ছিত হ’য়ে পড়েছে ধরায়।
কেহ বা চৈতন্য পেয়ে করে হায় হায়।।
কেহ বা জগবন্ধুর পদধরি কয়।
কেহ জগবন্ধু জগবন্ধু সে কোথায়।।
কেহ ধরে হস্ত পদ কেহ ধরে কোল।
মোদের গৌরাঙ্গ কোথা বোল বোল বোল।।
একদৃষ্টে কেহ করে মুখ দরশন।
মুখমধ্যে দেখে তাঁর গেরুয়া বসন।।
বসনের কোণ ধরি টানিতে লাগিল।
অরুণ বসন তায় বাহির হইল।।
গৌরাঙ্গের ভক্ত যত জগন্নাথে কয়।
আহারে রাক্ষস তোরে কে করে প্রত্যয়।।
কে বলে ঈশ্বর তোরে কে করে বিশ্বাস।
গৌরাঙ্গ খাইলি ওরে দুরন্ত রাক্ষস।।
খাইলি গৌরাঙ্গ মন্দিরেতে পেয়ে একা।
ভাল যদি চাস তবে শীগৌরাঙ্গ দেখা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ লীলা সাঙ্গ শ্রীক্ষেত্র উৎকল।
রসনা রসনা ভরি হরি হরি বল।।
গৌর-ভক্ত- খেদ ও দৈবাদেশ
দীর্ঘ-ত্রিপদী
তুই খালি শ্রীগৌরাঙ্গ, হইল রে লীলা সাঙ্গ,
আমরা এখন যাব কোথা।
যদি না গৌরাঙ্গ পাই, প্রাণে আর কার্য্য নাই,
পাষাণে কুটিব গিয়া মাথা।।
মরিলে বাঁচিত প্রাণ, পাবকি পাবকি ত্রাণ,
যে আগুনে দহিছে হৃদয়।
প্রহলাদ পুড়ে আগুণে, শ্রীকৃষ্ণের নামগুণে,
জ্বলন্ত অনল নিভে যায়।।
গৌরাঙ্গ গৌরাঙ্গ বলে, জ্বলি বিচ্ছেদ অনলে,
গৌরবিনে নিভে না অনল।
মরিলে মরণ নাই, দগ্ধ যে হইনু ভাই,
কিসে মরি বাঁচিয়া কি ফল।।
বিরহে কাতর হ’য়ে, জগন্নাথ কাছে গিয়ে,
বলে দেরে শ্রীগৌরাঙ্গ রায়।
গৌরাঙ্গ গ্রাসিলি যবে, আমা দিকে গ্রাস সবে,
এত বলি মাথা পাতি দেয়।।
জগন্নাথের নিকটে, কেহ কহে মাথা কুটে,
কেহ বলে ওরে জগন্নাথ।
বক্ষে করাঘাত হানে, কেহ বা উন্মত্ত মনে,
জগন্নাথে মারে মুষ্ট্যাঘাত।।
দণ্ডাঘাত করাঘাত, কেহ মুচড়ায় হাত,
উদরেতে কেহ মারে ভূষ।
কেহ পিছু পিছাইয়া, ফিরে এসে আগুলিয়া,
নির্ভয় শরীরে মারে ঢুষ।।
ভক্তগণে দুঃখ হেরি, জগন্নাথ কষ্ট ভারি,
সদয় হইয়া শ্রীচৈতন্য।
ভক্তগণ প্রবোধিতে, জগন্নাথ দেহ হ’তে,
শূন্যবাণী কহে থেকে শূন্য।।
কেন জগন্নাথে মার, আমার এ বাক্য ধর,
স্থির হও যাও নিজ ঘরে।
এ লীলা হইল সাঙ্গ, আমার গৌরাঙ্গ অঙ্গ,
মিশে গেল আমার শরীরে।।
এবে না পাইবে দেখা, গুরুজন শিষ্য শাখা,
স্থির কর সবে শোক মন।
কলির মধ্যাহ্নকালে, করিব একটি লীলে,
তারপরে পাবে দরশন।।
দীর্ঘ-ত্রিপদী
তুই খালি শ্রীগৌরাঙ্গ, হইল রে লীলা সাঙ্গ,
আমরা এখন যাব কোথা।
যদি না গৌরাঙ্গ পাই, প্রাণে আর কার্য্য নাই,
পাষাণে কুটিব গিয়া মাথা।।
মরিলে বাঁচিত প্রাণ, পাবকি পাবকি ত্রাণ,
যে আগুনে দহিছে হৃদয়।
প্রহলাদ পুড়ে আগুণে, শ্রীকৃষ্ণের নামগুণে,
জ্বলন্ত অনল নিভে যায়।।
গৌরাঙ্গ গৌরাঙ্গ বলে, জ্বলি বিচ্ছেদ অনলে,
গৌরবিনে নিভে না অনল।
মরিলে মরণ নাই, দগ্ধ যে হইনু ভাই,
কিসে মরি বাঁচিয়া কি ফল।।
বিরহে কাতর হ’য়ে, জগন্নাথ কাছে গিয়ে,
বলে দেরে শ্রীগৌরাঙ্গ রায়।
গৌরাঙ্গ গ্রাসিলি যবে, আমা দিকে গ্রাস সবে,
এত বলি মাথা পাতি দেয়।।
জগন্নাথের নিকটে, কেহ কহে মাথা কুটে,
কেহ বলে ওরে জগন্নাথ।
বক্ষে করাঘাত হানে, কেহ বা উন্মত্ত মনে,
জগন্নাথে মারে মুষ্ট্যাঘাত।।
দণ্ডাঘাত করাঘাত, কেহ মুচড়ায় হাত,
উদরেতে কেহ মারে ভূষ।
কেহ পিছু পিছাইয়া, ফিরে এসে আগুলিয়া,
নির্ভয় শরীরে মারে ঢুষ।।
ভক্তগণে দুঃখ হেরি, জগন্নাথ কষ্ট ভারি,
সদয় হইয়া শ্রীচৈতন্য।
ভক্তগণ প্রবোধিতে, জগন্নাথ দেহ হ’তে,
শূন্যবাণী কহে থেকে শূন্য।।
কেন জগন্নাথে মার, আমার এ বাক্য ধর,
স্থির হও যাও নিজ ঘরে।
এ লীলা হইল সাঙ্গ, আমার গৌরাঙ্গ অঙ্গ,
মিশে গেল আমার শরীরে।।
এবে না পাইবে দেখা, গুরুজন শিষ্য শাখা,
স্থির কর সবে শোক মন।
কলির মধ্যাহ্নকালে, করিব একটি লীলে,
তারপরে পাবে দরশন।।
লঘু ত্রিপদী
মানুষে আসিয়া, মানুষে মিশিয়া,
করিব মানুষ লীলে।
সেই ত সময়, পাইবা আমায়,
পুনশ্চ মানুষ হ’লে।।
আকার দেখিয়া, লইবা চিনিয়া,
বিশুদ্ধ মাধুর্য্য ভাব।
শুদ্ধ প্রেম রসে, তরাইব শেষে,
জগতের জীব সব।।
এতেক শুনিয়া, শোক সম্বরিয়া,
নিজ নিজ স্থানে যায়।
এ বাক্য বিধানে, প্রেমরস দানে,
জনম লভিতে হয়।।
গোলোকের নাথ, গোলোকের সাথ,
ওড়াকাঁন্দি আগমন।
লয়ে ভক্তবৃন্দ, করে মহানন্দ,
লীলামৃত বরিষণ।।
মানুষে আসিয়া, মানুষে মিশিয়া,
করিব মানুষ লীলে।
সেই ত সময়, পাইবা আমায়,
পুনশ্চ মানুষ হ’লে।।
আকার দেখিয়া, লইবা চিনিয়া,
বিশুদ্ধ মাধুর্য্য ভাব।
শুদ্ধ প্রেম রসে, তরাইব শেষে,
জগতের জীব সব।।
এতেক শুনিয়া, শোক সম্বরিয়া,
নিজ নিজ স্থানে যায়।
এ বাক্য বিধানে, প্রেমরস দানে,
জনম লভিতে হয়।।
গোলোকের নাথ, গোলোকের সাথ,
ওড়াকাঁন্দি আগমন।
লয়ে ভক্তবৃন্দ, করে মহানন্দ,
লীলামৃত বরিষণ।।
অবতার অনুক্রম, যশোমন্ত ঠাকুর ও পৌরাণিক অন্যান্য ভক্ত চরিত্র।
পয়ার
শ্রীনিবাস রামচন্দ্র নরোত্তম দাস।
সাধিল নিগূঢ় লীলা নিজ অভিলাষ।।
গৌরাঙ্গ লীলায় যেন লয়ে ভক্তগণ।
ঘরে ঘরে যারে তারে দেয় প্রেমধন।।
শ্রীনিবাস রামচন্দ্র করিলেন লীলা।
নিজ ভক্তগণ ল’য়ে প্রেম আস্বাদিলা।।
পূর্বে প্রভু অদ্বৈতেরে কহে যে বচন।
করিব নিগূঢ় লীলা রস আস্বাদন।।
এই প্রেম দিয়া যদি জগৎ মাতায়।
নিগূঢ় প্রকট হয় পূর্ব কথা যায়।।
ধর্ম সংস্থাপন জীব উদ্ধার হইল।
পরে প্রেম প্রকাশিবে বাসনা থাকিল।।
সফলানগরী ধন্য ওড়াকাঁন্দি ধন্য।
যে যে গ্রামে হরিচাঁদ হৈল অবতীর্ণ।।
সফলানগরী শ্রীযশোমন্ত ঠাকুর।
তাহার মহিমা কথা কহিতে প্রচুর।।
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান কৃষ্ণ প্রাণ তার।
কৃষ্ণের নৈবিদ্য বিনে না হ’ত আহার।।
সদা করে কৃষ্ণ কথা কথোপকথন।
কৃষ্ণ বলে অশ্রুজলে ভাসিত বয়ন।।
প্রতিপক্ষে করাইত বৈষ্ণব ভোজন।
হরিব্রত একাদশী নাম সংকীর্ত্তন।।
নীচ নীচ কুলে প্রভু দিয়া প্রেমধন।
নমঃশূদ্র কুলে এল ব্রহ্ম সনাতন।।
হয়গ্রীব কপিল হইল অবতার।
অংশ-অবতার সেও ব্রাহ্মণ কুমার।।
ব্রাহ্মণ সম্মান হেতু ভৃগুপদ ধরে।
শ্রীবামন অবতার কশ্যপের ঘরে।।
ভৃগুরাম অবতার জমদগ্নি সূত।
ক্রমে নীচ কুলে যায় হ’য়ে পদচ্যুত।।
শেষে দ্বিজ হ’তে এক পদ নীচে এলে।
ক্ষত্রীয় কুলেতে জন্ম করে রামলীলে।।
প্রথম পুরুষ অবতার রাম হ’ন।
তারপরে গোপ বৈশ্য শ্রীনন্দ নন্দন।।
ধরা দ্রোণ দুই জন ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।
অতিথি বিধানে পূজে শ্যাম চিন্তামণি।।
ছদ্মবেশে পদ্মনেত্র গিয়া সেই স্থানে।
ধরাকে দিলেন ধরা আতিথ্য বিধানে।।
স্তন কেঁটে সেবা করে সেই ত ব্রাহ্মণী।
ভক্তিতে আবদ্ধ হ’ল শ্যাম চিন্তামণি।।
ধরাকে দিলেন হরি এ সত্য কড়ার।
দ্বাপরে শোধিব মাগো তব ঋণধার।।
যেই স্তন কেটে মাগো আমাকে সেবিলে।
পুত্ররূপে সেই স্তন খাইব মা বলে।।
পতিত পাবন পুত্র পাইবেন বলে।
নীচকুলে নন্দ এসে বৈশ্য পুত্র হ’লে।।
দ্বাপরে করিল লীলা সেই ভগবান।
ব্রজলীলা ত্যাজি মথুরাতে হরি যান।।
সুদাম মালীর কন্যা কুবুজা সুন্দরী।
বসুদেব নন্দনের হৈল পাটেশ্বরী।।
যদুকুলে রাজা নাই উগ্রসেন রাজা।
রাজা হয়ে করে কুব্জা মোহনের পূজা।।
দ্বারকায় গিয়ে হরি লীলা প্রকাশিল।
প্রেমদায় অর্জ্জুনের সারথি হইল।।
পঞ্চভাই শ্রীকৃষ্ণের পঞ্চআত্মা প্রায়।
সে ‘দিব্য বিলাপ সিন্ধু’ গ্রন্থে লেখা যায়।।
সেই পঞ্চভাই সতী দ্রৌপদী সহিতে।
নিযুক্ত হইল রাম দাসের সেবাতে।।
রাজসূয় যজ্ঞকালে মুনিগণ ভজে।
মুচিরাম সেবাকালে স্বর্গে ঘণ্টা বাজে।।
ক্রমেই বাড়ান হরি নীচ জন মান।
তৃণাদপি শ্লোকে তার আছয় প্রমাণ।।
রাখালের এঁঠো খায় কিবা সখ্য ভাব।
বিদুরের খুদ খায় শুদ্ধ প্রেম ভাব।।
শচীগর্ভ সিন্ধু মাঝে ইন্দু পরকাশ।
হবিউল্লা কাজী পুত্র ব্রহ্ম হরিদাস।।
নরোত্তম করিয়াছে বৈষ্ণব বন্দনা।
কালীদাসে দেখায়েছে তাহার নিশানা।।
কায়স্থ কুলেতে জন্ম রায় রামানন্দ।
তার ঠাঁই কৃষ্ণপ্রেম পাইয়া আনন্দ।।
যুগল মধুর প্রেম করিল প্রকাশ।
রঘুনাথের খুল্লতাত নাম কালিদাস।।
বন্দি সেই কালীদাস রঘুনাথের খুড়া।
বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট খাইয়া সেই বুড়া।।
বৈষ্ণবের শিরোমণি ঝড়ু ভুঁইমালী।
যে পথে হাঁটিতে কালীদাস মাখে ধুলি।।
উচ্ছিষ্ট খাইতে সাধু পলাইয়া রয়।
ঝড়ুর রমণী যবে উচ্ছিষ্ট ফেলায়।।
কলার ডোঙ্গায় সাধু পেয়ে আম্র আটি।
বৈষ্ণব প্রসাদ বলে করে চাঁটাচাটি।।
প্রভুর নিকটে গিয়া বলে হরিবোল।
অন্তর্য্যামী মহাপ্রভু ধরে দিল কোল।।
অদ্য হ’ল বৈষ্ণবের প্রসাদ ভাজন।
তুমি কালীদাস মোর জীবনের জীবন।।
ব্রহ্মবংশে জন্মিয়া গৌরাঙ্গ ভগবান।
যবন ব্রাহ্মণ সব করিলা সমান।।
রায় রামানন্দে বলে প্রতিজ্ঞা করিয়া।
কর্মী জ্ঞানী মাতাইব নীচ শূদ্র দিয়া।।
বাদশাহের উজির ছিল দু’টি ভাই।
রামকেলী গ্রামে গেল গৌরাঙ্গের ঠাঁই।।
বাহু প্রসারিয়া প্রভু দিল আলিঙ্গণ।
তারা বলে মোরা হই অস্পৃশ্য যবন।।
নীচকুলে জন্ম মোরা করি নীচ কাজ।
মোদের স্পর্শিলা হরি লোকে দিবে লাজ।।
চৈতন্য চরিতামৃতে আছয় প্রকাশ।
সাকর মল্লিক আর নাম দবির খাস।।
ভাগবতে নাম রূপ সাকর মল্লিক।
দবির খাস সনাতন পরম নৈষ্ঠিক।।
প্রভু বলে যুগে যুগে ভক্ত দুইজন।
আজ হ’তে নাম হ’ল রূপ সনাতন।।
অবতার যখন হলেন শ্রীনিবাস।
নিত্যানন্দ হইলেন নরোত্তম দাস।।
কায়স্থ শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত খেতরিতে।
তার পুত্র নরোত্তম ব্যক্ত এ জগতে।।
সেই নরোত্তম শিষ্য দুই মহামতি।
এক শাখা গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী।।
আর শাখা চক্রবর্তী রামনারায়ণ।
শূদ্রের হইল শিষ্য দু’জন ব্রাহ্মণ।।
কিবা শূদ্র কিবা ন্যাসি যোগী কেন নয়।
যেই জানে কৃষ্ণ তত্ত্ব সেই শ্রেষ্ঠ হয়।।
পয়ার
শ্রীনিবাস রামচন্দ্র নরোত্তম দাস।
সাধিল নিগূঢ় লীলা নিজ অভিলাষ।।
গৌরাঙ্গ লীলায় যেন লয়ে ভক্তগণ।
ঘরে ঘরে যারে তারে দেয় প্রেমধন।।
শ্রীনিবাস রামচন্দ্র করিলেন লীলা।
নিজ ভক্তগণ ল’য়ে প্রেম আস্বাদিলা।।
পূর্বে প্রভু অদ্বৈতেরে কহে যে বচন।
করিব নিগূঢ় লীলা রস আস্বাদন।।
এই প্রেম দিয়া যদি জগৎ মাতায়।
নিগূঢ় প্রকট হয় পূর্ব কথা যায়।।
ধর্ম সংস্থাপন জীব উদ্ধার হইল।
পরে প্রেম প্রকাশিবে বাসনা থাকিল।।
সফলানগরী ধন্য ওড়াকাঁন্দি ধন্য।
যে যে গ্রামে হরিচাঁদ হৈল অবতীর্ণ।।
সফলানগরী শ্রীযশোমন্ত ঠাকুর।
তাহার মহিমা কথা কহিতে প্রচুর।।
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান কৃষ্ণ প্রাণ তার।
কৃষ্ণের নৈবিদ্য বিনে না হ’ত আহার।।
সদা করে কৃষ্ণ কথা কথোপকথন।
কৃষ্ণ বলে অশ্রুজলে ভাসিত বয়ন।।
প্রতিপক্ষে করাইত বৈষ্ণব ভোজন।
হরিব্রত একাদশী নাম সংকীর্ত্তন।।
নীচ নীচ কুলে প্রভু দিয়া প্রেমধন।
নমঃশূদ্র কুলে এল ব্রহ্ম সনাতন।।
হয়গ্রীব কপিল হইল অবতার।
অংশ-অবতার সেও ব্রাহ্মণ কুমার।।
ব্রাহ্মণ সম্মান হেতু ভৃগুপদ ধরে।
শ্রীবামন অবতার কশ্যপের ঘরে।।
ভৃগুরাম অবতার জমদগ্নি সূত।
ক্রমে নীচ কুলে যায় হ’য়ে পদচ্যুত।।
শেষে দ্বিজ হ’তে এক পদ নীচে এলে।
ক্ষত্রীয় কুলেতে জন্ম করে রামলীলে।।
প্রথম পুরুষ অবতার রাম হ’ন।
তারপরে গোপ বৈশ্য শ্রীনন্দ নন্দন।।
ধরা দ্রোণ দুই জন ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।
অতিথি বিধানে পূজে শ্যাম চিন্তামণি।।
ছদ্মবেশে পদ্মনেত্র গিয়া সেই স্থানে।
ধরাকে দিলেন ধরা আতিথ্য বিধানে।।
স্তন কেঁটে সেবা করে সেই ত ব্রাহ্মণী।
ভক্তিতে আবদ্ধ হ’ল শ্যাম চিন্তামণি।।
ধরাকে দিলেন হরি এ সত্য কড়ার।
দ্বাপরে শোধিব মাগো তব ঋণধার।।
যেই স্তন কেটে মাগো আমাকে সেবিলে।
পুত্ররূপে সেই স্তন খাইব মা বলে।।
পতিত পাবন পুত্র পাইবেন বলে।
নীচকুলে নন্দ এসে বৈশ্য পুত্র হ’লে।।
দ্বাপরে করিল লীলা সেই ভগবান।
ব্রজলীলা ত্যাজি মথুরাতে হরি যান।।
সুদাম মালীর কন্যা কুবুজা সুন্দরী।
বসুদেব নন্দনের হৈল পাটেশ্বরী।।
যদুকুলে রাজা নাই উগ্রসেন রাজা।
রাজা হয়ে করে কুব্জা মোহনের পূজা।।
দ্বারকায় গিয়ে হরি লীলা প্রকাশিল।
প্রেমদায় অর্জ্জুনের সারথি হইল।।
পঞ্চভাই শ্রীকৃষ্ণের পঞ্চআত্মা প্রায়।
সে ‘দিব্য বিলাপ সিন্ধু’ গ্রন্থে লেখা যায়।।
সেই পঞ্চভাই সতী দ্রৌপদী সহিতে।
নিযুক্ত হইল রাম দাসের সেবাতে।।
রাজসূয় যজ্ঞকালে মুনিগণ ভজে।
মুচিরাম সেবাকালে স্বর্গে ঘণ্টা বাজে।।
ক্রমেই বাড়ান হরি নীচ জন মান।
তৃণাদপি শ্লোকে তার আছয় প্রমাণ।।
রাখালের এঁঠো খায় কিবা সখ্য ভাব।
বিদুরের খুদ খায় শুদ্ধ প্রেম ভাব।।
শচীগর্ভ সিন্ধু মাঝে ইন্দু পরকাশ।
হবিউল্লা কাজী পুত্র ব্রহ্ম হরিদাস।।
নরোত্তম করিয়াছে বৈষ্ণব বন্দনা।
কালীদাসে দেখায়েছে তাহার নিশানা।।
কায়স্থ কুলেতে জন্ম রায় রামানন্দ।
তার ঠাঁই কৃষ্ণপ্রেম পাইয়া আনন্দ।।
যুগল মধুর প্রেম করিল প্রকাশ।
রঘুনাথের খুল্লতাত নাম কালিদাস।।
বন্দি সেই কালীদাস রঘুনাথের খুড়া।
বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট খাইয়া সেই বুড়া।।
বৈষ্ণবের শিরোমণি ঝড়ু ভুঁইমালী।
যে পথে হাঁটিতে কালীদাস মাখে ধুলি।।
উচ্ছিষ্ট খাইতে সাধু পলাইয়া রয়।
ঝড়ুর রমণী যবে উচ্ছিষ্ট ফেলায়।।
কলার ডোঙ্গায় সাধু পেয়ে আম্র আটি।
বৈষ্ণব প্রসাদ বলে করে চাঁটাচাটি।।
প্রভুর নিকটে গিয়া বলে হরিবোল।
অন্তর্য্যামী মহাপ্রভু ধরে দিল কোল।।
অদ্য হ’ল বৈষ্ণবের প্রসাদ ভাজন।
তুমি কালীদাস মোর জীবনের জীবন।।
ব্রহ্মবংশে জন্মিয়া গৌরাঙ্গ ভগবান।
যবন ব্রাহ্মণ সব করিলা সমান।।
রায় রামানন্দে বলে প্রতিজ্ঞা করিয়া।
কর্মী জ্ঞানী মাতাইব নীচ শূদ্র দিয়া।।
বাদশাহের উজির ছিল দু’টি ভাই।
রামকেলী গ্রামে গেল গৌরাঙ্গের ঠাঁই।।
বাহু প্রসারিয়া প্রভু দিল আলিঙ্গণ।
তারা বলে মোরা হই অস্পৃশ্য যবন।।
নীচকুলে জন্ম মোরা করি নীচ কাজ।
মোদের স্পর্শিলা হরি লোকে দিবে লাজ।।
চৈতন্য চরিতামৃতে আছয় প্রকাশ।
সাকর মল্লিক আর নাম দবির খাস।।
ভাগবতে নাম রূপ সাকর মল্লিক।
দবির খাস সনাতন পরম নৈষ্ঠিক।।
প্রভু বলে যুগে যুগে ভক্ত দুইজন।
আজ হ’তে নাম হ’ল রূপ সনাতন।।
অবতার যখন হলেন শ্রীনিবাস।
নিত্যানন্দ হইলেন নরোত্তম দাস।।
কায়স্থ শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত খেতরিতে।
তার পুত্র নরোত্তম ব্যক্ত এ জগতে।।
সেই নরোত্তম শিষ্য দুই মহামতি।
এক শাখা গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী।।
আর শাখা চক্রবর্তী রামনারায়ণ।
শূদ্রের হইল শিষ্য দু’জন ব্রাহ্মণ।।
কিবা শূদ্র কিবা ন্যাসি যোগী কেন নয়।
যেই জানে কৃষ্ণ তত্ত্ব সেই শ্রেষ্ঠ হয়।।
শ্লোক
ন শূদ্রা ভগবদ্ভক্তা স্তেহপি ভাগবতোত্তমাঃ।
সর্ব্ববর্ণেষু তে শূদ্রা যে ন ভক্তা জনার্দ্দনে।।
ন শূদ্রা ভগবদ্ভক্তা স্তেহপি ভাগবতোত্তমাঃ।
সর্ব্ববর্ণেষু তে শূদ্রা যে ন ভক্তা জনার্দ্দনে।।
অপিচ
চণ্ডলোহপি মুনিশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণঃ।
হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচাধমঃ।।
চণ্ডলোহপি মুনিশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণঃ।
হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচাধমঃ।।
পয়ার
পাষণ্ড দলনে আছে বহুত প্রমাণ।
ভক্ত হ’লে প্রভু তার বাড়ান সম্মান।।
আর ত প্রমাণ এক রাম অবতারে।
রাম কার্য্য করে সব ভল্লুক বানরে।।
কিবা জাতি কিবা কুল রাখাল ভূপাল।
শ্রীরামের মিত্র কপি রাক্ষস চণ্ডাল।।
নীচকুল ভক্তিগুণে করিল পবিত্র।
এ লীলায় হইল প্রভু যশোমন্ত পুত্র।।
কিসের রসিক ধর্ম কিসের বাউল।
ধর্ম যজে নৈষ্ঠিকেতে অটল আউল।।
সর্ব ধর্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থুল।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্ত্তি এই হয় মূল।।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
এই সুক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাইতে।
জনম লভিলা যশোমন্তের গৃহেতে।।
মুখে বল হরি হরি হাতে কর কাজ।
হরি বল দিন গেল বলে রসরাজ।।
পাষণ্ড দলনে আছে বহুত প্রমাণ।
ভক্ত হ’লে প্রভু তার বাড়ান সম্মান।।
আর ত প্রমাণ এক রাম অবতারে।
রাম কার্য্য করে সব ভল্লুক বানরে।।
কিবা জাতি কিবা কুল রাখাল ভূপাল।
শ্রীরামের মিত্র কপি রাক্ষস চণ্ডাল।।
নীচকুল ভক্তিগুণে করিল পবিত্র।
এ লীলায় হইল প্রভু যশোমন্ত পুত্র।।
কিসের রসিক ধর্ম কিসের বাউল।
ধর্ম যজে নৈষ্ঠিকেতে অটল আউল।।
সর্ব ধর্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থুল।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্ত্তি এই হয় মূল।।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
এই সুক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাইতে।
জনম লভিলা যশোমন্তের গৃহেতে।।
মুখে বল হরি হরি হাতে কর কাজ।
হরি বল দিন গেল বলে রসরাজ।।
আদিখণ্ড
দ্বিতীয় তরঙ্গ
দ্বিতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণবদাস জয় গৌরীদাস ।।
জয় শ্রীস্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হরি অবতার ।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন ।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময় ।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণবদাস জয় গৌরীদাস ।।
জয় শ্রীস্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হরি অবতার ।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন ।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময় ।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ ।।
মহাপ্রভুর পূর্ব পুরুষগণের বিবরণ
দীর্ঘ-ত্রিপদী।
দীর্ঘ-ত্রিপদী।
নাম ছিল রামদাস, রাঢ়দেশে ছিল বাস,
তীর্থযাত্রা করি বহুদিন।
স্ত্রী পুরুষ দুইজনে, শেষে যান বৃন্দাবনে,
কৃষ্ণপ্রেমে হয়ে উদাসীন ।।
কৃষ্ণনাম উচ্চারণে, ধারা বহিত নয়নে,
হেরিলে পবিত্র হয় জীব।
কাশী কাঞ্চি মধুপুরী, সরস্বতী গোদাবরী,
শান্তিপুর আদি নবদ্বীপ ।।
বিষয় সম্পত্তি ত্যাজে, তীর্থ-যাত্রী পদব্রজে,
পরে যান শ্রীচন্দ্রশেখর।
নবগঙ্গা নাম শুনি, দেখিবারে সুরধনী,
লক্ষ্মীপাশা এল তারপর ।।
কৃষ্ণভক্ত শিরোমণি, সবলোকে ধন্য মানি,
যত্ন করি রাখিল তথায়।
কৃষ্ণ ভকতের সঙ্গে, প্রেমকথা রসরঙ্গে,
থাকিলেন শ্রীলক্ষ্মীপাশায় ।।
চন্দ্রমোহন তার পুত্র, ক্রমে শুন তার সূত্র,
তার পুত্র শুকদেব নাম।
লক্ষ্মী পাশার উত্তর, নবগঙ্গা নদীপার,
বাস করে জয়পুর গ্রাম ।।
তস্য পুত্র কালিদাস, বহুদিন কৈল বাস,
তিনি যান পাথরঘাটায়।
রবিদাস নিধিরাম, কনিষ্ঠ শ্রীজীব নাম,
তিনপুত্র সহিত তথায় ।।
সর্ব্বদায় সাধুসেবা, সংকীর্ত্তন রাত্রি দিবা,
মাঝে মাঝে বাণিজ্য করিত।
যাহা করে উপার্জন, তাহাতে সাধু সেবন,
ক্ষেত্র কার্য্য অল্প পরিমিত ।।
একদিন কৃষ্ণ ধ্যানে, তুলসী বেদীর স্থানে,
বসিয়াছে কালীদাস যিনি।
করে করে মালা জপ, অপরে কৃষ্ণ আরোপ,
হেনকালে হ’ল দৈববাণী ।।
সাধুসেবা যে দিনেতে, হবে তব ভবনেতে,
এই বিলে আছয় প্রস্তর।
আসিয়া বিলের কূলে, দাঁড়াইও হরিবলে,
ভূরি ভূরি উঠিবে পাথর ।।
সে সব পাথর ল’য়ে, নিজ ভবনেতে গিয়ে,
সাধুসেবা করিও যতনে।
সাধুসেবা হ’লে পরে, লইয়া বিলের তীরে,
সে পাত্র রাখিও পূর্ব স্থানে ।।
এরূপ করেন তিনি, গ্রাম্য লোকে তাই শুনি,
মহোৎসব হ’লে কোন ঠাঁই।
প্রস্তর লইব ব’লে, দাঁড়া’ত বিলের কূলে,
দিয়া কালীদাসের দোঁহাই ।।
সে সব পাথর ল’য়ে, আনিয়া নিজ আলয়ে,
ভোজন করায় লোক সবে।
লোকের ভোজন পরে, আনিয়া বিলের তীরে,
পাথর রাখিলে যায় ডুবে ।।
পুরাতন লোকে জানে, সেই বিলের দক্ষিণে,
পাবুনে গ্রামের ছিল নাম।
পাথর আসিত ঘাটে, যে ঘাটে পাথর উঠে,
হইল পাথরঘাটা গ্রাম ।।
এক বাটী একদিনে, সে সব পাথর এনে,
বহুলোক ভোজন করায়।
প্রস্তর ঘাটেতে এনে, রেখে গেল সেই স্থানে,
একখানি পাথর না দেয় ।।
সন্ধ্যা হইল উত্তীর্ণ, সেই পাথরের জন্য,
হু হু শব্দ উঠিতেছে জলে।
বিলের যত পাথর, সবে হ’য়ে একত্তর,
সেই জল বৃদ্ধি হ’য়ে চলে ।।
যে ঘরে পাথর ছিল, জলেতে ভাঙ্গিয়া নিল,
মধুমতি নদীর মাঝেতে।
দেবশিলা স্বপ্নাদেশে, বলে গেল কালীদাসে,
কলুষ পশিল এ গ্রামেতে ।।
সে কালীদাসের সূত, নিধিরাম জ্যেষ্ঠ পুত্র,
তিনি হ’ন পরম নৈষ্ঠিক।
শ্রীনিধিরামের ঘরে, দুই পুত্র জন্ম ধরে,
মুকুন্দরাম কনিষ্ঠ কার্ত্তিক ।।
জ্যেষ্ঠ শ্রীমুকুন্দরাম, অশেষ গুণের ধাম,
ঠাকুর মোচাই নামে খ্যাত।
সফলানগরী এসে, বাস করিলেন শেষে,
পঞ্চ পুত্র ল’য়ে আনন্দিত ।।
যশোমন্ত সনাতন, প্রাণকৃষ্ণ রামমোহন,
রণকৃষ্ণ এ পাঁচ সন্তান।
সর্বজ্যেষ্ঠ যশোমন্ত, তার হ’ল পঞ্চ পুত্র,
এ পঞ্চের ঠাকুর আখ্যান ।।
এ বংশে জন্মিল যত, শুদ্ধ শান্ত কৃষ্ণভক্ত,
সবে মত্ত হরি গুণ গানে।
কৃষ্ণ ভক্তির গুণে, তার এক এক জনে,
সাধু কি বৈষ্ণব সবে মানে ।।
এ কয় পুরুষ মাঝে, মত্ত সাধু সেবা কাজে,
কৃষ্ণপ্রেম ভক্তি নিরবধি।
কেহ বা হ’ল সন্ন্যাসী, কেহ বৃন্দাবনবাসী,
তাতে বংশে ঠাকুর উপাধি ।।
ঠাকুরের এ বংশেতে, হরিচাঁদ অবনীতে,
করিলেন জনম গ্রহণ।
কহিছে তারকচন্দ্র, অবতীর্ণ হরিশ্চন্দ্র,
হরি হরি বল সর্বজন ।।
তীর্থযাত্রা করি বহুদিন।
স্ত্রী পুরুষ দুইজনে, শেষে যান বৃন্দাবনে,
কৃষ্ণপ্রেমে হয়ে উদাসীন ।।
কৃষ্ণনাম উচ্চারণে, ধারা বহিত নয়নে,
হেরিলে পবিত্র হয় জীব।
কাশী কাঞ্চি মধুপুরী, সরস্বতী গোদাবরী,
শান্তিপুর আদি নবদ্বীপ ।।
বিষয় সম্পত্তি ত্যাজে, তীর্থ-যাত্রী পদব্রজে,
পরে যান শ্রীচন্দ্রশেখর।
নবগঙ্গা নাম শুনি, দেখিবারে সুরধনী,
লক্ষ্মীপাশা এল তারপর ।।
কৃষ্ণভক্ত শিরোমণি, সবলোকে ধন্য মানি,
যত্ন করি রাখিল তথায়।
কৃষ্ণ ভকতের সঙ্গে, প্রেমকথা রসরঙ্গে,
থাকিলেন শ্রীলক্ষ্মীপাশায় ।।
চন্দ্রমোহন তার পুত্র, ক্রমে শুন তার সূত্র,
তার পুত্র শুকদেব নাম।
লক্ষ্মী পাশার উত্তর, নবগঙ্গা নদীপার,
বাস করে জয়পুর গ্রাম ।।
তস্য পুত্র কালিদাস, বহুদিন কৈল বাস,
তিনি যান পাথরঘাটায়।
রবিদাস নিধিরাম, কনিষ্ঠ শ্রীজীব নাম,
তিনপুত্র সহিত তথায় ।।
সর্ব্বদায় সাধুসেবা, সংকীর্ত্তন রাত্রি দিবা,
মাঝে মাঝে বাণিজ্য করিত।
যাহা করে উপার্জন, তাহাতে সাধু সেবন,
ক্ষেত্র কার্য্য অল্প পরিমিত ।।
একদিন কৃষ্ণ ধ্যানে, তুলসী বেদীর স্থানে,
বসিয়াছে কালীদাস যিনি।
করে করে মালা জপ, অপরে কৃষ্ণ আরোপ,
হেনকালে হ’ল দৈববাণী ।।
সাধুসেবা যে দিনেতে, হবে তব ভবনেতে,
এই বিলে আছয় প্রস্তর।
আসিয়া বিলের কূলে, দাঁড়াইও হরিবলে,
ভূরি ভূরি উঠিবে পাথর ।।
সে সব পাথর ল’য়ে, নিজ ভবনেতে গিয়ে,
সাধুসেবা করিও যতনে।
সাধুসেবা হ’লে পরে, লইয়া বিলের তীরে,
সে পাত্র রাখিও পূর্ব স্থানে ।।
এরূপ করেন তিনি, গ্রাম্য লোকে তাই শুনি,
মহোৎসব হ’লে কোন ঠাঁই।
প্রস্তর লইব ব’লে, দাঁড়া’ত বিলের কূলে,
দিয়া কালীদাসের দোঁহাই ।।
সে সব পাথর ল’য়ে, আনিয়া নিজ আলয়ে,
ভোজন করায় লোক সবে।
লোকের ভোজন পরে, আনিয়া বিলের তীরে,
পাথর রাখিলে যায় ডুবে ।।
পুরাতন লোকে জানে, সেই বিলের দক্ষিণে,
পাবুনে গ্রামের ছিল নাম।
পাথর আসিত ঘাটে, যে ঘাটে পাথর উঠে,
হইল পাথরঘাটা গ্রাম ।।
এক বাটী একদিনে, সে সব পাথর এনে,
বহুলোক ভোজন করায়।
প্রস্তর ঘাটেতে এনে, রেখে গেল সেই স্থানে,
একখানি পাথর না দেয় ।।
সন্ধ্যা হইল উত্তীর্ণ, সেই পাথরের জন্য,
হু হু শব্দ উঠিতেছে জলে।
বিলের যত পাথর, সবে হ’য়ে একত্তর,
সেই জল বৃদ্ধি হ’য়ে চলে ।।
যে ঘরে পাথর ছিল, জলেতে ভাঙ্গিয়া নিল,
মধুমতি নদীর মাঝেতে।
দেবশিলা স্বপ্নাদেশে, বলে গেল কালীদাসে,
কলুষ পশিল এ গ্রামেতে ।।
সে কালীদাসের সূত, নিধিরাম জ্যেষ্ঠ পুত্র,
তিনি হ’ন পরম নৈষ্ঠিক।
শ্রীনিধিরামের ঘরে, দুই পুত্র জন্ম ধরে,
মুকুন্দরাম কনিষ্ঠ কার্ত্তিক ।।
জ্যেষ্ঠ শ্রীমুকুন্দরাম, অশেষ গুণের ধাম,
ঠাকুর মোচাই নামে খ্যাত।
সফলানগরী এসে, বাস করিলেন শেষে,
পঞ্চ পুত্র ল’য়ে আনন্দিত ।।
যশোমন্ত সনাতন, প্রাণকৃষ্ণ রামমোহন,
রণকৃষ্ণ এ পাঁচ সন্তান।
সর্বজ্যেষ্ঠ যশোমন্ত, তার হ’ল পঞ্চ পুত্র,
এ পঞ্চের ঠাকুর আখ্যান ।।
এ বংশে জন্মিল যত, শুদ্ধ শান্ত কৃষ্ণভক্ত,
সবে মত্ত হরি গুণ গানে।
কৃষ্ণ ভক্তির গুণে, তার এক এক জনে,
সাধু কি বৈষ্ণব সবে মানে ।।
এ কয় পুরুষ মাঝে, মত্ত সাধু সেবা কাজে,
কৃষ্ণপ্রেম ভক্তি নিরবধি।
কেহ বা হ’ল সন্ন্যাসী, কেহ বৃন্দাবনবাসী,
তাতে বংশে ঠাকুর উপাধি ।।
ঠাকুরের এ বংশেতে, হরিচাঁদ অবনীতে,
করিলেন জনম গ্রহণ।
কহিছে তারকচন্দ্র, অবতীর্ণ হরিশ্চন্দ্র,
হরি হরি বল সর্বজন ।।
অথ যশোমন্ত চরিত্র কথা
প্রনাম শ্রীযশোমন্ত ঠাকুরের পায়।
জনমে জনমে যেন পদে মতি রয় ।।
ঠাকুর বৈষ্ণব বলে উপাধি যাঁহার।
আমি মূঢ় কিবা গুণ বর্ণীব তাঁহার ।।
বৈষ্ণব সঙ্গেতে সাধু কীর্ত্তন করিত।
ভাবেতে বিভোর হ’য়ে কত ভাব হত ।।
অশ্রু কম্প স্বেদ বীর বীভৎস পুলক।
লোমকূপ কন্ডুলোম ঈষৎ কন্টক ।।
অষ্ট সাত্ত্বিক দশাতে বাহ্যহারা হ’য়ে।
প্রেমস্বরে কহিতেন কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ।।
মম দেহগৃহে কৃষ্ণ এই মাত্র ছিল।
দেখিতে দেখিতে যেন কাহা লুকাইল ।।
কাহারে বাপরে কৃষ্ণ কাহা বলরাম।
কাহারে আমার সেই শ্রীদাম সুদাম ।।
করুণা করিত সাধু বাৎসল্য প্রকাশি।
কোন দিন কৃষ্ণ গোষ্ঠে পোহাইত নিশি ।।
শুদ্ধরাগ ভক্তি শুদ্ধ কৃষ্ণ অনুরাগী।
বৈষ্ণবেরা যশোমন্তে বলিত বৈরাগী ।।
বৈষ্ণব উপাধি বৈষ্ণবের পদ সেবি।
অন্নপূর্ণা মাকে সবে বলিত বৈষ্ণবী ।।
বৈরাগী ঠাকুর আর ঠাকুর বৈষ্ণব।
এ হেন উপাধিতে হইল জনরব ।।
যতকিছু সংসারেতে করিতেন আয়।
যত্র আয় তত্র ব্যয় বৈষ্ণব সেবায় ।।
গো-সেবা করিত বহু করিয়া যতন।
দুই তিন গাভী সদা থাকিত দোহন ।।
ঘৃত বানাইত দধি করিয়া মন্থন।
বৈষ্ণবেরা দধি দুগ্ধ করিত ভোজন ।।
মন্থন সময় হ’লে বৈষ্ণবাগমন।
বৈষ্ণবের মুখে তুলে দিতেন মাখন ।।
নির্ম্নল দয়ার্দ্র চিত্ত না মেলে এমন।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন ।।
ভাণ্ডপুরে ঘৃত লয়ে সাধু গেলেন হাটে।
ঘৃত বেচিলেন এক দ্বিজের নিকটে ।।
ব্রাহ্মণ বলেন সাধু বৈস হেথাকারে।
মূল্যসহ ভাণ্ড দিয়া যাব কিছু পরে ।।
ব্রাহ্মণ এল না ফিরে মূল্য নাহি দিল।
ঘৃতভাণ্ড লয়ে দ্বিজ পলাইয়া গেল ।।
উত্তীর্ণ হইল সন্ধ্যা হাট ভেঙ্গে যায়।
নির্জ্জনে বসিয়া সাধু কৃষ্ণগুণ গায় ।।
গৃহেতে পশিয়া সাধু মৌন হ’য়ে রয়।
ঠাকুরানী বলে হাট বেসাতি কোথায় ।।
কোথায় ঘৃতের ভাণ্ড কিছুই না দেখি।
কি হয়েছে ওহে নাথ বসিয়া ভাব কি ।।
লবণ তামাক পান কিছুই না আনিলে।
কি উপায় হ’বে সাধু বৈষ্ণব আসিলে ।।
সাধু কহে কি বলিব শুন গো বৈষ্ণবী।
যে দায় ঠেকেছি আমি বসে তাই ভাবি ।।
ঘৃত গেল ভাণ্ড গেল তাতে দুঃখ নাই।
না হইল হাট করা যদিও না খাই ।।
যা হোক বৈষ্ণব সেবা বৈষ্ণব কৃপায়।
কর্মবসে যদি দু’দিন উপবাস হয় ।।
যে দায় ঠেকেছি আমি জানা’ব কাহায়।
অপরাধে অব্যহতি পাইব কোথায় ।।
ব্রাহ্মণেতে আমার যে হ’ল অবিশ্বাস।
এ দায় কোথায় যাই হ’ল সর্বনাশ ।।
আদি অন্ত সে বৃত্তান্ত দেবীকে জানা’ল।
যে ভাবে ব্রাহ্মণ ঘৃত ভাণ্ড ল’য়ে গেল ।।
ঠাকুরানী বলে নাথ না ভেব বিস্ময়।
যবে যে ঘটনা ঘটে ঈশ্বর ইচ্ছায় ।।
ঈশ্বর তোমায় যদি বুঝিবারে মন।
ব্রাহ্মণ দ্বারায় হেন করে নারায়ণ।।
কেন তাতে দুঃখ ভাব, ভাব বিপরীত।
ঘটন কারণ ঈশ্বরের নিয়োজিত ।।
এ কথা শুনিয়া সাধু শান্তি পেল মনে।
তারক স্বভাব যাচে যশোমন্ত স্থানে ।।
জনমে জনমে যেন পদে মতি রয় ।।
ঠাকুর বৈষ্ণব বলে উপাধি যাঁহার।
আমি মূঢ় কিবা গুণ বর্ণীব তাঁহার ।।
বৈষ্ণব সঙ্গেতে সাধু কীর্ত্তন করিত।
ভাবেতে বিভোর হ’য়ে কত ভাব হত ।।
অশ্রু কম্প স্বেদ বীর বীভৎস পুলক।
লোমকূপ কন্ডুলোম ঈষৎ কন্টক ।।
অষ্ট সাত্ত্বিক দশাতে বাহ্যহারা হ’য়ে।
প্রেমস্বরে কহিতেন কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ।।
মম দেহগৃহে কৃষ্ণ এই মাত্র ছিল।
দেখিতে দেখিতে যেন কাহা লুকাইল ।।
কাহারে বাপরে কৃষ্ণ কাহা বলরাম।
কাহারে আমার সেই শ্রীদাম সুদাম ।।
করুণা করিত সাধু বাৎসল্য প্রকাশি।
কোন দিন কৃষ্ণ গোষ্ঠে পোহাইত নিশি ।।
শুদ্ধরাগ ভক্তি শুদ্ধ কৃষ্ণ অনুরাগী।
বৈষ্ণবেরা যশোমন্তে বলিত বৈরাগী ।।
বৈষ্ণব উপাধি বৈষ্ণবের পদ সেবি।
অন্নপূর্ণা মাকে সবে বলিত বৈষ্ণবী ।।
বৈরাগী ঠাকুর আর ঠাকুর বৈষ্ণব।
এ হেন উপাধিতে হইল জনরব ।।
যতকিছু সংসারেতে করিতেন আয়।
যত্র আয় তত্র ব্যয় বৈষ্ণব সেবায় ।।
গো-সেবা করিত বহু করিয়া যতন।
দুই তিন গাভী সদা থাকিত দোহন ।।
ঘৃত বানাইত দধি করিয়া মন্থন।
বৈষ্ণবেরা দধি দুগ্ধ করিত ভোজন ।।
মন্থন সময় হ’লে বৈষ্ণবাগমন।
বৈষ্ণবের মুখে তুলে দিতেন মাখন ।।
নির্ম্নল দয়ার্দ্র চিত্ত না মেলে এমন।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন ।।
ভাণ্ডপুরে ঘৃত লয়ে সাধু গেলেন হাটে।
ঘৃত বেচিলেন এক দ্বিজের নিকটে ।।
ব্রাহ্মণ বলেন সাধু বৈস হেথাকারে।
মূল্যসহ ভাণ্ড দিয়া যাব কিছু পরে ।।
ব্রাহ্মণ এল না ফিরে মূল্য নাহি দিল।
ঘৃতভাণ্ড লয়ে দ্বিজ পলাইয়া গেল ।।
উত্তীর্ণ হইল সন্ধ্যা হাট ভেঙ্গে যায়।
নির্জ্জনে বসিয়া সাধু কৃষ্ণগুণ গায় ।।
গৃহেতে পশিয়া সাধু মৌন হ’য়ে রয়।
ঠাকুরানী বলে হাট বেসাতি কোথায় ।।
কোথায় ঘৃতের ভাণ্ড কিছুই না দেখি।
কি হয়েছে ওহে নাথ বসিয়া ভাব কি ।।
লবণ তামাক পান কিছুই না আনিলে।
কি উপায় হ’বে সাধু বৈষ্ণব আসিলে ।।
সাধু কহে কি বলিব শুন গো বৈষ্ণবী।
যে দায় ঠেকেছি আমি বসে তাই ভাবি ।।
ঘৃত গেল ভাণ্ড গেল তাতে দুঃখ নাই।
না হইল হাট করা যদিও না খাই ।।
যা হোক বৈষ্ণব সেবা বৈষ্ণব কৃপায়।
কর্মবসে যদি দু’দিন উপবাস হয় ।।
যে দায় ঠেকেছি আমি জানা’ব কাহায়।
অপরাধে অব্যহতি পাইব কোথায় ।।
ব্রাহ্মণেতে আমার যে হ’ল অবিশ্বাস।
এ দায় কোথায় যাই হ’ল সর্বনাশ ।।
আদি অন্ত সে বৃত্তান্ত দেবীকে জানা’ল।
যে ভাবে ব্রাহ্মণ ঘৃত ভাণ্ড ল’য়ে গেল ।।
ঠাকুরানী বলে নাথ না ভেব বিস্ময়।
যবে যে ঘটনা ঘটে ঈশ্বর ইচ্ছায় ।।
ঈশ্বর তোমায় যদি বুঝিবারে মন।
ব্রাহ্মণ দ্বারায় হেন করে নারায়ণ।।
কেন তাতে দুঃখ ভাব, ভাব বিপরীত।
ঘটন কারণ ঈশ্বরের নিয়োজিত ।।
এ কথা শুনিয়া সাধু শান্তি পেল মনে।
তারক স্বভাব যাচে যশোমন্ত স্থানে ।।
শ্রীমদ্রামকান্ত গোস্বামীর উপাখ্যান।
রামকান্ত নামে সাধু মুখডোবা গাঁয়।
বৈরাগী উপাধি তার সাধু অতিশয় ।।
রামকান্ত যশোমন্ত আলয় আসিত।
স্ত্রী পুরুষে একত্তরে সাধুকে সেবিত ।।
সদা ছিল সে সাধুর উত্তার নয়ন।
শিবনেত্র প্রায় যেন আরোপ লক্ষণ ।।
কখন কখন সাধু বেড়াইতে যেত।
কোন কোন ঠাঁই গিয়া উপস্থিত হ’ত ।।
সর্বদা থাকিত সাধু মহাভাব হ’য়ে।
কোন কোন ভাগ্যবানে দয়া প্রকাশিয়ে ।।
যদি কোন পুত্রবতী সতী নারী পেত।
মা বলিয়া দুগ্ধ পান তাহার করিত ।।
সে নারীর গর্ভে যদি হইত সন্তান।
ধনে ধান্যে সুখী তারা সবে ভাগ্যবান ।।
ন পুত্র ন গর্ভবতী কোন নারী পেয়ে।
যদি তার স্তন পান করিতেন গিয়ে ।।
আহার করিত দুগ্ধ পানের সময়।
স্তন পান অন্তে দুগ্ধ শুকাইয়া যায় ।।
যাহা বলি দিত বর তাহাই ফলিত।
বাক্যসিদ্ধ পুরুষের যা মনে লইত ।।
একদিন প্রাতেঃ যশোমন্তের গৃহিণী।
পূর্ব্বভাব অন্তরেতে জাগিল অমনি।।
প্রাতঃকৃত্য কৃষ্ণনাম লইতে লইতে।
ব্রজভাব আসি তার জাগিল মনেতে ।।
বাহ্যস্মৃতি হারা হ’য়ে বলে বার বার।
কোথা রাম কৃষ্ণ প্রাণ পুতলি আমার ।।
এই ভাব তাহার হইত হৃদিমাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ ।।
বৈরাগী উপাধি তার সাধু অতিশয় ।।
রামকান্ত যশোমন্ত আলয় আসিত।
স্ত্রী পুরুষে একত্তরে সাধুকে সেবিত ।।
সদা ছিল সে সাধুর উত্তার নয়ন।
শিবনেত্র প্রায় যেন আরোপ লক্ষণ ।।
কখন কখন সাধু বেড়াইতে যেত।
কোন কোন ঠাঁই গিয়া উপস্থিত হ’ত ।।
সর্বদা থাকিত সাধু মহাভাব হ’য়ে।
কোন কোন ভাগ্যবানে দয়া প্রকাশিয়ে ।।
যদি কোন পুত্রবতী সতী নারী পেত।
মা বলিয়া দুগ্ধ পান তাহার করিত ।।
সে নারীর গর্ভে যদি হইত সন্তান।
ধনে ধান্যে সুখী তারা সবে ভাগ্যবান ।।
ন পুত্র ন গর্ভবতী কোন নারী পেয়ে।
যদি তার স্তন পান করিতেন গিয়ে ।।
আহার করিত দুগ্ধ পানের সময়।
স্তন পান অন্তে দুগ্ধ শুকাইয়া যায় ।।
যাহা বলি দিত বর তাহাই ফলিত।
বাক্যসিদ্ধ পুরুষের যা মনে লইত ।।
একদিন প্রাতেঃ যশোমন্তের গৃহিণী।
পূর্ব্বভাব অন্তরেতে জাগিল অমনি।।
প্রাতঃকৃত্য কৃষ্ণনাম লইতে লইতে।
ব্রজভাব আসি তার জাগিল মনেতে ।।
বাহ্যস্মৃতি হারা হ’য়ে বলে বার বার।
কোথা রাম কৃষ্ণ প্রাণ পুতলি আমার ।।
এই ভাব তাহার হইত হৃদিমাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ ।।
অন্নপূর্ণা মাতার যশোদা আবেশ
পয়ার
ধরিয়া গোপাল বেশ পিয়াইত স্তন।
এই সেই মায়াপুরী এই বৃন্দাবন ।।
যশোদা আবেশ হ’য়ে অন্নপূর্ণা কয়।
মা বলে ডাকরে বাছা এ দুঃখিনী মায় ।।
কোথা বাপ বিশ্বরূপ আয়রে কোলেতে।
দেখিনা ও চাঁদমুখ বহু দিন হ’তে ।।
সান্ত্বনা করিছে শ্রীযশোমন্ত ঠাকুর।
কি কহিলি কি গাইলি শুনিতে মধুর ।।
সুস্থিরা হইয়া পরে কহে ঠাকুরাণী।
কি কহিনু কি গাইনু কিছুই না জানি ।।
দেখিলাম হেন সেই নন্দের নন্দন।
মা মা বলিয়া মোরে পান করে স্তন ।।
সাধু বলে কৃষ্ণ গুণ গাইতে গাইতে।
ব্রজ ভাব হ’য়ে থাকে ভক্তের দেহেতে ।।
তোমার কি ভাব হয় বুঝিতে না পারি।
কাহা কিছু না বলিয়া থাক চুপ করি ।।
এ সময় ঠাকুরাণীর একটি কুমার।
কৃষ্ণদাস নাম বিশ্বরূপ অবতার ।।
সেই পুত্র করিতেন লালন পালন।
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান করে অনুক্ষণ ।।
যে দিন যশোদা ভাব আবেশ হইল।
সেইদিন রামকান্ত বৈরাগী আসিল ।।
শুভদিন বেলা এক প্রহর সময়।
দেবী চিঁড়া বানিবারে ঢেঁকিশালে যায় ।।
পশ্চিমাভিমুখ দেবী দক্ষিণেতে ঢেঁকি।
কৃষ্ণ বলে চিড়া আলে ঝরে দুটি আঁখি ।।
হেনকালে রামকান্ত বৈরাগী আসিয়া।
স্তন্যদুগ্ধ পান করে গলে হাত দিয়া ।।
পুত্রভাবে ঠাকুরাণী রাখিলেন কোলে।
স্নেহাবেশে ভাসে দুটি নয়নের জলে ।।
বলে অদ্য পোহাইল কি সুখ যামিনী।
প্রভাত আবেশ বুঝি ফলিল এখনি ।।
রামকান্ত বলে মাগো বলি যে তোমারে।
বাসুদেব জন্মিবেন তোমার উদরে ।।
কিছুদিন পরে রামকান্ত আর দিনে।
বাসুদেব কোলে করি বসিল যতনে ।।
বাসুদেবে বলে যাব সফলা নগরে।
পূজাদি লইব মাতা অন্নপূর্ণা ঘরে ।।
বাসুদেবে ল’য়ে সাধু পরম কুশলে।
যশোমন্ত গৃহে আসি উপনীত হ’লে ।।
মুহূর্তেক দিবা আছে সন্ধ্যার অগ্রেতে।
অন্নপূর্ণা ঝাড়ু দেন ঝাঁটা ল’য়ে হাতে ।।
ঠাকুরাণী ঝাঁট দেন পূর্ব্বাভিমুখেতে।
রামকান্ত আসিলেন পূর্ব্বদিক হ’তে ।।
সম্নুখে যাইয়া সাধু বলে যে মাতায়।
কোলে কর বাসুরে সময় বয়ে যায় ।।
আস্তে ব্যস্তে ঠাকুরাণী বাসুদেবে ধরে।
রাখিলেন পুত্র স্নেহে বাম কক্ষ পরে ।।
হইল অপূর্ব শোভা দরশন করে।
রামকান্ত নাচে চারিদিকে ঘুরে ফিরে ।।
সজল নয়ন সাধু প্রেমে পুলকিত।
হাতে তালি দিয়া নেচে নেচে গায় গীত ।।
দেখরে নগরবাসী হ’ল কি আনন্দ।
অন্নপূর্ণা অনায়াসে পাইল গোবিন্দ ।।
কিবা পূন্য করেছিল চৌধুরীর ঝি।
সেই পূণ্যে পুত্র পেল বাসুদেবজী ।।
রামকান্ত কহে যশোমন্ত বৈরাগীরে।
কিছুদিন বাসুদেবে রাখ তব ঘরে ।।
ওঢ়াকাঁদি মাচকাঁদি ঘৃতকাঁদি আদি।
বহুগ্রামে ভ্রমিতেন কান্ত গুণনিধি ।।
দুই চারি দিন পরে অথবা সপ্তাহে।
মাঝে মাঝে আসিতেন অন্নপূর্ণা গৃহে ।।
যে যে দিন না আসিত থাকিতেন দূরে।
অন্নপূর্ণা পূজিতেন বাসুদেবজীরে ।।
তুলসী চন্দন মেখে নানা পুষ্প তুলে।
দিত রাণী বাসুদেবে লহ লহ বলে ।।
এইরূপে পক্ষান্তর ভ্রমণ করিয়ে।
দেশে গেল রামকান্ত বাসুদেবে ল’য়ে ।।
কিছুদিন পরে সেই অন্নপূর্ণা সতী।
স্ত্রী আচারে যে দিন হইল শুদ্ধমতি ।।
শয়নে ছিলেন শ্রীযশোমন্ত বৈরাগী।
অন্নপূর্ণা বসিলেন পদসেবা লাগি ।।
পদ সেবি প্রণমিয়া করি জোড়পাণি।
পদপার্শ্বে শয়ন করিলা ঠাকুরাণী ।।
যশোদা আবেশ বর দিলা রামকান্ত।
বিরচিল তারক রসনা এ বৃত্তান্ত ।।
আদেশে গোলোকচন্দ্র নরহরি কায়।
পূর্ণ কর বাসনা রসনা গীত গায় ।।
পয়ার
ধরিয়া গোপাল বেশ পিয়াইত স্তন।
এই সেই মায়াপুরী এই বৃন্দাবন ।।
যশোদা আবেশ হ’য়ে অন্নপূর্ণা কয়।
মা বলে ডাকরে বাছা এ দুঃখিনী মায় ।।
কোথা বাপ বিশ্বরূপ আয়রে কোলেতে।
দেখিনা ও চাঁদমুখ বহু দিন হ’তে ।।
সান্ত্বনা করিছে শ্রীযশোমন্ত ঠাকুর।
কি কহিলি কি গাইলি শুনিতে মধুর ।।
সুস্থিরা হইয়া পরে কহে ঠাকুরাণী।
কি কহিনু কি গাইনু কিছুই না জানি ।।
দেখিলাম হেন সেই নন্দের নন্দন।
মা মা বলিয়া মোরে পান করে স্তন ।।
সাধু বলে কৃষ্ণ গুণ গাইতে গাইতে।
ব্রজ ভাব হ’য়ে থাকে ভক্তের দেহেতে ।।
তোমার কি ভাব হয় বুঝিতে না পারি।
কাহা কিছু না বলিয়া থাক চুপ করি ।।
এ সময় ঠাকুরাণীর একটি কুমার।
কৃষ্ণদাস নাম বিশ্বরূপ অবতার ।।
সেই পুত্র করিতেন লালন পালন।
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান করে অনুক্ষণ ।।
যে দিন যশোদা ভাব আবেশ হইল।
সেইদিন রামকান্ত বৈরাগী আসিল ।।
শুভদিন বেলা এক প্রহর সময়।
দেবী চিঁড়া বানিবারে ঢেঁকিশালে যায় ।।
পশ্চিমাভিমুখ দেবী দক্ষিণেতে ঢেঁকি।
কৃষ্ণ বলে চিড়া আলে ঝরে দুটি আঁখি ।।
হেনকালে রামকান্ত বৈরাগী আসিয়া।
স্তন্যদুগ্ধ পান করে গলে হাত দিয়া ।।
পুত্রভাবে ঠাকুরাণী রাখিলেন কোলে।
স্নেহাবেশে ভাসে দুটি নয়নের জলে ।।
বলে অদ্য পোহাইল কি সুখ যামিনী।
প্রভাত আবেশ বুঝি ফলিল এখনি ।।
রামকান্ত বলে মাগো বলি যে তোমারে।
বাসুদেব জন্মিবেন তোমার উদরে ।।
কিছুদিন পরে রামকান্ত আর দিনে।
বাসুদেব কোলে করি বসিল যতনে ।।
বাসুদেবে বলে যাব সফলা নগরে।
পূজাদি লইব মাতা অন্নপূর্ণা ঘরে ।।
বাসুদেবে ল’য়ে সাধু পরম কুশলে।
যশোমন্ত গৃহে আসি উপনীত হ’লে ।।
মুহূর্তেক দিবা আছে সন্ধ্যার অগ্রেতে।
অন্নপূর্ণা ঝাড়ু দেন ঝাঁটা ল’য়ে হাতে ।।
ঠাকুরাণী ঝাঁট দেন পূর্ব্বাভিমুখেতে।
রামকান্ত আসিলেন পূর্ব্বদিক হ’তে ।।
সম্নুখে যাইয়া সাধু বলে যে মাতায়।
কোলে কর বাসুরে সময় বয়ে যায় ।।
আস্তে ব্যস্তে ঠাকুরাণী বাসুদেবে ধরে।
রাখিলেন পুত্র স্নেহে বাম কক্ষ পরে ।।
হইল অপূর্ব শোভা দরশন করে।
রামকান্ত নাচে চারিদিকে ঘুরে ফিরে ।।
সজল নয়ন সাধু প্রেমে পুলকিত।
হাতে তালি দিয়া নেচে নেচে গায় গীত ।।
দেখরে নগরবাসী হ’ল কি আনন্দ।
অন্নপূর্ণা অনায়াসে পাইল গোবিন্দ ।।
কিবা পূন্য করেছিল চৌধুরীর ঝি।
সেই পূণ্যে পুত্র পেল বাসুদেবজী ।।
রামকান্ত কহে যশোমন্ত বৈরাগীরে।
কিছুদিন বাসুদেবে রাখ তব ঘরে ।।
ওঢ়াকাঁদি মাচকাঁদি ঘৃতকাঁদি আদি।
বহুগ্রামে ভ্রমিতেন কান্ত গুণনিধি ।।
দুই চারি দিন পরে অথবা সপ্তাহে।
মাঝে মাঝে আসিতেন অন্নপূর্ণা গৃহে ।।
যে যে দিন না আসিত থাকিতেন দূরে।
অন্নপূর্ণা পূজিতেন বাসুদেবজীরে ।।
তুলসী চন্দন মেখে নানা পুষ্প তুলে।
দিত রাণী বাসুদেবে লহ লহ বলে ।।
এইরূপে পক্ষান্তর ভ্রমণ করিয়ে।
দেশে গেল রামকান্ত বাসুদেবে ল’য়ে ।।
কিছুদিন পরে সেই অন্নপূর্ণা সতী।
স্ত্রী আচারে যে দিন হইল শুদ্ধমতি ।।
শয়নে ছিলেন শ্রীযশোমন্ত বৈরাগী।
অন্নপূর্ণা বসিলেন পদসেবা লাগি ।।
পদ সেবি প্রণমিয়া করি জোড়পাণি।
পদপার্শ্বে শয়ন করিলা ঠাকুরাণী ।।
যশোদা আবেশ বর দিলা রামকান্ত।
বিরচিল তারক রসনা এ বৃত্তান্ত ।।
আদেশে গোলোকচন্দ্র নরহরি কায়।
পূর্ণ কর বাসনা রসনা গীত গায় ।।
শ্রীহরি ঠাকুরের জন্ম বিবরণ
পয়ার
এবে শুন ঠাকুরের জন্ম বিবরণ।
যেই রূপে প্রভূ ভবে অবতীর্ণ হন ।।
পূর্বেতে কড়ার ছিল ভক্তগণ সঙ্গে।
উৎকলেতে দৈববানী ছিল যে প্রসঙ্গে ।।
আর এক বাক্য ছিল শূন্যবাণী সনে।
শেষ লীলা করিব আমি ঐশাণ্য কোণে ।।
নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার।
অতি নিম্নে না নামিলে কিসে অবতার ।।
কৃষ্ণ প্রেম সুনির্ম্মল উচ্চেতে না রবে।
নিম্নখাদে থাকে বারি দেখ মনে ভেবে ।।
নীচ জন উচ্চ হ’বে বুদ্ধ তপস্যায়।
বুদ্ধদেব অবতার যে সময় হয় ।।
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।।
বুদ্ধদেব বহুদিন তপস্যা করিল।
তাতে ব্রহ্ম প্রণবাদি শূদ্রেতে পাইল ।।
নীচজন প্রতি দয়া বুদ্ধদেব করে।
প্রণবেতে অধিকারী শূদ্র তার পরে ।।
বুদ্ধদেব তপস্যাতে হইয়া সদয়।
বরং গুরু বলে প্রভু বর দিতে চায় ।।
বুদ্ধ বলে বর যদি দিবে মহাশয়।
অগ্রভাগে কর প্রভূ শূদ্রের উপায় ।।
প্রভু বলে তব নামে অবতার হ’ব।
প্রণব ত্রিগুণ নাম শূদ্রেরে বিলাব ।।
এক হরিনাম মধ্যে গুণ দিয়া সব।
নীচজনে করাইব পরম বৈষ্ণব ।।
বুদ্ধ বলে যদি প্রভু হও অবতার।
এদেশে থাকেনা যেন জাতির বিচার ।।
আর এক প্রশ্ন তার মধ্যেতে উদয়।
সংক্ষেপে বলিব যাতে পুঁথি না বাড়ায় ।।
কুবের নামেতে জোলা জাতি সে যবন।
পরম বৈষ্ণব রাম মন্ত্রে উপাসন ।।
তাহার নন্দন হ’ল নামেতে নকিম।
নিরবধি কৃষ্ণপ্রেম যাহার অসীম ।।
কুবের আরোপে থেকে কৃষ্ণরূপ দেখে।
নকিম বুনায় তাঁত হরি বলে মুখে ।।
কুবের আরোপে গাঁথে কুসুমের হার।
গলে দিবে সাজাইবে শ্যাম নটবর ।।
ভক্তি ফুলে মনোসুতে হার গাঁথি নিল।
সেই মালা ত্রিভঙ্গের গলে তুলে দিল ।।
চূড়ায় ঠেকিয়া হার নাহি পড়ে গলে।
দিতে হার পুনর্বার চূড়ায় ঠেকিলে ।।
নকিম আরোপে তাঁত বুনা’য়েছে হাতে।
মুখে হরি বলে কৃষ্ণ দেখে আরোপেতে ।।
বাপের আরোপ দেখি নকীমের সুখ।
বলে হাত আরো কিছু উপরে উঠুক ।।
দেখহ জোলার এই প্রেমভক্তি গুণ।
কি করে তাহার কাছে সত্বঃ রজঃ গুণ ।।
দারুব্রহ্ম অবতার হ’ল যে সময়।
কুবেরের কীর্ত্তি রাখিলেন এ ধরায় ।।
কুবেরের তোড়ানী খাইবে যেই জন।
তার হবে দারুব্রহ্ম রূপ দরশন ।।
আর এক প্রস্তাব যে আসিল তাহাতে।
একদা নারদ মুনি গেল বৈকুন্ঠেতে ।।
বিষ্ণুর প্রসাদ মুনি খাইল তথায়।
কৈলাসেতে আসি মুনি হইল উদয় ।।
শিবেরে বলেন মুনি হরষিত মন।
অদ্য হৈনু শ্রীনাথের প্রসাদ ভাজন ।।
শিব বলে আমারে ত দিলেনা কিঞ্চিৎ।
প্রভুর প্রসাদে মোরে করিলে বঞ্চিত ।।
নারদের নখাগ্রে প্রসাদ কণা ছিল।
প্রেমভরে হরের বদনে তুলে দিল ।।
প্রেমে মত্ত হইলেন নারদ শঙ্কর।
বঞ্চিতা হইয়া গৌরী করে আঙ্গীকার ।।
আমি যদি সাধ্বী নারী হই তব ঘরে।
এ প্রসাদ বিলাইব বাজারে বাজারে ।।
তপস্যা করিল হরি বর দিতে এল।
প্রসাদ বাজারে বিকি বর চেয়ে নিল ।।
পয়ার
এবে শুন ঠাকুরের জন্ম বিবরণ।
যেই রূপে প্রভূ ভবে অবতীর্ণ হন ।।
পূর্বেতে কড়ার ছিল ভক্তগণ সঙ্গে।
উৎকলেতে দৈববানী ছিল যে প্রসঙ্গে ।।
আর এক বাক্য ছিল শূন্যবাণী সনে।
শেষ লীলা করিব আমি ঐশাণ্য কোণে ।।
নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার।
অতি নিম্নে না নামিলে কিসে অবতার ।।
কৃষ্ণ প্রেম সুনির্ম্মল উচ্চেতে না রবে।
নিম্নখাদে থাকে বারি দেখ মনে ভেবে ।।
নীচ জন উচ্চ হ’বে বুদ্ধ তপস্যায়।
বুদ্ধদেব অবতার যে সময় হয় ।।
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।।
বুদ্ধদেব বহুদিন তপস্যা করিল।
তাতে ব্রহ্ম প্রণবাদি শূদ্রেতে পাইল ।।
নীচজন প্রতি দয়া বুদ্ধদেব করে।
প্রণবেতে অধিকারী শূদ্র তার পরে ।।
বুদ্ধদেব তপস্যাতে হইয়া সদয়।
বরং গুরু বলে প্রভু বর দিতে চায় ।।
বুদ্ধ বলে বর যদি দিবে মহাশয়।
অগ্রভাগে কর প্রভূ শূদ্রের উপায় ।।
প্রভু বলে তব নামে অবতার হ’ব।
প্রণব ত্রিগুণ নাম শূদ্রেরে বিলাব ।।
এক হরিনাম মধ্যে গুণ দিয়া সব।
নীচজনে করাইব পরম বৈষ্ণব ।।
বুদ্ধ বলে যদি প্রভু হও অবতার।
এদেশে থাকেনা যেন জাতির বিচার ।।
আর এক প্রশ্ন তার মধ্যেতে উদয়।
সংক্ষেপে বলিব যাতে পুঁথি না বাড়ায় ।।
কুবের নামেতে জোলা জাতি সে যবন।
পরম বৈষ্ণব রাম মন্ত্রে উপাসন ।।
তাহার নন্দন হ’ল নামেতে নকিম।
নিরবধি কৃষ্ণপ্রেম যাহার অসীম ।।
কুবের আরোপে থেকে কৃষ্ণরূপ দেখে।
নকিম বুনায় তাঁত হরি বলে মুখে ।।
কুবের আরোপে গাঁথে কুসুমের হার।
গলে দিবে সাজাইবে শ্যাম নটবর ।।
ভক্তি ফুলে মনোসুতে হার গাঁথি নিল।
সেই মালা ত্রিভঙ্গের গলে তুলে দিল ।।
চূড়ায় ঠেকিয়া হার নাহি পড়ে গলে।
দিতে হার পুনর্বার চূড়ায় ঠেকিলে ।।
নকিম আরোপে তাঁত বুনা’য়েছে হাতে।
মুখে হরি বলে কৃষ্ণ দেখে আরোপেতে ।।
বাপের আরোপ দেখি নকীমের সুখ।
বলে হাত আরো কিছু উপরে উঠুক ।।
দেখহ জোলার এই প্রেমভক্তি গুণ।
কি করে তাহার কাছে সত্বঃ রজঃ গুণ ।।
দারুব্রহ্ম অবতার হ’ল যে সময়।
কুবেরের কীর্ত্তি রাখিলেন এ ধরায় ।।
কুবেরের তোড়ানী খাইবে যেই জন।
তার হবে দারুব্রহ্ম রূপ দরশন ।।
আর এক প্রস্তাব যে আসিল তাহাতে।
একদা নারদ মুনি গেল বৈকুন্ঠেতে ।।
বিষ্ণুর প্রসাদ মুনি খাইল তথায়।
কৈলাসেতে আসি মুনি হইল উদয় ।।
শিবেরে বলেন মুনি হরষিত মন।
অদ্য হৈনু শ্রীনাথের প্রসাদ ভাজন ।।
শিব বলে আমারে ত দিলেনা কিঞ্চিৎ।
প্রভুর প্রসাদে মোরে করিলে বঞ্চিত ।।
নারদের নখাগ্রে প্রসাদ কণা ছিল।
প্রেমভরে হরের বদনে তুলে দিল ।।
প্রেমে মত্ত হইলেন নারদ শঙ্কর।
বঞ্চিতা হইয়া গৌরী করে আঙ্গীকার ।।
আমি যদি সাধ্বী নারী হই তব ঘরে।
এ প্রসাদ বিলাইব বাজারে বাজারে ।।
তপস্যা করিল হরি বর দিতে এল।
প্রসাদ বাজারে বিকি বর চেয়ে নিল ।।
শ্লোক
কমলা রন্ধনাযুক্তা ভোজনে চ জনার্দ্দনঃ।
কুক্কুরেণ মুখাদ্ভ্রষ্টা দেবানাং দুর্ল্লভামপি ।।
কমলা রন্ধনাযুক্তা ভোজনে চ জনার্দ্দনঃ।
কুক্কুরেণ মুখাদ্ভ্রষ্টা দেবানাং দুর্ল্লভামপি ।।
পয়ার
বুদ্ধদেব বাসনা হইয়া গেল পূর্ণ।
ঘরে ঘরে নীচ শূদ্র সবে হ’ল ধন্য ।।
এই মত দেখ নানা কারণ বশতঃ।
গোলোক বিহারী হ’ল যশোমন্ত সূত ।।
অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী ছিলেন শয়নে।
কৃষ্ণদাস পুত্র কোলে আনন্দিত মনে ।।
রাম-কৃষ্ণ মুখে বলে কোলে কৃষ্ণদাস।
প্রভুর অগ্রজ যিনি ভুবনে প্রকাশ ।।
দ্বাপরেতে সংকর্ষণ যিনি বলরাম।
আপনি অনন্ত শক্তি সুন্দর সুঠাম ।।
সেই অংশে বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গ লীলায়।
শচী গর্ভে জনমিল এসে নদিয়ায় ।।
গৃহত্যাগী অনুরাগী সন্নাসী হইল।
পুত্র শোকে শচীমাতা কাঁদিয়া ফিরিল ।।
যদ্যপিও বিষ্ণু অংশে স্বয়ং অবতার।
কেহ না শোধিতে পারে মাতৃ ঋণ ধার ।।
যখন গৌরাঙ্গ গেল মাকে তেয়াগিয়া।
কড়ার দিলেন জন্ম লইব আসিয়া ।।
কিছু না বলিয়া বিশ্বরূপ উদাসীন।
তার জন্য শচীমাতা কাঁদে রাত্রি দিন ।।
সে কারণ মাতৃসেবা অপরাধ ছিল।
সেই ঋণ শোধিবারে জনম লভিল ।।
স্বয়ং এর অবতার হয় যেই কালে।
আর আর অবতার তাতে এসে মিলে ।।
যিনি ছিল বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গ লীলায়।
তিনি কৃষ্ণদাস যশোমন্ত পুত্র হয় ।।
একমাত্র পুত্র নববর্ষ কৃষ্ণদাস।
এক পুত্রে সুখী মাতা নাহি অন্য আশ ।।
এ হেন সময় প্রভুর মনে হ’ল আশ।
অন্নপূর্ণা গর্ভ সিন্ধু ইন্দু পরকাশ ।।
নানারূপ বিভীষিকা দেখে অন্নপূর্ণা।
ঠাকুরানী নিদ্রাযুক্তা নহে অচৈতন্যা ।।
জাগরিতা যেন কিছু নিদ্রার আবেশ।
দেখে যেন জয়ধ্বনি হয় সর্ব্বদেশ ।।
যশোমন্ত বলে প্রিয়া শুনহ বচন।
যে রূপ আমার মনে জাগে সর্ব্বক্ষণ ।।
নবীন মেঘের বর্ণ বনমালা গলে।
ভৃগুপদ চিহ্ন দেখা যায় বক্ষঃস্থলে ।।
পিতাম্বর ধর কোকনদ পদাম্বুজে।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শোভে চতুর্ভুজে ।।
এইরূপ আভা মম হৃদয় পশিয়া।
সে যে তব কোলে বৈসে দ্বিভুজ হইয়া ।।
ঠাকুরাণী বলে নাথ নিশার স্বপন।
নিশাকালে প্রকাশ না করে বুধজন ।।
কৃষ্ণময় চিত্ত তব কৃষ্ণ প্রতি আর্ত্তি।
শয়নে স্বপনে দেখ ঈশ্বর শ্রীমূর্ত্তি ।।
ঠাকুর বলেন প্রিয়া নহেত যামিনী।
উদয় হইল দীপ্তিকর দিনমণি ।।
ঠাকুরাণী বলে এত বাতুল লক্ষণ।।
কিংবা দানবের কার্য্য না বুঝি কারণ ।।
ঠাকুর বলেন যদি বাতুল লক্ষণ।
তবে কেন দেখিলাম মুরলী বদন ।।
ঠাকুরাণী বলে তবে জ্যোতির্ম্ময় রূপ।
সেরূপ দেখিয়া ভাব দিবার স্বরূপ ।।
শত সূর্য্যসম রশ্মি বায়ুতে মিশিল।
অন্নপূর্ণা গর্ভে আসি প্রবেশ করিল ।।
এ হেন প্রকারে মাতা হৈল গর্ভাবতী।
ঈশ্বর ইচ্ছায় হৈল বায়ুগর্ভে স্থিতি ।।
শুভ গ্রহ নক্ষত্র শুভ লগ্ন হইল।
মাহেন্দ্র সুযোগে পুত্র প্রসব করিল ।।
বার’শ আঠার সাল শ্রীমহাবারুণী।
কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশী তিথি সে ফাল্গুণী ।।
হরি সাল বলি সাল ভক্তগণে গণে।
নাহিক বৈদিক ক্রিয়া শ্রীবারুণী বিনে ।।
ধন্য অন্নপূর্ণা হেন পুত্র পেল কোলে।
দ্বাপরে যশোদা যিনি ছিলেন গোকুলে ।।
দ্বাপরে ছিলেন নন্দ যশোদার কান্ত।
যশোমতি কান্ত এবে হ’ল যশোমন্ত ।।
ধরা দ্রোণ দুইজন তস্য পূর্ব্বে ছিল।
নন্দ যশোমতি তেঁই দ্বাপরে হইল ।।
কলিকালে জগন্নাথ মিশ্র শচীরাণী।
এবে যশোমন্ত অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী ।।
ধন্য রামকান্ত সাধু ধন্য এ জগতে।
প্রভু আসি জনমিল যাহার বরেতে ।।
প্রভুর জনম খন্ড সুধা হ’তে সুধা।
কহিছে রসনা খেলে খন্ডে ভব ক্ষুধা ।।
বুদ্ধদেব বাসনা হইয়া গেল পূর্ণ।
ঘরে ঘরে নীচ শূদ্র সবে হ’ল ধন্য ।।
এই মত দেখ নানা কারণ বশতঃ।
গোলোক বিহারী হ’ল যশোমন্ত সূত ।।
অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী ছিলেন শয়নে।
কৃষ্ণদাস পুত্র কোলে আনন্দিত মনে ।।
রাম-কৃষ্ণ মুখে বলে কোলে কৃষ্ণদাস।
প্রভুর অগ্রজ যিনি ভুবনে প্রকাশ ।।
দ্বাপরেতে সংকর্ষণ যিনি বলরাম।
আপনি অনন্ত শক্তি সুন্দর সুঠাম ।।
সেই অংশে বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গ লীলায়।
শচী গর্ভে জনমিল এসে নদিয়ায় ।।
গৃহত্যাগী অনুরাগী সন্নাসী হইল।
পুত্র শোকে শচীমাতা কাঁদিয়া ফিরিল ।।
যদ্যপিও বিষ্ণু অংশে স্বয়ং অবতার।
কেহ না শোধিতে পারে মাতৃ ঋণ ধার ।।
যখন গৌরাঙ্গ গেল মাকে তেয়াগিয়া।
কড়ার দিলেন জন্ম লইব আসিয়া ।।
কিছু না বলিয়া বিশ্বরূপ উদাসীন।
তার জন্য শচীমাতা কাঁদে রাত্রি দিন ।।
সে কারণ মাতৃসেবা অপরাধ ছিল।
সেই ঋণ শোধিবারে জনম লভিল ।।
স্বয়ং এর অবতার হয় যেই কালে।
আর আর অবতার তাতে এসে মিলে ।।
যিনি ছিল বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গ লীলায়।
তিনি কৃষ্ণদাস যশোমন্ত পুত্র হয় ।।
একমাত্র পুত্র নববর্ষ কৃষ্ণদাস।
এক পুত্রে সুখী মাতা নাহি অন্য আশ ।।
এ হেন সময় প্রভুর মনে হ’ল আশ।
অন্নপূর্ণা গর্ভ সিন্ধু ইন্দু পরকাশ ।।
নানারূপ বিভীষিকা দেখে অন্নপূর্ণা।
ঠাকুরানী নিদ্রাযুক্তা নহে অচৈতন্যা ।।
জাগরিতা যেন কিছু নিদ্রার আবেশ।
দেখে যেন জয়ধ্বনি হয় সর্ব্বদেশ ।।
যশোমন্ত বলে প্রিয়া শুনহ বচন।
যে রূপ আমার মনে জাগে সর্ব্বক্ষণ ।।
নবীন মেঘের বর্ণ বনমালা গলে।
ভৃগুপদ চিহ্ন দেখা যায় বক্ষঃস্থলে ।।
পিতাম্বর ধর কোকনদ পদাম্বুজে।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শোভে চতুর্ভুজে ।।
এইরূপ আভা মম হৃদয় পশিয়া।
সে যে তব কোলে বৈসে দ্বিভুজ হইয়া ।।
ঠাকুরাণী বলে নাথ নিশার স্বপন।
নিশাকালে প্রকাশ না করে বুধজন ।।
কৃষ্ণময় চিত্ত তব কৃষ্ণ প্রতি আর্ত্তি।
শয়নে স্বপনে দেখ ঈশ্বর শ্রীমূর্ত্তি ।।
ঠাকুর বলেন প্রিয়া নহেত যামিনী।
উদয় হইল দীপ্তিকর দিনমণি ।।
ঠাকুরাণী বলে এত বাতুল লক্ষণ।।
কিংবা দানবের কার্য্য না বুঝি কারণ ।।
ঠাকুর বলেন যদি বাতুল লক্ষণ।
তবে কেন দেখিলাম মুরলী বদন ।।
ঠাকুরাণী বলে তবে জ্যোতির্ম্ময় রূপ।
সেরূপ দেখিয়া ভাব দিবার স্বরূপ ।।
শত সূর্য্যসম রশ্মি বায়ুতে মিশিল।
অন্নপূর্ণা গর্ভে আসি প্রবেশ করিল ।।
এ হেন প্রকারে মাতা হৈল গর্ভাবতী।
ঈশ্বর ইচ্ছায় হৈল বায়ুগর্ভে স্থিতি ।।
শুভ গ্রহ নক্ষত্র শুভ লগ্ন হইল।
মাহেন্দ্র সুযোগে পুত্র প্রসব করিল ।।
বার’শ আঠার সাল শ্রীমহাবারুণী।
কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশী তিথি সে ফাল্গুণী ।।
হরি সাল বলি সাল ভক্তগণে গণে।
নাহিক বৈদিক ক্রিয়া শ্রীবারুণী বিনে ।।
ধন্য অন্নপূর্ণা হেন পুত্র পেল কোলে।
দ্বাপরে যশোদা যিনি ছিলেন গোকুলে ।।
দ্বাপরে ছিলেন নন্দ যশোদার কান্ত।
যশোমতি কান্ত এবে হ’ল যশোমন্ত ।।
ধরা দ্রোণ দুইজন তস্য পূর্ব্বে ছিল।
নন্দ যশোমতি তেঁই দ্বাপরে হইল ।।
কলিকালে জগন্নাথ মিশ্র শচীরাণী।
এবে যশোমন্ত অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী ।।
ধন্য রামকান্ত সাধু ধন্য এ জগতে।
প্রভু আসি জনমিল যাহার বরেতে ।।
প্রভুর জনম খন্ড সুধা হ’তে সুধা।
কহিছে রসনা খেলে খন্ডে ভব ক্ষুধা ।।
রামকান্ত বৈরাগীর পূর্ব্বাপর প্রস্তাব-কথন
পয়ার
রামকান্ত মহাসাধু পরম উদার।
অন্নপূর্ণা মাতাকে দিলেন পুত্রবর ।।
সান্দিপনী দ্বাপরে, ত্রেতায় বিশ্বামিত্র।
কলিকালে গঙ্গাদাস পন্ডিত সুপাত্র ।।
ভারতী গোঁসাই শক্তি হইয়া মিশ্রিত।
মুকডোবা রামকান্ত হৈল উদ্ভাবিত ।।
তাহাতে মিশ্রিত হ’ল বাসুদেব শক্তি।
স্নেহ ভাবে বাসুদেবে করিতেন ভক্তি ।।
বাসুদেবে সমর্পিয়া আত্ম স্বার্থ-আত্মা।
ব্রজের মাধুর্য্য ভাবে করিত মমতা ।।
সাধুর সঙ্গেতে ছিল বাসুদেব মুর্ত্তি।
কভু সখ্যভাব কভু ব্রজভাবে আর্ত্তি ।।
ধুপ দীপ নৈবিদ্যাদি আতপ তন্ডুলে।
পূজিতেন রম্ভা দুর্ব্বা তুলসীর দলে ।।
নিবেদিয়া করিতেন ভোজন আরতি।
বাসুদেব খাইতেন দেখিত সুমতি ।।
মূলা থোড় মোচা কাচা রম্ভার ব্যঞ্জন।
আতপের অন্ন দিত না দিত লবণ ।।
ছোলা ডাল মুগ বুট গোধুম চাপড়ী।
তৈল হরিদ্রা বিনে ঘৃতপক্ক বড়ি ।।
ভোগ লাগাইয়া সাধু আরতি করিত।
বাসুদেব খেত তাহা চাক্ষুস দেখিত ।।
একদিন গ্রামবাসী বিপ্র একজন।
বাসুদেব ভোগ রাগ করিল দর্শন ।।
ক্রোধ করি বলে বিপ্র এ কোন বিচার।
শূদ্রের কি আছে অন্নভোগ অধিকার ।।
শূদ্র হ’য়ে বাসুদেবে অন্ন দিলি রাঁধি।
কোথায় শুনিলি বেটা এমত অবিধি ।।
হারে রে বৈরাগী তোর এত অকল্যাণ।
শূদ্র হ’য়ে হবি নাকি ব্রাহ্মণ সমান ।।
ব্রাহ্মণ কহিল গিয়া ব্রাহ্মণ সকলে।
শুনিয়া ব্রাহ্মণ সব ক্রোধে উঠে জ্বলে ।।
দশজন বিপ্র গেল বৈরাগীর বাড়ী।
ক্রোধভরে বাসুদেবে ল’য়ে এল কাড়ি ।।
বৈরাগী নির্মল চিত্তে দিলেন ছাড়িয়া।
বলিল রে প্রাণ বাসু সুখে থাক গিয়া ।।
কাঙ্গালের কাছে তুমি ছিলে অনাদরে।
আদরে খাইও এবে ষোড়শোপচারে ।।
ভাল হ’ল ব্রাহ্মণেরা লইল তোমারে।
সুখেতে থাকিবা এবে খট্টার উপরে ।।
দঃখিত দরিদ্র আমি কপর্দ্দক নাই।
বহু কষ্টে থোড় মোচা তোমারে খাওয়াই ।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত মধু পায়স পিষ্টক।
লুচি পুরি মন্ডা খেও যাহা লয় সখ ।।
চিরদিন রাখিয়াছ ব্রাহ্মণের মান।
যাও যাও বিপ্র ঘরে নাহি অপমান ।।
আমি অজ্ঞ নাহি জানি তোমারে পূজিতে।
এখন পূজিবে তোমা মন্ত্রের সহিতে ।।
যেখানে সেখানে থাক তাতে ক্ষতি নাই।
তুমি যেন সুখে থাক আমি তাই চাই ।।
ব্রাহ্মণেরা বাসুদেবে ল’য়ে হরষেতে।
বাসুদেবে অভিষেক করে তন্ত্রমতে ।।
কেহ বলে রাখ দেবে প্রতিষ্ঠা করিয়ে।
জাতিনেশে নমঃশূদ্রের পক্ক-অন্ন খেয়ে ।।
প্রতিষ্ঠা করিয়ে পঞ্চ গব্য দ্বারা স্নান।
অভিষিক্ত করিয়া মণ্ডপে দিল স্থান ।।
খাট্টার উপরে রজতের পদ্মাসন।
তাহার উপরে দেবে করিলা স্থাপন ।।
শ্বেতপদ্ম রক্তপদ্ম শতদল পদ্ম।
নীলপদ্ম স্থলপদ্ম কোকনদ পদ্ম ।।
গোলাপ টগর আর পুষ্প জাতি জুতি।
গন্ধার অপরাজিতা মল্লিকা মালতী ।।
গন্ধরাজ শেফালিকা ধবল করবী।
কৃষ্ণকেলী কৃষ্ণচূড়া কামিনী মাধবী ।।
দূর্ব্বা তুলসীর পত্র অগুরু চন্দন।
শ্রীঅঙ্গে লেপন আর শ্রীপদ সেবন ।।
মন্ত্রপুত করি পরে তন্ত্র অনুসারে।
ভোগাদি নৈবেদ্য দেন নানা উপহারে ।।
আতপ তন্ডুল ভোগ দেয় যে কখন।
যেখানে যে মিষ্ট ফল পায় যে ব্রাহ্মণ ।।
আনিয়া লাগায় ভোগ বাসুদেব ঠাঁই।
রন্ধন শালান্য ভোগ সুপক্ক মিঠাঁই ।।
সব দ্বিজ বাসুদেবের ভক্ত হইল।
পূজারি ব্রাহ্মণ এক নিযুক্ত করিল ।।
সন্ধ্যাকালে ঘৃত দ্বীপ পঞ্চ বাতি জ্বালি।
আরতি করেন সব ব্রাহ্মণমণ্ডলী ।।
শঙ্খ ঘন্টা কংস করতাল ঝাঁজ খোল।
রাম শিঙ্গে ভেরী তুরী মধুর মাদল ।।
এই রূপে বাসুদেব ব্রাহ্মণের পূজ্য।
আর এক লীলাগুণ বড়ই আশ্চর্য্য ।।
এই বাসুদেব জন্ম সফলানগরী।
তারক রসনা ভরি বল হরি হরি ।।
পয়ার
রামকান্ত মহাসাধু পরম উদার।
অন্নপূর্ণা মাতাকে দিলেন পুত্রবর ।।
সান্দিপনী দ্বাপরে, ত্রেতায় বিশ্বামিত্র।
কলিকালে গঙ্গাদাস পন্ডিত সুপাত্র ।।
ভারতী গোঁসাই শক্তি হইয়া মিশ্রিত।
মুকডোবা রামকান্ত হৈল উদ্ভাবিত ।।
তাহাতে মিশ্রিত হ’ল বাসুদেব শক্তি।
স্নেহ ভাবে বাসুদেবে করিতেন ভক্তি ।।
বাসুদেবে সমর্পিয়া আত্ম স্বার্থ-আত্মা।
ব্রজের মাধুর্য্য ভাবে করিত মমতা ।।
সাধুর সঙ্গেতে ছিল বাসুদেব মুর্ত্তি।
কভু সখ্যভাব কভু ব্রজভাবে আর্ত্তি ।।
ধুপ দীপ নৈবিদ্যাদি আতপ তন্ডুলে।
পূজিতেন রম্ভা দুর্ব্বা তুলসীর দলে ।।
নিবেদিয়া করিতেন ভোজন আরতি।
বাসুদেব খাইতেন দেখিত সুমতি ।।
মূলা থোড় মোচা কাচা রম্ভার ব্যঞ্জন।
আতপের অন্ন দিত না দিত লবণ ।।
ছোলা ডাল মুগ বুট গোধুম চাপড়ী।
তৈল হরিদ্রা বিনে ঘৃতপক্ক বড়ি ।।
ভোগ লাগাইয়া সাধু আরতি করিত।
বাসুদেব খেত তাহা চাক্ষুস দেখিত ।।
একদিন গ্রামবাসী বিপ্র একজন।
বাসুদেব ভোগ রাগ করিল দর্শন ।।
ক্রোধ করি বলে বিপ্র এ কোন বিচার।
শূদ্রের কি আছে অন্নভোগ অধিকার ।।
শূদ্র হ’য়ে বাসুদেবে অন্ন দিলি রাঁধি।
কোথায় শুনিলি বেটা এমত অবিধি ।।
হারে রে বৈরাগী তোর এত অকল্যাণ।
শূদ্র হ’য়ে হবি নাকি ব্রাহ্মণ সমান ।।
ব্রাহ্মণ কহিল গিয়া ব্রাহ্মণ সকলে।
শুনিয়া ব্রাহ্মণ সব ক্রোধে উঠে জ্বলে ।।
দশজন বিপ্র গেল বৈরাগীর বাড়ী।
ক্রোধভরে বাসুদেবে ল’য়ে এল কাড়ি ।।
বৈরাগী নির্মল চিত্তে দিলেন ছাড়িয়া।
বলিল রে প্রাণ বাসু সুখে থাক গিয়া ।।
কাঙ্গালের কাছে তুমি ছিলে অনাদরে।
আদরে খাইও এবে ষোড়শোপচারে ।।
ভাল হ’ল ব্রাহ্মণেরা লইল তোমারে।
সুখেতে থাকিবা এবে খট্টার উপরে ।।
দঃখিত দরিদ্র আমি কপর্দ্দক নাই।
বহু কষ্টে থোড় মোচা তোমারে খাওয়াই ।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত মধু পায়স পিষ্টক।
লুচি পুরি মন্ডা খেও যাহা লয় সখ ।।
চিরদিন রাখিয়াছ ব্রাহ্মণের মান।
যাও যাও বিপ্র ঘরে নাহি অপমান ।।
আমি অজ্ঞ নাহি জানি তোমারে পূজিতে।
এখন পূজিবে তোমা মন্ত্রের সহিতে ।।
যেখানে সেখানে থাক তাতে ক্ষতি নাই।
তুমি যেন সুখে থাক আমি তাই চাই ।।
ব্রাহ্মণেরা বাসুদেবে ল’য়ে হরষেতে।
বাসুদেবে অভিষেক করে তন্ত্রমতে ।।
কেহ বলে রাখ দেবে প্রতিষ্ঠা করিয়ে।
জাতিনেশে নমঃশূদ্রের পক্ক-অন্ন খেয়ে ।।
প্রতিষ্ঠা করিয়ে পঞ্চ গব্য দ্বারা স্নান।
অভিষিক্ত করিয়া মণ্ডপে দিল স্থান ।।
খাট্টার উপরে রজতের পদ্মাসন।
তাহার উপরে দেবে করিলা স্থাপন ।।
শ্বেতপদ্ম রক্তপদ্ম শতদল পদ্ম।
নীলপদ্ম স্থলপদ্ম কোকনদ পদ্ম ।।
গোলাপ টগর আর পুষ্প জাতি জুতি।
গন্ধার অপরাজিতা মল্লিকা মালতী ।।
গন্ধরাজ শেফালিকা ধবল করবী।
কৃষ্ণকেলী কৃষ্ণচূড়া কামিনী মাধবী ।।
দূর্ব্বা তুলসীর পত্র অগুরু চন্দন।
শ্রীঅঙ্গে লেপন আর শ্রীপদ সেবন ।।
মন্ত্রপুত করি পরে তন্ত্র অনুসারে।
ভোগাদি নৈবেদ্য দেন নানা উপহারে ।।
আতপ তন্ডুল ভোগ দেয় যে কখন।
যেখানে যে মিষ্ট ফল পায় যে ব্রাহ্মণ ।।
আনিয়া লাগায় ভোগ বাসুদেব ঠাঁই।
রন্ধন শালান্য ভোগ সুপক্ক মিঠাঁই ।।
সব দ্বিজ বাসুদেবের ভক্ত হইল।
পূজারি ব্রাহ্মণ এক নিযুক্ত করিল ।।
সন্ধ্যাকালে ঘৃত দ্বীপ পঞ্চ বাতি জ্বালি।
আরতি করেন সব ব্রাহ্মণমণ্ডলী ।।
শঙ্খ ঘন্টা কংস করতাল ঝাঁজ খোল।
রাম শিঙ্গে ভেরী তুরী মধুর মাদল ।।
এই রূপে বাসুদেব ব্রাহ্মণের পূজ্য।
আর এক লীলাগুণ বড়ই আশ্চর্য্য ।।
এই বাসুদেব জন্ম সফলানগরী।
তারক রসনা ভরি বল হরি হরি ।।
রাম কান্তের বাসুদেব দর্শন
দীর্ঘ -ত্রিপদী।
ভিক্ষা করে রামকান্ত, মনেতে চিন্তা একান্ত,
মম বাসুদেব আছে সুখে।
পূজা করে দ্বিজগণে, অনেক দিন দেখিনে,
আমার বাসুরে আসি দেখে ।।
ইহা ভাবি মনে মনে, দ্বিজগণ অদর্শনে,
মণ্ডপের পিছে গিয়া রয়।
আমি নাহি দিব দেখা, গোপনে রহিব একা,
দেখি বাসু কিভাবে কি খায় ।।
দক্ষিণাভিমুখ হ’য়ে, বাসুদেব দণ্ডাইয়ে,
সর্ব্বদাই মন্ডপেতে রয়।
পূজক ব্রাহ্মণ গিয়া, মন্ডপ দ্বার খুলিয়া,
উত্তরাভিমুখ দেখতে পায় ।।
পূজক ব্রাহ্মণ কয়, কে এসে ঠাকুরালয়,
ঠাকুর ফিরায়ে রেখে গেল।
কপাট নাহি খুলিল, মন্ডপেতে কে আসিল,
বাসুদেব কেন হেন হ’ল ।।
কেহ বলে দ্বার রুদ্ধ, কার হেন আছে সাধ্য,
ঘরে এসে ফিরায় দেবলা।
তবে যে ফিরিল কেনে, দেবমায়া কেবা জানে,
কি জানি কি ঠাকুরের লীলা ।।
ঠাকুরের ভোগ দিতে, ভোগ রাগ সমাধিতে,
দিবা দুই প্রহর সময়।
রন্ধন করি শাল্যান্ন, ঘৃত মিশ্রিত ব্যাঞ্জন,
ডাল্না শাক শুক্ত লাবেড়ায় ।।
দক্ষিণ মুখ করিয়ে, ঠাকুরে ফিরায়ে ল’য়ে,
পুরোহিত বসিল পূজায়।
তাম্র রজতের পাতে, কতই মিষ্টান্ন তাতে,
লিখিতে পুস্তক বেড়ে যায় ।।
নয়ন মুদ্রিত করে, ভোগ নিবেদিল পরে,
ভোগ রহে বাসুদেব পিছে।
যবে নয়ন মেলিল, পূজক দেখিতে পেল,
বাসুদেব ফিরিয়া রয়েছে ।।
বক্ষদেশে হস্ত দিয়া, বাসুদেবকে ধরিয়া,
দক্ষিণ মুখ করিতে চায়।
বাসুদেব নাহি ঘুরে, বিপ্র ডাকে উচ্চৈঃস্বরে,
কে তোরা দেখিবি আয় আয় ।।
বাসুদেব ফিরে গেল, উত্তর মুখ রহিল,
ফিরাইলে আর নাহি ফিরে।
হইনু আশ্চর্য্যান্বিত, অকস্মাৎ বিপরীত,
না জানি কি অমঙ্গল করে ।।
সে বানী শুনি তরাসে, চারি পাঁচ বিপ্র এসে,
কেহ যায় মন্ডপের পিছে।
এক বিপ্র তরাসেতে, দেখে গিয়া স্বচক্ষেতে,
রামকান্ত গোপনেতে আছে ।।
বিপ্র বলে দফা সারা, কার বাসুদেব তোরা,
জোর করে এনেছিস সবে।
যার ভক্তি তার হরি, মোরা যে গৌরব করি,
সে কেবল ব্রাহ্মণ গৌরবে ।।
যার বাসুদেব এই, উদয় হইল সেই,
সাধু পানে কেন নাহি চাও।
মূলমর্ম নাহি জান, দেবলা ধরিয়া টান,
জোর করে দেবতা ঘুরাও ।।
একবিপ্র ক্রোধ ভরে, রামকান্তে নিল ধরে,
মন্ডপের সম্মুখেতে রাখি।
বিপ্র বলে যদি আ’লি, সম্মুখে কেন না ছিলি,
পিছে থেকে করেছ বুজরুকি ।।
যদি নিজ ভালো চাও, শীঘ্র করে উঠে যাও,
শুনি রামকান্ত চলে গেল।
ভোগ রাগ লাগিবে কি, বৈরাগীর ভোজ ভেল্কি,
বাসুদেব উদ্ভাব হইল ।।
কান্তলীলা চমৎকার, যেন অমৃতের ধার,
কর্ণভরি পিও সাধুজন।
ওঢ়াকাঁদি অবতীর্ণ, নমঃশূদ্র কূল ধন্য,
রসনা, রসনা কি কারণ ।।
দীর্ঘ -ত্রিপদী।
ভিক্ষা করে রামকান্ত, মনেতে চিন্তা একান্ত,
মম বাসুদেব আছে সুখে।
পূজা করে দ্বিজগণে, অনেক দিন দেখিনে,
আমার বাসুরে আসি দেখে ।।
ইহা ভাবি মনে মনে, দ্বিজগণ অদর্শনে,
মণ্ডপের পিছে গিয়া রয়।
আমি নাহি দিব দেখা, গোপনে রহিব একা,
দেখি বাসু কিভাবে কি খায় ।।
দক্ষিণাভিমুখ হ’য়ে, বাসুদেব দণ্ডাইয়ে,
সর্ব্বদাই মন্ডপেতে রয়।
পূজক ব্রাহ্মণ গিয়া, মন্ডপ দ্বার খুলিয়া,
উত্তরাভিমুখ দেখতে পায় ।।
পূজক ব্রাহ্মণ কয়, কে এসে ঠাকুরালয়,
ঠাকুর ফিরায়ে রেখে গেল।
কপাট নাহি খুলিল, মন্ডপেতে কে আসিল,
বাসুদেব কেন হেন হ’ল ।।
কেহ বলে দ্বার রুদ্ধ, কার হেন আছে সাধ্য,
ঘরে এসে ফিরায় দেবলা।
তবে যে ফিরিল কেনে, দেবমায়া কেবা জানে,
কি জানি কি ঠাকুরের লীলা ।।
ঠাকুরের ভোগ দিতে, ভোগ রাগ সমাধিতে,
দিবা দুই প্রহর সময়।
রন্ধন করি শাল্যান্ন, ঘৃত মিশ্রিত ব্যাঞ্জন,
ডাল্না শাক শুক্ত লাবেড়ায় ।।
দক্ষিণ মুখ করিয়ে, ঠাকুরে ফিরায়ে ল’য়ে,
পুরোহিত বসিল পূজায়।
তাম্র রজতের পাতে, কতই মিষ্টান্ন তাতে,
লিখিতে পুস্তক বেড়ে যায় ।।
নয়ন মুদ্রিত করে, ভোগ নিবেদিল পরে,
ভোগ রহে বাসুদেব পিছে।
যবে নয়ন মেলিল, পূজক দেখিতে পেল,
বাসুদেব ফিরিয়া রয়েছে ।।
বক্ষদেশে হস্ত দিয়া, বাসুদেবকে ধরিয়া,
দক্ষিণ মুখ করিতে চায়।
বাসুদেব নাহি ঘুরে, বিপ্র ডাকে উচ্চৈঃস্বরে,
কে তোরা দেখিবি আয় আয় ।।
বাসুদেব ফিরে গেল, উত্তর মুখ রহিল,
ফিরাইলে আর নাহি ফিরে।
হইনু আশ্চর্য্যান্বিত, অকস্মাৎ বিপরীত,
না জানি কি অমঙ্গল করে ।।
সে বানী শুনি তরাসে, চারি পাঁচ বিপ্র এসে,
কেহ যায় মন্ডপের পিছে।
এক বিপ্র তরাসেতে, দেখে গিয়া স্বচক্ষেতে,
রামকান্ত গোপনেতে আছে ।।
বিপ্র বলে দফা সারা, কার বাসুদেব তোরা,
জোর করে এনেছিস সবে।
যার ভক্তি তার হরি, মোরা যে গৌরব করি,
সে কেবল ব্রাহ্মণ গৌরবে ।।
যার বাসুদেব এই, উদয় হইল সেই,
সাধু পানে কেন নাহি চাও।
মূলমর্ম নাহি জান, দেবলা ধরিয়া টান,
জোর করে দেবতা ঘুরাও ।।
একবিপ্র ক্রোধ ভরে, রামকান্তে নিল ধরে,
মন্ডপের সম্মুখেতে রাখি।
বিপ্র বলে যদি আ’লি, সম্মুখে কেন না ছিলি,
পিছে থেকে করেছ বুজরুকি ।।
যদি নিজ ভালো চাও, শীঘ্র করে উঠে যাও,
শুনি রামকান্ত চলে গেল।
ভোগ রাগ লাগিবে কি, বৈরাগীর ভোজ ভেল্কি,
বাসুদেব উদ্ভাব হইল ।।
কান্তলীলা চমৎকার, যেন অমৃতের ধার,
কর্ণভরি পিও সাধুজন।
ওঢ়াকাঁদি অবতীর্ণ, নমঃশূদ্র কূল ধন্য,
রসনা, রসনা কি কারণ ।।
শ্রীশ্রীবাসুদেবজীর স্নান যাত্রা
দীর্ঘ ত্রিপদী
জগন্নাথ স্নানযাত্রা, ব্রাহ্মণেরা একত্রতা
হ’ল সবে স্নানের কারণ।
গিয়া পুকুরের ঘাটে, বাসুদেবে রেখে তটে,
করে জলকেলী সংকীর্ত্তন ।।
ঝাঁজ শঙ্খ ঘন্টাধ্বনী, কুলবতীর হুলুধ্বনী,
সুগন্ধি কুসুম ফেলাফেলি।
বাসুদেবে ল’য়ে কোলে, নামি পুষ্করিণী জলে,
সব মিলি করে জলকেলি ।।
বাসুদেব ছিল কোলে, কোল হ’তে নামি জলে,
ছল করি লুকাইয়া রয়।
সে বিপ্র জলে নামিয়া, বাসুদেবে হারাইয়া,
আর নাহি অন্বেষিয়া পায় ।।
বিপ্র বলে কিবা হ’ল, বাসুদেব কোথা গেল,
ডুব দিল না পাই খুজিয়া।
সব দ্বিজ তাহা শুনি, জলে ডুবয়ে অমনি,
খুঁজিতেছে ডুবিয়া ডুবিয়া ।।
যত ছিল প্রেমানন্দ, সব হ’ল নিরানন্দ,
জলে হারাইয়া বাসুদেবে।
কেহ বলে হায় হায়, কোথা বাসুদেব রায়,
কেহ কাঁদে হাহাকার রবে ।।
কূলে তার বক্ষঃদেশ, মধ্যে তার গলদেশ,
পুকুরের বারি পরিমাণ।
পুকুরের অল্পজলে, বাসুদেব লুকাইলে,
কি হ’ল কোথায় অন্তর্ধান ।।
গ্রামের ব্রাহ্মণ মাত্র, সকলে হয়ে একত্র,
বাসুদেবে অন্বেষণ করে।
হয়ে এল সন্ধ্যাকাল, ডুবাইয়া চক্ষু লাল,
হাহাকার করে উচ্চৈঃস্বরে ।।
কেহ বলে অমঙ্গল, কেহ বলে হরিবোল,
কেহ বলে রামকান্তে কও।
তার বাসুদেব এনে, জোর করে রাখ কেনে,
সে কারণ অপরাধী হও ।।
যে দিনে ফিরিয়া ছিল, হইত না অমঙ্গল,
তার বাসুদেব তারে দিলে।
মোদের থাকিলে ভক্তি, কেন বাসুদেব মূর্ত্তি,
ছল করি ডুব মারে জলে ।।
দ্বিজগণ সকাতর, জাগরণে নিশিভোর,
রামকান্তে সংবাদ জানায়।
স্বান করাবার তরে, বাসুদেবে লয়ে নীরে,
হারা’লেম বাসুদেব রায় ।।
রামকান্ত ধীরে ধীরে, গিয়া পুকুরের তীরে,
অতঃপর জলে নামিলেন।
জলমধ্যে দণ্ডাইয়া, বাসুদেবের লাগিয়া,
পদ দিয়া তল্লাস করেন ।।
ব্রাহ্মণেরা বলে রাগী, দুরাচার রে বৈরাগী,
পা দিয়া তালাসে বাসুদেবে।
মুনি ঋষি করে ধ্যান, ব্রহ্মা করে ব্রহ্মজ্ঞান,
কমলা যাহার পদ সেবে ।।
বাসুদেব কক্ষমধ্যে, রামকান্ত বামপদে,
ঠেলে ফেলে পুকুরের পার।
হাতে ধরি লয়ে কোলে, বাসুদেবে ডেকে বলে,
হারে বাসু কি মন তোমার ।।
ব্রাহ্মণের বাড়ী রহিবা, কিম্বা মম সঙ্গে যা’বা,
হাস্য মুখে কহত’ আমায়।
বাসুদেব হাস্য করে, দ্বিজগণ সবে হেরে,
হাসি লুকায় বিদ্যুতের ন্যায় ।।
রামকান্ত কুতুহলে, দ্বিজগণে ডেকে বলে,
বাসুদেব আমার দেবলা।
না রহিবে দ্বিজালয়, মোর সঙ্গে যেতে চায়,
আমার যে হ’তে চায় চেলা ।।
ব্রাহ্মণেরা ছিল রুষি, দেবলা মুখেতে হাসি,
দেখে আর নাহি সরে বাক।
বলে ওরে রামকান্ত, তোর ভকতি একান্ত,
তোর বাসু তুই নিয়া রাখ ।।
বাসুদেব রামকান্ত, মহিমার নাহি অন্ত,
লীলামৃত মাধুর্য্যের সার।
পাগলচন্দ্র আদেশে, হরিচাঁদ কৃপাবেশে,
কহে কবি রায়-সরকার ।।
দীর্ঘ ত্রিপদী
জগন্নাথ স্নানযাত্রা, ব্রাহ্মণেরা একত্রতা
হ’ল সবে স্নানের কারণ।
গিয়া পুকুরের ঘাটে, বাসুদেবে রেখে তটে,
করে জলকেলী সংকীর্ত্তন ।।
ঝাঁজ শঙ্খ ঘন্টাধ্বনী, কুলবতীর হুলুধ্বনী,
সুগন্ধি কুসুম ফেলাফেলি।
বাসুদেবে ল’য়ে কোলে, নামি পুষ্করিণী জলে,
সব মিলি করে জলকেলি ।।
বাসুদেব ছিল কোলে, কোল হ’তে নামি জলে,
ছল করি লুকাইয়া রয়।
সে বিপ্র জলে নামিয়া, বাসুদেবে হারাইয়া,
আর নাহি অন্বেষিয়া পায় ।।
বিপ্র বলে কিবা হ’ল, বাসুদেব কোথা গেল,
ডুব দিল না পাই খুজিয়া।
সব দ্বিজ তাহা শুনি, জলে ডুবয়ে অমনি,
খুঁজিতেছে ডুবিয়া ডুবিয়া ।।
যত ছিল প্রেমানন্দ, সব হ’ল নিরানন্দ,
জলে হারাইয়া বাসুদেবে।
কেহ বলে হায় হায়, কোথা বাসুদেব রায়,
কেহ কাঁদে হাহাকার রবে ।।
কূলে তার বক্ষঃদেশ, মধ্যে তার গলদেশ,
পুকুরের বারি পরিমাণ।
পুকুরের অল্পজলে, বাসুদেব লুকাইলে,
কি হ’ল কোথায় অন্তর্ধান ।।
গ্রামের ব্রাহ্মণ মাত্র, সকলে হয়ে একত্র,
বাসুদেবে অন্বেষণ করে।
হয়ে এল সন্ধ্যাকাল, ডুবাইয়া চক্ষু লাল,
হাহাকার করে উচ্চৈঃস্বরে ।।
কেহ বলে অমঙ্গল, কেহ বলে হরিবোল,
কেহ বলে রামকান্তে কও।
তার বাসুদেব এনে, জোর করে রাখ কেনে,
সে কারণ অপরাধী হও ।।
যে দিনে ফিরিয়া ছিল, হইত না অমঙ্গল,
তার বাসুদেব তারে দিলে।
মোদের থাকিলে ভক্তি, কেন বাসুদেব মূর্ত্তি,
ছল করি ডুব মারে জলে ।।
দ্বিজগণ সকাতর, জাগরণে নিশিভোর,
রামকান্তে সংবাদ জানায়।
স্বান করাবার তরে, বাসুদেবে লয়ে নীরে,
হারা’লেম বাসুদেব রায় ।।
রামকান্ত ধীরে ধীরে, গিয়া পুকুরের তীরে,
অতঃপর জলে নামিলেন।
জলমধ্যে দণ্ডাইয়া, বাসুদেবের লাগিয়া,
পদ দিয়া তল্লাস করেন ।।
ব্রাহ্মণেরা বলে রাগী, দুরাচার রে বৈরাগী,
পা দিয়া তালাসে বাসুদেবে।
মুনি ঋষি করে ধ্যান, ব্রহ্মা করে ব্রহ্মজ্ঞান,
কমলা যাহার পদ সেবে ।।
বাসুদেব কক্ষমধ্যে, রামকান্ত বামপদে,
ঠেলে ফেলে পুকুরের পার।
হাতে ধরি লয়ে কোলে, বাসুদেবে ডেকে বলে,
হারে বাসু কি মন তোমার ।।
ব্রাহ্মণের বাড়ী রহিবা, কিম্বা মম সঙ্গে যা’বা,
হাস্য মুখে কহত’ আমায়।
বাসুদেব হাস্য করে, দ্বিজগণ সবে হেরে,
হাসি লুকায় বিদ্যুতের ন্যায় ।।
রামকান্ত কুতুহলে, দ্বিজগণে ডেকে বলে,
বাসুদেব আমার দেবলা।
না রহিবে দ্বিজালয়, মোর সঙ্গে যেতে চায়,
আমার যে হ’তে চায় চেলা ।।
ব্রাহ্মণেরা ছিল রুষি, দেবলা মুখেতে হাসি,
দেখে আর নাহি সরে বাক।
বলে ওরে রামকান্ত, তোর ভকতি একান্ত,
তোর বাসু তুই নিয়া রাখ ।।
বাসুদেব রামকান্ত, মহিমার নাহি অন্ত,
লীলামৃত মাধুর্য্যের সার।
পাগলচন্দ্র আদেশে, হরিচাঁদ কৃপাবেশে,
কহে কবি রায়-সরকার ।।
বাসুদেব ও রামকান্ত বৈরাগীর চরিত্র কথন, নৌকাগঠন ও রথযাত্রা
পয়ার
বাসুদেবে নিতে আ’সে বহু শিষ্যগণ।
কান্ত বলে না শুনিয়া বলি কি বচন ।।
ইচ্ছাময় বাসু যদি যান ইচ্ছা করি।
বাসুর হইয়া বাসো * যাইবারে পারি ।।
এতবলি বাসুর নিকটে কান্ত গিয়া।
শিষ্যগণ নিকটেতে বলিত আসিয়া ।।
কাহারে বলিত বাসু যাওয়া হ’বে না।
আমার পরাণ বাসু কিছু কহিল না ।।
কেহ কেহ আসামাত্র অমনি যাইত।
কেহ কেহ এলে তারে যাইব কহিত ।।
বাসুদেবে কোলে করি শিষ্যবাড়ী যেত।
গুণ-গুণ বাসু গুণ সদায় গাইত ।।
বাসুদেব ইচ্ছা করে তরণীতে যেতে।
কান্তের হইল মন তরণী গঠিতে ।।
চারিজন শিষ্য দিল নিযুক্ত করিয়া।
বাওয়ালীরা যেতে ছিল বাওয়াল লইয়া ।।
চকে গিয়া দিত বাসুদেবের দোহাই।
নির্বিঘ্নে বাওয়াল করি এসেছে সবাই ।।
বাসুদেব নৌকা গঠিবেন জানাইল।
বাওয়ালীরা বড় এক গাছ দিয়া গেল ।।
সেই গ্রামে ভক্ত এক কর্মকার ছিল।
লাগিল পাতাম প্রেক যত তাহা দিল ।।
তরণী গঠিত হইল জয় জয় ধ্বনি।
নাম হ’ল বাসুদেবের পান্সী তরণী ।।
নৌকায় চড়িয়া মাত্র যায় দু’ গোঁসাই।
বাসুদেব রামকান্ত আর কেহ নাই ।।
ছাপ্পর বাঁধিয়া মধ্যে থাকেন বসিয়া।
রামকান্ত বাসুদেব একত্র হইয়া ।।
পাল তুলে দিত মাত্র দাঁড়ি মাঝি নাই।
তরণী চলিত বেগে দেখিত সবাই ।।
বাতাস উজান হ’লে বাঁক ঘুরে গেলে।
রামকান্ত দাঁড় বাহে বাসুদেব হা’লে ।।
কতক্ষণ দাঁড় বেয়ে বলে ওরে বাসো।
এ সময় আগা নায় একবার এস ।।
এতবলি রামকান্ত পাছানায় গিয়া।
হাল ধরে মনো সুখে থাকিত বসিয়া ।।
আগানায় বাসুদেব দাঁড়াইয়া আছে।
দাঁড় পড়িতেছে নৌকা বেগে চলিতেছে ।।
মাধুর্য্য প্রাচুর্য্য লীলা দেখিত সবায়।
কেহ কেহ দেখে বাসুদেব দাঁড় বায় ।।
রামকান্ত ধেয়ে গিয়ে বলে ওরে বাসো।
পরিশ্রম হ’য়েছে ছায়ায় এসে বস ।।
বাসুকে করিয়া কোলে বলে মনোদুঃখে।
ঘামিয়াছে চাঁদমুখ হাসি নাই মুখে ।।
ওরে বাসো! তুমি দাঁড় বাহিওনা আর।
আমার বক্ষের নিধি বক্ষে রও আমার ।।
এত বলি বাসুদেবে বসাইয়া বুকে।
ঘুম পড় বলিয়া চুম্বিত চাঁদমুখে ।।
শিষ্যদের ঘাটে গিয়া ঘোনাইত নাও।
বলিত উঠরে বাসো শিষ্যবাড়ী যাও ।।
কান্তলীলা মধুর শুনিতে চমৎকার।
ভনে শ্রীতারক, খেলে জন্ম নাহি আর ।।
পয়ার
বাসুদেবে নিতে আ’সে বহু শিষ্যগণ।
কান্ত বলে না শুনিয়া বলি কি বচন ।।
ইচ্ছাময় বাসু যদি যান ইচ্ছা করি।
বাসুর হইয়া বাসো * যাইবারে পারি ।।
এতবলি বাসুর নিকটে কান্ত গিয়া।
শিষ্যগণ নিকটেতে বলিত আসিয়া ।।
কাহারে বলিত বাসু যাওয়া হ’বে না।
আমার পরাণ বাসু কিছু কহিল না ।।
কেহ কেহ আসামাত্র অমনি যাইত।
কেহ কেহ এলে তারে যাইব কহিত ।।
বাসুদেবে কোলে করি শিষ্যবাড়ী যেত।
গুণ-গুণ বাসু গুণ সদায় গাইত ।।
বাসুদেব ইচ্ছা করে তরণীতে যেতে।
কান্তের হইল মন তরণী গঠিতে ।।
চারিজন শিষ্য দিল নিযুক্ত করিয়া।
বাওয়ালীরা যেতে ছিল বাওয়াল লইয়া ।।
চকে গিয়া দিত বাসুদেবের দোহাই।
নির্বিঘ্নে বাওয়াল করি এসেছে সবাই ।।
বাসুদেব নৌকা গঠিবেন জানাইল।
বাওয়ালীরা বড় এক গাছ দিয়া গেল ।।
সেই গ্রামে ভক্ত এক কর্মকার ছিল।
লাগিল পাতাম প্রেক যত তাহা দিল ।।
তরণী গঠিত হইল জয় জয় ধ্বনি।
নাম হ’ল বাসুদেবের পান্সী তরণী ।।
নৌকায় চড়িয়া মাত্র যায় দু’ গোঁসাই।
বাসুদেব রামকান্ত আর কেহ নাই ।।
ছাপ্পর বাঁধিয়া মধ্যে থাকেন বসিয়া।
রামকান্ত বাসুদেব একত্র হইয়া ।।
পাল তুলে দিত মাত্র দাঁড়ি মাঝি নাই।
তরণী চলিত বেগে দেখিত সবাই ।।
বাতাস উজান হ’লে বাঁক ঘুরে গেলে।
রামকান্ত দাঁড় বাহে বাসুদেব হা’লে ।।
কতক্ষণ দাঁড় বেয়ে বলে ওরে বাসো।
এ সময় আগা নায় একবার এস ।।
এতবলি রামকান্ত পাছানায় গিয়া।
হাল ধরে মনো সুখে থাকিত বসিয়া ।।
আগানায় বাসুদেব দাঁড়াইয়া আছে।
দাঁড় পড়িতেছে নৌকা বেগে চলিতেছে ।।
মাধুর্য্য প্রাচুর্য্য লীলা দেখিত সবায়।
কেহ কেহ দেখে বাসুদেব দাঁড় বায় ।।
রামকান্ত ধেয়ে গিয়ে বলে ওরে বাসো।
পরিশ্রম হ’য়েছে ছায়ায় এসে বস ।।
বাসুকে করিয়া কোলে বলে মনোদুঃখে।
ঘামিয়াছে চাঁদমুখ হাসি নাই মুখে ।।
ওরে বাসো! তুমি দাঁড় বাহিওনা আর।
আমার বক্ষের নিধি বক্ষে রও আমার ।।
এত বলি বাসুদেবে বসাইয়া বুকে।
ঘুম পড় বলিয়া চুম্বিত চাঁদমুখে ।।
শিষ্যদের ঘাটে গিয়া ঘোনাইত নাও।
বলিত উঠরে বাসো শিষ্যবাড়ী যাও ।।
কান্তলীলা মধুর শুনিতে চমৎকার।
ভনে শ্রীতারক, খেলে জন্ম নাহি আর ।।
রামকান্তের বাসুদেব ও রথযাত্রা
পয়ার
রামকান্ত বাসুদেব গলাগলি ধরে।
শয়ন করিত সুখে শয্যার উপরে ।।
এইভাবে প্রবীণ হইল রামকান্ত।
বর্ণনে অতীত লীলা নাহি তার অন্ত ।।
এদিকে ব্রাক্ষণগণ রথযাত্রা করে।
কান্তের হইল মন রথ করিবারে ।।
বাঁশ দিয়া রামকান্ত রথ বানাইল।
বাঁশো রথে বাসুদেব উঠিতে ইচ্ছিল ।।
অধিবাস দিনে সব লোক আসে যায়।
লোকের সংঘট হ’ল লোকারণ্য ময় ।।
ব্রাক্ষণেরা সবে মিলে করে পরামিশে।
রথযাত্রা না হইতে এত লোক আসে ।।
আমাদের রথে কল্য মানুষ হবে না।
বৈরাগীর রথে কল্য লোক ধরিবে না ।।
ভাল বলি বাসুদেবে দিলাম ফিরা’য়ে।
এতেক স্পর্ধা তার বাদ হাটা মিলা’য়ে ।।
কল্য প্রাতেঃ সবে মিলে গিয়ে তার বাড়ী।
আর বার বাসুদেব ল’য়ে এস কাড়ি ।।
প্রভাতে সকল দ্বিজ ক্রোধভরে যায়।
জোর করি বাসুদেব আনিল আলয় ।।
রামকান্ত বলে মম কি দোষ পাইলে।
পরাণ পুতুলী বাসু কেড়ে নিয়ে গেলে ।।
রথে উঠাঁইয়া দেখিতাম বাসুরাজে।
দেখিতাম বাসুদেব কি রকম সাজে ।।
বাসুরে লইয়া গেল আর লক্ষ্য নাই।
লয়ে গেল বাসুরে জগার কাছে যাই ।।
অবশ্য যাইব আমি জগার নিকটে।
দেখি সে বাসুর মত উঠে কিনা উঠে ।।
যাত্রা করে রামকান্ত ক্ষেত্র যাইবারে।
পথে যেতে দৈববাণী হইল তাহারে ।।
ফিরে যাও রামকান্ত যাও নিজালয়।
অবশ্য যাইব রথে মোরা দু’জনায় ।।
আমি যাব আর তব বাসুদেব যা’বে।
দু’জনার রথযাত্রা দেখিবারে পাবে ।।
শুনে শান্ত রামকান্ত এল আখড়ায়।
প্রেমে পুলকিত চিত নাচিয়া বেড়ায় ।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় হাতে দিয়া তালি।
ক্ষণে ক্ষণে লম্ফ দেয় দুই বাহু তুলি ।।
ডেকে বলে ভক্তগণে আমি ত দুর্ভাগা।
তোমাদের ভক্তি-জোরে আসিবে সে জগা ।।
উৎকলেতে থাকে জগা বড়ই দয়াল।
চলে না জগার রথ না গেলে কাঙ্গাল ।।
কাঙ্গালের বন্ধু জগা কাঙ্গালের বন্ধু।
জগা বাসো এবার তরা’বে ভবসিন্ধু ।।
যাইতে ছিলাম ক্ষেত্রে জগারে আনিতে।
পথমাঝে দৈববাণী হইল দেবেতে ।।
জগা বাসো দুইজন উঠিবে সে রথে।
দেখিব যুগল রূপ বাসনা মনেতে ।।
ব্রাহ্মণেরা শালগ্রাম উঠাইয়া রথে।
রথযাত্রা নির্ব্বাহ করিত বিধিমতে ।।
অদ্য তারা বাসুদেবে রথে উঠাইয়া।
নির্ব্বাহ করিল সুখে রথযাত্রা ক্রিয়া ।।
দ্বিজদের রথযাত্রা সকালে হইল।
বৈকালে কান্তের রথে বাজার মিলিল ।।
বহুলোক সংঘটন হৈল সেই রথে।
এত লোক হইল ধরেনা বাজারেতে ।।
খাদ্যবস্তু বাদ্যবস্তু শিল্প পুত্তলিকা।
ক্রয় করে যুবা বৃদ্ধ বালক বালিকা ।।
কুম্ভকার মৃন্ময় পাত্র মৃন্ময় ছবি।
চিত্র ঘট চিত্র পট চিত্র দেব দেবী ।।
কেনা বেচা হয় কত কে করে গণন।
স্থানে স্থানে হয় হরিনাম সংকীর্ত্তন ।।
অপরাহ্ন হ’ল দিবা যামেক থাকিতে।
ব্রাক্ষণেরা দেখে বাসুদেব নাই রথে ।।
বৈরাগীর বংশরথে বাসুদেবোদয়।
সর্ব্বলোকে তাহা দেখি মানিল বিস্ময় ।।
তাহা দেখি রামকান্ত কেঁদে কেঁদে কয়।
বাসু এল বাশোঁ রথে জগা এলে হয় ।।
দেখরে জগৎবাসী দেখ দাঁড়াইয়া।
বাসুদেব রথযাত্রা দেখরে চাহিয়া ।।
মোর বাসু রথে সাজে নব জলধর।
বলিতে বলিতে স্বেদকম্প থর থর ।।
রথের উপরে উঠি মনের হরিষে।
রামকান্ত বাসুদেবে কোলে করি বসে ।।
হেন কালে এল কোলে প্রভু জগন্নাথ।
দুই প্রভু দুই কোলে চলে যায় রথ ।।
কেহ বলে রথের হইল এক টান।
কেহ বলে কে টানিল চলে রথখান ।।
মুহূর্তেক চলি রথ হইল সুস্থির।
ভূমিতে নামিল কান্ত চক্ষে বহে নীর ।।
প্রেমে গদ গদ হ’য়ে রামকান্ত কয়।
দেখরে নগরবাসী দিন ব’য়ে যায় ।।
দেখ দেখ চেয়ে দেখ যত ভক্তগণ।
জগা বাসো এক রথে অপূর্ব্ব মিলন ।।
প্রেমাবেশে ধরায় দিতেছে গড়াগড়ি।
কি ধরে টানিব রথ, রথে নাই দড়ি ।।
জগা বাসো মিলন দেখিয়া সর্ব্বলোক।
এইতো বৈকুণ্ঠ মম এই তো গোলোক ।।
জগা বাসো দুইজন একত্র মিলন।
এ মোর মথুরাপুরী এই বৃন্দাবন ।।
জগা বাসো সম্মিলন, অপূর্ব্ব মাধুরী।
তারক রসনা ভরি বল হরি হরি ।।
পয়ার
রামকান্ত বাসুদেব গলাগলি ধরে।
শয়ন করিত সুখে শয্যার উপরে ।।
এইভাবে প্রবীণ হইল রামকান্ত।
বর্ণনে অতীত লীলা নাহি তার অন্ত ।।
এদিকে ব্রাক্ষণগণ রথযাত্রা করে।
কান্তের হইল মন রথ করিবারে ।।
বাঁশ দিয়া রামকান্ত রথ বানাইল।
বাঁশো রথে বাসুদেব উঠিতে ইচ্ছিল ।।
অধিবাস দিনে সব লোক আসে যায়।
লোকের সংঘট হ’ল লোকারণ্য ময় ।।
ব্রাক্ষণেরা সবে মিলে করে পরামিশে।
রথযাত্রা না হইতে এত লোক আসে ।।
আমাদের রথে কল্য মানুষ হবে না।
বৈরাগীর রথে কল্য লোক ধরিবে না ।।
ভাল বলি বাসুদেবে দিলাম ফিরা’য়ে।
এতেক স্পর্ধা তার বাদ হাটা মিলা’য়ে ।।
কল্য প্রাতেঃ সবে মিলে গিয়ে তার বাড়ী।
আর বার বাসুদেব ল’য়ে এস কাড়ি ।।
প্রভাতে সকল দ্বিজ ক্রোধভরে যায়।
জোর করি বাসুদেব আনিল আলয় ।।
রামকান্ত বলে মম কি দোষ পাইলে।
পরাণ পুতুলী বাসু কেড়ে নিয়ে গেলে ।।
রথে উঠাঁইয়া দেখিতাম বাসুরাজে।
দেখিতাম বাসুদেব কি রকম সাজে ।।
বাসুরে লইয়া গেল আর লক্ষ্য নাই।
লয়ে গেল বাসুরে জগার কাছে যাই ।।
অবশ্য যাইব আমি জগার নিকটে।
দেখি সে বাসুর মত উঠে কিনা উঠে ।।
যাত্রা করে রামকান্ত ক্ষেত্র যাইবারে।
পথে যেতে দৈববাণী হইল তাহারে ।।
ফিরে যাও রামকান্ত যাও নিজালয়।
অবশ্য যাইব রথে মোরা দু’জনায় ।।
আমি যাব আর তব বাসুদেব যা’বে।
দু’জনার রথযাত্রা দেখিবারে পাবে ।।
শুনে শান্ত রামকান্ত এল আখড়ায়।
প্রেমে পুলকিত চিত নাচিয়া বেড়ায় ।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় হাতে দিয়া তালি।
ক্ষণে ক্ষণে লম্ফ দেয় দুই বাহু তুলি ।।
ডেকে বলে ভক্তগণে আমি ত দুর্ভাগা।
তোমাদের ভক্তি-জোরে আসিবে সে জগা ।।
উৎকলেতে থাকে জগা বড়ই দয়াল।
চলে না জগার রথ না গেলে কাঙ্গাল ।।
কাঙ্গালের বন্ধু জগা কাঙ্গালের বন্ধু।
জগা বাসো এবার তরা’বে ভবসিন্ধু ।।
যাইতে ছিলাম ক্ষেত্রে জগারে আনিতে।
পথমাঝে দৈববাণী হইল দেবেতে ।।
জগা বাসো দুইজন উঠিবে সে রথে।
দেখিব যুগল রূপ বাসনা মনেতে ।।
ব্রাহ্মণেরা শালগ্রাম উঠাইয়া রথে।
রথযাত্রা নির্ব্বাহ করিত বিধিমতে ।।
অদ্য তারা বাসুদেবে রথে উঠাইয়া।
নির্ব্বাহ করিল সুখে রথযাত্রা ক্রিয়া ।।
দ্বিজদের রথযাত্রা সকালে হইল।
বৈকালে কান্তের রথে বাজার মিলিল ।।
বহুলোক সংঘটন হৈল সেই রথে।
এত লোক হইল ধরেনা বাজারেতে ।।
খাদ্যবস্তু বাদ্যবস্তু শিল্প পুত্তলিকা।
ক্রয় করে যুবা বৃদ্ধ বালক বালিকা ।।
কুম্ভকার মৃন্ময় পাত্র মৃন্ময় ছবি।
চিত্র ঘট চিত্র পট চিত্র দেব দেবী ।।
কেনা বেচা হয় কত কে করে গণন।
স্থানে স্থানে হয় হরিনাম সংকীর্ত্তন ।।
অপরাহ্ন হ’ল দিবা যামেক থাকিতে।
ব্রাক্ষণেরা দেখে বাসুদেব নাই রথে ।।
বৈরাগীর বংশরথে বাসুদেবোদয়।
সর্ব্বলোকে তাহা দেখি মানিল বিস্ময় ।।
তাহা দেখি রামকান্ত কেঁদে কেঁদে কয়।
বাসু এল বাশোঁ রথে জগা এলে হয় ।।
দেখরে জগৎবাসী দেখ দাঁড়াইয়া।
বাসুদেব রথযাত্রা দেখরে চাহিয়া ।।
মোর বাসু রথে সাজে নব জলধর।
বলিতে বলিতে স্বেদকম্প থর থর ।।
রথের উপরে উঠি মনের হরিষে।
রামকান্ত বাসুদেবে কোলে করি বসে ।।
হেন কালে এল কোলে প্রভু জগন্নাথ।
দুই প্রভু দুই কোলে চলে যায় রথ ।।
কেহ বলে রথের হইল এক টান।
কেহ বলে কে টানিল চলে রথখান ।।
মুহূর্তেক চলি রথ হইল সুস্থির।
ভূমিতে নামিল কান্ত চক্ষে বহে নীর ।।
প্রেমে গদ গদ হ’য়ে রামকান্ত কয়।
দেখরে নগরবাসী দিন ব’য়ে যায় ।।
দেখ দেখ চেয়ে দেখ যত ভক্তগণ।
জগা বাসো এক রথে অপূর্ব্ব মিলন ।।
প্রেমাবেশে ধরায় দিতেছে গড়াগড়ি।
কি ধরে টানিব রথ, রথে নাই দড়ি ।।
জগা বাসো মিলন দেখিয়া সর্ব্বলোক।
এইতো বৈকুণ্ঠ মম এই তো গোলোক ।।
জগা বাসো দুইজন একত্র মিলন।
এ মোর মথুরাপুরী এই বৃন্দাবন ।।
জগা বাসো সম্মিলন, অপূর্ব্ব মাধুরী।
তারক রসনা ভরি বল হরি হরি ।।
রামকান্ত বৈরাগীর মানবলীলা সম্বরণ
পয়ার
কতদূরে দূরে গিয়া রামকান্ত কয়।
টানিতে নারিব রথ তোরা চ’লে আয় ।।
বলিতে বলিতে ঘড় ঘড় শব্দ হয়।
কেহ না টানিল রথ বেগে চলে যায় ।।
আশ্চর্য্য মানিয়া সবে দৃঢ়ভক্তি হ’য়ে।
একদৃষ্টে রথপানে সবে রৈল চেয়ে ।।
লোক ভিড় নিকটে না সবে যেতে পারে।
কেহ কেহ দূরে থেকে রথ দৃষ্টি করে ।।
কোন কোন ভাগ্যবান করে দরশন।
জগন্নাথ বাসুদেব যুগল মিলন ।।
ঘড় ঘড় শব্দে রথখানা চলে এল।
রামকান্ত পথ মাঝে বসিয়া রহিল ।।
কেহ বলে উঠ উঠ উঠ হে বৈরাগী।
এখানে বসিলে কেন মরিবার লাগি ।।
অষ্টাঙ্গ লোটায়ে সাধু করে দন্ডবৎ।
রামকান্ত উপরে উঠিল গিয়া রথ ।।
পৃষ্ঠোপরে রথখানা উঠিল যখন।
উঠে এক জ্যোতি প্রাতঃ সূর্য্যের মতন ।।
দেখিয়া সকল লোকে লাগে চমৎকার।
রথ নীচ হ’তে যেন উঠে দিবাকর ।।
বিদ্যুতের ন্যায় তেজ রথোপরে গেল।
জগন্নাথ বাসুদেবের অঙ্গেতে মিশিল ।।
পূর্ব্ব মুখ রথখানা হইল সুস্থির।
পথে পড়ে রৈল রামকান্তের শরীর ।।
সকলে দেখিল গেছে ব্রহ্মরন্ধ্র ফাটি।
রামকান্তের মৃতদেহে হ’ল পুষ্পবৃষ্টি ।।
রামকান্ত লীলা সাঙ্গ হরিবল ভাই।
শ্রবণে গোলোকে বাস কাল ভয় নাই ।।
জগন্নাথ রথ হ’তে হ’ল অর্ন্তধান।
বাসুদেবে ল’য়ে দ্বিজগণ গৃহে যান ।।
ভূবন পবিত্র হেতু রামকান্ত এল।
এই রামকান্ত বরে হরি জনমিল ।।
রামকান্ত ভক্ত সব একত্র হইল।
ঘৃতাগ্নি সংযুক্ত করি সৎকার করিল ।।
রামকান্ত মহাসাধু রসিক সমাজ।
কান্তলীলা রচিল তারক রসরাজ ।।
পয়ার
কতদূরে দূরে গিয়া রামকান্ত কয়।
টানিতে নারিব রথ তোরা চ’লে আয় ।।
বলিতে বলিতে ঘড় ঘড় শব্দ হয়।
কেহ না টানিল রথ বেগে চলে যায় ।।
আশ্চর্য্য মানিয়া সবে দৃঢ়ভক্তি হ’য়ে।
একদৃষ্টে রথপানে সবে রৈল চেয়ে ।।
লোক ভিড় নিকটে না সবে যেতে পারে।
কেহ কেহ দূরে থেকে রথ দৃষ্টি করে ।।
কোন কোন ভাগ্যবান করে দরশন।
জগন্নাথ বাসুদেব যুগল মিলন ।।
ঘড় ঘড় শব্দে রথখানা চলে এল।
রামকান্ত পথ মাঝে বসিয়া রহিল ।।
কেহ বলে উঠ উঠ উঠ হে বৈরাগী।
এখানে বসিলে কেন মরিবার লাগি ।।
অষ্টাঙ্গ লোটায়ে সাধু করে দন্ডবৎ।
রামকান্ত উপরে উঠিল গিয়া রথ ।।
পৃষ্ঠোপরে রথখানা উঠিল যখন।
উঠে এক জ্যোতি প্রাতঃ সূর্য্যের মতন ।।
দেখিয়া সকল লোকে লাগে চমৎকার।
রথ নীচ হ’তে যেন উঠে দিবাকর ।।
বিদ্যুতের ন্যায় তেজ রথোপরে গেল।
জগন্নাথ বাসুদেবের অঙ্গেতে মিশিল ।।
পূর্ব্ব মুখ রথখানা হইল সুস্থির।
পথে পড়ে রৈল রামকান্তের শরীর ।।
সকলে দেখিল গেছে ব্রহ্মরন্ধ্র ফাটি।
রামকান্তের মৃতদেহে হ’ল পুষ্পবৃষ্টি ।।
রামকান্ত লীলা সাঙ্গ হরিবল ভাই।
শ্রবণে গোলোকে বাস কাল ভয় নাই ।।
জগন্নাথ রথ হ’তে হ’ল অর্ন্তধান।
বাসুদেবে ল’য়ে দ্বিজগণ গৃহে যান ।।
ভূবন পবিত্র হেতু রামকান্ত এল।
এই রামকান্ত বরে হরি জনমিল ।।
রামকান্ত ভক্ত সব একত্র হইল।
ঘৃতাগ্নি সংযুক্ত করি সৎকার করিল ।।
রামকান্ত মহাসাধু রসিক সমাজ।
কান্তলীলা রচিল তারক রসরাজ ।।
আদিখণ্ড
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
যশোমন্ত ঠাকুরের বৈষ্ণব সেবা ও বৈষ্ণব দাসের পুনর্জীবন
পয়ার
তস্য পরে জনমিল শ্রীবৈষ্ণব দাস।
বৈষ্ণব দাসের পরে জন্মে গৌরীদাস।।
সবার কনিষ্ঠ হ’ল শ্রীস্বরূপ দাস।
জগৎ পবিত্র কৈল হইয়া প্রকাশ।।
ত্রেতাযুগে প্রকাশ হইল চারি অংশে।
এবে এসে প্রকাশ হইল পঞ্চ অংশে।।
যশোমন্ত সদা দেন বৈষ্ণব ভোজন।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন।।
একাদশী দিনে সব বৈষ্ণব আসিল।
কৃষ্ণ প্রেমানন্দে হরি বাসর করিল।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
বয়স বৈষ্ণব দাস চতুর্থ বৎসর।
একাদশী দিনে গায় আছে কিছু জ্বর।।
পারণা দিবসে হরি বাসর প্রভাতে।
পুকুরের ঘাটে গেল হাটিতে হাটিতে।।
পুকুরের জলে পড়ি মরিল বালক।
এদিকে বৈষ্ণবগণ প্রেমেতে পুলক।।
দেবী অন্নপূর্ণা দেখি কাঁদিয়া উঠিল।
যশোমন্ত এসে মুখ চাপিয়া ধরিল।।
কান্না শুনি বৈষ্ণবের সুখ ভঙ্গ হবে।
না হ’বে বৈষ্ণব সেবা সব বৃথা যা’বে।।
মরেছে বালক যদি এখানে থাকুক।
অগ্রে সব বৈষ্ণবের পারণা হউক।।
মরা পুত্র যশোমন্ত গৃহে রাখে সেরে।
বৈষ্ণবের সঙ্গে গিয়া হরিনাম করে।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
নাম সংকীর্ত্তন হ’ল পারনা হইল।
সবে ভোগ দরশন করিতে আসিল।।
মৃত পুত্র শিরে করি নাচিছে সুধীর।
অন্নপূর্ণা দেবী তবে কাঁদিয়া অস্থির।।
যশোমন্ত বলে তুমি কাঁদ কেন মিছে।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক ম’রেছে।।
ধন্য রত্নগর্ভা তুমি তোমার উদরে।
এহেন বালক জন্মে আমাদের ঘরে।।
আমার ঔরস ধন্য তাতে জানা গেল।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক মরিল।।
হেন ভাগ্য কার হয় জনম লইয়া।
বৈষ্ণব সেবায় মোরে কীর্ত্তন শুনিয়া।।
বৈষ্ণব হইয়া বরং বাঁচে পঞ্চদিন।
বৃথা সহস্রেক কল্প হরিভক্তিহীন।।
সকল বৈষ্ণব সেবা হইল স্বচ্ছন্দ।
মৃত পুত্র তথা আনি বাড়িল আনন্দ।।
মৃত পুত্র শিরে নাচে পুলক শরীর।
বৈষ্ণবেরা বলে কি হইল বৈরাগীর।।
এক সাধু বলে শুন যত সাধুগণ।
কি কহিব বৈরাগীর মরিল নন্দন।।
সবে বলে এ বালক মরিল কখন।
তিনি কন তোমাদের কীর্ত্তন যখন।।
জলেতে পড়িয়া পুত্র মরেছে তখন।
এই সে মরা পুত্র মস্তকে ধারণ।।
ডাক দিয়া যশোমন্তে বৈরাগীরা কয়।
মৃত ছেলে কি কারণে রাখিলে মাথায়।।
বৈষ্ণবের কথা শুনি যশোমন্ত বলে।
মরেছে বালক মম সাধু সেবা কালে।।
সাধু সেবা হরি নাম শুনে শিশু মরে।
পুত্র নয় সাধু বলে রাখিয়াছি শিরে।।
মরেছে বালক তাতে নাহিক বিষাদ।
মম ভয় বৈষ্ণবের সেবা হয় বাদ।।
সে কারণে না জানাই বৈষ্ণব সমাজে।
মড়া পুত্র গোপনে রাখিনু মাঝে।।
হইল বৈষ্ণব সেবা আনন্দ হৃদয়।
এবে আনিলাম ছেলে বৈষ্ণব সভায়।।
মৃত পুত্র লয়ে নাচে আনন্দিত মন।
বালকের মুখে হৈল জল উদ্গীরণ।।
বালকের মৃত দেহে সঞ্চারে জীবন।
ধন্য ধন্য করি হরি বলে সাধুজন।।
অন্নপূর্ণা বাঞ্ছাপূর্ণ পুত্র নিল কোলে।
রচিল রসনা মৃত্যুঞ্জয় কৃপা বলে।।
পয়ার
তস্য পরে জনমিল শ্রীবৈষ্ণব দাস।
বৈষ্ণব দাসের পরে জন্মে গৌরীদাস।।
সবার কনিষ্ঠ হ’ল শ্রীস্বরূপ দাস।
জগৎ পবিত্র কৈল হইয়া প্রকাশ।।
ত্রেতাযুগে প্রকাশ হইল চারি অংশে।
এবে এসে প্রকাশ হইল পঞ্চ অংশে।।
যশোমন্ত সদা দেন বৈষ্ণব ভোজন।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন।।
একাদশী দিনে সব বৈষ্ণব আসিল।
কৃষ্ণ প্রেমানন্দে হরি বাসর করিল।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
বয়স বৈষ্ণব দাস চতুর্থ বৎসর।
একাদশী দিনে গায় আছে কিছু জ্বর।।
পারণা দিবসে হরি বাসর প্রভাতে।
পুকুরের ঘাটে গেল হাটিতে হাটিতে।।
পুকুরের জলে পড়ি মরিল বালক।
এদিকে বৈষ্ণবগণ প্রেমেতে পুলক।।
দেবী অন্নপূর্ণা দেখি কাঁদিয়া উঠিল।
যশোমন্ত এসে মুখ চাপিয়া ধরিল।।
কান্না শুনি বৈষ্ণবের সুখ ভঙ্গ হবে।
না হ’বে বৈষ্ণব সেবা সব বৃথা যা’বে।।
মরেছে বালক যদি এখানে থাকুক।
অগ্রে সব বৈষ্ণবের পারণা হউক।।
মরা পুত্র যশোমন্ত গৃহে রাখে সেরে।
বৈষ্ণবের সঙ্গে গিয়া হরিনাম করে।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
নাম সংকীর্ত্তন হ’ল পারনা হইল।
সবে ভোগ দরশন করিতে আসিল।।
মৃত পুত্র শিরে করি নাচিছে সুধীর।
অন্নপূর্ণা দেবী তবে কাঁদিয়া অস্থির।।
যশোমন্ত বলে তুমি কাঁদ কেন মিছে।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক ম’রেছে।।
ধন্য রত্নগর্ভা তুমি তোমার উদরে।
এহেন বালক জন্মে আমাদের ঘরে।।
আমার ঔরস ধন্য তাতে জানা গেল।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক মরিল।।
হেন ভাগ্য কার হয় জনম লইয়া।
বৈষ্ণব সেবায় মোরে কীর্ত্তন শুনিয়া।।
বৈষ্ণব হইয়া বরং বাঁচে পঞ্চদিন।
বৃথা সহস্রেক কল্প হরিভক্তিহীন।।
সকল বৈষ্ণব সেবা হইল স্বচ্ছন্দ।
মৃত পুত্র তথা আনি বাড়িল আনন্দ।।
মৃত পুত্র শিরে নাচে পুলক শরীর।
বৈষ্ণবেরা বলে কি হইল বৈরাগীর।।
এক সাধু বলে শুন যত সাধুগণ।
কি কহিব বৈরাগীর মরিল নন্দন।।
সবে বলে এ বালক মরিল কখন।
তিনি কন তোমাদের কীর্ত্তন যখন।।
জলেতে পড়িয়া পুত্র মরেছে তখন।
এই সে মরা পুত্র মস্তকে ধারণ।।
ডাক দিয়া যশোমন্তে বৈরাগীরা কয়।
মৃত ছেলে কি কারণে রাখিলে মাথায়।।
বৈষ্ণবের কথা শুনি যশোমন্ত বলে।
মরেছে বালক মম সাধু সেবা কালে।।
সাধু সেবা হরি নাম শুনে শিশু মরে।
পুত্র নয় সাধু বলে রাখিয়াছি শিরে।।
মরেছে বালক তাতে নাহিক বিষাদ।
মম ভয় বৈষ্ণবের সেবা হয় বাদ।।
সে কারণে না জানাই বৈষ্ণব সমাজে।
মড়া পুত্র গোপনে রাখিনু মাঝে।।
হইল বৈষ্ণব সেবা আনন্দ হৃদয়।
এবে আনিলাম ছেলে বৈষ্ণব সভায়।।
মৃত পুত্র লয়ে নাচে আনন্দিত মন।
বালকের মুখে হৈল জল উদ্গীরণ।।
বালকের মৃত দেহে সঞ্চারে জীবন।
ধন্য ধন্য করি হরি বলে সাধুজন।।
অন্নপূর্ণা বাঞ্ছাপূর্ণ পুত্র নিল কোলে।
রচিল রসনা মৃত্যুঞ্জয় কৃপা বলে।।
মোহমুদগরোপখ্যান
পয়ার
পুনঃ বৈষ্ণবেরা বসিলেন একঠাঁই।
বলে ধন্য যশোমন্ত হেন দেখি নাই।।
মোহ মুদ্গরের বাটি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন।
কৃষ্ণভক্তি বুঝিবারে গেলেন দুজন।।
ব্রাহ্মণ বেশেতে গিয়া উপনীত অতিথি।
মুদ্গরে ডাকিয়া বলে আমরা অতিথি।।
অতিথিরে দিল সাধু পাক করিবারে।
তিন পুত্র পাঠাঁইল পরিচর্যা তরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র গিয়াছিল জল আনিবারে।
অকস্মাৎ সেই পুত্র খাইল কুম্ভিরে।।
মধ্যম সন্তান গেল কাষ্ঠ আনিবারে।
বন মাঝে ব্যাঘ্র ধরি মারিল তাহারে।।
কনিষ্ঠ সন্তান গেল আনিবারে পাত্র।
কালসর্প তাঁর শিরে করিল আঘাত।।
পুত্রের বিলম্ব দেখি মুদ্গর চলিল।
সাপে বাঘে কুমিরে মেরেছে দেখে এল।।
এই ভাবে তিন পুত্র মরে গেল তাঁর।
নিজে এনে দ্রব্য দিল অতিথি সেবার।।
মুদ্গরের নারী আর পুত্রবধু তিন।
নহে তারা শোকাতুরা বিকারবিহীন।।
ছদ্মবেশে কৃষ্ণ বলে শুন মহাশয়।
কাষ্ঠ পাতা আনতে গেল তাহার কোথায়।।
মুদ্গর কহিছে তারা মহা ভাগ্যবান।
অতিথি সেবাতে তারা ত্যজিয়াছে প্রাণ।।
কৃষ্ণ বলে ম’ল তব তিনটি নন্দন।
পুত্র শোকে মুদ্গর কাঁদনা কি কারণ।।
মুদ্গর কহিছে কেন করিব রোদন।
পুত্র ম’ল ভাল হ’ল ঘুচিল বন্ধন।।
মায়ার বন্ধন কেটে দিলেন গোবিন্দ।
নির্বিঘ্নে বলিব হরি করিব আনন্দ।।
কৃষ্ণ বলে শীঘ্র যাও ডেকে আন ঘরে।
অতিথি সেবাতে কবে কার পুত্র মরে।।
যারে নিল কুম্ভীরেতে উপজিল আসি।
কৃষ্ণ অগ্রে এনে দিল জলের কলসী।।
এই মত তিন পুত্র হ’ল উপনীত।
হরি পদ ধরি সব ধূলায় লুণ্ঠিত।।
পরিচয় দিয়া হরি করিল গমন।
অভিমন্যু শোক পার্থ কৈল সম্বরণ।।
মুদ্গরের পুত্র দিল গোলোক গোঁসাই।
যশোমন্ত বৈরাগীর আজ হ’ল তাই।।
আর সাধু বলে শুন বৈষ্ণবের গণ।
কৃষ্ণলীলা সুধাধার মধুর বর্ষণ।।
অম্বরীষ গৃহে ছিল একটি নন্দন।
দশ বর্ষ পরমায়ু ছিল নিরূপণ।।
সংক্ষেপে বলিব এবে তাঁর বিবরণ।
সূতিকা আগারে যবে ছিল সে নন্দন।।
অদৃষ্ট লিখন যবে লেখে পদ্মাসন।
দাসী গিয়া ধরিল সে বিধির চরণ।।
দাসী বলে ওহে বিধি কি লিখিয়া যাও।
বালকের আয়ু কত মম ঠাঁই কও।।
অনেক স্তবেতে বিধি সন্তুষ্ট হইল।
দশ বর্ষ পরমায়ু দাসীকে বলিল।।
দাসী জানাইল রাজরানীর গোচরে।
রানী জানাইল তাহা মহারাজ তরে।।
অল্প আয়ু জানি নাহি দিল লিখিবারে।
মনে মনে চিন্তা করে রাজার কুমার।।
ভাবে আমি রাজকূলে একটি কুমার।।
পিতা না করেন যত্ন মোরে লেখাবার।।
রাজপুত্র জিজ্ঞাসিল পিতৃদেব স্থলে।
কেন পিতা মোরে নাহি দেন পাঠশালে।।
রাজা বলিলেন সেই বালকের ঠাঁই।
দশবর্ষ আয়ু আছে বাছা লেখাব কি ছাই।।
দশবর্ষ পরমায়ু তোমার যে ছিল।
নয় বর্ষ এই তার গত হয়ে গেল।।
রাজপুত্র বলে পিতা আর শুনিব কি।
এখনতো মরণের একবর্ষ বাকি।।
এই ভিক্ষা চাই পিতা আমি যদি মরি।
একবর্ষ প্রজা লয়ে বলি হরি হরি।।
খেতে দিবা প্রজাগণ না লইবা কর।
এই ভিক্ষা চাই পিতা একটি বৎসর।।
স্বীকার করিল রাজা সন্তোষ অন্তরে।
প্রজাবর্গ লয়ে শিশু হরিনাম করে।।
মরণের কাল তার হইল যখন।
তাহাকে লইতে এল রবির নন্দন।।
হরিভক্ত শিশু নিতে যম উপস্থিত।
ভক্ত বৎসল হরি অন্তরে দুঃখিত।।
হরি এসে বালকেরে করিলেন কোলে।
মুখ দেখে কমলাখি ভাসে আঁখি জলে।।
শমন বলেন হরি কারে কর কোলে।
আয়ু শেষ ফেলে দাও ল’য়ে যাই চলে।।
হরি ক’ন শেষে এ বালকে লয়ে যাও।
অগ্রেতে তলব খাতা আমাকে দেখাও।।
শমন তলব খাতা হরিকে দেখায়।
দশবর্ষ আয়ু দেখে কাঁদে দয়াময়।।
কৃষ্ণের নয়ন জলে কজ্জল যে ছিল।
নয়নের জলে তাহা গলিত হইল।।
সেই ত্রিভঙ্গের ভঙ্গি কেবা তাহা জানে।
কজ্জলাক্ত অশ্রু পড়ে আয়ুর দক্ষিণে।।
হরি কন শতবর্ষ পরমায়ু দেখি।
যম বলে তবে চিত্রগুপ্ত বলিল কি।।
চিত্রগুপ্ত হাঁতে নিয়া দেখে সেই খাতা।
ক্রোধেতে কম্পিত গুপ্ত ঝাকি দিল মাথা।।
চিত্রগুপ্ত কর্ণেতে লেখার তুলী ছিল।
আয়ুর দক্ষিণে মসি দুইবিন্দু প’ল।।
দুইশূন্য শতাঙ্কের দক্ষিণে পতন।
অযুত বৎসর আয়ু পাইল নন্দন।।
হরিলীলামৃত কথা অমৃত সমান।
তারক কহিছে সাধু সুখে কর পান।।
পয়ার
পুনঃ বৈষ্ণবেরা বসিলেন একঠাঁই।
বলে ধন্য যশোমন্ত হেন দেখি নাই।।
মোহ মুদ্গরের বাটি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন।
কৃষ্ণভক্তি বুঝিবারে গেলেন দুজন।।
ব্রাহ্মণ বেশেতে গিয়া উপনীত অতিথি।
মুদ্গরে ডাকিয়া বলে আমরা অতিথি।।
অতিথিরে দিল সাধু পাক করিবারে।
তিন পুত্র পাঠাঁইল পরিচর্যা তরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র গিয়াছিল জল আনিবারে।
অকস্মাৎ সেই পুত্র খাইল কুম্ভিরে।।
মধ্যম সন্তান গেল কাষ্ঠ আনিবারে।
বন মাঝে ব্যাঘ্র ধরি মারিল তাহারে।।
কনিষ্ঠ সন্তান গেল আনিবারে পাত্র।
কালসর্প তাঁর শিরে করিল আঘাত।।
পুত্রের বিলম্ব দেখি মুদ্গর চলিল।
সাপে বাঘে কুমিরে মেরেছে দেখে এল।।
এই ভাবে তিন পুত্র মরে গেল তাঁর।
নিজে এনে দ্রব্য দিল অতিথি সেবার।।
মুদ্গরের নারী আর পুত্রবধু তিন।
নহে তারা শোকাতুরা বিকারবিহীন।।
ছদ্মবেশে কৃষ্ণ বলে শুন মহাশয়।
কাষ্ঠ পাতা আনতে গেল তাহার কোথায়।।
মুদ্গর কহিছে তারা মহা ভাগ্যবান।
অতিথি সেবাতে তারা ত্যজিয়াছে প্রাণ।।
কৃষ্ণ বলে ম’ল তব তিনটি নন্দন।
পুত্র শোকে মুদ্গর কাঁদনা কি কারণ।।
মুদ্গর কহিছে কেন করিব রোদন।
পুত্র ম’ল ভাল হ’ল ঘুচিল বন্ধন।।
মায়ার বন্ধন কেটে দিলেন গোবিন্দ।
নির্বিঘ্নে বলিব হরি করিব আনন্দ।।
কৃষ্ণ বলে শীঘ্র যাও ডেকে আন ঘরে।
অতিথি সেবাতে কবে কার পুত্র মরে।।
যারে নিল কুম্ভীরেতে উপজিল আসি।
কৃষ্ণ অগ্রে এনে দিল জলের কলসী।।
এই মত তিন পুত্র হ’ল উপনীত।
হরি পদ ধরি সব ধূলায় লুণ্ঠিত।।
পরিচয় দিয়া হরি করিল গমন।
অভিমন্যু শোক পার্থ কৈল সম্বরণ।।
মুদ্গরের পুত্র দিল গোলোক গোঁসাই।
যশোমন্ত বৈরাগীর আজ হ’ল তাই।।
আর সাধু বলে শুন বৈষ্ণবের গণ।
কৃষ্ণলীলা সুধাধার মধুর বর্ষণ।।
অম্বরীষ গৃহে ছিল একটি নন্দন।
দশ বর্ষ পরমায়ু ছিল নিরূপণ।।
সংক্ষেপে বলিব এবে তাঁর বিবরণ।
সূতিকা আগারে যবে ছিল সে নন্দন।।
অদৃষ্ট লিখন যবে লেখে পদ্মাসন।
দাসী গিয়া ধরিল সে বিধির চরণ।।
দাসী বলে ওহে বিধি কি লিখিয়া যাও।
বালকের আয়ু কত মম ঠাঁই কও।।
অনেক স্তবেতে বিধি সন্তুষ্ট হইল।
দশ বর্ষ পরমায়ু দাসীকে বলিল।।
দাসী জানাইল রাজরানীর গোচরে।
রানী জানাইল তাহা মহারাজ তরে।।
অল্প আয়ু জানি নাহি দিল লিখিবারে।
মনে মনে চিন্তা করে রাজার কুমার।।
ভাবে আমি রাজকূলে একটি কুমার।।
পিতা না করেন যত্ন মোরে লেখাবার।।
রাজপুত্র জিজ্ঞাসিল পিতৃদেব স্থলে।
কেন পিতা মোরে নাহি দেন পাঠশালে।।
রাজা বলিলেন সেই বালকের ঠাঁই।
দশবর্ষ আয়ু আছে বাছা লেখাব কি ছাই।।
দশবর্ষ পরমায়ু তোমার যে ছিল।
নয় বর্ষ এই তার গত হয়ে গেল।।
রাজপুত্র বলে পিতা আর শুনিব কি।
এখনতো মরণের একবর্ষ বাকি।।
এই ভিক্ষা চাই পিতা আমি যদি মরি।
একবর্ষ প্রজা লয়ে বলি হরি হরি।।
খেতে দিবা প্রজাগণ না লইবা কর।
এই ভিক্ষা চাই পিতা একটি বৎসর।।
স্বীকার করিল রাজা সন্তোষ অন্তরে।
প্রজাবর্গ লয়ে শিশু হরিনাম করে।।
মরণের কাল তার হইল যখন।
তাহাকে লইতে এল রবির নন্দন।।
হরিভক্ত শিশু নিতে যম উপস্থিত।
ভক্ত বৎসল হরি অন্তরে দুঃখিত।।
হরি এসে বালকেরে করিলেন কোলে।
মুখ দেখে কমলাখি ভাসে আঁখি জলে।।
শমন বলেন হরি কারে কর কোলে।
আয়ু শেষ ফেলে দাও ল’য়ে যাই চলে।।
হরি ক’ন শেষে এ বালকে লয়ে যাও।
অগ্রেতে তলব খাতা আমাকে দেখাও।।
শমন তলব খাতা হরিকে দেখায়।
দশবর্ষ আয়ু দেখে কাঁদে দয়াময়।।
কৃষ্ণের নয়ন জলে কজ্জল যে ছিল।
নয়নের জলে তাহা গলিত হইল।।
সেই ত্রিভঙ্গের ভঙ্গি কেবা তাহা জানে।
কজ্জলাক্ত অশ্রু পড়ে আয়ুর দক্ষিণে।।
হরি কন শতবর্ষ পরমায়ু দেখি।
যম বলে তবে চিত্রগুপ্ত বলিল কি।।
চিত্রগুপ্ত হাঁতে নিয়া দেখে সেই খাতা।
ক্রোধেতে কম্পিত গুপ্ত ঝাকি দিল মাথা।।
চিত্রগুপ্ত কর্ণেতে লেখার তুলী ছিল।
আয়ুর দক্ষিণে মসি দুইবিন্দু প’ল।।
দুইশূন্য শতাঙ্কের দক্ষিণে পতন।
অযুত বৎসর আয়ু পাইল নন্দন।।
হরিলীলামৃত কথা অমৃত সমান।
তারক কহিছে সাধু সুখে কর পান।।
জয়পুর রাজ কুমারের পুনর্জ্জীবন
পয়ার
এইরূপ জয়পুর মান সিংহরায়।
তাহার হইল সুত সুতিকালয়।।
এরূপে দাসীকে ধাতা দিল দরশন।
বালকের জানিলেন আয়ু বিবরণ।।
পরমায়ু ছিল তার উনিশ বৎসর।
মাঝে মাঝে কাঁদে দাসী হইয়া কাতর।
অষ্ঠাদশবর্ষ আয়ু হইল যখন।
পাঠশালা হতে গৃহে আসিল নন্দন।।
বালকে করিয়া কোলে দাসী যবে কাঁদে।
রাজপুত্র সুধায়েছে ধরি তার পদে।।
দাসী বলে মম মনে অনেক সন্তাপ।
তোমার কল্যাণ হেতু কাঁদি ওরে বাপ।।
বলিতে না পারে দাসী মুখে না জুয়ায়।
রাজপুত্র কাতরে দাসীরে ধরে পায়।।
আমার শপথ লাগে করি প্রণিপাত।
সত্য করি কহ মম শিরে দিয়া হাত।।
ধাত্রী বলে কি বলিব শুন বাছাধন।
উনিশ বৎসরে হবে তোমার মরণ।।
আঠার বৎসর গত একটি বৎসর।
বাকি মাত্র আছে বাছা পরমায়ু তোর।।
শুনিয়া বালক বলে শুন ধাত্রী মাই।
বিশ্বেশ্বর দরশনে তবে আমি যাই।।
মার্কণ্ডের পরমায়ু বার বৎসর ছিল।
শঙ্কর কৃপাতে আয়ু সপ্তকল্প হ’ল।।
তার পিতা তাহারে দিলেন বনবাস।
হরি হরি বলিয়া কাটিল কর্ম ফাঁস।।
প্রস্তাব রয়েছে তার মার্কণ্ডপুরাণে।
হরি বলে মার্কণ্ড কাঁদিল বনে বনে।।
মার্কণ্ড নারদ সঙ্গে গেলেন কৈলাসে।
হেন কালে শমন তাহারে নিতে আসে।।
চর্ম্ম রসি কসে তার গলে বেঁধে দিল।
শিবলিঙ্গ বাম হাঁতে জড়ায়ে ধরিল।।
শিব এসে মহা রোষে ভক্ত নিল কোলে।
যম বক্ষ পরে তীক্ষ্ণ শূল নিক্ষেপিল।।
দুর্গতি নাশিনী দুর্গা শিশু নিল কোলে।
মাতৃ কোলে মার্কণ্ড শ্রী হরি হরি বলে।।
সদয় হইয়া বর দিল দিগম্বর।
বলে এর পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
শিব যদি বর দিল যম গেল ফিরে।
সপ্তকল্প পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
তব সম দয়ানিধি ভবে কেবা আছে।
শঙ্কর দয়ালু আর দয়ালু শ্রীহরি।।
শ্রীহরি বলিয়া মাগো করিব শ্রীহরি।।
স্বচক্ষেতে বিশ্বনাথ দরশন করি।
শমন দমন করি বলে হরি হরি।।
মাতা পিতা ধাত্রীকে বসায়ে এক ঠাঁই।
বলে মা বিদায় দেহ কাশীধামে যাই।।
আধ্যাত্মিক ভাবেতে সকলে বুঝাইল।
রাজপুত্র কাশীধামে গমন করিল।।
একবর্ষ কাশীধামে করে হরিনাম।
কিবা দিবা বিভাবরী না করি বিরাম।।
যে দিনেতে কুমারের আসন্ন সময়।
আনন্দ কাননে বসি হরিগুণ গায়।।
এসে পরে বিশ্বেশ্বর করে দরশন।
বহুস্তবে তোষে ভবে করিয়া রোদন।।
সিদ্ধ ঋষি তথা বসি বিশ্বেশ্বর দ্বারে।
রাজপুত গিয়া তথা তার পদ ধরে।।
পরমহংস, অবতংশ উলঙ্গ সন্ন্যাসী।
দীর্ঘজীবী তুই হবি বর দিল হাসি।।
রাজপুত্র বলে সুত পরমায়ু নাই।
সহস্রায়ু তোর আয়ু বলিল গোঁসাই।।
হেনকালে সেই সাধু গঙ্গা স্নানে যায়।
রাজপুত্র হাঁচি দিল এমন সময়।।
হাঁচি শুনি সাধু শিরোমণি দিল বর।
জীবন সহস্র বলে করে ধরে কর।।
রাজপুত্র সাধুর চরণ গিয়া ধরে।
আজ মম মৃত্যু ব’লে ভাসে অশ্রুনীরে।।
সাধু বলে হরি যে দিয়াছে হাঁচি।
জীবন সহস্র আমি তাহারে বলেছি।।
রণে বনে গমনে ভোজনে স্নানে দানে।
হাঁচিতে সুফল বেদের বিধানে।।
পশ্চিমে পরিলে হাঁচি বহু লভ্য হয়।
পশ্চিমেতে হাঁচি প’ল স্নানের সময়।।
হরিনাম ধ্বনি তোর ভক্তি রসময়।
তাতে তোর হাঁচি শুনে প্রফুল্ল হৃদয়।।
জীবন সহস্র মম মুখেতে আসিল।
কুমার তোমার ভাগ্য প্রসন্ন হইল।।
রাজপুত্র বলে মম অবশ্য মরণ।
বলিতে বলিতে তথা আইল শমন।।
মহিষ বাহন যম কালদণ্ডাকারে।
রাজপুত্র বলে ঐ নিতে এল মোরে।।
সাধু বলে চল শঙ্করের কাছে যাই।
দেখি বাক্য রাখে কি না শঙ্কর গোঁসাই।।
হেনকালে অন্নপূর্ণা বলে মৃদু হাসি।
দৈববানী প্রায় যেন বলিল প্রকাশি।।
বহুদিন করে সাধু সাধন ভজন।
সত্য সত্য সাধু বাক্য না হ’বে লঙ্ঘন।।
বিশ্বেশর বলে তুমি শুন ব্রহ্মময়ী।
তুমি যাহা বলিলে আমার বাক্য অই।।
সাধু বলে ধর্মরাজ শুনিতে কি পাও।
রাজপুত্র পরিবর্তে মম প্রাণ লও।।
শঙ্করী শঙ্কর বাক্য আমি দিনু বলে।
তিনবাক্য নষ্ট হয় রাজপুত্র নিলে।।
যম বলে তব বাক্যে ছাড়িনু কুমারে।
নির্ভয়েতে হরিভক্ত যাক নিজ ঘরে।।
রাজপুত্র চলে গেল আপন ভবনে।
বন্দিলেন পিতা মাতা ধাত্রীর চরণে।।
দুরন্ত কৃতান্ত শান্ত এ বৃতান্ত শুনি।
জয়পুরে প্রেমানন্দ জয় জয় ধ্বনি।।
ধাত্রীবাক্যে পরে করে মহা মহোৎসব।
হরি বলে নৃত্য করে যতেক বৈষ্ণব।।
আর দেখ কর্ণ পুত্র বৃষকেতু ছিল।
করাতে কাটিয়া তারে কৃষ্ণ পূজা কৈল।।
সেই পুত্র বাচালে কৃষ্ণ ভগবান।
কেন না বাচিবে বল এ ছেলের প্রাণ।।
কত মতে সাধু সেবা কৈল যশোমন্ত।
কেন ছেলে বাচিবেনা ভক্তি করে।।
বৈষ্ণবের সুখভঙ্গ এই ভয় করে।
দুঃখ নাই মড়া ছেলে সেরে রাখে ঘরে।।
যশোমন্ত পুত্র দিল অন্নপূর্ণা কোলে।
পতিপদ ধরি সতী হরি হরি বলে।।
ওহে নাথ এ তনয় আমার তো নয়।
ছেলের জীবন পেল বৈষ্ণবের কৃপায়।।
এছেলে থাকুক সাধু সেবায় নিযুক্ত।
বৈষ্ণবের নফর হউক বৈষ্ণবের ভক্ত।।
বৈষ্ণবের দাস হবে মম অভিলাস।
এ ছেলের নাম থাক শ্রীবৈষ্ণব দাস।।
পরে গৌরীদাস পরে শ্রীস্বরূপ দাস।
এক বিষ্ণু পঞ্চঅংশে ভুবনে প্রকাশ।।
পঞ্চভাই জন্ম নিল ভুবনের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
পয়ার
এইরূপ জয়পুর মান সিংহরায়।
তাহার হইল সুত সুতিকালয়।।
এরূপে দাসীকে ধাতা দিল দরশন।
বালকের জানিলেন আয়ু বিবরণ।।
পরমায়ু ছিল তার উনিশ বৎসর।
মাঝে মাঝে কাঁদে দাসী হইয়া কাতর।
অষ্ঠাদশবর্ষ আয়ু হইল যখন।
পাঠশালা হতে গৃহে আসিল নন্দন।।
বালকে করিয়া কোলে দাসী যবে কাঁদে।
রাজপুত্র সুধায়েছে ধরি তার পদে।।
দাসী বলে মম মনে অনেক সন্তাপ।
তোমার কল্যাণ হেতু কাঁদি ওরে বাপ।।
বলিতে না পারে দাসী মুখে না জুয়ায়।
রাজপুত্র কাতরে দাসীরে ধরে পায়।।
আমার শপথ লাগে করি প্রণিপাত।
সত্য করি কহ মম শিরে দিয়া হাত।।
ধাত্রী বলে কি বলিব শুন বাছাধন।
উনিশ বৎসরে হবে তোমার মরণ।।
আঠার বৎসর গত একটি বৎসর।
বাকি মাত্র আছে বাছা পরমায়ু তোর।।
শুনিয়া বালক বলে শুন ধাত্রী মাই।
বিশ্বেশ্বর দরশনে তবে আমি যাই।।
মার্কণ্ডের পরমায়ু বার বৎসর ছিল।
শঙ্কর কৃপাতে আয়ু সপ্তকল্প হ’ল।।
তার পিতা তাহারে দিলেন বনবাস।
হরি হরি বলিয়া কাটিল কর্ম ফাঁস।।
প্রস্তাব রয়েছে তার মার্কণ্ডপুরাণে।
হরি বলে মার্কণ্ড কাঁদিল বনে বনে।।
মার্কণ্ড নারদ সঙ্গে গেলেন কৈলাসে।
হেন কালে শমন তাহারে নিতে আসে।।
চর্ম্ম রসি কসে তার গলে বেঁধে দিল।
শিবলিঙ্গ বাম হাঁতে জড়ায়ে ধরিল।।
শিব এসে মহা রোষে ভক্ত নিল কোলে।
যম বক্ষ পরে তীক্ষ্ণ শূল নিক্ষেপিল।।
দুর্গতি নাশিনী দুর্গা শিশু নিল কোলে।
মাতৃ কোলে মার্কণ্ড শ্রী হরি হরি বলে।।
সদয় হইয়া বর দিল দিগম্বর।
বলে এর পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
শিব যদি বর দিল যম গেল ফিরে।
সপ্তকল্প পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
তব সম দয়ানিধি ভবে কেবা আছে।
শঙ্কর দয়ালু আর দয়ালু শ্রীহরি।।
শ্রীহরি বলিয়া মাগো করিব শ্রীহরি।।
স্বচক্ষেতে বিশ্বনাথ দরশন করি।
শমন দমন করি বলে হরি হরি।।
মাতা পিতা ধাত্রীকে বসায়ে এক ঠাঁই।
বলে মা বিদায় দেহ কাশীধামে যাই।।
আধ্যাত্মিক ভাবেতে সকলে বুঝাইল।
রাজপুত্র কাশীধামে গমন করিল।।
একবর্ষ কাশীধামে করে হরিনাম।
কিবা দিবা বিভাবরী না করি বিরাম।।
যে দিনেতে কুমারের আসন্ন সময়।
আনন্দ কাননে বসি হরিগুণ গায়।।
এসে পরে বিশ্বেশ্বর করে দরশন।
বহুস্তবে তোষে ভবে করিয়া রোদন।।
সিদ্ধ ঋষি তথা বসি বিশ্বেশ্বর দ্বারে।
রাজপুত গিয়া তথা তার পদ ধরে।।
পরমহংস, অবতংশ উলঙ্গ সন্ন্যাসী।
দীর্ঘজীবী তুই হবি বর দিল হাসি।।
রাজপুত্র বলে সুত পরমায়ু নাই।
সহস্রায়ু তোর আয়ু বলিল গোঁসাই।।
হেনকালে সেই সাধু গঙ্গা স্নানে যায়।
রাজপুত্র হাঁচি দিল এমন সময়।।
হাঁচি শুনি সাধু শিরোমণি দিল বর।
জীবন সহস্র বলে করে ধরে কর।।
রাজপুত্র সাধুর চরণ গিয়া ধরে।
আজ মম মৃত্যু ব’লে ভাসে অশ্রুনীরে।।
সাধু বলে হরি যে দিয়াছে হাঁচি।
জীবন সহস্র আমি তাহারে বলেছি।।
রণে বনে গমনে ভোজনে স্নানে দানে।
হাঁচিতে সুফল বেদের বিধানে।।
পশ্চিমে পরিলে হাঁচি বহু লভ্য হয়।
পশ্চিমেতে হাঁচি প’ল স্নানের সময়।।
হরিনাম ধ্বনি তোর ভক্তি রসময়।
তাতে তোর হাঁচি শুনে প্রফুল্ল হৃদয়।।
জীবন সহস্র মম মুখেতে আসিল।
কুমার তোমার ভাগ্য প্রসন্ন হইল।।
রাজপুত্র বলে মম অবশ্য মরণ।
বলিতে বলিতে তথা আইল শমন।।
মহিষ বাহন যম কালদণ্ডাকারে।
রাজপুত্র বলে ঐ নিতে এল মোরে।।
সাধু বলে চল শঙ্করের কাছে যাই।
দেখি বাক্য রাখে কি না শঙ্কর গোঁসাই।।
হেনকালে অন্নপূর্ণা বলে মৃদু হাসি।
দৈববানী প্রায় যেন বলিল প্রকাশি।।
বহুদিন করে সাধু সাধন ভজন।
সত্য সত্য সাধু বাক্য না হ’বে লঙ্ঘন।।
বিশ্বেশর বলে তুমি শুন ব্রহ্মময়ী।
তুমি যাহা বলিলে আমার বাক্য অই।।
সাধু বলে ধর্মরাজ শুনিতে কি পাও।
রাজপুত্র পরিবর্তে মম প্রাণ লও।।
শঙ্করী শঙ্কর বাক্য আমি দিনু বলে।
তিনবাক্য নষ্ট হয় রাজপুত্র নিলে।।
যম বলে তব বাক্যে ছাড়িনু কুমারে।
নির্ভয়েতে হরিভক্ত যাক নিজ ঘরে।।
রাজপুত্র চলে গেল আপন ভবনে।
বন্দিলেন পিতা মাতা ধাত্রীর চরণে।।
দুরন্ত কৃতান্ত শান্ত এ বৃতান্ত শুনি।
জয়পুরে প্রেমানন্দ জয় জয় ধ্বনি।।
ধাত্রীবাক্যে পরে করে মহা মহোৎসব।
হরি বলে নৃত্য করে যতেক বৈষ্ণব।।
আর দেখ কর্ণ পুত্র বৃষকেতু ছিল।
করাতে কাটিয়া তারে কৃষ্ণ পূজা কৈল।।
সেই পুত্র বাচালে কৃষ্ণ ভগবান।
কেন না বাচিবে বল এ ছেলের প্রাণ।।
কত মতে সাধু সেবা কৈল যশোমন্ত।
কেন ছেলে বাচিবেনা ভক্তি করে।।
বৈষ্ণবের সুখভঙ্গ এই ভয় করে।
দুঃখ নাই মড়া ছেলে সেরে রাখে ঘরে।।
যশোমন্ত পুত্র দিল অন্নপূর্ণা কোলে।
পতিপদ ধরি সতী হরি হরি বলে।।
ওহে নাথ এ তনয় আমার তো নয়।
ছেলের জীবন পেল বৈষ্ণবের কৃপায়।।
এছেলে থাকুক সাধু সেবায় নিযুক্ত।
বৈষ্ণবের নফর হউক বৈষ্ণবের ভক্ত।।
বৈষ্ণবের দাস হবে মম অভিলাস।
এ ছেলের নাম থাক শ্রীবৈষ্ণব দাস।।
পরে গৌরীদাস পরে শ্রীস্বরূপ দাস।
এক বিষ্ণু পঞ্চঅংশে ভুবনে প্রকাশ।।
পঞ্চভাই জন্ম নিল ভুবনের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
প্রভুদের বাল্য খেলা
পয়ার
ফরিদপুর জিলা গ্রাম সফলা ডাঙ্গায়।
পঞ্চভ্রাতা জন্মিলেন এসে এ ধরায়।।
প্রভু আগমনে ধন্য হ’ল মত্ত্যপুরী।
বঙ্গদেশে ধন্য গ্রাম সফলা নগরী।।
অগ্রগন্য কৃষ্ণ দাস ভজনেতে।
শুদ্ধ্বাচারী কৃষ্ণ ভক্তে আর্তি বৈষ্ণবেতে।।
একাদশী উপবাসী তুলসী ভজন।
শ্রীহরি বাসর হরিব্রত পরায়ন।।
নাম সংকীর্ত্তন আদি সদা সাধু সঙ্গ।
অন্তরে মাধুর্য শুধু প্রেমের তরঙ্গ।।
বৈষ্ণব দাসের মন শুধু বৈষ্ণব সেবায়।
বৈষ্ণবের সঙ্গে রঙ্গে কৃষ্ণ গুণ গায়।।
প্রভুর অংশেতে জন্ম ভক্তি যুক্ত কায়।
ভক্তের হইয়া ভক্ত ভক্তি শিখায়।।
স্বয়ং এর প্রতিজ্ঞা এ চিরদিন রয়।
ভক্তের হইতে ভৃত্য মোর বাঞ্ছা হয়।।
জানেনা বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা বিনে।
গৃহেতে বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা দিনে।।
জিজ্ঞাসা করিত মাতা অন্নপূর্ণা ঠাঁই।
বলে মাগো আজ তো বৈষ্ণব আসে নাই।।
বৈষ্ণবের পাক করা লাবড়া ব্যঞ্জন।
বৈষ্ণব প্রসাদ নিতে বড়ই মনন।।
বৈষ্ণবে নিঃশ্বাস ছাড়ে হরে কৃষ্ণ বলে।
তখন আমার মনে আনন্দ উথলে।।
যার গলে মালা ভালে তিলক ধারন।
তারে গিয়া করিত বৈষ্ণব সম্বোধন।।
বালক নিকট যেত বাল্য খেলা লাগি।
বলে ভাই এস খেলি বৈরাগী বৈরাগী।।
একত্র হইয়া সব বালকের সনে।
বলে ভাই ভালো মাটি পাবো কোন খানে।।
যে স্থানে বিশুদ্ধ মাটি আনিত তুলিয়া।
অষ্টাঙ্গে লইত ফোঁটা সে মাটি গুলিয়া।।
বৈষ্ণবেরা যেমন পরিত বহির্বাস।
তেমতি পরিত নিজ পরিধান বাস।।
তুলসির চারা আনি করিত রোপণ।
বলে ভাই হেথা কর নাম সংকীর্ত্তন।।
হরি বলি বাহুতূলি নাচিয়া নাচিয়া।
ভূমে দিত গড়াগড়ি মাতিয়া মাতিয়া।।
নামরসে খেলা বশে মত্ত সুধা পানে।
আহারাদি ক্ষুদা তৃষ্ণা না থাকিত মনে।।
গৌরীদাস গুণভাষ কহন না যায়।
অহরহ বদনেতে হরি গুণ গায়।।
থাকিতেন বৈষ্ণবদাসের হয়ে অনুগত।
বৈষ্ণব দেখিলে হইতেন পদানত।।
মাতৃ পিতৃ আজ্ঞা মানি করিতেন কার্য্য।
ভাতৃগণ আজ্ঞা করিতেন শিরধার্য্য।।
পৌগণ্ডেতে বালকের সঙ্গেতে মিশিয়া।
হরি হরি বলিতেন নাচিয়া নাচিয়া।।
স্বরূপ দাসের বাল্য লীলা চমৎকার।
পিতৃ সেবা মাতৃ সেবা বিশুদ্ধ আচার।।
ভাতৃগণ আজ্ঞাধীন সদা করে কায্য।
ভৃত্যবৎ ভ্রাতৃ পরিচরজাদি গাম্ভীর্য।।
অতিথি বৈষ্ণব পেলে করিত সেবন।
বালক বৈষ্ণব সঙ্গে নাম সংকীর্ত্তন।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তরে পুষ্পবন্ত কলি।
কাঁচা মধু পূর্ণ অফুটন্ত পুষ্প কলি।।
শ্রীহরি ভাস্কর জ্যোতি তাতে ভাতি দিল।
পুষ্পবন্ত কলি “ফুল্ল” জগৎ মাতিল।।
পুষ্পবন্ত কলি ধন্য বৈষ্ণবোপসনা।
সে রসে রস না কেন তারক রসনা।।
পয়ার
ফরিদপুর জিলা গ্রাম সফলা ডাঙ্গায়।
পঞ্চভ্রাতা জন্মিলেন এসে এ ধরায়।।
প্রভু আগমনে ধন্য হ’ল মত্ত্যপুরী।
বঙ্গদেশে ধন্য গ্রাম সফলা নগরী।।
অগ্রগন্য কৃষ্ণ দাস ভজনেতে।
শুদ্ধ্বাচারী কৃষ্ণ ভক্তে আর্তি বৈষ্ণবেতে।।
একাদশী উপবাসী তুলসী ভজন।
শ্রীহরি বাসর হরিব্রত পরায়ন।।
নাম সংকীর্ত্তন আদি সদা সাধু সঙ্গ।
অন্তরে মাধুর্য শুধু প্রেমের তরঙ্গ।।
বৈষ্ণব দাসের মন শুধু বৈষ্ণব সেবায়।
বৈষ্ণবের সঙ্গে রঙ্গে কৃষ্ণ গুণ গায়।।
প্রভুর অংশেতে জন্ম ভক্তি যুক্ত কায়।
ভক্তের হইয়া ভক্ত ভক্তি শিখায়।।
স্বয়ং এর প্রতিজ্ঞা এ চিরদিন রয়।
ভক্তের হইতে ভৃত্য মোর বাঞ্ছা হয়।।
জানেনা বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা বিনে।
গৃহেতে বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা দিনে।।
জিজ্ঞাসা করিত মাতা অন্নপূর্ণা ঠাঁই।
বলে মাগো আজ তো বৈষ্ণব আসে নাই।।
বৈষ্ণবের পাক করা লাবড়া ব্যঞ্জন।
বৈষ্ণব প্রসাদ নিতে বড়ই মনন।।
বৈষ্ণবে নিঃশ্বাস ছাড়ে হরে কৃষ্ণ বলে।
তখন আমার মনে আনন্দ উথলে।।
যার গলে মালা ভালে তিলক ধারন।
তারে গিয়া করিত বৈষ্ণব সম্বোধন।।
বালক নিকট যেত বাল্য খেলা লাগি।
বলে ভাই এস খেলি বৈরাগী বৈরাগী।।
একত্র হইয়া সব বালকের সনে।
বলে ভাই ভালো মাটি পাবো কোন খানে।।
যে স্থানে বিশুদ্ধ মাটি আনিত তুলিয়া।
অষ্টাঙ্গে লইত ফোঁটা সে মাটি গুলিয়া।।
বৈষ্ণবেরা যেমন পরিত বহির্বাস।
তেমতি পরিত নিজ পরিধান বাস।।
তুলসির চারা আনি করিত রোপণ।
বলে ভাই হেথা কর নাম সংকীর্ত্তন।।
হরি বলি বাহুতূলি নাচিয়া নাচিয়া।
ভূমে দিত গড়াগড়ি মাতিয়া মাতিয়া।।
নামরসে খেলা বশে মত্ত সুধা পানে।
আহারাদি ক্ষুদা তৃষ্ণা না থাকিত মনে।।
গৌরীদাস গুণভাষ কহন না যায়।
অহরহ বদনেতে হরি গুণ গায়।।
থাকিতেন বৈষ্ণবদাসের হয়ে অনুগত।
বৈষ্ণব দেখিলে হইতেন পদানত।।
মাতৃ পিতৃ আজ্ঞা মানি করিতেন কার্য্য।
ভাতৃগণ আজ্ঞা করিতেন শিরধার্য্য।।
পৌগণ্ডেতে বালকের সঙ্গেতে মিশিয়া।
হরি হরি বলিতেন নাচিয়া নাচিয়া।।
স্বরূপ দাসের বাল্য লীলা চমৎকার।
পিতৃ সেবা মাতৃ সেবা বিশুদ্ধ আচার।।
ভাতৃগণ আজ্ঞাধীন সদা করে কায্য।
ভৃত্যবৎ ভ্রাতৃ পরিচরজাদি গাম্ভীর্য।।
অতিথি বৈষ্ণব পেলে করিত সেবন।
বালক বৈষ্ণব সঙ্গে নাম সংকীর্ত্তন।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তরে পুষ্পবন্ত কলি।
কাঁচা মধু পূর্ণ অফুটন্ত পুষ্প কলি।।
শ্রীহরি ভাস্কর জ্যোতি তাতে ভাতি দিল।
পুষ্পবন্ত কলি “ফুল্ল” জগৎ মাতিল।।
পুষ্পবন্ত কলি ধন্য বৈষ্ণবোপসনা।
সে রসে রস না কেন তারক রসনা।।
মহাপ্রভু শ্রীহরিচাঁদের বাল্যলীলা
পয়ার
এইভাবে চারিভাই করে বাল্য খেলা।
এবে শুন মহাপ্রভুর স্বীয় বাল্যলীলা।।
মহাপ্রভু বাল্যকালে রাখিতেন গরু।
ধরিয়া গোপালবেশ বাঞ্ছাকল্পতরু।।
আবাধ্বনি দিয়া করে ধরিতেন তাল।
আনন্দে করিত নৃত্য গোধনের পাল।।
গোপনীয় ভাব যেন ছিল বৃন্দাবনে।
করিত তেমনি খেলা রাখালের সনে।।
ব্রজেতে যেমন ভাব ছিল ভঙ্গী বাঁকা।
সেইভাবে দাঁড়াতেন যষ্টি দিয়া ঠেকা।।
ভাব দেখে রাখালেরা জিজ্ঞাসিত নাম।
বলিতেন নাম কৃষ্ণ দূর্বাদল শ্যাম।।
পয়ার
এইভাবে চারিভাই করে বাল্য খেলা।
এবে শুন মহাপ্রভুর স্বীয় বাল্যলীলা।।
মহাপ্রভু বাল্যকালে রাখিতেন গরু।
ধরিয়া গোপালবেশ বাঞ্ছাকল্পতরু।।
আবাধ্বনি দিয়া করে ধরিতেন তাল।
আনন্দে করিত নৃত্য গোধনের পাল।।
গোপনীয় ভাব যেন ছিল বৃন্দাবনে।
করিত তেমনি খেলা রাখালের সনে।।
ব্রজেতে যেমন ভাব ছিল ভঙ্গী বাঁকা।
সেইভাবে দাঁড়াতেন যষ্টি দিয়া ঠেকা।।
ভাব দেখে রাখালেরা জিজ্ঞাসিত নাম।
বলিতেন নাম কৃষ্ণ দূর্বাদল শ্যাম।।
মহাপ্রভু শ্রীশ্রীহরিচাঁদের গোপালবেশ
ত্রিপদী
যখন পৌগণ্ডলীলা, রাখালের সঙ্গে খেলা,
করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।
গোপাল পাল হইতে, বাহুড়ী গেলে দূরেতে,
আবাধ্বনি করিত তখন।।
আবাধ্বনি শ্রুত হ’য়ে, গাভী বৃষভ আসিয়ে,
তৃণ বারি খাইত একত্রে।
প্রভু কহে গাভী এড়ে, যাইতে না পারে এঁড়ে,
বাঁধা আছে অলক্ষিত সূত্রে।।
কখন রাখালগণে, কহিত আনন্দ মনে,
হরিচাঁদ বাঞ্ছাকল্পতরু।
রাখালের প্রাণধন, হে নটবর! রঞ্জন,
নাটুয়া নাচাও দেখি গরু।।
হরিচাঁদ বলে ভাই, তোমাদের জ্ঞান নাই,
গরু নাচে মানুষের বোলে।
রাখালেরা কহে বাণী, আমরা তোমারে মানি,
ওরা মানিবে না কিবা বলে।।
হরিচাঁদ বলে কথা, সকলে আসিয়া হেথা,
ধেনু রাখি, যতেক রাখালে।
মানুষে মানুষ মানে, পশু না’চাব কেমনে,
আমি নহে বাজীকরের ছেলে।।
রাখালেরা বলে বুঝি, নিত্য যে দেখাও বাজী,
বাজীকর তুমি মন্দ নয়।
আবাধ্বনি দিয়া কেন, পালের গোধন আন,
তারা কি ডোরেতে বন্ধ রয়।।
তুমি রাখালের রাজা, আমরা তোমার প্রজা,
মোরা প্রজা ওরা কি প্রজা না।
আমরা বাক্য মেনেছি, নাচা’লে আমরা নাচি,
মোরা নাচি ওরা কি নাচে না।।
আমরা বাথানে থাকি, তব বাক্যে ধেনু রাখি,
পাল হ’তে অন্য ঠাই যায়।
দে, ব’লে দর্প করিলে, অমনি ফিরিয়া চলে,
ফেরে দেখি মোদের কথায়।।
হলধর হাল চাষে, দাপটে ফিরিয়া আসে,
চাষে বৃষে মাঠে ঘাটে রাখা।
রাখালেরা মনঃক্ষুন্ন, ইচ্ছামত পূর্ণব্রহ্ম,
দেখা-দেখা না দেখা না দেখা।।
রাখালের কথা শুনি, রাখালের শিরোমণি,
আবাধ্বনি দিয়া দাঁড়াইল।
পিছে পাঁচনী ঠেকায়ে, পদ পরে পদ দিয়ে,
ফিরাইয়া কবরী বাঁধিল।।
রাখালে বলে ডাকিয়া, নাচ আমারে ঘেরিয়া,
হুকাড়িয়া গোপালে দে হাঁক।
আবাধ্বনি ক’রে ক’রে, সবে ফুকারে ফুকারে,
উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণ বলে ডাক।।
শুনিয়া রাখাল সবে, কৃষ্ণ বলে উচ্চরবে,
নৃত্য করে ঠাকুরে ঘেরিয়া।
গো-গণের মুখ উচ্চ, উচ্চ কর্ণ উচ্চ পুচ্ছ,
নৃত্য করে নাচিয়া ধাইয়া।।
কখন বা নিজালয়, কখন মাতুলালয়,
করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।
গোষ্ঠেতে দেখিলে সর্প, করিতেন ঘোর দর্প,
ধেয়ে গিয়া করিতেন ধারণ।।
দেখি ঠাকুরের দর্প, পালাইত কাল সর্প,
কোন সর্পে ধরিতেন ফণী।
ঠাকুর পানে চাহিয়ে, সভয় প্রণাম হ’য়ে,
ফিরে দূরে যাইত অমনি।।
কোন ফণী বৃক্ষ পরে, ঠাকুর দেখিলে পরে,
বলিতেন রাখালগণেরে।
এনে দেরে বেত্র শিষ, তোরা অন্তরে থাকিস,
আমি আনি অই ফণী ধরে।।
শিষ অগ্র ফিরাইয়া, তাতে এক গ্রন্থি দিয়া,
ফাঁসি বানাইয়া ধরে ফণী।
ফণী টানিয়া আনিয়া, গোষ্ঠের মাঝেতে গিয়া,
ছেড়ে দিয়া খেলিত অমনি।।
গাইত পদ্ম-পুরাণ, মনসা ভাসাণ গান,
বেহুলার করুণ কাহিনী।
রাখালে দিতেন বলি, আমি সাপ ল’য়ে খেলি,
তোরা নাচ দিয়া হরিধ্বনি।।
হরিচাঁদের শ্রীঅঙ্গ, হেরিয়া কাল ভুজঙ্গ,
আর শুনি মনসার গান।
সর্পের চক্ষের জল, বহি যায় ছল ছল,
রাখালেরা হেরে হতজ্ঞান।।
দেখে রাখালেরা বলে, সাপুড়ে মন্ত্র শিখিলে,
কহ হরি কাহার নিকটে।
ঠাকুর কহিল সর্বে, ওরা যথা ছিল পূর্বে,
ভ্রমণ করেছি তার তটে।।
ওরা বড় ছিল খল, আমি দিনু প্রতিফল,
কাত্যায়নী নাম মন্ত্র গুণে।
দমন করেছি কালী, সেই হ’তে চিরকালি,
দেখে চিনে নাম শুনে মানে।।
নাটু আর বিশ্বনাথ, থাকিত ঠাকুর সাথ,
হরিচাঁদ প্রেমে বড় আর্তি।
যেখানে সেখানে যেত, সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইত,
কার্য করে আজ্ঞা অনুবর্তী।।
লইয়া রাখালগণ, করে গোষ্ঠ গোচারণ,
কভু বসে বৃক্ষের ছায়ায়।
আপনি হইয়া রাজা, খেলিতেন রাজা প্রজা,
এদিকে গোধন তৃণ খায়।।
যেই ভাব বৃন্দাবনে, খেলিতেন গোবর্ধনে,
সেই ভাবে এবে গোপালক।
হরিচাঁদ কৃপালেশে, পাগলচাঁদ আদেশে,
হরি লীলা রচিল তারক।।
ত্রিপদী
যখন পৌগণ্ডলীলা, রাখালের সঙ্গে খেলা,
করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।
গোপাল পাল হইতে, বাহুড়ী গেলে দূরেতে,
আবাধ্বনি করিত তখন।।
আবাধ্বনি শ্রুত হ’য়ে, গাভী বৃষভ আসিয়ে,
তৃণ বারি খাইত একত্রে।
প্রভু কহে গাভী এড়ে, যাইতে না পারে এঁড়ে,
বাঁধা আছে অলক্ষিত সূত্রে।।
কখন রাখালগণে, কহিত আনন্দ মনে,
হরিচাঁদ বাঞ্ছাকল্পতরু।
রাখালের প্রাণধন, হে নটবর! রঞ্জন,
নাটুয়া নাচাও দেখি গরু।।
হরিচাঁদ বলে ভাই, তোমাদের জ্ঞান নাই,
গরু নাচে মানুষের বোলে।
রাখালেরা কহে বাণী, আমরা তোমারে মানি,
ওরা মানিবে না কিবা বলে।।
হরিচাঁদ বলে কথা, সকলে আসিয়া হেথা,
ধেনু রাখি, যতেক রাখালে।
মানুষে মানুষ মানে, পশু না’চাব কেমনে,
আমি নহে বাজীকরের ছেলে।।
রাখালেরা বলে বুঝি, নিত্য যে দেখাও বাজী,
বাজীকর তুমি মন্দ নয়।
আবাধ্বনি দিয়া কেন, পালের গোধন আন,
তারা কি ডোরেতে বন্ধ রয়।।
তুমি রাখালের রাজা, আমরা তোমার প্রজা,
মোরা প্রজা ওরা কি প্রজা না।
আমরা বাক্য মেনেছি, নাচা’লে আমরা নাচি,
মোরা নাচি ওরা কি নাচে না।।
আমরা বাথানে থাকি, তব বাক্যে ধেনু রাখি,
পাল হ’তে অন্য ঠাই যায়।
দে, ব’লে দর্প করিলে, অমনি ফিরিয়া চলে,
ফেরে দেখি মোদের কথায়।।
হলধর হাল চাষে, দাপটে ফিরিয়া আসে,
চাষে বৃষে মাঠে ঘাটে রাখা।
রাখালেরা মনঃক্ষুন্ন, ইচ্ছামত পূর্ণব্রহ্ম,
দেখা-দেখা না দেখা না দেখা।।
রাখালের কথা শুনি, রাখালের শিরোমণি,
আবাধ্বনি দিয়া দাঁড়াইল।
পিছে পাঁচনী ঠেকায়ে, পদ পরে পদ দিয়ে,
ফিরাইয়া কবরী বাঁধিল।।
রাখালে বলে ডাকিয়া, নাচ আমারে ঘেরিয়া,
হুকাড়িয়া গোপালে দে হাঁক।
আবাধ্বনি ক’রে ক’রে, সবে ফুকারে ফুকারে,
উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণ বলে ডাক।।
শুনিয়া রাখাল সবে, কৃষ্ণ বলে উচ্চরবে,
নৃত্য করে ঠাকুরে ঘেরিয়া।
গো-গণের মুখ উচ্চ, উচ্চ কর্ণ উচ্চ পুচ্ছ,
নৃত্য করে নাচিয়া ধাইয়া।।
কখন বা নিজালয়, কখন মাতুলালয়,
করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।
গোষ্ঠেতে দেখিলে সর্প, করিতেন ঘোর দর্প,
ধেয়ে গিয়া করিতেন ধারণ।।
দেখি ঠাকুরের দর্প, পালাইত কাল সর্প,
কোন সর্পে ধরিতেন ফণী।
ঠাকুর পানে চাহিয়ে, সভয় প্রণাম হ’য়ে,
ফিরে দূরে যাইত অমনি।।
কোন ফণী বৃক্ষ পরে, ঠাকুর দেখিলে পরে,
বলিতেন রাখালগণেরে।
এনে দেরে বেত্র শিষ, তোরা অন্তরে থাকিস,
আমি আনি অই ফণী ধরে।।
শিষ অগ্র ফিরাইয়া, তাতে এক গ্রন্থি দিয়া,
ফাঁসি বানাইয়া ধরে ফণী।
ফণী টানিয়া আনিয়া, গোষ্ঠের মাঝেতে গিয়া,
ছেড়ে দিয়া খেলিত অমনি।।
গাইত পদ্ম-পুরাণ, মনসা ভাসাণ গান,
বেহুলার করুণ কাহিনী।
রাখালে দিতেন বলি, আমি সাপ ল’য়ে খেলি,
তোরা নাচ দিয়া হরিধ্বনি।।
হরিচাঁদের শ্রীঅঙ্গ, হেরিয়া কাল ভুজঙ্গ,
আর শুনি মনসার গান।
সর্পের চক্ষের জল, বহি যায় ছল ছল,
রাখালেরা হেরে হতজ্ঞান।।
দেখে রাখালেরা বলে, সাপুড়ে মন্ত্র শিখিলে,
কহ হরি কাহার নিকটে।
ঠাকুর কহিল সর্বে, ওরা যথা ছিল পূর্বে,
ভ্রমণ করেছি তার তটে।।
ওরা বড় ছিল খল, আমি দিনু প্রতিফল,
কাত্যায়নী নাম মন্ত্র গুণে।
দমন করেছি কালী, সেই হ’তে চিরকালি,
দেখে চিনে নাম শুনে মানে।।
নাটু আর বিশ্বনাথ, থাকিত ঠাকুর সাথ,
হরিচাঁদ প্রেমে বড় আর্তি।
যেখানে সেখানে যেত, সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইত,
কার্য করে আজ্ঞা অনুবর্তী।।
লইয়া রাখালগণ, করে গোষ্ঠ গোচারণ,
কভু বসে বৃক্ষের ছায়ায়।
আপনি হইয়া রাজা, খেলিতেন রাজা প্রজা,
এদিকে গোধন তৃণ খায়।।
যেই ভাব বৃন্দাবনে, খেলিতেন গোবর্ধনে,
সেই ভাবে এবে গোপালক।
হরিচাঁদ কৃপালেশে, পাগলচাঁদ আদেশে,
হরি লীলা রচিল তারক।।
রাখাল বিশ্বনাথের জীবন দান
পয়ার
একদিন শুন এক আশ্চর্য ঘটনা।
বিশ্বনাথ নামেতে রাখাল একজনা।।
গোধন চরাতে বিশ্বনাথ সাথে যায়।
সর্বক্ষণ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে রয়।।
যখন যে খেলা করে রাখাল স্বভাব।
তার মধ্যে মধুমাখা ঈশ্বরীয় ভাব।।
ঠাকুর থাকেন এক স্থানেতে বসিয়ে।
সবে মিলে খেলে আজ্ঞা অনুবর্তী হয়ে।।
রাখালেরা মিলিয়া বারিক করি লয়।
এক জন রাখে গরু বারিক সময়।।
প্রভু দেন আজ্ঞা করে শুন রে রাখাল।
ফিরাইয়া আন গিয়া গোধনের পাল।।
প্রভু দেন আজ্ঞা করে রাখালেরা শুনে।
ঠিক যেন পূর্ব ভার গিরি গোবর্ধনে।। (পূর্বভাব)
বিশ্বনাথ নামে এক রাখাল চতুর।
আত্মা সম ভাল তারে বাসিত ঠাকুর।।
সকল রাখাল এল গোষ্ঠ গোচারণে।
বিশ্বনাথ এল না দৈবের নির্বন্ধনে।।
ঠাকুর বলেন তবে সব সখাগণে।
সকলে আসিলি তোরা বিশে কোনখানে।।
নাটু কহে ওহে হরি কি কহিব আর।
আসিলাম বলিতে বিশের সমাচার।।
বিশের হ’য়েছে রাত্রে বিসূচিকা ব্যাধি।
মৃতপ্রায় সকলে করিতেছে কাঁদাকাঁদি।।
ঠাকুর বলেন নিদানের কর্তা আমি।
বিশাইর কি করিবে তুচ্ছ ভেদবমি।।
নাটুকে করিয়া সঙ্গে ঠাকুর চলিল।
হেনকালে বিশ্বনাথ অজ্ঞান হইল।।
বিশাইর হইয়াছে মৃত্যুর লক্ষণ।
ঘনশ্বাস বহে তার উত্তার নয়ন।।
বিশাইর জ্ঞাতি বন্ধু বলেছে সকলি।
বিশারে বাহিরে নিয়া কর অন্তর্জলী।।
হেনকালে প্রভু নাটু সঙ্গে তাড়াতাড়ি।
উঠিতেছে হরিচাঁদ বিশেদের বাড়ী।।
বিশার জননী কাঁদে আগুলিয়া পথ।
বলে আজ ছেড়ে যায় তোর বিশ্বনাথ।।
আর কি করিবি খেলা ল’য়ে বিশ্বনাথে।
প্রভু বলে আইলাম বিশারে কিনিতে।।
ঠাকুর বলেন বিশে শীঘ্র উঠে আয়।
বয়ে যায় রাখালিয়া খেলার সময়।।
খেলা ছাড়ি কেন বা রইলি অন্তর্জলে।
অন্তর্জলে তুই দেখে মোর অন্তর জ্বলে।।
এত বলি হস্ত ধরি বিশারে তুলিল।
নিদ্রা ভঙ্গে যেন বিশে গোষ্ঠেতে চলিল।।
বিশ্বনাথ গোঠে গেল ঠাকুরের সঙ্গে।
রাখাল মণ্ডলে গিয়া খেলা করে রঙ্গে।।
উঠিল মঙ্গল রোল জুড়িয়া মেদিনী।
বাল বৃদ্ধ যুবা করে জয় জয় ধ্বনি।।
কেহ বলে রামকান্ত দিয়াছিল বর।
এ ছেলে মনুষ্য নয় ব্রহ্ম পরাৎপর।।
কেহ বলে যশোমন্ত অতি নিষ্ঠা নর।
তার পুণ্যে হ’ল কোন দেব অবতার।।
বিশ্বনাথ উপাখ্যান শুনে যেই জন।
শমনের ভয় তার হয় নিবারণ।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।
প্রভুর পৌগণ্ড লীলা রচিল তারক।।
পয়ার
একদিন শুন এক আশ্চর্য ঘটনা।
বিশ্বনাথ নামেতে রাখাল একজনা।।
গোধন চরাতে বিশ্বনাথ সাথে যায়।
সর্বক্ষণ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে রয়।।
যখন যে খেলা করে রাখাল স্বভাব।
তার মধ্যে মধুমাখা ঈশ্বরীয় ভাব।।
ঠাকুর থাকেন এক স্থানেতে বসিয়ে।
সবে মিলে খেলে আজ্ঞা অনুবর্তী হয়ে।।
রাখালেরা মিলিয়া বারিক করি লয়।
এক জন রাখে গরু বারিক সময়।।
প্রভু দেন আজ্ঞা করে শুন রে রাখাল।
ফিরাইয়া আন গিয়া গোধনের পাল।।
প্রভু দেন আজ্ঞা করে রাখালেরা শুনে।
ঠিক যেন পূর্ব ভার গিরি গোবর্ধনে।। (পূর্বভাব)
বিশ্বনাথ নামে এক রাখাল চতুর।
আত্মা সম ভাল তারে বাসিত ঠাকুর।।
সকল রাখাল এল গোষ্ঠ গোচারণে।
বিশ্বনাথ এল না দৈবের নির্বন্ধনে।।
ঠাকুর বলেন তবে সব সখাগণে।
সকলে আসিলি তোরা বিশে কোনখানে।।
নাটু কহে ওহে হরি কি কহিব আর।
আসিলাম বলিতে বিশের সমাচার।।
বিশের হ’য়েছে রাত্রে বিসূচিকা ব্যাধি।
মৃতপ্রায় সকলে করিতেছে কাঁদাকাঁদি।।
ঠাকুর বলেন নিদানের কর্তা আমি।
বিশাইর কি করিবে তুচ্ছ ভেদবমি।।
নাটুকে করিয়া সঙ্গে ঠাকুর চলিল।
হেনকালে বিশ্বনাথ অজ্ঞান হইল।।
বিশাইর হইয়াছে মৃত্যুর লক্ষণ।
ঘনশ্বাস বহে তার উত্তার নয়ন।।
বিশাইর জ্ঞাতি বন্ধু বলেছে সকলি।
বিশারে বাহিরে নিয়া কর অন্তর্জলী।।
হেনকালে প্রভু নাটু সঙ্গে তাড়াতাড়ি।
উঠিতেছে হরিচাঁদ বিশেদের বাড়ী।।
বিশার জননী কাঁদে আগুলিয়া পথ।
বলে আজ ছেড়ে যায় তোর বিশ্বনাথ।।
আর কি করিবি খেলা ল’য়ে বিশ্বনাথে।
প্রভু বলে আইলাম বিশারে কিনিতে।।
ঠাকুর বলেন বিশে শীঘ্র উঠে আয়।
বয়ে যায় রাখালিয়া খেলার সময়।।
খেলা ছাড়ি কেন বা রইলি অন্তর্জলে।
অন্তর্জলে তুই দেখে মোর অন্তর জ্বলে।।
এত বলি হস্ত ধরি বিশারে তুলিল।
নিদ্রা ভঙ্গে যেন বিশে গোষ্ঠেতে চলিল।।
বিশ্বনাথ গোঠে গেল ঠাকুরের সঙ্গে।
রাখাল মণ্ডলে গিয়া খেলা করে রঙ্গে।।
উঠিল মঙ্গল রোল জুড়িয়া মেদিনী।
বাল বৃদ্ধ যুবা করে জয় জয় ধ্বনি।।
কেহ বলে রামকান্ত দিয়াছিল বর।
এ ছেলে মনুষ্য নয় ব্রহ্ম পরাৎপর।।
কেহ বলে যশোমন্ত অতি নিষ্ঠা নর।
তার পুণ্যে হ’ল কোন দেব অবতার।।
বিশ্বনাথ উপাখ্যান শুনে যেই জন।
শমনের ভয় তার হয় নিবারণ।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।
প্রভুর পৌগণ্ড লীলা রচিল তারক।।
মহাপ্রভুর গোষ্ঠলীলা ও ফুলসজ্জা
পয়ার
পৌগণ্ড সময় করিতেন গোষ্ঠলীলা।
প্রথম কৈশোরে করিতেন সেই খেলা।।
রাখাল সঙ্গেতে করিতেন গোচারণ।
নূতন মাধুর্য খেলা খেলিত তখন।।
গোপাল রাখিতে হ’ত গোপাল আবেশ।
গোপালক সঙ্গে হ’ত গোপালের বেশ।।
খেলিতে খেলিতে সঙ্গীগণ সমিভ্যরে।
যাইতেন রত্নডাঙ্গা বিলের ভিতরে।।
বলিতেন সঙ্গীগণে থেকে বিলকূল।
উঠাইয়া আন গিয়া কস্তূরীর ফুল।।
আন ভাই অই ফুল আমি অঙ্গে পরি।
রাখালেরা এনে দিত কুসুম কস্তূরী।।
সেই কস্তূরীর ফুল পরিত কর্ণেতে।
পদ পরে পদ রেখে দাড়া’ত ভঙ্গিতে।।
বলিত রাখালগণে ওরে ভাই সব।
একবার কর সবে আবা আবা রব।।
ঠাকুরে ঘেরিয়া সবে দিত আবাধ্বনি।
গাভী বৎস্য নাচিত মধুর রব শুনি।।
বাঁকা সাজে দাঁড়াতেন কর্ণে ফুল দিয়া।
কটি বেড়ি দিত ফুল গুজিয়া গুজিয়া।।
উভ করি মস্তকেতে বাঁধিতেন চুল।
মাথা বেড়ি গুজে দিত কস্তূরীর ফুল।।
মনোহর বেশ দেখে কাঁদিত রাখাল।
গো-বৎস্য নাচিত চক্ষে অবিরত জল।।
কখন কখন ফুল আনিতেন নিজে।
অই ভাবে কস্তূরীর ফুল সাজে সেজে।।
বসিতেন গিয়া প্রভু রাখালের মাঝ।
ঠিক যেন বৃন্দাবনে রাখালের রাজ।।
পরিধান বসন জলেতে ভিজাইয়ে।
রাখালে প্রভুর পদ দিত ধোয়াইয়ে।।
ধোয়াইত পাদ-পদ্ম বস্ত্র চিপাড়িয়ে।
সেই ভিজা বসনেতে দিত মুছাইয়ে।।
সখাভাবে রাখালেরা করিত কাকুতি।
আমরা রাখাল তুই রাখালের পতি।।
জনমে জনমে ভাই সঙ্গেতে রাখিস।
এই ভাবে সাজিয়া মোদের দেখা দিস।।
এই ফুলে সাজিলে দেখায় কিবা শোভা।
(এক লাইন জ্ঞাপ)
সঙ্গে রেখ হরিরে! গোচারণ-বিহারী।
এই খেলা খেলিতে আমরা যেন পারি।।
প্রভু বলে গরু রাখি রাখালের সনে।
রাখাল রাজার রূপ পড়ে মোর মনে।।
সেই রাখালিয়া ভাব ক্রমে হয় বৃদ্ধি।
কস্তূরীর ফুলে সাজি রাখালিয়া বুদ্ধি।।
তোমরাও যে রাখাল আমি সে রাখাল।
কলিতে কস্তূরী ত্রেতাযুগে নীলোৎপল।।
ত্রেতাযুগে পুঁজে রাম দেবীর চরণ।
দেবীদহ হ’তে করে এ ফুল চয়ন।।
মর্তে এসে নীলোৎপল হইল কস্তূরী।
সাধারণ লোকে বলে কচড়ী কচড়ী।।
কালগুণে মহতেরা তেজ লুকাইয়া।
গোপনে থাকেন তারা ঈশ্বর ভাসিয়া।। (ভাবিয়া)
তাহাতে কি মহতের মান কমে যায়।
জহরী জহর পেলে চিনে সেই লয়।।
মাঝে মাঝে শুনে থাকি গীত রামায়ণ।
শ্রীরাম দেবীর পুজা করিল যখন।।
করিলেন দেবীর পূজা সংকল্প করিয়া।
শতাধিক অস্টপদ্ম দিলেন গণিয়া।।
ফুল হেরে প্রসন্না প্রসন্নময়ী দুর্গে।
এক পদ্ম হরণ করিল পূজা অগ্রে।।
সবে বলে রাম প্রতি দেবী প্রতিকুল।
নতুবা বল কে নিল নীল পদ্ম ফুল।।
সেই পদ্ম রামচন্দ্র পূরণ করিতে।
উদ্যত হইল নীলপদ্ম চক্ষু দিতে।।
চক্ষু লক্ষ্য করি কমলাক্ষ জুড়ে বাণ।
বলে এই পদ্মে কর পূজা সমাধান।।
তাহা দেখি মহামায়া হ’য়ে তুস্টমতি।
বলে ক্ষান্ত হও শান্ত ওহে রঘুপতি।।
নীলপদ্ম দেখি মম প্রফুল্লিত মন।
তাই এক পদ্ম অগ্রে করেছি গ্রহণ।।
না পূজিতে অগ্রে পূজা ল’য়েছি তোমার।
হাতে ধরি হও ক্ষান্ত ওহে রঘুবর।।
এই সেই রাজীব হে রাজীবলোচন।
এই কীর্তি তোমার ঘষিবে ত্রিভুবন।।
অকাল বোধন করে রাম দয়াময়।
কস্তূরী কুসুম পেয়ে দেবী তুস্টা হয়।।
বসন্তে বাসন্তী দুর্গা পূজিত সবায়।
রাম হ’তে আশ্বিনে অম্বিকা পূজা হয়।।
সেই নীলপদ্ম ফুল এই কলিকালে।
কস্তূরীর ফুল বিলে সাজি সেই ফুলে।।
এ বড় দুঃখের ফুল দুঃখের সময়।
হৃদয় ধরিলে হয় ভক্তি প্রেমোদয়।।
তাহা শুনি রাখালেরা ডাকে মা মা করি।
প্রেমানন্দে বলে জয় রাম দুর্গা হরি।।
শ্রীহরি ফুলসজ্জা কস্তূরীর কুসুমে।
রাখালের আনন্দ যেন বৃন্দাবন ধামে।।
শ্রীহরির ফুলসজ্জা ভুবনমোহন।
হরি ঘেরি, করে সবে হরি সংকীর্তন।।
রত্নডাঙ্গা বিলকূলে রত্ন উপজিল।
তারকের মহানন্দ হরি হরি বল।।
মৃত্যুঞ্জয় আজ্ঞা দিল রচনা কারণে।
অপারক তারক রচিল তার গুণে।।
কতক দিনের পরে হইল রচনা।
হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজনা।।
পয়ার
পৌগণ্ড সময় করিতেন গোষ্ঠলীলা।
প্রথম কৈশোরে করিতেন সেই খেলা।।
রাখাল সঙ্গেতে করিতেন গোচারণ।
নূতন মাধুর্য খেলা খেলিত তখন।।
গোপাল রাখিতে হ’ত গোপাল আবেশ।
গোপালক সঙ্গে হ’ত গোপালের বেশ।।
খেলিতে খেলিতে সঙ্গীগণ সমিভ্যরে।
যাইতেন রত্নডাঙ্গা বিলের ভিতরে।।
বলিতেন সঙ্গীগণে থেকে বিলকূল।
উঠাইয়া আন গিয়া কস্তূরীর ফুল।।
আন ভাই অই ফুল আমি অঙ্গে পরি।
রাখালেরা এনে দিত কুসুম কস্তূরী।।
সেই কস্তূরীর ফুল পরিত কর্ণেতে।
পদ পরে পদ রেখে দাড়া’ত ভঙ্গিতে।।
বলিত রাখালগণে ওরে ভাই সব।
একবার কর সবে আবা আবা রব।।
ঠাকুরে ঘেরিয়া সবে দিত আবাধ্বনি।
গাভী বৎস্য নাচিত মধুর রব শুনি।।
বাঁকা সাজে দাঁড়াতেন কর্ণে ফুল দিয়া।
কটি বেড়ি দিত ফুল গুজিয়া গুজিয়া।।
উভ করি মস্তকেতে বাঁধিতেন চুল।
মাথা বেড়ি গুজে দিত কস্তূরীর ফুল।।
মনোহর বেশ দেখে কাঁদিত রাখাল।
গো-বৎস্য নাচিত চক্ষে অবিরত জল।।
কখন কখন ফুল আনিতেন নিজে।
অই ভাবে কস্তূরীর ফুল সাজে সেজে।।
বসিতেন গিয়া প্রভু রাখালের মাঝ।
ঠিক যেন বৃন্দাবনে রাখালের রাজ।।
পরিধান বসন জলেতে ভিজাইয়ে।
রাখালে প্রভুর পদ দিত ধোয়াইয়ে।।
ধোয়াইত পাদ-পদ্ম বস্ত্র চিপাড়িয়ে।
সেই ভিজা বসনেতে দিত মুছাইয়ে।।
সখাভাবে রাখালেরা করিত কাকুতি।
আমরা রাখাল তুই রাখালের পতি।।
জনমে জনমে ভাই সঙ্গেতে রাখিস।
এই ভাবে সাজিয়া মোদের দেখা দিস।।
এই ফুলে সাজিলে দেখায় কিবা শোভা।
(এক লাইন জ্ঞাপ)
সঙ্গে রেখ হরিরে! গোচারণ-বিহারী।
এই খেলা খেলিতে আমরা যেন পারি।।
প্রভু বলে গরু রাখি রাখালের সনে।
রাখাল রাজার রূপ পড়ে মোর মনে।।
সেই রাখালিয়া ভাব ক্রমে হয় বৃদ্ধি।
কস্তূরীর ফুলে সাজি রাখালিয়া বুদ্ধি।।
তোমরাও যে রাখাল আমি সে রাখাল।
কলিতে কস্তূরী ত্রেতাযুগে নীলোৎপল।।
ত্রেতাযুগে পুঁজে রাম দেবীর চরণ।
দেবীদহ হ’তে করে এ ফুল চয়ন।।
মর্তে এসে নীলোৎপল হইল কস্তূরী।
সাধারণ লোকে বলে কচড়ী কচড়ী।।
কালগুণে মহতেরা তেজ লুকাইয়া।
গোপনে থাকেন তারা ঈশ্বর ভাসিয়া।। (ভাবিয়া)
তাহাতে কি মহতের মান কমে যায়।
জহরী জহর পেলে চিনে সেই লয়।।
মাঝে মাঝে শুনে থাকি গীত রামায়ণ।
শ্রীরাম দেবীর পুজা করিল যখন।।
করিলেন দেবীর পূজা সংকল্প করিয়া।
শতাধিক অস্টপদ্ম দিলেন গণিয়া।।
ফুল হেরে প্রসন্না প্রসন্নময়ী দুর্গে।
এক পদ্ম হরণ করিল পূজা অগ্রে।।
সবে বলে রাম প্রতি দেবী প্রতিকুল।
নতুবা বল কে নিল নীল পদ্ম ফুল।।
সেই পদ্ম রামচন্দ্র পূরণ করিতে।
উদ্যত হইল নীলপদ্ম চক্ষু দিতে।।
চক্ষু লক্ষ্য করি কমলাক্ষ জুড়ে বাণ।
বলে এই পদ্মে কর পূজা সমাধান।।
তাহা দেখি মহামায়া হ’য়ে তুস্টমতি।
বলে ক্ষান্ত হও শান্ত ওহে রঘুপতি।।
নীলপদ্ম দেখি মম প্রফুল্লিত মন।
তাই এক পদ্ম অগ্রে করেছি গ্রহণ।।
না পূজিতে অগ্রে পূজা ল’য়েছি তোমার।
হাতে ধরি হও ক্ষান্ত ওহে রঘুবর।।
এই সেই রাজীব হে রাজীবলোচন।
এই কীর্তি তোমার ঘষিবে ত্রিভুবন।।
অকাল বোধন করে রাম দয়াময়।
কস্তূরী কুসুম পেয়ে দেবী তুস্টা হয়।।
বসন্তে বাসন্তী দুর্গা পূজিত সবায়।
রাম হ’তে আশ্বিনে অম্বিকা পূজা হয়।।
সেই নীলপদ্ম ফুল এই কলিকালে।
কস্তূরীর ফুল বিলে সাজি সেই ফুলে।।
এ বড় দুঃখের ফুল দুঃখের সময়।
হৃদয় ধরিলে হয় ভক্তি প্রেমোদয়।।
তাহা শুনি রাখালেরা ডাকে মা মা করি।
প্রেমানন্দে বলে জয় রাম দুর্গা হরি।।
শ্রীহরি ফুলসজ্জা কস্তূরীর কুসুমে।
রাখালের আনন্দ যেন বৃন্দাবন ধামে।।
শ্রীহরির ফুলসজ্জা ভুবনমোহন।
হরি ঘেরি, করে সবে হরি সংকীর্তন।।
রত্নডাঙ্গা বিলকূলে রত্ন উপজিল।
তারকের মহানন্দ হরি হরি বল।।
মৃত্যুঞ্জয় আজ্ঞা দিল রচনা কারণে।
অপারক তারক রচিল তার গুণে।।
কতক দিনের পরে হইল রচনা।
হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজনা।।
শ্রীগৌরাঙ্গের হস্ত গণনা।
পয়ার।
এমন আশ্চর্যলীলা সকলে দেখিল।
তবু প্রভু পেয়ে কেহ চিনিতে নারিল।।
হেন মায়া স্বয়ং এর যুগে যুগে আছে।
মানুষ লীলার বেলা কে কবে চিনেছে।।
বদনে ব্রহ্মাণ্ড দেখাইল যশোদারে।
বাৎসল্য তাচ্ছিল্যজ্ঞানে চিনিতে না পারে।।
যখন গৌরাঙ্গ রায় শচী মার ঘরে।
আমি সেই আমি সেই বলে বারে বারে।।
সুরধনী গঙ্গা জন্মে আমার চরণে।
ডুবিলি মায়ার কূপে আমারে না চিনে।।
নদীয়ার নর নারী শচীমাকে কয়।
পড়িতে পড়িতে উহার বায়ু ঊর্ধ্ব হয়।।
গ্রহণের বেড়ী ভব বন্ধন চরণে।
বিষ্ণুতৈল শিরে দেয় শিখার মুণ্ডনে।।
আপনি হইয়া শান্ত জগৎ রঞ্জন।
জ্যোতির্জ্ঞ পণ্ডিত কাছে দিল দরশন।।
সামুদ্রিক জানে ভাল হস্ত অঙ্ক দেখে। (জ্ঞানে)
তিন জনমের কথা বলে দেয় লোকে।।
তার ঠাই গিয়া বলে গৌরাঙ্গ সুন্দর।
তিন জনমের বার্তা কহত আমার।।
গণক বলেন আমি পাই গণনায়।
পূর্বে তুমি কৃষ্ণ ছিলে যশোদা তনয়।।
নন্দ নামে গোপ বৈশ্য ছিল তব পিতা।
আমার গণনা কভু না হইবে মিথ্যা।।
তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।
এ গণনা ভুল অদ্য হ’য়েছে আমার।।
প্রভু কন হে ঠাকুর আর আছে কার্য।
এর পূর্বে কে ছিলাম করে দেহ ধার্য।।
গণক বলেন তবে ফিরে ধরি হাত।
এর পূর্ব জন্মে তুমি ছিলে রঘুনাথ।।
দশরথ পুত্র তুমি কৌশল্যা উদরে।
চারি অংশে জন্ম নিলা অযোধ্যানগরে।।
গণনাতে টের পাই তোমার যে নাম।
জগৎ মন রমতে তুমি ছিলে রাম।।
তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।
নিশ্চয় গণনা ভ্রান্তি হ’য়েছে আমার।।
কালীয় দমন করে ডুবে কালীদয়।
রাণী ব’লে বাঁচাইল কাত্যায়নী মায়।।
যখন করেন লীলা মানব রূপেতে।
তখন তাঁহাকে কেহ না পারে চিনিতে।।
যোগে বসি ধ্যান করে যত মুনিগণ।
একা গর্গ ধ্যান করে জানিল তখন।।
কণ্বমুনি পারণা করিতে নিবেদয়।
আপনি আসিয়া কৃষ্ণ তার অন্ন খায়।।
ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে মুনিবর কয়।
গোয়ালের ছেলে মোর অন্ন মেরে দেয়।।
যশোদা রাখিল বেঁধে তবু এসে খায়।
ক্রোধ দেখি যশোদা ধরিল মুনি পায়।।
যশোদা বলেরে কৃষ্ণ অন্ন মার কেনে।
কৃষ্ণ বলে আমারে ডাকিল কি কারণে।।
গৃহে বাঁধা এক কৃষ্ণ আর কৃষ্ণ খায়।
তবু মুনি চিনিতে নারিল দয়াময়।।
বিস্ময় মানিয়া মুনি ধ্যানস্থ হইল।
ধ্যান করি বিশ্ব হরি তবে সে চিনিল।।
কার্যক্ষেত্রে তাঁহারে না চিনে কোনজন।
পূর্বেতে যেমন ভাব এখন তেমন।।
সেই মত লীলা করে যশোমন্ত সুত।
শুনিতে তাঁহার লীলা বড়ই অদ্ভুত।।
শ্রবণে কলুষ ক্ষয় গোলোকেতে বাস।
কৃষ্ণভক্তি লাভ হয় কর্মকাণ্ড নাশ।।
পাপে ধরা পরিপূর্ণ পাপাচ্ছন্ন তায়।
মন্দ সন্দ অন্ধকারে হরি চন্দ্রোদয়।।
শ্রীহরি চরিত্র সুধা রসনা রসিল। (রচিল)
হরি প্রেমানন্দে সবে হরি হরি বল।।
পয়ার।
এমন আশ্চর্যলীলা সকলে দেখিল।
তবু প্রভু পেয়ে কেহ চিনিতে নারিল।।
হেন মায়া স্বয়ং এর যুগে যুগে আছে।
মানুষ লীলার বেলা কে কবে চিনেছে।।
বদনে ব্রহ্মাণ্ড দেখাইল যশোদারে।
বাৎসল্য তাচ্ছিল্যজ্ঞানে চিনিতে না পারে।।
যখন গৌরাঙ্গ রায় শচী মার ঘরে।
আমি সেই আমি সেই বলে বারে বারে।।
সুরধনী গঙ্গা জন্মে আমার চরণে।
ডুবিলি মায়ার কূপে আমারে না চিনে।।
নদীয়ার নর নারী শচীমাকে কয়।
পড়িতে পড়িতে উহার বায়ু ঊর্ধ্ব হয়।।
গ্রহণের বেড়ী ভব বন্ধন চরণে।
বিষ্ণুতৈল শিরে দেয় শিখার মুণ্ডনে।।
আপনি হইয়া শান্ত জগৎ রঞ্জন।
জ্যোতির্জ্ঞ পণ্ডিত কাছে দিল দরশন।।
সামুদ্রিক জানে ভাল হস্ত অঙ্ক দেখে। (জ্ঞানে)
তিন জনমের কথা বলে দেয় লোকে।।
তার ঠাই গিয়া বলে গৌরাঙ্গ সুন্দর।
তিন জনমের বার্তা কহত আমার।।
গণক বলেন আমি পাই গণনায়।
পূর্বে তুমি কৃষ্ণ ছিলে যশোদা তনয়।।
নন্দ নামে গোপ বৈশ্য ছিল তব পিতা।
আমার গণনা কভু না হইবে মিথ্যা।।
তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।
এ গণনা ভুল অদ্য হ’য়েছে আমার।।
প্রভু কন হে ঠাকুর আর আছে কার্য।
এর পূর্বে কে ছিলাম করে দেহ ধার্য।।
গণক বলেন তবে ফিরে ধরি হাত।
এর পূর্ব জন্মে তুমি ছিলে রঘুনাথ।।
দশরথ পুত্র তুমি কৌশল্যা উদরে।
চারি অংশে জন্ম নিলা অযোধ্যানগরে।।
গণনাতে টের পাই তোমার যে নাম।
জগৎ মন রমতে তুমি ছিলে রাম।।
তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।
নিশ্চয় গণনা ভ্রান্তি হ’য়েছে আমার।।
কালীয় দমন করে ডুবে কালীদয়।
রাণী ব’লে বাঁচাইল কাত্যায়নী মায়।।
যখন করেন লীলা মানব রূপেতে।
তখন তাঁহাকে কেহ না পারে চিনিতে।।
যোগে বসি ধ্যান করে যত মুনিগণ।
একা গর্গ ধ্যান করে জানিল তখন।।
কণ্বমুনি পারণা করিতে নিবেদয়।
আপনি আসিয়া কৃষ্ণ তার অন্ন খায়।।
ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে মুনিবর কয়।
গোয়ালের ছেলে মোর অন্ন মেরে দেয়।।
যশোদা রাখিল বেঁধে তবু এসে খায়।
ক্রোধ দেখি যশোদা ধরিল মুনি পায়।।
যশোদা বলেরে কৃষ্ণ অন্ন মার কেনে।
কৃষ্ণ বলে আমারে ডাকিল কি কারণে।।
গৃহে বাঁধা এক কৃষ্ণ আর কৃষ্ণ খায়।
তবু মুনি চিনিতে নারিল দয়াময়।।
বিস্ময় মানিয়া মুনি ধ্যানস্থ হইল।
ধ্যান করি বিশ্ব হরি তবে সে চিনিল।।
কার্যক্ষেত্রে তাঁহারে না চিনে কোনজন।
পূর্বেতে যেমন ভাব এখন তেমন।।
সেই মত লীলা করে যশোমন্ত সুত।
শুনিতে তাঁহার লীলা বড়ই অদ্ভুত।।
শ্রবণে কলুষ ক্ষয় গোলোকেতে বাস।
কৃষ্ণভক্তি লাভ হয় কর্মকাণ্ড নাশ।।
পাপে ধরা পরিপূর্ণ পাপাচ্ছন্ন তায়।
মন্দ সন্দ অন্ধকারে হরি চন্দ্রোদয়।।
শ্রীহরি চরিত্র সুধা রসনা রসিল। (রচিল)
হরি প্রেমানন্দে সবে হরি হরি বল।।
জ্ঞানযোগ ও রস প্রকরণ।
পয়ার।
শ্রীরামে যখন বিশ্বামিত্র ল’য়ে গেল।
স্বয়ং জানিয়া তবু মন্ত্র শিক্ষা দিল।।
তাড়কা বধিতে যবে রাম ছাড়ে বাণ।
বিশ্বামিত্র কেন ভীত হইল অজ্ঞান।।
পারে কিনা পারে রাম বধিতে তাড়কা।
তিন জনে খাইবেক যদি পায় দেখা।।
যদ্যপি বৈকুণ্ঠপতি বিষ্ণু অবতার।
তথাপি শ্রীরামরূপে মানুষ আকার।।
যখন বশিষ্ঠ মুনি অভিষেক করে।
সাগরের জলে স্নান করা’ল রামেরে।।
চারি সাগরের জল মুনি আনাইল।
শ্রীরামে ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করাইল।।
যদ্যপি জানেন রাম সংসারের সার।
তথাপি করা’ল রামে মানুষ আচার।।
লীলার সময় সবে তেমতি জানিবে।
স্বয়ং জানিলে সেও নরভাবে ভাবে।।
ভূ-ভার হরণ তার প্রতিজ্ঞা সমস্ত।
অসুরের মুণ্ডচ্ছেদ ধরি ধনু অস্ত্র।।
গৌরাঙ্গ লীলায় দয়া অস্ত্র ধনু ধরি।
কলির কলুষ নাশ করিল শ্রীহরি।।
লিখিলেন গোস্বামীরা অস্ত্র সাঙ্গোপাঙ্গ।
করিলেন পাষণ্ড দলন শ্রীগৌরাঙ্গ।।
ধন্য লীলা প্রেম-ভক্তি করিল প্রকাশ।
রামচন্দ্র নরোত্তম প্রভু শ্রীনিবাস।।
তবু নাহি গেল বৈষ্ণবের কুটিনাটি।
জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড বিষয় ভ্রুকুটি।।
বৈষ্ণবের পক্ষে হরি ভকতি বিলাস।
লিখিলেন গ্রন্থ কবিরাজ কৃষ্ণদাস।।
তাহার মধ্যেতে প্রকাশিল বিধি ভক্তি।
বিধি ভক্তে নাহি হয় ব্রজভাব প্রাপ্তি।।
স্বয়ং এর শ্রীমুখের বাক্য নিদর্শন।
চৈতন্য চরিতামৃত মঙ্গলাচরণ।।
এবে দয়া প্রকাশিয়া প্রভু হরিচাঁদ।
বৈষ্ণবের কাটিলেন নাম অপরাধ।।
জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড মুক্তি অষ্টপাশ।
দয়া সুদর্শনে কাটিলেন হরিদাস।।
ভক্তি অঙ্গ জানাইতে নাম হরিদাস।
আপনি আপনা লীলা করেন প্রকাশ।।
বিরাগ বিশুদ্ধ প্রেম ভক্তি আচরণ।
রাগ ভক্তি দিয়া মাতাইল সর্বজন।।
গৃহে থেকে প্রেম ভক্তি সেই হয় শ্রেষ্ঠ।
অনুরাগ বিরাগেতে প্রেম ইষ্ট নিষ্ঠ।।
সাক্ষী তার কাশিখণ্ডে দেবতা সবাই।
শুনিলেন ধর্মকথা লোপামুদ্রা ঠাই।।
গৃহকর্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয়।
বাণপ্রস্থ পরমহংস তার তুল্য নয়।।
গয়া গঙ্গা প্রয়াগ পুষ্কর দ্বারাবতী।
প্রভাস নর্মদা কুরুক্ষেত্র সরস্বতী।।
পৃথিবীর পুণ্য ক্ষেত্র আছে যত্র যত্র।
সব তীর্থ শ্রেষ্ঠ সে প্রয়াগ পুণ্যক্ষেত্র।।
যত যত তীর্থ আছে অবনী ভিতরে।
সত্য বাক্য সমকক্ষ হইতে না পারে।।
পর অন্ন খায় যে বা তীর্থধামে যায়।
ষড়াংশের এক অংশ ফল সেই পায়।।
বাণিজ্য কারণে যে বা তীর্থধামে যায়।
তীর্থের নাহিক ফল বাণিজ্য সে পায়।।
দেহের ইন্দ্রিয় বশ না হয়েছে যার।
তীর্থে গেলে ফলপ্রাপ্তি না হইবে তার।।
দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন।
তার দরশনে সব তীর্থ দরশন।।
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয়।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।।
অনুধ্বজ, শিখিধ্বজ, সুধন্বা, সুরথ।
অম্বরীষ, বিভীষণ, রঘু, ভগিরথ।।
প্রহলাদ, নারদ, শুক, ধ্রুব, মুচুকন্দ।
বিদুর, গুহক, বলী, শ্রীসহস্রস্কন্দ।।
এ সব গৃহস্থ নর বিধি ভক্তি রসে।
অন্তরঙ্গ ভক্ত সব থাকে গৃহবাসে।।
তার মধ্যে পঞ্চ অঙ্গ অতি অন্তরঙ্গ।
দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর পঞ্চঅঙ্গ।।
শান্তভাব নিষ্ঠা-বতী চারি রসে রয়।
শান্ত রস রতি নিষ্ঠা পঞ্চ অঙ্গ কয়।।
অনর্পিত চরিং চিরাৎ শ্লোকে বাখানি।
লিখে বিল্বমঙ্গল উজ্জ্বল নীলমণি।।
অতি অন্তরঙ্গ মধ্যে করিয়াছে ঠিক।
তিন প্রভু ছয় গোঁসাই পঞ্চ রসিক।।
ইহারা সকলে মাত্র গৃহাশ্রমী হয়।
গৃহত্যাগী শেষে হয় গোস্বামীরা ছয়।।
ঢাকিয়া রসিক ধর্ম গৃহধর্ম দিয়া।
অবনীতে অবতীর্ণ শ্রীহরি আসিয়া।।
গৃহধর্ম লভিবেক যজিবে যাজন।
অন্তরঙ্গ রসিক হইবে সেই জন।।
পূর্বে যার যেই পথ আছে জানাজানি।
এদানি লইবে তারে সেই পথে টানি।।
বিশ্বনাথে বাঁচাইয়া হরিচাঁদ নিল।
সেই বিশ্বনাথ শেষে দরবেশ হ’ল।।
করেছেন কত লীলা পৌগণ্ড সময়।
লিখিতে অসাধ্য মোর পুঁথি বেড়ে যায়।।
কিছুদিন পরে হ’ল গোচারণ সায়।
বিবাহ করিল প্রভু কৈশোর সময়।।
ঠাকুরের জন্ম অগ্রে পরে যে সময়।
রামকান্ত আসিতেন মোহান্ত আলয়।।
বৈরাগী ব্রাহ্মণ আদি অতিথি আসিত।
কারু না কহিত প্রভু নিজ মনোনীত।।
নিন্দা কি বন্দনা কারু কিছু না করিত।
রামকান্ত এলে গিয়া পদে লোটাইত।।
কিছু অন্তরেতে রামকান্তে ল’য়ে যেত।
দুই প্রভু একাসনে নির্জনে বসিত।।
রামকান্তে বলিতেন তুমি মম গুরু।
যুগে যুগে তুমি মোর বাঞ্ছাকল্পতরু।।
এইভাবে রামকান্তে করিতেন স্তুতি।
কথোপকথনে কাটাতেন দিবারাতি।।
প্রভু সব মনোবৃত্তি কান্তে জানাইল।
মধুময় শ্রীহরি চরিত্র হরিবল।।
পয়ার।
শ্রীরামে যখন বিশ্বামিত্র ল’য়ে গেল।
স্বয়ং জানিয়া তবু মন্ত্র শিক্ষা দিল।।
তাড়কা বধিতে যবে রাম ছাড়ে বাণ।
বিশ্বামিত্র কেন ভীত হইল অজ্ঞান।।
পারে কিনা পারে রাম বধিতে তাড়কা।
তিন জনে খাইবেক যদি পায় দেখা।।
যদ্যপি বৈকুণ্ঠপতি বিষ্ণু অবতার।
তথাপি শ্রীরামরূপে মানুষ আকার।।
যখন বশিষ্ঠ মুনি অভিষেক করে।
সাগরের জলে স্নান করা’ল রামেরে।।
চারি সাগরের জল মুনি আনাইল।
শ্রীরামে ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করাইল।।
যদ্যপি জানেন রাম সংসারের সার।
তথাপি করা’ল রামে মানুষ আচার।।
লীলার সময় সবে তেমতি জানিবে।
স্বয়ং জানিলে সেও নরভাবে ভাবে।।
ভূ-ভার হরণ তার প্রতিজ্ঞা সমস্ত।
অসুরের মুণ্ডচ্ছেদ ধরি ধনু অস্ত্র।।
গৌরাঙ্গ লীলায় দয়া অস্ত্র ধনু ধরি।
কলির কলুষ নাশ করিল শ্রীহরি।।
লিখিলেন গোস্বামীরা অস্ত্র সাঙ্গোপাঙ্গ।
করিলেন পাষণ্ড দলন শ্রীগৌরাঙ্গ।।
ধন্য লীলা প্রেম-ভক্তি করিল প্রকাশ।
রামচন্দ্র নরোত্তম প্রভু শ্রীনিবাস।।
তবু নাহি গেল বৈষ্ণবের কুটিনাটি।
জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড বিষয় ভ্রুকুটি।।
বৈষ্ণবের পক্ষে হরি ভকতি বিলাস।
লিখিলেন গ্রন্থ কবিরাজ কৃষ্ণদাস।।
তাহার মধ্যেতে প্রকাশিল বিধি ভক্তি।
বিধি ভক্তে নাহি হয় ব্রজভাব প্রাপ্তি।।
স্বয়ং এর শ্রীমুখের বাক্য নিদর্শন।
চৈতন্য চরিতামৃত মঙ্গলাচরণ।।
এবে দয়া প্রকাশিয়া প্রভু হরিচাঁদ।
বৈষ্ণবের কাটিলেন নাম অপরাধ।।
জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড মুক্তি অষ্টপাশ।
দয়া সুদর্শনে কাটিলেন হরিদাস।।
ভক্তি অঙ্গ জানাইতে নাম হরিদাস।
আপনি আপনা লীলা করেন প্রকাশ।।
বিরাগ বিশুদ্ধ প্রেম ভক্তি আচরণ।
রাগ ভক্তি দিয়া মাতাইল সর্বজন।।
গৃহে থেকে প্রেম ভক্তি সেই হয় শ্রেষ্ঠ।
অনুরাগ বিরাগেতে প্রেম ইষ্ট নিষ্ঠ।।
সাক্ষী তার কাশিখণ্ডে দেবতা সবাই।
শুনিলেন ধর্মকথা লোপামুদ্রা ঠাই।।
গৃহকর্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয়।
বাণপ্রস্থ পরমহংস তার তুল্য নয়।।
গয়া গঙ্গা প্রয়াগ পুষ্কর দ্বারাবতী।
প্রভাস নর্মদা কুরুক্ষেত্র সরস্বতী।।
পৃথিবীর পুণ্য ক্ষেত্র আছে যত্র যত্র।
সব তীর্থ শ্রেষ্ঠ সে প্রয়াগ পুণ্যক্ষেত্র।।
যত যত তীর্থ আছে অবনী ভিতরে।
সত্য বাক্য সমকক্ষ হইতে না পারে।।
পর অন্ন খায় যে বা তীর্থধামে যায়।
ষড়াংশের এক অংশ ফল সেই পায়।।
বাণিজ্য কারণে যে বা তীর্থধামে যায়।
তীর্থের নাহিক ফল বাণিজ্য সে পায়।।
দেহের ইন্দ্রিয় বশ না হয়েছে যার।
তীর্থে গেলে ফলপ্রাপ্তি না হইবে তার।।
দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন।
তার দরশনে সব তীর্থ দরশন।।
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয়।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।।
অনুধ্বজ, শিখিধ্বজ, সুধন্বা, সুরথ।
অম্বরীষ, বিভীষণ, রঘু, ভগিরথ।।
প্রহলাদ, নারদ, শুক, ধ্রুব, মুচুকন্দ।
বিদুর, গুহক, বলী, শ্রীসহস্রস্কন্দ।।
এ সব গৃহস্থ নর বিধি ভক্তি রসে।
অন্তরঙ্গ ভক্ত সব থাকে গৃহবাসে।।
তার মধ্যে পঞ্চ অঙ্গ অতি অন্তরঙ্গ।
দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর পঞ্চঅঙ্গ।।
শান্তভাব নিষ্ঠা-বতী চারি রসে রয়।
শান্ত রস রতি নিষ্ঠা পঞ্চ অঙ্গ কয়।।
অনর্পিত চরিং চিরাৎ শ্লোকে বাখানি।
লিখে বিল্বমঙ্গল উজ্জ্বল নীলমণি।।
অতি অন্তরঙ্গ মধ্যে করিয়াছে ঠিক।
তিন প্রভু ছয় গোঁসাই পঞ্চ রসিক।।
ইহারা সকলে মাত্র গৃহাশ্রমী হয়।
গৃহত্যাগী শেষে হয় গোস্বামীরা ছয়।।
ঢাকিয়া রসিক ধর্ম গৃহধর্ম দিয়া।
অবনীতে অবতীর্ণ শ্রীহরি আসিয়া।।
গৃহধর্ম লভিবেক যজিবে যাজন।
অন্তরঙ্গ রসিক হইবে সেই জন।।
পূর্বে যার যেই পথ আছে জানাজানি।
এদানি লইবে তারে সেই পথে টানি।।
বিশ্বনাথে বাঁচাইয়া হরিচাঁদ নিল।
সেই বিশ্বনাথ শেষে দরবেশ হ’ল।।
করেছেন কত লীলা পৌগণ্ড সময়।
লিখিতে অসাধ্য মোর পুঁথি বেড়ে যায়।।
কিছুদিন পরে হ’ল গোচারণ সায়।
বিবাহ করিল প্রভু কৈশোর সময়।।
ঠাকুরের জন্ম অগ্রে পরে যে সময়।
রামকান্ত আসিতেন মোহান্ত আলয়।।
বৈরাগী ব্রাহ্মণ আদি অতিথি আসিত।
কারু না কহিত প্রভু নিজ মনোনীত।।
নিন্দা কি বন্দনা কারু কিছু না করিত।
রামকান্ত এলে গিয়া পদে লোটাইত।।
কিছু অন্তরেতে রামকান্তে ল’য়ে যেত।
দুই প্রভু একাসনে নির্জনে বসিত।।
রামকান্তে বলিতেন তুমি মম গুরু।
যুগে যুগে তুমি মোর বাঞ্ছাকল্পতরু।।
এইভাবে রামকান্তে করিতেন স্তুতি।
কথোপকথনে কাটাতেন দিবারাতি।।
প্রভু সব মনোবৃত্তি কান্তে জানাইল।
মধুময় শ্রীহরি চরিত্র হরিবল।।
অথ লক্ষ্মীমাতার জন্ম-বিবাহ ও যশোমন্ত ঠাকুরের তিরোভাব।
পয়ার।
জিকাবাড়ী নিবাসী লোচন প্রামাণিক।
একমাত্র কন্যা ভালবাসে প্রাণাধিক।।
বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী যিনি সত্যে বেদবতী।
অম্বরীষ কন্যা যিনি দ্বাপরে শ্রীমতি।।
বিষ্ণুপদ সেবানন্দ ক্ষীরোদ বাসিনী।
ত্রেতাযুগে সীতা সতী দ্বাপরে রুক্মিনী।।
বিষ্ণুপ্রিয়া নাম ধরে গৌরাঙ্গ গৃহিণী।
কলিতে হ’লেন তিনি লোচন নন্দিনী।।
যে কালে জন্মিল মাতা লোচনের ঘরে।
ভূমিষ্ঠ হ’লেন যবে সূতিকা আগারে।।
কি লিখিব কি লিখিব ভেবেছি বসিয়া।
শান্তিদেবী পদ ভাবি নয়ন মুদিয়া।।
অন্তর হইতে এক নারী বাহিরিল।
সেই নারী লক্ষ্মীমার ধাত্রী যেন ছিল।।
আমি যেন দেখিলাম বিভীষিকা প্রায়।
ধ্যানে কি স্বপনে দেখি বোঝা নাহি যায়।।
দেখিলাম শান্তিমার শান্তিময়ী পদ।
রাঙা চরণেতে ফুটিয়াছে কোকনদ।।
ধাত্রী দেখে কোকনদ উড়িয়া আসিল।
শান্তিমার শ্রীচরণে প’ড়ে লুটাইল।।
প্রসবিনী ফুলনাড়ি যবে প্রসবিল।
এক ফুল তথা হতে পদে লুকাইল।।
ইহা শুনিলাম যেন প্রলাপের প্রায়।
সজ্ঞানেতে লিখিলাম ধাত্রী যাহা কয়।।
ধাত্রী বলে প্রসূতিরে বলি মা তোমায়।
তোমার এ কন্যা মা সামান্যা কভু নয়।।
ধাত্রী কহিলেন লোচনের গৃহিণীরে।
লোচন-গৃহিণী কয় লোচনের তরে।।
শুনিয়া লোচন সব করিল প্রত্যয়।
এ মেয়ের যোগ্য বর পাইব কোথায়।।
নির্জনে বসিয়া করে ঈশ্বরের ধ্যান।
এই কন্যা কাহাকে করিব সম্প্রদান।।
বহু চিন্তা মনে মনে করিতে লাগিল।
এদিকেতে লক্ষ্মীমাতা বলিষ্ঠা হইল।।
বাল্যকালে যখনেতে করিতেন খেলা।
বালিকাগণের সঙ্গে করিতেন মেলা।।
আয় গো ভগিনী মোরা খেলিব সকলে।
সর্বমঙ্গলার পূজা করি সবে মিলে।।
সতীর বেদনা যানে সেই মাতা সতী।
পঞ্চতপা হইয়া পাইল পশুপতি।।
কল্য শাস্ত্র শুনিয়াছি বাবার গোচরে।
জগন্মাতা জন্ম নিয়াছিল গিরিপুরে।।
বাল্যকালে করিলেন তপস্যা আরম্ভ।
শিবপূজা করিলেন সদা অবলম্ব।।
তপস্যার ফলে পতি পায় কৃত্তিবাস।
সতীমার পূর্ণ হ’ল মনো অভিলাষ।।
একদিন আমার পিতার গুরু এল।
গোঁসাই বসিয়া কত শাস্ত্র শুনাইল।।
শুনিলাম কাত্যায়নী পূজে ব্রজঙ্গনা।
মাধব মাধব পয়ে পুরা’ল বাসনা।।
দয়মন্তী সতী শক্তি আরাধনা ফলে।
হংসমুখে বার্তা শুনি পতি পেল নলে।।
ভদ্রাবতী সতী বাহু রাজার নন্দিনী।
পাইল শ্রীবৎস পতি দৈববাণী শুনি।।
সাবিত্রীর ব্রত করে সতী সে সাবিত্রী।
মৃত্যুপতি জিনে, বাঁচাইল মৃত পতি।।
সাধনা বিহনে ভাল পতি মিলে কার।
আয় মোরা পূজা করি সর্বমঙ্গলার।।
বালিকাগণের সহ হইয়া একত্র।
আনিতেন দূর্বাদল তুলসীর পত্র।।
গৃহ হ’তে চেয়ে নিত আতপ তণ্ডুল।
তুলে নিত গ্রামে পেত যত যত ফুল।।
কুষ্মাণ্ড কাচড়া লাউ কলম্বী ধুতুরা।
মরিচ বেগুন বন্যা ফুল কেওয়া তারা।।
ফাল্গুনী সংক্রান্তি দিনে দ্বিজমন্ত্র বিনে।
পূজিতেন কাত্যায়নী ল’য়ে বালাগণে।।
তুলসী চন্দন মাখি’ যতন করিয়া।
কালী লও ব’লে দিত অঞ্জলী পুরিয়া।।
খেলিতেন ল’য়ে যত গ্রাম বালিকায়।
ইহার অগ্রেতে বাল্য খেলার সময়।।
বালিকা আচারে আলো তণ্ডুল বিহনে।
বালি দিয়া নৈবিদ্য সাজা’ত বালাগণে।।
বলিতেন এই মত তোরা সবে সাজা।
আয় লো ভগিনী মোরা খেলি পূজা পূজা।।
এরূপে পৌগণ্ডকাল হ’য়ে এল গত।
এমন সময় খেলে সাবিত্রীর ব্রত।।
কখন কখন ল’য়ে বালিকার গণ।
ভক্তিভাবে পূজিতেন দেব নারায়ণ।।
অম্বরীষ কন্যা শ্রীমতীরে তুমি নাও।
সেই মত দয়াময় মোরে ল’য়ে যাও।।
লোচন শুনিল দৈবে বাল্যখেলার ছলে।
যশোমন্ত পুত্র হরি বিশাকে বাঁচা’লে।।
চিত্ত চমকিত হ’ল মানিল বিস্ময়।
এ ছেলে ঈশ্বর অংশ সামান্য ত নয়।।
হরির সঙ্গেতে দিলে শান্তির বিবাহ।
ইহকাল পরকাল হইবে নির্বাহ।।
লোচন সফলাডাঙ্গা আসিয়া আসিয়া।
যশোমন্তে কথা কয় হাসিয়া হাসিয়া।।
তোমার মধ্যম পুত্র আমি তাঁরে চাই।
কন্যা দিয়া আমি তাঁরে করিব জামাই।।
শুনি যশোমন্ত বড় হ’ল আনন্দিত।
বলে এই কর্ম কর যে হয় উচিত।।
আসা যাওয়া দেখা শুনা হয় রীতিমতে।
কন্যাদান করিলেন শুভ সু-লগ্নেতে।।
যশোমন্ত বিয়া দিল পাঁচটি নন্দন।
অচিরাৎ লোকলীলা কৈল সম্বরণ।।
একদিন গাত্র শীত হৃদিকম্প হয়।
মুহূর্তেক বসিলেন তুলসী তলায়।।
জপিলেন ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর।
সজ্ঞানেতে দেহত্যাগী হ’ল লোকান্তর।।
পুষ্পরথে চড়ি সুখে গোলোকে গমন।
যশোমন্ত প্রীতে হরি বল সর্বজন।।
হরি পিতা লোকান্তর সমাধি শুনিলে।
পুলকে গোলোকে যাবে হরি হরি বলে।।
অন্তকালে হবে তাঁর হরি কর্ণধার।
বিরচিল রসরাজ কবি সরকার।
পয়ার।
জিকাবাড়ী নিবাসী লোচন প্রামাণিক।
একমাত্র কন্যা ভালবাসে প্রাণাধিক।।
বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী যিনি সত্যে বেদবতী।
অম্বরীষ কন্যা যিনি দ্বাপরে শ্রীমতি।।
বিষ্ণুপদ সেবানন্দ ক্ষীরোদ বাসিনী।
ত্রেতাযুগে সীতা সতী দ্বাপরে রুক্মিনী।।
বিষ্ণুপ্রিয়া নাম ধরে গৌরাঙ্গ গৃহিণী।
কলিতে হ’লেন তিনি লোচন নন্দিনী।।
যে কালে জন্মিল মাতা লোচনের ঘরে।
ভূমিষ্ঠ হ’লেন যবে সূতিকা আগারে।।
কি লিখিব কি লিখিব ভেবেছি বসিয়া।
শান্তিদেবী পদ ভাবি নয়ন মুদিয়া।।
অন্তর হইতে এক নারী বাহিরিল।
সেই নারী লক্ষ্মীমার ধাত্রী যেন ছিল।।
আমি যেন দেখিলাম বিভীষিকা প্রায়।
ধ্যানে কি স্বপনে দেখি বোঝা নাহি যায়।।
দেখিলাম শান্তিমার শান্তিময়ী পদ।
রাঙা চরণেতে ফুটিয়াছে কোকনদ।।
ধাত্রী দেখে কোকনদ উড়িয়া আসিল।
শান্তিমার শ্রীচরণে প’ড়ে লুটাইল।।
প্রসবিনী ফুলনাড়ি যবে প্রসবিল।
এক ফুল তথা হতে পদে লুকাইল।।
ইহা শুনিলাম যেন প্রলাপের প্রায়।
সজ্ঞানেতে লিখিলাম ধাত্রী যাহা কয়।।
ধাত্রী বলে প্রসূতিরে বলি মা তোমায়।
তোমার এ কন্যা মা সামান্যা কভু নয়।।
ধাত্রী কহিলেন লোচনের গৃহিণীরে।
লোচন-গৃহিণী কয় লোচনের তরে।।
শুনিয়া লোচন সব করিল প্রত্যয়।
এ মেয়ের যোগ্য বর পাইব কোথায়।।
নির্জনে বসিয়া করে ঈশ্বরের ধ্যান।
এই কন্যা কাহাকে করিব সম্প্রদান।।
বহু চিন্তা মনে মনে করিতে লাগিল।
এদিকেতে লক্ষ্মীমাতা বলিষ্ঠা হইল।।
বাল্যকালে যখনেতে করিতেন খেলা।
বালিকাগণের সঙ্গে করিতেন মেলা।।
আয় গো ভগিনী মোরা খেলিব সকলে।
সর্বমঙ্গলার পূজা করি সবে মিলে।।
সতীর বেদনা যানে সেই মাতা সতী।
পঞ্চতপা হইয়া পাইল পশুপতি।।
কল্য শাস্ত্র শুনিয়াছি বাবার গোচরে।
জগন্মাতা জন্ম নিয়াছিল গিরিপুরে।।
বাল্যকালে করিলেন তপস্যা আরম্ভ।
শিবপূজা করিলেন সদা অবলম্ব।।
তপস্যার ফলে পতি পায় কৃত্তিবাস।
সতীমার পূর্ণ হ’ল মনো অভিলাষ।।
একদিন আমার পিতার গুরু এল।
গোঁসাই বসিয়া কত শাস্ত্র শুনাইল।।
শুনিলাম কাত্যায়নী পূজে ব্রজঙ্গনা।
মাধব মাধব পয়ে পুরা’ল বাসনা।।
দয়মন্তী সতী শক্তি আরাধনা ফলে।
হংসমুখে বার্তা শুনি পতি পেল নলে।।
ভদ্রাবতী সতী বাহু রাজার নন্দিনী।
পাইল শ্রীবৎস পতি দৈববাণী শুনি।।
সাবিত্রীর ব্রত করে সতী সে সাবিত্রী।
মৃত্যুপতি জিনে, বাঁচাইল মৃত পতি।।
সাধনা বিহনে ভাল পতি মিলে কার।
আয় মোরা পূজা করি সর্বমঙ্গলার।।
বালিকাগণের সহ হইয়া একত্র।
আনিতেন দূর্বাদল তুলসীর পত্র।।
গৃহ হ’তে চেয়ে নিত আতপ তণ্ডুল।
তুলে নিত গ্রামে পেত যত যত ফুল।।
কুষ্মাণ্ড কাচড়া লাউ কলম্বী ধুতুরা।
মরিচ বেগুন বন্যা ফুল কেওয়া তারা।।
ফাল্গুনী সংক্রান্তি দিনে দ্বিজমন্ত্র বিনে।
পূজিতেন কাত্যায়নী ল’য়ে বালাগণে।।
তুলসী চন্দন মাখি’ যতন করিয়া।
কালী লও ব’লে দিত অঞ্জলী পুরিয়া।।
খেলিতেন ল’য়ে যত গ্রাম বালিকায়।
ইহার অগ্রেতে বাল্য খেলার সময়।।
বালিকা আচারে আলো তণ্ডুল বিহনে।
বালি দিয়া নৈবিদ্য সাজা’ত বালাগণে।।
বলিতেন এই মত তোরা সবে সাজা।
আয় লো ভগিনী মোরা খেলি পূজা পূজা।।
এরূপে পৌগণ্ডকাল হ’য়ে এল গত।
এমন সময় খেলে সাবিত্রীর ব্রত।।
কখন কখন ল’য়ে বালিকার গণ।
ভক্তিভাবে পূজিতেন দেব নারায়ণ।।
অম্বরীষ কন্যা শ্রীমতীরে তুমি নাও।
সেই মত দয়াময় মোরে ল’য়ে যাও।।
লোচন শুনিল দৈবে বাল্যখেলার ছলে।
যশোমন্ত পুত্র হরি বিশাকে বাঁচা’লে।।
চিত্ত চমকিত হ’ল মানিল বিস্ময়।
এ ছেলে ঈশ্বর অংশ সামান্য ত নয়।।
হরির সঙ্গেতে দিলে শান্তির বিবাহ।
ইহকাল পরকাল হইবে নির্বাহ।।
লোচন সফলাডাঙ্গা আসিয়া আসিয়া।
যশোমন্তে কথা কয় হাসিয়া হাসিয়া।।
তোমার মধ্যম পুত্র আমি তাঁরে চাই।
কন্যা দিয়া আমি তাঁরে করিব জামাই।।
শুনি যশোমন্ত বড় হ’ল আনন্দিত।
বলে এই কর্ম কর যে হয় উচিত।।
আসা যাওয়া দেখা শুনা হয় রীতিমতে।
কন্যাদান করিলেন শুভ সু-লগ্নেতে।।
যশোমন্ত বিয়া দিল পাঁচটি নন্দন।
অচিরাৎ লোকলীলা কৈল সম্বরণ।।
একদিন গাত্র শীত হৃদিকম্প হয়।
মুহূর্তেক বসিলেন তুলসী তলায়।।
জপিলেন ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর।
সজ্ঞানেতে দেহত্যাগী হ’ল লোকান্তর।।
পুষ্পরথে চড়ি সুখে গোলোকে গমন।
যশোমন্ত প্রীতে হরি বল সর্বজন।।
হরি পিতা লোকান্তর সমাধি শুনিলে।
পুলকে গোলোকে যাবে হরি হরি বলে।।
অন্তকালে হবে তাঁর হরি কর্ণধার।
বিরচিল রসরাজ কবি সরকার।
আদিখণ্ড
চতুর্থ তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
গ্রন্থকারের প্রতি গ্রন্থ লিখিবার আদেশ
পয়ার
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ এই দুইজনা।
বলিলেন লীলামৃত করিতে রচনা।।
প্রভূর এ শেষ লীলা প্রেমভক্তি দান।
রচনা করহ শীঘ্র লীলার প্রধান।।
চরণ ধরিয়া তবে বলিল তারক।
স্বীকার করিনু আমি তোমার সেবক।।
অতিদীন অভাজন আমি মূঢ়মতি।
এ লীলা বর্ণিতে মম না হবে শকতি।।
একে আমি দীনহীন অক্ষম জঘন্য।
আমার এ লেখা ভবে কে করিবে মান্য।।
দুই প্রভ বলে হরিচাঁদে রেখে ভক্তি।
লিখিতে আরম্ভ কর হবে তোর শক্তি।।
বিশ্বাস না করিস মোদের কথা ধর।
লিখিতে পারিবি গ্রন্থ তোরে দিনু বর।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে তুমি শুন মোর সোনা।
উপাধি দিয়াছি তোরে তারক রসনা।।
দশরথ বলে বাক্য লঙ্ঘিও না আর।
মৃত্যুঞ্জয় দিল বর আমার সে বর।।
আমার রচিত গান আছে তোর শুনা।
তাতে পদ গাঁথা আছে তারক-রসনা।।
নিচ জন বলে ভেবে হইলি ব্যাকুল।
কাঁদা জল বিনে কোথা ফুটে পদ্ম ফুল।।
মুনি হৈল বিশ্বামিত্র গাধির নন্দন।
মেনকার সঙ্গে তার হইল মিলন।।
তাতে জন্মে কন্যা শকুন্তলা নাম ধরে।
কুরুপান্ডবের আদি ব্যক্ত এ সংসারে।।
হরিনীর গর্ভে জন্মে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।
যার যজ্ঞে চরু জন্মে রামায়ণে শুনি।।
লোমপাদ রাজার রাজ্যে অনাবৃষ্টি ছিল।
মুনি আগমনে শেষে ইন্দ্র বরষিল।।
অযোধ্যায় এসে সেই মুনি যজ্ঞ করে।
চরু খেয়ে তিন রাজরাণী গর্ভ ধরে।।
সেই গর্ভে হইলেন রাম অবতার।
যথা তথা জন্ম কিন্তু কর্ম ধর সার।।
ব্রহ্মার ঔরষে তিলোত্তমার উদরে।
বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠ সে ব্যক্ত চরাচরে।।
যোগ-বশিষ্ঠ রামায়ণ যোগে বসি করে।
ব্যাস মুনি জন্মে মৎস্যগন্ধার উদরে।।
চারি বেদ চৌদ্দ শাস্ত্র আঠার পুরাণ।
বেদব্যাসকৃত জীব বাসনা পুরাণ।।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছে আপনি।
শক্ত্যাবেশ অবতার পৃথু ব্যাস মুনি।।
তোর কেন ভয় হ’ল করিতে রচনা।
তোর জন্য তপস্যা করিব দুই জনা।।
যার কর্ম সেই করাইবে তোরে দিয়া।
রচনা করহ গ্রন্থ তাহারে ভাবিয়া।।
এই ভাবে কত দিন গত হ’য়ে গেল।
পারিব না ভেবে গ্রন্থ লেখা নাহি হ’ল।।
একদিন দৈব যোগে নিশি অবসানে।
গোঁসাই গোলক এসে দেখায় স্বপনে।।
নর হরি রূপ ধরি বুকে হাটু দিয়া।
বক্ষঃস্থলে দিল হস্ত নখ বাঁধাইয়া।।
বলে তোরে নখে চিরি করিব খানখান।
নৈলে “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” পুঁথি আন।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ বর দিয়াছিল।
চতুর্ব্বিংশ বর্ষ এই গত হয়ে গেল।।
পুঁথি যদি না লিখিবি তোর রক্ষা নাই।
পুস্তক লিখিস যদি ছেড়ে দিয়ে যাই।।
স্বীকার করিনু আমি লিখিব পুস্তক।
কেমনে লিখিব আমি মূর্খ অপারক।।
শুনিয়া গোস্বামী অতি ক্রোধভরে কয়।
তুই মূর্খ প্রভুর লীলা ত মূর্খ নয়।।
গোস্বামী বলেন বেটা বুঝে দেখ সুক্ষ্ম।
তুই মূর্খ মহতের বর নহে মূর্খ।।
উপাধি দিয়াছে তোরে রসনা বলিয়া।
এত দিন পরে তাহা গিয়াছে ফলিয়া।।
কবি গাও কালিয়ার পন্ডিত সমাজ।
উপাধি দিয়াছে তোরে কবি রসরাজ।।
হরিবংশে হরিপুত্র গুরুচাঁদ যিনি।
তিনি দেন উপাধি প্রেমিক শিরোমণি।।
ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ বহুগুনে গুণী।
তিনি দেন উপাধি সরকার চূড়ামণি।।
ইতিনার ভট্টাচার্য্য পাড়া হয় গান।
সুকবি বলিয়া তোরে দিয়াছে আখ্যান।।
রজত ম্যাডেলে সেই উপাধি লিখিয়া।
তোমার গলায় সবে দিল ঝুলাইয়া।।
কেন বল আমি নাহি জানি ব্যাকরণ।
এখন সাহস ভরে লিখিতে দে মন।।
যে লেখা যে পড়া জান তাহা উঘাড়িয়া।
দেশ ভাষা মতে দাও পুস্তক রচিয়া।।
যুবা বুড়া সবে যাতে বুঝিবারে পারে।
সেই মত লিখে দাও আমাদের বরে।।
স্বপনেতে কেহ যদি পুথি করে দান।
সে জন পন্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ।।
বিরাজা নামেতে মধু কাণের ভগিনী।
স্বপনেতে পুথি তোরে দিল আমি জানি।।
এক দিন স্বপনে সাপের পা দেখিলি।
সে সব বৃত্তান্ত বাছা কেন ভুলে গেলি।।
স্বপনেতে এক নারী ঢাকার সহরে।
হরিচাঁদ স্তবাষ্টক দিয়াছিল তোরে।।
তোর লেখা স্তব তোরে সেই নারী দিল।
সেই স্বপ্ন কেন বাছা তোর ভুল হ’ল।।
আনুকূল্যে গোলোক পাগল চূড়ামণি।
রচিল তারক সরকার চূড়ামণি।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ এই দুইজনা।
বলিলেন লীলামৃত করিতে রচনা।।
প্রভূর এ শেষ লীলা প্রেমভক্তি দান।
রচনা করহ শীঘ্র লীলার প্রধান।।
চরণ ধরিয়া তবে বলিল তারক।
স্বীকার করিনু আমি তোমার সেবক।।
অতিদীন অভাজন আমি মূঢ়মতি।
এ লীলা বর্ণিতে মম না হবে শকতি।।
একে আমি দীনহীন অক্ষম জঘন্য।
আমার এ লেখা ভবে কে করিবে মান্য।।
দুই প্রভ বলে হরিচাঁদে রেখে ভক্তি।
লিখিতে আরম্ভ কর হবে তোর শক্তি।।
বিশ্বাস না করিস মোদের কথা ধর।
লিখিতে পারিবি গ্রন্থ তোরে দিনু বর।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে তুমি শুন মোর সোনা।
উপাধি দিয়াছি তোরে তারক রসনা।।
দশরথ বলে বাক্য লঙ্ঘিও না আর।
মৃত্যুঞ্জয় দিল বর আমার সে বর।।
আমার রচিত গান আছে তোর শুনা।
তাতে পদ গাঁথা আছে তারক-রসনা।।
নিচ জন বলে ভেবে হইলি ব্যাকুল।
কাঁদা জল বিনে কোথা ফুটে পদ্ম ফুল।।
মুনি হৈল বিশ্বামিত্র গাধির নন্দন।
মেনকার সঙ্গে তার হইল মিলন।।
তাতে জন্মে কন্যা শকুন্তলা নাম ধরে।
কুরুপান্ডবের আদি ব্যক্ত এ সংসারে।।
হরিনীর গর্ভে জন্মে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।
যার যজ্ঞে চরু জন্মে রামায়ণে শুনি।।
লোমপাদ রাজার রাজ্যে অনাবৃষ্টি ছিল।
মুনি আগমনে শেষে ইন্দ্র বরষিল।।
অযোধ্যায় এসে সেই মুনি যজ্ঞ করে।
চরু খেয়ে তিন রাজরাণী গর্ভ ধরে।।
সেই গর্ভে হইলেন রাম অবতার।
যথা তথা জন্ম কিন্তু কর্ম ধর সার।।
ব্রহ্মার ঔরষে তিলোত্তমার উদরে।
বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠ সে ব্যক্ত চরাচরে।।
যোগ-বশিষ্ঠ রামায়ণ যোগে বসি করে।
ব্যাস মুনি জন্মে মৎস্যগন্ধার উদরে।।
চারি বেদ চৌদ্দ শাস্ত্র আঠার পুরাণ।
বেদব্যাসকৃত জীব বাসনা পুরাণ।।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছে আপনি।
শক্ত্যাবেশ অবতার পৃথু ব্যাস মুনি।।
তোর কেন ভয় হ’ল করিতে রচনা।
তোর জন্য তপস্যা করিব দুই জনা।।
যার কর্ম সেই করাইবে তোরে দিয়া।
রচনা করহ গ্রন্থ তাহারে ভাবিয়া।।
এই ভাবে কত দিন গত হ’য়ে গেল।
পারিব না ভেবে গ্রন্থ লেখা নাহি হ’ল।।
একদিন দৈব যোগে নিশি অবসানে।
গোঁসাই গোলক এসে দেখায় স্বপনে।।
নর হরি রূপ ধরি বুকে হাটু দিয়া।
বক্ষঃস্থলে দিল হস্ত নখ বাঁধাইয়া।।
বলে তোরে নখে চিরি করিব খানখান।
নৈলে “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” পুঁথি আন।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ বর দিয়াছিল।
চতুর্ব্বিংশ বর্ষ এই গত হয়ে গেল।।
পুঁথি যদি না লিখিবি তোর রক্ষা নাই।
পুস্তক লিখিস যদি ছেড়ে দিয়ে যাই।।
স্বীকার করিনু আমি লিখিব পুস্তক।
কেমনে লিখিব আমি মূর্খ অপারক।।
শুনিয়া গোস্বামী অতি ক্রোধভরে কয়।
তুই মূর্খ প্রভুর লীলা ত মূর্খ নয়।।
গোস্বামী বলেন বেটা বুঝে দেখ সুক্ষ্ম।
তুই মূর্খ মহতের বর নহে মূর্খ।।
উপাধি দিয়াছে তোরে রসনা বলিয়া।
এত দিন পরে তাহা গিয়াছে ফলিয়া।।
কবি গাও কালিয়ার পন্ডিত সমাজ।
উপাধি দিয়াছে তোরে কবি রসরাজ।।
হরিবংশে হরিপুত্র গুরুচাঁদ যিনি।
তিনি দেন উপাধি প্রেমিক শিরোমণি।।
ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ বহুগুনে গুণী।
তিনি দেন উপাধি সরকার চূড়ামণি।।
ইতিনার ভট্টাচার্য্য পাড়া হয় গান।
সুকবি বলিয়া তোরে দিয়াছে আখ্যান।।
রজত ম্যাডেলে সেই উপাধি লিখিয়া।
তোমার গলায় সবে দিল ঝুলাইয়া।।
কেন বল আমি নাহি জানি ব্যাকরণ।
এখন সাহস ভরে লিখিতে দে মন।।
যে লেখা যে পড়া জান তাহা উঘাড়িয়া।
দেশ ভাষা মতে দাও পুস্তক রচিয়া।।
যুবা বুড়া সবে যাতে বুঝিবারে পারে।
সেই মত লিখে দাও আমাদের বরে।।
স্বপনেতে কেহ যদি পুথি করে দান।
সে জন পন্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ।।
বিরাজা নামেতে মধু কাণের ভগিনী।
স্বপনেতে পুথি তোরে দিল আমি জানি।।
এক দিন স্বপনে সাপের পা দেখিলি।
সে সব বৃত্তান্ত বাছা কেন ভুলে গেলি।।
স্বপনেতে এক নারী ঢাকার সহরে।
হরিচাঁদ স্তবাষ্টক দিয়াছিল তোরে।।
তোর লেখা স্তব তোরে সেই নারী দিল।
সেই স্বপ্ন কেন বাছা তোর ভুল হ’ল।।
আনুকূল্যে গোলোক পাগল চূড়ামণি।
রচিল তারক সরকার চূড়ামণি।।
কবি জন্মোপাখ্যান।
পয়ার।
ওরে বৎস শোন তোর জন্ম বিবরণ।
তুই যে জন্মিলি তোর পিতার সাধন।।
দেখেছিস বাল্যকালে তোর খুল্লতাত।
জন্ম-অন্ধ নাম তার ছিল শম্ভুনাথ।।
তোর জন্ম বিবরণ তোর মনে নাই।
মৌখিক শুনিলি তোর পিসিমার ঠাই।।
তোর পিতা কাশীনাথ ছিল কালী ভক্ত।
শক্তি আরাধিত কালীপদে অনুরক্ত।।
অপুত্রক ছিল বংশে পুত্র না জন্মিল।
বংশ রক্ষা হেতু দুর্গা বলিয়া কাঁদিল।।
বটপত্রে লক্ষ দুর্গা নাম লিখে পরে।
সপ্তাহ পর্যন্ত শিব স্বস্ত্যয়ন করে।।
আচার্য ফকিরচাঁদ করে স্বস্ত্যয়ন।
স্বস্ত্যয়ন করি বলে বলে জন্মিবে নন্দন।।
স্বর্ণময়ী দশভুজা মূর্তি গঠি লয়।
পূজা করিলেন শুভ-নবমী সময়।।
শ্রীনবকুমার শর্মা পুরোহিত এসে।
পূজা করে জগদ্ধাত্রী পূজার দিবসে।।
সপ্তাহ পর্যন্ত চণ্ডী করিল পঠন।
অষ্টম দিবসে দিল ব্রাহ্মণ ভোজন।।
নবমী দিবসে পূজা কৈল ভবানীর।
তব পিতা বুক চিরে দিলেন রুধির।।
মার্গশীর্ষ অমাবস্যা শনিবার দিনে।
তোর মাতা প্রসব করিল শুভক্ষণে।।
নাম করণেতে নাম রাখিল তারক।
আচার্য বলিল পুত্র হইবে রচক।।
যেই নারী স্তবাস্টক দিলেন তোমায়।
সেই শক্তি দিবে শক্তি রচনা সময়।।
যে কথা লিখিতে সন্দেহ হইবে তব।
সেও শক্তি দিবে তোরে আমি শক্তি দিব।।
যে সময় জীবনান্ত হইল আমার।
কোলে করি ধরেছিলি মম কলেবর।।
হরিসুত গুরুচাঁদ আজ্ঞা অনুসারে।
রচনা করহ শীঘ্র নির্ভয় অন্তরে।।
পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান।
এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।।
পঙ্গুজন লঙ্ঘে গিরি বোবা কথা কয়।
অন্ধজন চক্ষে দেখে মহৎ কৃপায়।।
বাজীকর ছায়াবাজী দেখায় বিপুল।
নাচাইতে পারে তারা কাষ্ঠের পুতুল।।
গোস্বামী গোলোক দশরথ মৃত্যুঞ্জয়।
তুই কাষ্ঠ পুত্তলিকা তেমনি নাচায়।।
বালকেরা খেলে যেন কড়িখেলা দান।
নানাভাবে পড়ি কড়ি গড়াগড়ি যান।।
কড়িতে না জানে আমি কি খেলা খেলাই।
খেড়ুবিনে সে খেলা বুঝিতে সাধ্য নাই।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ আর মহানন্দ।
তোরে করে ফেলাফেলি তাদের আনন্দ।।
শীঘ্র করি লেখ মোর প্রভুর মহিমে।
লেখ লেখ যাহা তোর উঠিবে কলমে।।
যা দেখিস যা শুনিস তাহাতো লিখিবি।
না দেখিলি না শুনিলি কেমনে পারিবি।।
কোন ঠাই লিখিতে হইলে কিছু সন্ধ।
আরোপে দেখিল হরি চরণারবিন্দ।।
অজ্ঞান অবিদ্যা নাশ হবে অত্রানন্দ।
হৃদয় আসিয়া লেখাইবে হরিচন্দ্র।।
এভাবে গোলোকচন্দ্র সদয় হইল।
হরি হরি বল ভাই তারক রচিল।।
গ্রন্থকারের অনুনয়ন।
ত্রিপদী।
গোস্বামীর অনুমতি বন্দি মাতা সরস্বতী
মুঢ় মতি আমি অভাজন।
শক্তিময়ী দিয়া শক্তি আমা দ্বারা কর উক্তি
পঞ্চাশ বর্ণ স্বর ব্যঞ্জন।।
নাহি মোর বর্ণ জ্ঞান নাহি সূক্ষ্মানুসন্ধান
সাহসিনু লিখিতে পুস্তক।
যদ্যপি জ্ঞানবিহীন তবু মম শুভদিন
লিখিতে এ হাতের সার্থক।।
হৃদিপদ্ম প্রস্ফুটিত মন বড় আনন্দিত
রচিতে হরি চরিত্র লীলা।
এই মঙ্গলাচরণ ভব বন্ধন মোচন
শুনিতে মঙ্গল সুশৃঙ্খলা।।
কৃষ্ণসারচর্ম দলে কুঠার বাঁধিয়া গলে
অই দলে জুড়ি দুই হাত।
দন্তে তৃণ ধরি কেঁদে সাধু বৈষ্ণবের পদে
কোটি কোটি করি দণ্ডবৎ।।
হরি কথা লীলামৃত কে বলিতে পারে কত
যে যত বা করেন প্রকাশ।
মুনিগণে লেখে যত ধ্যান অনুযায়ী মত
বেদব্যাস কবি কৃষ্ণদাস।।
লেখে যদি শূলপাণি বাণী যদি বলে বাণী
তবু বাণী অবধি না হয়।
আমি যে সাহস করি লিখিতে কলম ধরি
সাধু গুরু বৈষ্ণব কৃপায়।।
কার্য অতি দুরারোধ্য লিখিতে নাহিক সাধ্য
হেন সাধ্য যেন তেন মতে।
লিখি লীলা গুহ্য বাহ্য গ্রন্থকার মনোধার্য
পূজ্য হোক ভক্ত সমাজেতে।।
বেদব্যাস মহামুনি যত লিখিলেন তিনি
চারিবেদ আঠার পুরাণ।
শাস্ত্র লেখে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গ্রন্থ লেখে লক্ষ লক্ষ
দেখিল যাহা করিয়া ধ্যান।।
একদা বদরিকাশ্রমে ব্যাসমুনি ছিল ঘুমে
হেনকালে আসি দুই পাখী।
বদরী শাখা উপরে দুই পাখী শব্দ করে
ব্যসদেব মেলিলেন আঁখি।।
শাখে বসি দুই শুকে একটি কহিছে সুখে
অবিরত ত্রয়োস্ত্রিংশৎ।
অন্যটির মুখে বাণী শুনিতেছে ব্যাসমুনি
উঠে ধ্বনি পঞ্চাশৎ।।
বাণী শুনি অকস্মাৎ ব্যাস করে দৃষ্টিপাত
পাখী কেন সংস্কৃত কহে।
তাহা শুনিয়া বিস্ময় সত্যবতীর তনয়
কিঞ্চিৎ ধ্যানস্থ হ’য়ে রহে।।
ধ্যানেতে হইল জ্ঞাত উভয় পাখীর তত্ত্ব
ত্রয়োস্ত্রিংশৎ যে করে প্রকাশ।
অইটি বাল্মীকি মুনি দেখেছেন ব্যাস মুনি
পঞ্চ পঞ্চাশৎ কহে ব্যাস।।
পাখী কহে সংস্কৃত ইহার কারণ অর্থ
জানিবারে পুনঃ করে ধ্যান।
বাল্মীকি কহিছে বাণী রচি রামায়ণ খানি
করিয়াছি নামের বাখান।।
ধর্ম অর্থ পাপ পুণ্য ব্যবস্থা হয়েছে ধন্য
প্রথম পুরুষ রামলীলে।
বৈকুণ্ঠ নায়ক হরি যৈছে অবতারকারী
বর্নিলাম স্বয়ং হরি বলে।।
স্বয়ং কৃষ্ণলীলা সার শুদ্ধ মানুষাবতার
তাঁর তত্ত্ব তাঁর প্রাপ্তি কিসে।
তাহা আমি লিখি নাই ধ্যানেতে ও নাহি পাই
তুমি তাহা লেখ অবশেষে।।
ব্যাস কহে শুক পাখী আমি যে ভারত লিখি
বৈকুণ্ঠ পতির সব লীলা।
বাসুদেব যদুবংশ নারায়ণ কৃষ্ণ অংশ
লিখি তার ঐশ্বর্যের খেলা।।
লিখিবারে তার মর্ম ব্যাখ্যা করিয়াছি ব্রহ্ম
স্বয়ং কৃষ্ণ মাধুর্যের সার।
কোন প্রেমে তারে পাই আমি তাহা লিখি নাই
তুমি তাহা করহে প্রচার।।
গ্রন্থ হ’বে ভাগবত সাধুজন মনোমত
ব্রজভাব মাধুর্যের ধার্য।
গ্রন্থ হ’বে পরচার ভক্তিরস তত্ত্বসার
রসিক ভকত শিরোধার্য।।
শুনি ব্যাস ভাবে মনে ব্যাস কহে ব্যাস স্থানে
এরা দুই শুক শ্যাম শুক।
এরা কহে রচিবারে এ রচনা রচিবারে
এবে আমি না হ’ব ইচ্ছুক।।
ফিরে যাক যোগে বসা দেখি করিয়া তপস্যা
তপস্যায় বসিলেন মুনি।
কতদিন গত হয় দৈবে এমন সময়
শুনিতে পাইল দৈববাণী।।
শীঘ্রই রচনা কর বৃথা কেন কাল হর
উপলক্ষ তোমারে রাখিব।
লিখিতে উদ্যোগী হও করে তুলি তুলি’ লও
যা করিবে আমি সে করিব।।
এই দৈববাণী শুনি লিখিতে লাগিল মুনি
কৃষ্ণলীলা রস ভাগবত।
লিখিতে লিখিতে গ্রন্থ ব্রজলীলার বৃত্তান্ত
ব্রজলীলা লিখে মনোরথ।।
শান্ত দাস্য সখ্য আদি বাৎসল্যের নিরবধি
মধুরের রাধা প্রেমরস।
দাস্য শান্ত ক্রিয়াগুণ লিখিতে হ’ল নিপুণ
মধুরের ক্রিয়া গুণ যশ।।
লিখিতে উদ্যত হ’ল হেন কালেতে শুনিল
দৈববাণী হ’ল পুনর্বার।
আর না লিখ আগত ব্রজভাব তত্ত্ব যত
তা লিখিবে নন্দন তোমার।।
পরে ব্যাস পুত্র যিনি শুকদেব মহামুনি
তিনি লিখিলেন ভাগবত।
লিখিতে লিখিতে মুনি পরে হ’ল দৈববাণী
আর না লিখিও তুল হাত।।
কতদিন গত হ’ল ব্যাস ভাবিতে লাগিল
আমি লিখি আমি করি সই।
যদ্যপি লেখান হরি জানিতে তা আমি পারি
অন্যে তাহা জানিল বা কই।।
দৈববাণী শুনিলাম আমি একা জানিলাম
গ্রন্থ মান্য হ’বে স্বর্গমর্ত্য।
গোলোক বৈকুণ্ঠ মান্য হইল যে গ্রন্থ ধন্য
দেবগণে না জানিল তত্ত্ব।।
গোলোক বিহারী হরি গণপতি রূপ ধরি
হ’য়েছেন শিবের নন্দন।
কোলে করিয়া ভবানী হ’ল গণেশ জননী
কোলে আদি ব্রহ্ম সনাতন।।
এবে বক্তা আমি হ’ব গণেশেরে লেখাইব
চলিলেন কৈলাশ শিখর।
স্তব করে মহামুনি ব্যাসের স্তবন শুনি
তুষ্ট হ’ল দেব দিগম্বর।।
আজ্ঞা দিলেন গণেশেরে যেতে ব্যাস সমিভ্যারে
গণেশ বলিল আমি যা’ব।
বলিতে বিলম্ব হ’লে হস্ত অবসর পেলে
লিখিব না ফিরিয়া আসিব।।
শুনি ব্যাস চমকিত হইলেন উপস্থিত
বৈকুণ্ঠ নারায়ণ সদনে।
গললগ্নী কৃতবাসে স্তব করে পীতবাসে
তুষ্ট হরি ব্যাসের স্তবনে।।
ব্যাস কহিছে ভারতী ভারতে যাবে ভারতী
ভাগবত-ভারত রচনে।
আমি যা বলিব বাণী বাণী যোগাইবে বাণী
বসি মম রসনা আসনে।।
আজ্ঞা দেন চক্রপাণি আজ্ঞায় চলিল বাণী
গজানন কহে পুনর্বার।
কণ্ঠে রহিবে ভারতী বলিবেন যে ভারতী
লিখিব হে যে সাধ্য আমার।।
কালি হ’লে মসিপাত্র মসি ফুরাইলে মাত্র
আর না লিখিব যা’ব ফিরি।
শুনি ব্যাস বারিনেত্র আমি হ’ব মসিপত্র
ডেকে কন শ্বেত বাগীশ্বরী।।
শুনিয়া এ সব বার্তা ব্যাস মুনি করে যাত্রা
গোলোকের পানে চাহি কাঁদে।
গোলোকে ছিলেন স্থিতি যিনি নীল সরস্বতী
তাকে করে আজ্ঞা কালাচাঁদে।।
বৈকুণ্ঠেতে শ্বেতবাণী মসিপত্র হ’বে তিনি
তুমি গিয়া হও তাতে মসী।
কজ্জ্বলস্বরূপা হ’য়ে তুমি তাতে থাক গিয়ে
আমি তব পিছে পিছে আসি।।
আসি ব্যাস মুনিবর গণেশের বরাবর
কহে দেব লিখ কহি কথা।
ডেকে বলে শিব-পুত্র দিলে মোরে মসিপত্র
লিখিবার লেখনিটা কোথা।।
এরণ্ডের কুঞ্চি আনি দিলা ব্যাস মহামুনি
অস্ত্র দিল প্রস্তুতে কলম।
কূপিলেন গজানন ক্রোধে ঘূর্ণ ত্রিনয়ন
বলে ব্যাস তোর মতিভ্রম।।
বাণী কণ্ঠে বিরাজিত শ্বেত সরস্বতী দত
কালী হ’ল নীল সরস্বতী।
এতে মোর আসে হাস তার কি কলম বাঁশ
কি পত্রে বা লিখাইবি পাঁতি।।
গিয়া বৃন্দাবন বাসে ভ্রমণ চৌরাশী ক্রোশে
বেল ভাণ্ডি তমালের বন।
বন ভ্রমি একে একে গন্ধরাজ শেফালিকে
তালতরু দেখে হৈল মন।।
বসি তালতরু মূলে ভেসেছে নয়ন জলে
হরি বলে কাঁদি উচ্চৈঃস্বরে।
আমি শক্তি কৃষ্ণাঙ্গিনি ভাগবত শাস্ত্র মুনি
লেখ তুমি মম বক্ষঃ পরে।।
দেখে পরাশর পুত্র পড়িতেছে তালপত্র
তালপত্রে কহে মুনিবর।
যাহ শ্রীকৃষ্ণের ঠাই বলগে বলেছে রাই
শিরে শিখিপাখা দিতে মোরে।।
ব্যাস অতি ব্যস্ত হ’য়ে শ্যামকুণ্ড তীরে গিয়ে
করেছেন কৃষ্ণ আরাধন।
যুগল মিলন হ’য়ে ব্যাসের সম্মুখে গিয়ে
রাধা কৃষ্ণ দিল দরশন।।
বলেছেন শ্রীরাধিকে যা লিখিবে মম বুকে
অন্য কলমে তা কি হয়।
শুনিয়া রাধার বাণী রাধানাথ রসখনি
শিখিপাখা দিলেন তাহায়।।
শিখিপুচ্ছ অংশ করি ব্যাসেরে দিলেন হরি
হাসিয়া বলে রাধানাথ।
যাহা অনন্ত গোচরে জিহ্বা সে দিবে তোমারে
তাহাতে না কর অস্ত্রাঘাত।।
উদয় ক্ষীরোদ কূলে তপ করে হরি বলে
হরি ছিল অনন্ত শয়নে।
ফণা এক কোন হ’তে এক জিহ্বা হৈল তাতে
এনে দিল ব্যাসমুনি স্থানে।।
বলীকে ছলিতে হরি নাভি হ’তে পদতরী
বাহির করিল যে প্রকার।
তেমনি অনন্ত ফণা জিহ্বাকণা এককণা
প্রকাশিল ক্ষীরোদ ঈশ্বর।।
কলম কালি সহিত সুচিক্কণ মনোগীত
মিশ্রিত করিলা শিখিপুচ্ছে।
বাসুদেব নন্দসুত ঘন সৌদামিনীবৎ
অঙ্গে অঙ্গ মিশ্রিতায় যৈছে।।
তেমনি মিশ্রিত হ’ল কলম আনিয়া দিল
গণেশের কলম করেতে।
মসী নীল সরস্বতী মস্যাধারে শ্বেত সতী
গণপতি লাগিল লিখিতে।।
ব্যাসের মুখ নিঃসৃত গণেশের নিজ হস্ত
লিখিল ভারত ভাগবত।
আমি অতি অভাজন হীন সাধন ভজন
বিদ্যাহীন না জানি সংস্কৃত।।
ত্রেতাযুগে সেতুবন্ধে ভল্লুক বানরবৃন্দে
বড়বৃক্ষ আনে বড় বীরে।
বড় বড় যে পর্বত বানরেরা আনে কত
হনুমান লোমে বন্ধি করে।।
রামকার্য করিবারে ব্যস্ত ভল্লুক বানরে
কাষ্ঠ বিড়ালের হৈল মন।
পড়িয়া সমুদ্র নীরে গড়াগড়ি দিয়া তীরে
সেতুবন্ধ উপরে গমন।।
মনে মনে বিবেচনা শ্রীপদে পাবে বেদনা
বালি দিলে খাদ পূর্ণ হয়।
পন্থা হয় সুকোমল যতেক কাষ্ঠ বিড়াল
কার্য করে সাধ্য অনুযায়।।
সেইমত লিখি পুঁথি হরিচাঁদ লীলাগীতি
রামকার্য মাজ্জারের ন্যায়।
আমি অজ্ঞ নাহি যোগ্য মার্জার হ’তে অযোগ্য
হরিলীলা মহাযোগ্য প্রায়।।
সজ্জনের দয়াগুণ হরিচাঁদ লীলাগুণ
প্রকাশিয়া সে গুণ গাওয়ায়।
যদ্যপি লেখনী ধরি বলি এ বিনয় করি
শ্রোতাগণ মহাজন পায়।।
শ্রোতাগণ হংসবৎ দোষ ছাড়ি গুণ যত
দুগ্ধবৎ করুণ গ্রহণ।
হরিলীলামৃত কথা তেমনি করি মমতা
কর্ণপথে পিও সর্বজন।।
হরিলীলা শ্রবণেতে ভবসিন্ধু পারে যেতে
পাতকীর নাহি আর ভয়।
ঘুচিবে শমন শঙ্কা হরিনামে মার ডঙ্কা
ধর পাড়ি ভাস ঐ নায়।।
দশরথ হীরামন মহানন্দ শ্রীলোচন
রামকান্ত যশোমন্ত পদে।
গুরুচাঁদ কৃপালেশ গোলোক নৃসিংহ বেশ
তারক রচকাভয় সাধে।।
শ্রীমদ্ ব্রজনাথ পাগলোপাখ্যান।
পয়ার।
সুধারস আশ্চর্য লীলার বিবরণ।
ব্রজনাথ উপাখ্যান শুন সর্বজন।।
ব্রজনাথ নামে এক প্রভুর ভকত।
বাল্য হ’তে গুরু সেবা করে অবিরত।।
গুরুপদে ছিল আর্তি দৃঢ় ভক্তি তার।
গুরুকার্য বিনে তার কার্য নাহি আর।।
জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড কিছু না মানিত।
জ্ঞানশূন্য ভক্তি অঙ্গ প্রেমে পুলকিত।।
সর্বদা উন্মাদ দশা চিন্তা জাগরণ।
ভাবনা জড়িমা কৃতি প্রলাপ বচন।।
গুরুপত্নী আজ্ঞা দিল কার্যান্তরে যেতে।
ব্রজ রহে জ্ঞানশূন্য গুরু আরোপেতে।।
ব্রজ তাহা নাহি জানে নাহি বাহ্যস্মৃতি।
ঠাকুরানী কহিলেন ঠাকুরে সম্প্রতি।।
আমি যাহা কহি তাহা নাহি কর গ্রাহ্য।
এ শিষ্য রাখিয়া তব হ’বে কোন কার্য।।
গৃহস্থের বাড়ী থাকে নাহি জ্ঞান বাহ্য।
মিছা এরে খেতে দেওয়া শীঘ্র কর ত্যজ্য।।
পাগলা স্বভাব ব্রজ নৈষ্ঠিক আচারে।
ঠাকুরানী সেই ভাব বুঝিতে না পারে।।
ঠাকুরানী কথা শুনি ঠাকুর ভুলিল।
ব্রজনাথে বলে যেতে ব্রজ না উঠিল।।
ব্রজভাবে মত্ত ব্রজ অঙ্গভঙ্গী করে।
নির্বোধ ভাবিল, ব্রজ ব্যঙ্গ করে মোরে।।
ক্রোধভরে ব্রজোপরে রুষিল ঠাকুর।
পাদুকা ধরিয়া দণ্ড করিল প্রচুর।।
হেন কালে ব্রজের হইল স্মৃতি জ্ঞান।
গুরু কেন দণ্ড করে না বুঝি সন্ধান।।
পায়ের খড়ম ধরি করেন প্রহার।
ব্রজ বলে কি স্বার্থক জনম আমার।।
হইয়াছে গুরু সেবা যে ত্রুটি আমার।
প্রতিশোধে করে গুরু পাদুকা প্রহার।।
দণ্ড পরিমাণে তার বেদনা যে কম।
প্রহারে ভাঙ্গিল তার হাতের খড়ম।।
ব্রজ কহে শিষ্য নহে আমি দুষ্ট ভণ্ড।
নৈলে কেন গুরু হেন করে গুরুদণ্ড।।
আমাকে মারিয়া গুরু হাতে পেল ব্যথা।
বুঝিতে না পারি আমি অপরাধ কোথা।।
কি বুঝিয়া গুরু মোরে এতেক বৈমুখ।
সে ব্রজনাথের মনে হৈল বড় দুঃখ।।
গুরু অপরাধী তার জীবনে কি ফল।
গুরু অপরাধী তার জীবনে কি ফল।
জীবন ত্যজিতে ব্রজ হইল চঞ্চল।।
মনোদুঃখে ধারা চক্ষে কাতর অন্তরে।
ধীরে ধীরে যায় ব্রজ চকের ভিতরে।।
সেই চকে আছে এক হিজলীকা বৃক্ষ।
জনরব আছে গাছে থাকে এক যক্ষ।।
একাকী পাইলে কারে করয় সংহার।
রাত্রে কেহ নাহি যায় দিনে লাগে ডর।।
আরো সেই গ্রামে ছিল শার্দূলের ভয়।
দুরন্ত সদন্ত বরা চকেতে ভ্রময়।।
হিজলীকা বৃক্ষমূলে ব্রজ বসে রয়।
নিশাকালে ব্যাঘ্র ডাকে ব্রজ ডাকে আয়।।
শার্দূল আসিয়া ব্রজনাথকে ধরিল।
অঙ্গ ঘ্রাণ ল’য়ে ব্যাঘ্র ফিরিয়া চলিল।।
দাঁতাল বরাহ আসে গণ গণ করি।
ব্রজ ডাকে আয় আয় বলে হরি হরি।।
শার্দূল না মারে মোরে তুই মোরে মার।
গুরু ত্যাগী দেহে মোর নাহি দরকার।।
শার্দূল বরাহ এসে তরাসে পালায়।
ব্রজ ভাবে খাক্ ওরা তারা নাহি খায়।।
হিংস্রক শার্দূল বরা হিংসা নাহি করে।
আশ্চর্য গণিয়া ব্রজ ভেবেছে অন্তরে।।
এবে বুঝি মৃত্যু নাই মৃত্যু আছে পাছে।
না জানি আমাতে গুরুর কোন কার্য আছে।।
তবে কেন মৃত্যু ইচ্ছা এ বড় প্রমাদ।
গুরু ঈশ্বরের কার্য কেন করি বাদ।।
আমাতে কি কার্য আছে তার মনে আছে।
বাঁচিবার চেষ্টা করি উঠি গিয়া গাছে।।
মারে কি বাঁচায় তার মনে যাহা লয়।
শ্রীগুরুর দেহ কেন আমি করি লয়।।
বৃক্ষোপরে উঠিল সে ভক্ত ব্রজনাথ।
দেখে এক মহামূর্তি হইল সাক্ষাৎ।।
বলে ব্রজা আলি কেন এই বৃক্ষপর।
আমি কাল এই বৃক্ষে মম অধিকার।।
ব্রজ বলে যেই মার সেই মোর কাল।
যাহা ইচ্ছা তাহা কর শ্রীনন্দ দুলাল।।
সে মহাপুরুষ কহে নাহি তোর কষ্ট।
আমি তোর কৃষ্ণ হই আমি তোর ইষ্ট।।
যশোদা দুলাল আমি ভকত বৎসল।
তোর জন্য বাছা আমি হ’য়েছি পাগল।।
গুরুমন্ত্র লয় জীবে মোরে পাইবারে।
এই আমি পশিলাম তোমার শরীরে।।
গুরুনিষ্ঠা লোক হয় আমার পরাণ।
তুই মোর প্রাণ বাছা আমি তোর প্রাণ।।
দুষ্ট দুশ্চারিণী তোর গুরুর রমণী।
গুরুদণ্ড করিল তোমারে যাদুমণি।।
গুরুপাট নিকটেতে আর নাহি যেও।
হরি বলে ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে খেও।।
এবে আমি হইয়াছি যশোমন্ত সুত।
তোমার দেহেতে হইলাম আবির্ভূত।।
মুখডোবা ছিনু বাসুদেব মূর্তি ধরে।
যশোমন্ত সুত হইনু রামকান্ত বরে।।
পরশুরামের দেহে বিষ্ণুতেজ ছিল।
রামের দেহেতে তেজ যেমন মিশিল।।
যশোমন্ত সুত দেখা যেখানে পাইব।
আমি গিয়া সেই দেহে মেশামেশি হ’ব।।
তোমা হেন ভক্ত ছেড়ে না যা’ব কখনে।
আমি তোর তুই মোর জীবনে মরণে।।
এত শুনি ব্রজনাথ ভ্রমিয়া বেড়ায়।
কখন বা বৃক্ষতলা কখন আলয়।।
মনে চিন্তা যশোমন্ত সুত কোন জন।
কবে তার শ্রীঅঙ্গ করিব দরশন।।
এদিকেতে সফলানগরে প্রভু বাস।
ব্রজনাথ মিলনেতে মনে হ’ল আশ।।
উত্তরাভিমুখে প্রভু একদিন চলে।
ডাকে প্রভু আহারে ব্রজারে কোথা বলে।।
এমন সময় উপস্থিত ব্রজনাথ।
বসাইল প্রভু তারে হাতে ধ’রে হাত।।
নাটু আর বিশ্বনাথ সঙ্গে দুইজন।
দোঁহে দেখে দু’জনার অপূর্ব মিলন।।
বার তের বৎসর বয়স এক ছেলে।
পরিধান পীতাম্বর বনমালা গলে।।
রতন বলয় হাতে চরণে নুপুর।
নবঘনশ্যাম বর্ণ মুরতি মধুর।।
শিরে শোভে শিখিপাখা করে শোভে বাঁশী।
বিধুমুখে মধুমাখা মৃদু মৃদু হাসি।।
ব্রজনাথ অঙ্গ হ’তে উঠে এক জ্যোতি।
সেই জ্যোতি হ’তে এই মধুর মুরতি।।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম বাঁকা হাসি কথা কয়।
হরিচাঁদ শ্রীঅঙ্গেতে সে অঙ্গ মিশায়।।
ঠিক যেন ব্রজধামে যমুনা মাঝেতে।
বাসুদেব পড়ে বসুদেব হাত হ’তে।।
সেই দেহে আবির্ভূত গোলোকবিহারী।
বসুদেব সেই পুত্রে নিল কোলে করি।।
যশোদার গর্ভে হয় যমজ সন্তান।
সেই পুত্র এই পুত্র দোঁহে মিশে যান।।
ভাগবতে শ্লোক আছে তাঁহার প্রমাণ।
ব্যাসদেব রচিত শ্লোক শুকদেব গান।।
শ্লোক
বসুদেবগৃহে জাত বাসুদেহখিলাত্মনি।
নীলনন্দসুতে রমা ঘনে সৌদামিনী যথা।।
গর্গ উবাচ
সত্যে শ্বেতবর্ণানি চ ত্রেতায়াং রক্তবর্ণানি।
পীতবর্ণ তথা কলৌ ইদানিং কৃষ্ণতাং গতঃ।।
পয়ার
পীতবর্ণ কলিকালে যখনে গৌরাঙ্গ।
দ্বাপরে নারদ কহে লীলার প্রসঙ্গে।।
নারদীয় পুরাণে
কলৌ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষ্মীকান্তো ভবিষ্যামি।
সন্ন্যাসঃ গৌরবিগ্রহঃ সান্ত্বায়পুরুষোত্তম।।
পয়ার
স্বয়ং এর কার্যে জন্মে ব্রহ্মা ইন্দ্রে ভ্রম।
কভু নাহি হয় তার গর্ভেতে জনম।।
শচীগর্ভে অবতীর্ণ হইল প্রকাশ।
ভারতীর কাছে যবে লইল সন্ন্যাস।।
হা কৃষ্ণ বলিয়া প্রেমে হইল বিভোর।
ভারতী কপিন দিল আর দিল ডোর।।
কি মন্ত্র দেবেন তাই ভারতী ভেবেছে।
বলেন গৌরাঙ্গ প্রভু ভারতীর কাছে।।
স্বপনে পেয়েছি মন্ত্র গুরু তোমা কই।
ভারতী বলেন সন্ন্যাসের মন্ত্র অই।।
সন্ন্যাস গ্রহণ হ’লে নামান্তর লাগে।
কি নাম রাখিব গুরু ভেবেছেন যোগে।।
হেনকালে শূন্যবাণী কহে থেকে শূন্য।
রাখ নিমাইর নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।।
সেই কালে নিত্যবস্তু হৈল আবির্ভূত।
নৈলে কেনে দণ্ড ভাঙ্গে নিতাই অবধূত।।
এইভাবে আবির্ভূত মিশামিশি হয়।
অবতারে নিত্যযোগ নাহিক সংশয়।।
নাটু আর বিশ্বনাথ এ লীলা দেখিয়া।
হরি বলি বাহু তুলি উঠিল নাচিয়া।।
ঠাকুর বলেন শুন ওরে ব্রজনাথ।
যাবি না থাকিবি তুই আমাদের সাথ।।
ব্রজনাথ বলে আমি আর কোথা যাব।
প্রাণ থুয়ে কোথা গিয়ে এ দেহ জুড়াব।।
রসনা বাসনা করে ব্রজনাথ সঙ্গ।
ব্রজনাথ শান্তিনাথ দোঁহে এক অঙ্গ।।
সফলানগরী শ্রীহরির আবির্ভাব ও শ্রীহরির অঙ্গে
পয়ার
সফলানগরী শ্রীহরির আবির্ভাব।
ধন্য ধন্য বলিয়া হইল জনরব।।
শনিবার আর যে মঙ্গল বার হ’লে।
ঠাকুর বসিত ঝোঁকে ঝোঁকে হেলে দুলে।।
প্রাতঃসূর্য মত হ’ত ঠাকুরের মুখ।
কত লোকে গিয়া তথা দেখিত কৌতুক।।
প্রাতঃ হ’তে প্রহরেক থাকিত তেমন।
সকলে করিত হরিনাম সংকীর্তন।।
ব্যধিযুক্ত লোক যত সেই খানে যেত।
মুখের বাক্যতে সব আরোগ্য করিত।।
একদিন হরি ঠাকুরের বার মানি।
সফলানগরে হয় জয় জয় ধ্বনি।।
মহাপ্রভু বলে ব্রজ চল মোরা যাই।
কেমন হরির বার দেখে আসি তাই।।
তাহা শুনি ব্রজনাথ সঙ্গেতে চলিল।
দুই প্রভু একত্র হইয়া চলে গেল।।
শ্রীহরি ঠাকুর মধ্যে লোক চতুঃপার্শ্বে।
দুই প্রভু উপনীত হেনকালে এসে।।
যখনে শ্রীহরিচাঁদ উপনীত হ’ল।
প্রাতঃসূর্য বর্ণ মুখ বিবর্ণ হিইল।।
দিবসে উঠিলে চন্দ্র হীনপ্রভা যেন।
শ্রীহরিদর্শনে তেম্নি সে হরি বিবর্ণ।।
ছিল যে ঠাকুরের মুখ প্রাতঃসূর্য বর্ণ।
মুখ হ’তে বাহিরিল সে জ্যোতি সম্পূর্ণ।।
চতুঃপার্শ্বে লোক সব করিল দর্শন।
হরিচাঁদ অঙ্গে জ্যোতি হৈল সম্মিলন।।
চুম্বকে চুম্বক দিয়া লৌহ টেনে লয়।
মেঘে সৌদামিনী যথা হ’ল তার প্রায়।।
সে ঠাকুর জ্যোতি হরিচাঁদেতে মিশিল।
ব্রজনাথে ল’য়ে হরি নিজালয় গেল।।
তখন সে ডেকে বলে সব ভক্ত ঠাই।
যে আমাতে ছিল বাপু সে আমাতে নাই।।
এতদিন যার ধনে ছিনু অধিকারী।
যার ধন সেই নিল কি করিতে পারি।।
তবে যদি ভক্তি করি পার গো ডাকিতে।
মুক্তি পাবে যার যার ভক্তির গুণেতে।।
যে মানুষ মম দেহে আবির্ভূত ছিল।
ঐ যে সে মানুষ মানুষে মিশিয়া গেল।।
মানুষে মানুষ সঙ্গে মিশে গেল আজ।
গেল রবি কহে ভাবি কবি রসরাজ।।
ব্রজনাথের দ্বারা মৃত গরুর জীবন দান।
পয়ার।
ব্রজা পাগলা ব্রজা পাগলা বলে হ’ল খ্যাতি।
হরিচাঁদ হয়েছে সে ব্রজা পাগলার সাথী।।
সংসারী সংসার কাজ কিছুই করে না।
কোথাও বসিলে আর উঠিতে চাহে না।।
ব্রজনাথ বিশ্বনাথ আর নাটু হরিচাঁদ।
কয়জনে পাতিয়াছে পীরিতির ফাঁদ।।
কভু বৃক্ষশাখামূলে কভু বৃক্ষমূলে।
কভু গোচারণ মাঠে কভু ভূমিতলে।।
বসিয়া থাকেন কয় প্রভু একত্তর।
কোন কোন দিন গিয়া খায় কারু ঘর।।
কেহ কেহ ডেকে লয় সেবার জন্যেতে।
বিশার জননী দেন প্রায় সময় খেতে।।
বেশী থাকে বিশাইর মাতার কাছেতে।
মনে হ’লে কোন কাজ করে তৎক্ষণাতে।।
তিনজনে কভু যদি কোন কাজ ধরে।
দশ কিষাণের কাজ করে দিতে পারে।।
কোনদিন কার্য নাহি করে দিনভরি।
বড় কাজ করে যদি দণ্ড দুই চারি।।
তাহাতে যে কার্য করে হেন জ্ঞান হয়।
দশ দিনের কার্য করে মুহূর্ত সময়।।
বিশ্বনাথ বাড়ী কভু নাটুদের বাড়ী।
কোন দিন কার্য প্রভু করে নিজ বাড়ী।।
অধিকাংশ কাজ করে বিশেদের বাড়ী।
অল্প অল্প কাজ করে নাটুদের বাড়ী।।
মধ্যমাংশ কাজ করে প্রভু নিজালয়।
হয় করে, নয় করে হরিগুণ গায়।।
কোনদিন বসি প্রভু ঘুড়ি উড়াইত।
নির্মিয়া মানুষ ঘুড়ি উড়াইয়া দিত।।
প্রভু বলে ওরে বিশে দেখ তোরা চেয়ে।
এইভাবে গুণ ধরি দিয়াছি উড়া’য়ে।।
ব্রজনাথ বিশে আর নাটুয়া পাগল।
তাহা দেখি আনন্দে বলিত হরিবোল।।
একদিন তিনজন প্রেমানন্দভরে।
পতিত ভূমেতে ব’সে বাটীর উত্তরে।।
ঠাকুরের নিজের পালের শ্রেষ্ঠ গরু।
ব্যাধি হ’য়ে, হইয়াছি মরিবার শুরু।।
ক্রমেই বাড়িল ব্যাধি গরু লালাইয়া।
নাসারন্ধ্রে শ্লেষ্মা উঠে গিয়াছে পড়িয়া।।
নোয়া কর্তা সেজ কর্তা গরুর নিকটে।
গরু ল’য়ে পড়েছেন বিষম সংকটে।।
বড় কর্তা ছোট কর্তা কহে উভয়েরে।
কেন বসিয়াছ মরা গরু কোলে করে।।
পেটফুলে উঠিয়াছে পা হ’য়েছে টান।
দাঁতে দাঁতে লেগে গেছে উত্তার নয়ন।।
বাঁচিবে না ঐ গরু প্রায় মরে গেছে।
উঠে এস থাক কেন বলদের কাছে।।
এত শুনি উঠে এল নিরানন্দ চিত।
হেনকালে কয় প্রভু এসে উপস্থিত।।
বসিয়াছে তিন প্রভু দিবা অবশেষ।
বড়কর্তা কৃষ্ণদাস রাগে করে দ্বেষ।।
তিন জন ঠাকুরালী করিয়া বেড়াও।
কি গুণেতে বসে বসে এত ভাত খাও।।
ঠাকুর কোলা’য়ে এত ভাত খেয়ে ফের।
গোগৃহে মরেছে গরু রক্ষা গিয়ে কর।।
বেড়ায়ে খেয়ে খেয়ে করিলি পয়মাল।
এই গরু বাঁচিলে বুঝিব ঠাকুরাল।।
বিশারে বাঁচালি বলে ওরে হরিদাস।
এই গরু বাঁচাইয়া খাওয়া দেখি ঘাস।।
বড় সাধু ব্রজা তুই পাগল কোলা’স।
হরির সঙ্গেতে তুই অনেক বেড়াস।।
এই গরু আ’জ যদি না পার বাঁচাতে।
তা’হলে তোদের আর নাহি দেব খেতে।।
এত শুনি ব্রজ চাহে ঠাকুরের ভিতে।
ঠাকুর ব্রজকে ব’লে দিলেন ইঙ্গিতে।।
যারে ব্রজ আমি তোরে দেই অনুমতি।
ওঠ বলি বলদেরে মার গিয়া লাথি।।
হুঙ্কার করিয়া ব্রজ করি হরিধ্বনি।
বলদেরে লাথি গিয়া মারিল অমনি।।
ওঠ ওঠ ওরে গরু র’লি কেন শুয়ে।
অমনি উঠিয়া গরু গেল দৌড়াইয়ে।।
যে পতিত জমিতে ঠাকুর বসে ছিল।
সে জমিতে গিয়া ঘাস খাইতে লাগিল।।
বড়কর্তা বলে ওরে ব্রজ হরিদাস।
অপরাধী হইয়াছি তোমাদের পাশ।।
আজ হতে চিনিলাম তোমা সবাকারে।
এত বলি বড় কর্তা অনুনয় করে।।
রচিল তারকচন্দ্র মহানন্দ ভাষে।
বড়কর্তা সুখনীরে মহানন্দে ভাসে।।
বড় কর্তার অনুনয়
লঘু ত্রিপদী
বড় কর্তা কহে বার্তা শুন হরিদাস।
তব খেলা সব লীলা জগতে প্রকাশ।।
এতদিনে নাহি চিনে কতযে বলেছি।
ব্রজনাথে বিশ্বনাথে চিনেছি চিনেছি।।
গেল চিন্তে তোমাচিন্তে আর চিন্তা নাই।
মনোভ্রান্তে তোমাচিন্তে পারিনারে ভাই।।
ধন্য মাতা ধন্য পিতা ধন্য তুমি ভাই।
তোমা হেন ভাই যেন জন্মে জন্মে পাই।।
ধন্য বংশ অবতংশ তুমিযে আসিয়ে।
আমি ধন্য জগন্মান্য তোমা ভাই পেয়ে।।
তুমি আদি গুণনিধি পালক পালিকা।
তুমি স্থুল বৃক্ষমূল মোরা পত্র শাখা।।
ভক্তসঙ্গে মনোরঙ্গে বসে থাক ঘরে।
দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে খাওয়াব তোরে।।
আর তিন ভাই দীন তারা শাখা পত্র।
তব গুণে জগজ্জনে হইবে পবিত্র।।
কর খেলা সব বেলা ভক্তগণ ল’য়ে।
ক্ষুদা হ’লে সবে মিলে যেওরে খেয়ে।।
আমি ভৃত্য চির নিত্য খাটিব সংসারে।
তব সেবা রাত্র দিবা করিব সাদরে।।
ভক্তিময় অনুনয় করে বড়কর্তা।
শ্রীতারক সুরচক হরিলীলা বার্তা।।
মহাপ্রভুর মহিমা প্রকাশ ও কুষ্ঠব্যাধি মুক্তির বিবরণ।
দীর্ঘ ত্রিপদী।
হরিকথা রসরঙ্গে ভক্তগণ ল’য়ে সঙ্গে
লীলা করে কৈশোর সময়।
কৈশোরের অবশেষ যৌবন প্রথমাবেশ
ঈশ্বরত্ব প্রকাশিত হয়।।
হরি পিতা যশোমন্ত নরলীলা করি অন্ত
শ্রীধাম গোলোকে চলে গেছে।
শেষে ঘটিল প্রমাদ জমিদার সঙ্গে বাদ
সে প্রস্তাব লেখা হইতেছে।।
যবে রামদিয়া যান ব্রজনাথ সঙ্গে র’ন
বিশ্বনাথ সঙ্গে বেড়ায়েছে।
নাটু এসে মিশে সঙ্গে হরিনাম প্রেমরঙ্গে
প্রেমানন্দে মত্ত হ’য়ে আছে।।
এইভাবে কত লীলা রাখালের সঙ্গে খেলা
একদিন নিভৃতে বসিয়া।
মুখে বলে হরিবোল আসিয়া ব্রজ পাগল
কহিতেছে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।।
করি না সংসার কাজ কহিতে বড়ই লাজ
শুন প্রভু আমি বড় ভণ্ড।
আমি বড় অভাজন মন্দ বলে গুরুজন
ভাইসবে মোরে করে দণ্ড।।
প্রভু বলে তারা ভণ্ড তোরে যারা করে দণ্ড
তাহা আমি জানি ভাল মতে।
করেছে চপটাঘাত আর করে মুষ্ট্যাঘাত
সে আঘাত আমার অঙ্গেতে।।
শ্রীঅঙ্গেতে ছিন্ন ভিন্ন আছে প্রহারের চিহ্ন
ভক্ত গণে করে অনুযোগ।
এ অঙ্গে করে প্রহার সেই মুঢ় দুরাচার
তার অঙ্গে হো’ক মহারোগ।।
মেরেছিল বড় ভাই তিন দিন মধ্যে তাই
ঘটিল যে তাহার কপালে।
মেরেছিল যেদিনেতে সেই দিবস হইতে
হস্ত তার উঠিয়াছে ফুলে।।
বিষম হস্ত বেদনা মহাব্যাধির সূচনা
গায় মুখে চাকা চাকা হ’ল।
কিছুদিনের পরেতে গলিত হইল তা’তে
ক্লেদ রক্ত বহিতে লাগিল।।
যেদিন বলদ বাঁচে অনেকে তাহা জেনেছে
পরস্পর জানাজানি হয়।
কেহ করিল বিশ্বাস কেহ করে অবিশ্বাস
কেহ এসে গরু দেখে যায়।।
লোকমুখে শুনি কথা ব্রজনাথ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা
বলে ভাই ক্ষম অপরাধ।
ছোট ভাই বলে গণি তোমাকে নাহিক চিনি
দোষ করে ঘটিল প্রমাদ।।
ব্রজ বলে শুন ভাই তব কিছু দোষ নাই
কার কাজ কেবা যেন করে।
যার কাজ সেই করে লোকে বলে লোকে করে
যা করে শ্রীহরিচাঁদ করে।।
ক্ষমাকর্তা প্রেমকর্তা রোগের আরোগ্য কর্তা
কর্মকর্তা কর্ম অনুসারে।
কেটে যাবে কর্মভোগ আরোগ্য হইবে রোগ
পার যদি ধর গিয়া তারে।।
ঠাকুরের পদে পড়ি ভূমে লুটে গড়াগড়ি
শির কুটি’ বুকেতে কিলায়।
ক্ষমা কর অপরাধ ওহে প্রভু হরিচাঁদ
পতিত পাবন দয়াময়।।
বহু রোদনের পরে হরিচাঁদ বলে তারে
শোন যুক্তি মুক্তির বিধান।
ব্রজনাথ পদানত হ’য়ে খা চরণামৃত
কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠ করি মান।।
যেইমাত্র করে তাই আর তার ব্যাধি নাই
সবে করে জয় জয় ধ্বনি।
রোগেতে হইয়া মুক্ত সে’ হলো প্রভুর ভক্ত
ব্যক্ত হ’ল অমনি অবনী।।
ত্যাজিয়া গোলোকপুরী ওঢ়াকাঁদি এল হরি
অদ্বৈত গোলোক হুহুঙ্কারে।
সুকবি তারকচন্দ্র বলে প্রভু হরিশচন্দ্র
উর মম হৃদয় গহ্বরে।।
প্রভুদের জমিদার সঙ্গে বিবাদ বিবরণ।
ত্রিপদী।
কৃষ্ণদাস হরিদাস, আর শ্রীবৈষ্ণবদাস,
তিন প্রভু যুবত্ব সময়।
কৈশোরেতে গৌরিদাস, আর শ্রীস্বরূপদাস,
পঞ্চদেহে এক প্রাণ প্রায়।।
প্রভুদের জমিদার, সূর্যমণি মজুম্দার,
অষ্টমের লাটের সময়।
দুর্ভিক্ষে কষ্ট প্রজার, আদায় না হয় কর,
গোমস্তা ভাবিয়া নিরুপায়।।
সফলাডাঙ্গা কাছারি, চিন্তাকুল হ’য়ে ভারি,
কিসে রক্ষা হবে রাজ্যপাট।
কাছারিতে টাকা নাস্তি, না দিলে অষ্টম কিস্তি,
জমিদারি হ’য়ে যায় লাট।।
গোমস্তা যাইয়া শেষে, বড়কর্তা কৃষ্ণদাসে,
বলিলেন অতি সকাতরে।
আপনার জমিদার, সূর্যমণি মজুম্দার,
এ বিপদে কেবা রক্ষা করে।।
শ্রেষ্ঠ প্রজা আপনারা, দায়ে ঠেকেছি আমরা,
বিপদে দিলাম এই ভার।
এই তালুক সমস্ত, যখনেতে বন্দোবস্ত,
আপনি জামিন ছিলে’ তার।।
বড়কর্তা দিল সায়, কহে কত মুদ্রা দায়,
করিব তাহার উপকার।
মুদ্রা ল’ব সাতশত, গোমস্তা করে শপথ,
পৌষমাস, শুধিব এ ধার।।
গোমস্তার শুনি বাণী, গৃহ হ’তে মুদ্রা আনি,
অমনি দিলেন গোমস্তায়।
গত হ’ল পৌষমাস, দুর্ভিক্ষ হ’ল বিনাশ,
ধার শোধিবারে নাহি যায়।।
উৎপাদন হ’ল ধান্য, ধান্যে ধরা পরিপূর্ণ,
প্রজাগণ হৈল বড় সুখী।
শেষ চৈত্র মাস শুদ্ধ, আদায় বকেয়া শুদ্ধ,
প্রজাদের কর নাহি বাকী।।
কৃষ্ণদাস বড়কর্তা, গোমস্তারে কহে বার্তা,
কড়ার হইল কেন ভ্রষ্ট।
আদায় হইল কর, বাকী না রহিল আর,
ভূস্বামীর নাহি কোন কষ্ট।।
গোমস্তা করে উত্তর, আদায় হ’য়েছে কর,
তোমাদের ধার শোধ দিতে।
রাজার হুকুম নাই, কারণ হ’য়েছে তাই,
বিশেষতঃ ভ্রম মম চিতে।।
এতেক শুনিয়া বার্তা, ক্রোধে কহে বড়কর্তা,
এ নহে সত্যের ব্যবহার।
বিশ্বাসী লোকের স্থলে, হেনরূপ নাহি চলে,
বৃথা হ’ল সত্য অঙ্গীকার।।
শুন বলি মহাশয়, নিবেদি’ তোমার পায়,
কহ গিয়া জমিদার ঠাই।
বৈশাখে কি জ্যৈষ্ঠ মাসে, কিস্তি আদায়ের শেষে,
তখন আমার টাকা চাই।।
ফিরে আসিল গোঁসাই, গোমস্তা শুনিয়া তাই,
কহে গিয়া জমিদার পাশে।
অষ্টমের কিস্তি শেষে, আগামীতে জ্যৈষ্ঠ মাসে,
টাকা দিতে হ’বে কৃষ্ণদাসে।।
জ্যৈষ্ঠ মাস গত হ’ল, আষাঢ় শ্রাবণ গেল,
অষ্টম আদায় হৈল সায়।
ধার নাহি দিল শোধ, বড়কর্তা হ’য়ে ক্রোধ,
গোমস্তার পার্শ্বে গিয়া কয়।।
দায় ঠেকে জমিদার, বিপদ হ’তে উদ্ধার,
ধার করে তোমার দ্বারায়।
হেন দায়ের কারণে, আপনার কথা শুনে,
টাকা দেই মুখের কথায়।।
এখন এরূপ কার্য, আর নাহি হয় সহ্য,
গ্রাহ্য নাহি ধার শোধিবারে।
ত্রেতাযুগে বিভীষণ, বলেছিল যে বচন,
তাই বুঝি ঘটিল আমারে।।
বলিল রামের ঠাই, রামায়ণে শুনি তাই,
রাজত্ব ব্রহ্মত্ব কলি কালে।
রাজা হবে হিংসুক, ব্রাহ্মণ হবে মিথ্যুক,
সেই দুই আমার কপালে।।
যাতায়াতে হ’য়ে ত্যক্ত, সহজে কহিয়া শক্ত,
বিরক্ত হইয়া অতিশয়।
নিজ গৃহে এল ফিরে, কহিলেন সবাকারে,
টাকা নাহি দিল গোমস্তায়।।
প্রবঞ্চনা মহাকষ্ট, ক্ষণে কাঁপে অধরোষ্ট,
টাকা বলে নহে কিছু ক্ষুণ্ণ।
মন্দের হ’ল সূচনা, কহে তারক রসনা,
বিশ্বরূপ ক্রোধে পরিপূর্ণ।।
জমিদারের অত্যাচার।
পয়ার।
ভাদ্রমাসে জমিদার কাছারী আসিয়া।
অই সব বাচনিক শুনিলেন বসিয়া।।
গোমস্তা বলিল সব বাবুর গোচরে।
কৃষ্ণদাস কাছারী আসিয়া নিন্দা করে।।
সহজে বিনয় করি রামায়ণ কয়।
নিন্দা করিয়াছে তার মনে যত লয়।।
বিভীষণের উপাখ্যান কহে বার বার।
কলির ব্রাহ্মণ রাজা দুয়ের আচার।।
শুনে বলিলেন মজুমদার মহাশয়।
টাকাগুলি না দে’য়া ত’ বড়ই অন্যায়।।
গোমস্তা বলিল যদি টাকা নিতে পারে।
কাছারী আসিয়া কেন এত নিন্দা করে।।
আছে নয় কৃষ্ণদাস বড় মান্যমান।
তমে তম ভর্ৎসে মম কিসে থাকে মান।।
মজুমদার বলে চল যাইব এখনে।
এত নিন্দা করে কেন আসি গিয়া শুনে।।
নৌকায় চলিল দুই পেয়াদা লইয়া।
গোমস্তার সঙ্গে ঘাটে উত্তরিল গিয়া।।
গোমস্তা কহিছে’ কৃষ্ণদাসে ধ’রে আন।
দুই বৎসরের কর দেনা কি কারণ।।
পেয়াদা বাটীতে গিয়া বলে কৃষ্ণদাসে।
খাজনার জন্য বাবু ডাকে ঘাটে ব’সে।।
বড়কর্তা মাঝে মাঝে খাইতেন সিদ্ধি।
সিদ্ধি মন্ত্র জপিতেন হইবারে সিদ্ধি।।
যে সময় পেয়াদা আসিয়া ডাক দিল।
সিদ্ধি সেবনের আয়োজন ক’রেছিল।।
সাজিয়া গাঁজার কল্কি দিতেছে আগুণ।
সিদ্ধি সেবনের জন্য হইয়া নিপুণ।।
পেয়াদারে বলে থাক কিছুকাল বসি।
বল গিয়া জমিদারে গাঁজা খেয়ে আসি।।
ধরিল গাঁজার কল্কি করজপ করি।
গাঁজায় দিলেন টান বলে হরি হরি।।
ক্ষণকাল দোম করি না ছাড়ি নিঃশ্বাস।
হইল আরক্ত নেত্র যেন কৃত্তিবাস।।
পেয়াদাকে কহে বাণী অন্তর নির্মল।
কোথা আছে জমিদার চল দেখি চল।।
ঠাকুর চলিল বড় হরষিত চিতে।
টাকা বুঝি পা’ব আজ ভাবিল মনেতে।।
বড়কর্তা জমিদারে সবিনয় কন।
আ’জ মম সুপ্রভাত রাজ দরশন।।
আপনার বাড়ী এ যে আপনার ঘর।
দয়া করে আসুন এ বাড়ীর উপর।।
গোমস্তা কহিছে তুমি কর যে দিলে না।
কর্তা বলে আগে শোধ কর মম দেনা।।
গোমস্তা হুকুম দিল পেয়াদার পর।
কৃষ্ণদাস কাছে লও দুই সোনা কর।।
তব টাকা যেই জন হাওলাত নিছে।
আদায় করগে টাকা গিয়া তার কাছে।।
কর্তা কহে আগে কি তোমার টাকা দিব।
কিম্বা আমাদের টাকা অগ্রেতে পাইব।।
খোদ কর্তা জমিদার কহিল বিহিত।
আগে আগ পিছে পাছ এইত উচিৎ।।
বড়কর্তা কহে বার্তা এই কথা ভাল।
বাবুর হুকুম মম টাকা গুলি ফেল।।
গোমস্তা হুকুম দিল পেয়াদার ঠাই।
আন ধ’রে কৃষ্ণদাসে বাকী কর চাই।।
ঘাড় ধরে কৃষ্ণদাসে নৌকাপরে আন।
এতেক আস্পর্ধা ওরে কর অপমান।।
পেয়াদা এতেক শুনি গেল বাড়ীপরে।
ধরিবারে গেলে ধরে অপমান করে।।
পেয়াদার অপমানে গোমস্তা ধাইল।
ঠাকুরের কয় ভাই রাগিয়া উঠিল।।
গোমস্তারে ধ’রে দুই পেয়াদার সাথ।
মারিল চপেটাঘাত মুষ্টিক আঘাত।।
এমতি মারিল মার দুষ্ট গোমস্তারে।
মৃতপ্রায় হইয়া রহিল ভূমিপরে।।
মজুমদার মহাশয় নৌকাপরে ছিল।
নৌকা ধ’রে টেনে এনে কূলে উঠাইল।।
ভয় পেয়ে জমিদার থরহরি কাঁপ।
বলে ওরে কৃষ্ণদাস তুমি মোর বাপ।।
প্রভু হরিচাঁদ বলে ক্ষমা কর দাদা।
মার হইয়াছে যবে মেরেছ পেয়াদা।।
বিশেষ ব্রাহ্মণ জাতি ব্রাহ্মবীজে জন্ম।
বিশেষতঃ জমিদার মারিলে অধর্ম।।
প্রভুমাতা অন্নপূর্ণা নিষেধে তখন।
শুন ওরে কৃষ্ণদাস মেরনা ব্রাহ্মণ।।
আমি যাহা বলি তাহা শুনরে সকলে।
ভালভাবে নৌকা নামাইয়া দেও জলে।।
পেয়াদা গোমস্তা দেও নায় উঠাইয়া।
হোক্গিয়া বড় মানুষ এ টাকা না দিয়া।।
মাতৃআজ্ঞা পেয়ে শান্ত হ’ল পাঁচ ভাই।
আজ্ঞা অনুসারে কার্য করিলেন তাই।।
বড় অপমান হ’ল পেয়াদা-গোমস্তা।
বাবু বলে কাজ হ’ল বড় অব্যবস্থা।।
ভদ্রভাবে কৃষ্ণদাস কৈল সম্ভাষণ।
ধ’রে আন এ হুকুম দিলে কি কারণ।।
কি দোষেতে করি এ প্রজার অপমান।
না দেখি পাতকী আর আমার সমান।।
এখনে প্রজার ঠাই করি পরিহার।
ধর্ম থাকে শোধ হ’লে এই ঋণধার।।
এবে আর অন্য প্রজা মোরে না মানিবে।
এই অপমানে সবে অবজ্ঞা করিবে।।
ইহার বিধান কিবা করি বল তাই।
গোমস্তা চলরে চল আগে দেশে যাই।।
গোমস্তা ব্যবস্থাহীন প্রমাদ ঘটা’ল।
রসরাজ কহে কাজ নহে কভু ভাল।।
জমিদার কর্তৃক প্রজা উচ্ছন্ন বিবরণ।
পয়ার।
নিজন ভবনেতে এসে মন্ত্রীগণ লয়ে।
মন্ত্রণা করিল সবে একত্র হইয়ে।।
বড় জমিদার কহে মন্ত্রণা প্রবীণ।
বন্দোবস্ত সময়েতে তাহারা জামিন।।
যে সময়ে জমিদারী বন্দোবস্ত হ’ল।
শ্রেষ্ঠ প্রজা কৃষ্ণদাস জামিনাত ছিল।।
প্রজা দমনের তরে এই পরামিশ।
শরীক সাব্যস্ত করি করহ নালিশ।।
শরীকের অংশ নেয় কর নাহি দেয়।
কান্ট্রিবিউশনের নালিশ হ’ল সায়।।
তালুকের শরীক যে করিল সাব্যস্ত।
কর নাহি দেয় বলে করিল দরখাস্ত।।
কোনরূপ জবাব না দিলেন গোঁসাই।
তের হাজারের ডিক্রী হইলেন দায়ী।।
আদালতের পিয়ন আসিয়া বাটী’পরে।
অস্থাবর মাল বিক্রি করিলেন পরে।।
মজুমদার নিজ নামে খরিদ করিল।
অস্থাবর সম্পত্তি সকল লুটে নিল।।
ঠাকুরেরা পাঁচ ভাই হ’ল ফেরয়ার।
বিষয় সম্পত্তি কিছু না রহিল আর।।
সম্পত্তি লুঠিয়া নিল না হইল বাদী।
সব ছাড়ি পাঁচ ভাই এল ওঢ়াকাঁদি।।
প্রথম ভাদ্রেতে গোমস্তাকে মারিলেন।
শেষ ভাদ্রে পাঁচ ভাই বাটী ত্যাজিলেন।।
বিষয় সম্পত্তি যত সব দিল ছাড়ি।
রামদিয়া থাকিলেন সেনদের বাড়ী।।
সব লুঠে নিয়া নিল উত্তরের ঘর।
করিল কাছারী ঘর কাছারীর পর।।
সাত দিন পর সে কাছারী পুড়ে গেল।
দুইগোলা ধান্য পুড়ে ভস্মীভূত হ’ল।।
সূর্যমণি মজুমদার পার্বতীচরণ।
দুই ভাই করিলেন কথোপকথন।।
কি অধর্ম করিলাম ঠাকুরের বাটী।
মিথ্যা করি বিষয়াদি আনিলাম লুঠি।।
প্রজার বাসের ঘর করিনু কাছারী।
দাহ হ’য়ে গেল সব পাপ ছিল ভারি।।
সূর্যমণি বলে ভাই পার্বতীচরণ।
জমিদারী র’বে নারে পাপ আচরণ।।
পার্বতী বলিল দাদা এত’ যদি জান।
ভিটায় প্রজারে তবে ক’য়ে বলে আন।।
আশ্বিন কার্ত্তিক মার্গশীর্ষ পৌষমাস।
রামদিয়া সেনদের বাটী কৈল বাস।।
কখন কখন যাইতেন ওঢ়াকাঁদি।
কখনও সফলাডাঙ্গা যাইতেন যদি।।
দুই দিন কিম্বা একদিন মাত্র থাকি।
আনিতেন কোন দ্রব্য মূল্যবান দেখি।।
কতদিন পরে সেই রামদিয়া ছাড়ি।
থাকিলেন ভজরাম চৌধুরীর বাড়ী।।
চৌধুরীর বাসবাড়ী ওঢ়াকাঁদি গ্রাম।
পরম বৈষ্ণব জপে রাধাকৃষ্ণ নাম।।
প্রভুর মাতুল বংশ পঞ্চসহোদর।
রামচাঁদ স্বরূপ যে অতি গুণাকর।।
ঠাকুরেরা তার পিতৃস্বসার কুমার।
কয় ভাই সেই বাটী বাঁধিলেন ঘর।।
এক-আত্মা এক-প্রাণ তুল্য দশ ভাই।
পিস্তাত মামতাত ভ্রাতা ভিন্ন ভেদ নাই।।
বৈষ্ণবের শিরোমণি ছিল ভজরাম।
প্রভুদের সঙ্গে সদা করে হরিনাম।।
হরিকথা কৃষ্ণকথা হ’য়ে একতর।
কোন কোন নিশি হ’ত অই ভাবে ভোর।।
চৌধুরীর বাটী ছিল পঞ্চ সহোদর।
একা প্রভু আমভিটা বাঁধিলেন ঘর।।
তথা আসি পারিষদগণের মিলন।
রাত্রি দিবা করিতেন হরি-সংকীর্তন।।
তার পূর্ব অংশে ছিল পোদ্দারের বাটী।
চারি ভাই সেইখানে বাঁধিলেন ভিটি।।
অই বাটী পূর্বকালে বিশ্বনাথ ছিল।
সে জন বৈরাগী হ’য়ে বৃন্দাবনে গেল।।
এভাবে করিল সবে ওঢ়াকাঁদি বাস।
কবি বলে শুনিলে পাপের হয় নাশ।।
প্রভুদের প্রতি জমিদারের বিনয়।
পয়ার।
স্থানত্যাগী ওঢ়াকাঁদি আছে পঞ্চ ভাই।
জমিদারে লুঠে নিল বিত্ত কিছু নাই।।
পার্বতীচরণ বাবু ওঢ়াকাঁদি গিয়া।
প্রভুদের বলিলেন বিনয় করিয়া।।
বহু স্তুতি মিনতি করিল বারেবার।
সফলানগরে যেতে করি পরিহার।।
কৃষ্ণদাস বলে শুন শুন মহাশয়।
আর না হইব প্রজা তোমার ভিটায়।।
তুমি রাজা নাহি তব উচিৎ বিচার।
তোমার সমান অধার্মিক নাহি আর।।
একবার যার সঙ্গে হ’য়েছে শত্রুতা।
পুনঃ তার সঙ্গে কেহ না করে মিত্রতা।।
নারীকে রাজাকে নাহি বিশ্বাস করিবে।
চাণক্য পণ্ডিতবাক্য মিথ্যা নাহি হ’বে।।
বিশেষ বিভীষণের প্রতিজ্ঞা র’য়েছে।
সে বাক্য মোদের পক্ষে সকল ফ’লেছে।।
জমিদার কহে তোমাদের টাকা দিব।
সাতশত টাকা সুদসহ শোধ হ’ব।।
ধান্য গোলা ঘর গরু যত লুঠিয়াছি।
যেহেতু আমরা বড় দুষ্কর্ম করেছি।।
ইহকালে আমাদের হইল দুর্নাম।
আখেরে হইবে মন্দ বুঝে দেখিলাম।।
জমাজমি তোমাদের ছিল যে সমস্ত।
অন্যের সহিতে করি নাই বন্দোবস্ত।।
যত লুঠ করিয়াছি অস্থাবর মাল।
বুঝে দিব খাট পাট ঘটি বাটি থাল।।
যা হ’বার হ’য়েছে আমি ত’ জমিদার।
তোমাদের নিকটেতে করি পরিহার।।
পঞ্চ ভাই জমিদারের নিকট আসিয়া।
কহিলেন ভূ-স্বামীকে বিনয় করিয়া।।
আমাদের ক্রোধ আর নাহি তোমা প্রতি।
এখানে আসিয়া মোরা হইয়াছি স্থিতি।।
রাজা রামরত্ন রায় মহিমা অপার।
হইয়াছি তার প্রজা করি অঙ্গীকার।।
এখনে তাহাকে ত্যাগ করা বড় লাজ।
বিনাদোষে ভিটা ছাড়া অধর্মের কাজ।।
বিনা অপরাধে বল কেবা ছাড়ে বাপ।
এখন তোমার ভিটাতে যাওয়া পাপ।।
এত শুনি বাবু তবে ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
নিজ ঘরে গেল ফিরে হইয়া নৈরাশ।।
স্বচ্ছন্দে আনন্দ চিতে সুখে করে বাস।
বড়কর্তা কৃষ্ণদাস করিল প্রকাশ।।
হরি হরি বল ভাই নাম কর সার।
তারক কহিছে হরি হবে কর্ণধার।।
পঞ্চভাই পৃথগন্ন ও মুদ্রা বণ্টন।
লঘু ত্রিপদী।
পঞ্চ ভাই এক ঠাই বসিয়া হরিষে।
হৃষ্ট মনে ভ্রাতাগণে কৃষ্ণদাস ভাষে।।
কল্য দিনে মম মনে ভাবিয়াছি যাহা।
হৃদি খুলে সবেস্থলে বলি ভাই তাহা।।
দেখ ভাই এক ভাই করে ঠাকুরালী।
পারে যদি করে বিধি মন্দ নাহি বলি।।
যে সময় ত্যাগ হয় সফলানগরী।
এর আগে হ’তে লাগে প্রকাশ ঠাকুরী।।
তাহা যত অবগত লিখিব সে লীলে।
শুন বার্তা বড়কর্তা এবে যা কহিলে।।
হ’লে বংশ বহু অংশ হইব পৃথক।
সরাজিতে এ কালেতে হইব বণ্টক।।
কর্মছাড়া ঘরছাড়া হ’য়েছি নাতক।
যে অবস্থা এ ব্যবস্থা হওরে পৃথক।।
চারি ভাই শুনে তাই বাক্য দিল সায়।
বড়কর্তা কহে বার্তা য’বে লুঠ হয়।।
মোর ঠাই আছে ভাই মুদ্রা দশ শত।
দ্বিশতক এক এক ভাগ পরিমিত।।
পয়ার।
মহাপ্রভু বলে ভাই আমার নিকটে।
এইক্ষণে পঞ্চশত টাকা আছে বটে।।
তৈলের দোকান করিয়াছি কিনা হাটে।
এই টাকা লভ্য আছে আমার নিকটে।।
এর এক এক শত পাবে একজন।
এই টাকা সবে লহ করিয়া বণ্টন।।
যার যার অংশ সেই সেই বুঝে নিল।
তিনশত টাকা এক জনে অংশে পেল।।
বিশ্বনাথ ভিটা পরে চারি সহোদর।
মহাপ্রভু র’ল আম ভিটা বেঁধে ঘর।।
জমিদার ফিরে গেল সফলানগরী।
করিল বহু বিলাপ আসিয়া কাছারী।।
কহিল নিষ্ঠুরবাণী তারা পঞ্চ ভাই।
উচ্ছন্ন করেছি প্রজা ভালো করি নাই।।
রাজার মিনতি আর বণ্টনের লীলা।
শ্রবণে গৃহেতে লক্ষ্মী থাকেন অচলা।।
শ্রীধাম শ্রীওঢ়াকাঁদি প্রভুর বিরাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
ব্রজনাথের জীবন ত্যাগ।
দীর্ঘ ত্রিপদী।
প্রভু যবে রামদিয়া ব্রজনাথ সঙ্গে গিয়া
প্রভু সঙ্গে রঙ্গেতে বেড়ায়।
পরে উড়িয়া নগরে মহাপ্রভু বাস করে
ব্রজনাথ সফলাডাঙ্গায়।।
ফিরে এল জমিদার প্রভু না আসিবে আর
ওঢ়াকাঁদি হ’ল বাসস্থান।
শুনিয়া নিষ্ঠুর বাণী বুকে করাঘাত হানি
ব্রজনাথ ত্যজিল পরাণ।।
গিয়া উত্তরের ঘরে মধ্য চৌকি খাম্বা ধ’রে
দাদা বলে ছাড়ে হুহুঙ্কার।
দাঁড়ায়ে ত্যজিল তনু বাহিরায় পরমাণু
ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে যায় তার।।
যেন শশী প’ল খসি ব্রজনাথ জ্যোতি আসি
হরিচাঁদ পদে লুকাইল।
তার ভ্রাতাগণ যত করিল অগ্নি সংস্কৃত
কবি কহে রবি ডুবে গেল।।
আদিখণ্ড
পঞ্চম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
[embed]https://www.youtube.com/watch?v=FxtWxglGueM[/embed]
মহাপ্রভু কর্ত্তৃক কৃষিকর্ম
পয়ার
বর্ণনা অতীত ঠাকুরের লীলা যত ।
আর দিন হইলেন কৃষিকার্য্যে রত।।
সফলানগরী প্রভু যবে কৈল বাস।
ক্রমে ক্রমে ঈশ্বরত্ব হইল প্রকাশ।।
একদিন শুভদিন রজনী প্রভাত।
তিন ডাক ছাড়ে প্রভু কোথা বিশ্বনাথ।।
মুহূর্ত্তেক পরে বিশ্বনাথ উপস্থিত।
বলে প্রভু ডাক কেন কহ মনোনীত।।
সকলে বিস্ময় মানি আশ্চর্য্য গণিল।
কোথা হ’তে ডাকিল বা কোথা হ’তে এল।।
বহুদিন বিশ্বনাথ হ’ল দেশান্তরী।
শুনিয়াছি বৃন্দাবনে হ’য়েছে ভিখারী।।
বিশ্বনাথ নিকটে কহেন হরিচাঁদ।
ওরে বিশে আমার হ’য়েছে এক সাধ।।
বসিয়া বসিয়া বৃথা গত হল কাল।
আয় মোরা একদিন চাষ করি হাল।।
সর্ব্বকার্য্য হ’তে শ্রেষ্ঠ কৃষিকার্য্য হয়।
এ কার্য্য না করা আমাদের ভাল নয়।।
একদিন হাল ধরি আর না ধরিব।
বলরাম ভক্ত মোরা আজ হ’তে হ’ব।।
বিশ্বনাথ বলে প্রভু যে ইচ্ছা তোমার।
হ’ল ধর হ’য়ে অদ্য শোধিব কড়ার।।
হালুয়ারা হাল ধারে হাসি কয় কথা।
ভাল হ’ল অদ্য পা’ব লাঙ্গলের গাতা।।
প্রভু বলে পা’ব হাল মোরা গিয়ে লই।
আ’জ মোরা সবে গিয়া হলধর হই।।
একবার হ’য়েছিনু তৈলের দোকানী।
হাল ধরা চাষ করা মোরা নহে জানি।।
সর্ব্ব কর্ম করা ভাল গৃহীজন পক্ষে।
গৃহস্থের করা ভাল সর্ব্ব কার্য্য শিক্ষে।।
মোরা যে যোগাল দেই তোরা নিস হাল।
মোরা আজ হাল ধরি তোরা দে যোগাল।।
এত বলি মহাপ্রভু নিজে হাল নিল।
বিশ্বনাথ এক হাল স্কন্ধেতে করিল।।
গোগৃহের গরু যত বাহির করিয়া।
ধেনু বৎস্য বলদ লইল চালাইয়া।।
একবন্দ জমি দুই বিঘা পরিমাণ।
বহুদিন সে জমিতে নাহি হয় ধান।।
সব জমি মধ্য হ’তে লোণা উথলিয়া।
বুনাইলে ধান্য যায় করা’টে হইয়া।।
চারিবর্ষ সে জমিতে হাল চাষে নাই।
সেই জমি চাষ কর্ত্তে লাগিল গোঁসাই।।
লোকে বলে এ জমিতে ধান্য নাহি ফলে।
বৃথা পরিশ্রম প্রভু কর বা কি বলে।।
এত শুনি হাসি মুখে কহেন গোঁসাই।
অফলা জমিতে আমি সুফল ফলাই।।
যশোমন্ত পুত্র আমি নাম হরিচাঁদ।
এবার করিব যত পতিত আবাদ।।
এদেশে আবাদী তোরা চিনিলি না কেহ।
মাটী যে অফলা থাকে এ বড় সন্দেহ।।
পতিত আবাদ জন্য আশা এ দেশেতে।
কি ফল ফলিবে টের পাবি ভবিষ্যতে।।
খাটি মাটি হ’লে ফল নাহয় বিফল।
ভক্তি করে ডাকে তারে দেই প্রেমফল।।
যে ফল চাহিবি তোরা সে ফল পাইবি।
কল্প-বৃক্ষমূলে যদি প্রার্থনা করিবি।।
সফলা নগরী রই যে চাহে যে ফল।
বিফল না হয় ফল সে পায় সে ফল।।
বীজ আন বুনি ধান ফল পাবি শেষে।
ধান্যসতী তার পতি আছে এই দেশে।।
যেদিন করিল চাষ সেদিন বুনিল।
বুনাইয়া পুন চাষ আরম্ভ করিল।।
এমন সময় হ’ল মেঘের লক্ষণ।
ঘন ঘন ঘন করে ভীষণ গর্জ্জন।।
উত্তরে যাইয়া মেঘ বেগ বহে বাতে।
ঘোর অন্ধকার নিশি হইল দিবাতে।।
চিকি চিকি তড়িৎ তাহাতে আলোময়।
বিদ্যুৎজ্যোতি ঠাকুরের অঙ্গে লীন হয়।।
প্রভুর অঙ্গেতে জ্যোতি এক একবার।
মাঝে মাঝে ঝলসিছে বিদ্যুৎ আকার।
বরষণ ঘন ঘন হয় বহু বহু।
শীলাপাত বজ্রাঘাত হয় মূহুর্মূহু।।
চতুর্দ্দিকে হয় বৃষ্টি ঠাকুর যে ভূমে।
একবিন্দু পাত নাহি হয় কোন ক্রমে।।
ভাদ্রমাসে স্রোত যেন মহাবেগে ধায়।
তেমনি বৃষ্টির ধারা পতিত ধরায়।।
চতুর্দ্দিকে বৃষ্টিজলে স্রোত বহি যায়।
প্রভু যে জমিতে জল নাহি প্রবেশয়।।
সে ভূমি হইতে উচ্চ বিঘত প্রমাণ।
বহে জল ঠাকুরের ভুমিতে না জান।।
হাল উঠাইয়া যবে চাষ হ’ল সারা।
তখন জমিতে বহে বিন্দু বিন্দু ধারা।।
বীজ বপনের হ’ল সুযোগ তাহাতে।
ধান্যাঙ্কুর উপজিল সপ্তম দিনেতে।।
এমেত হইল সব চারার পত্তন।
রহে পরিষ্কার ভূমি না হইল বন।।
আউস হইল আর হইল আমান্য।
দুই বিঘা জমিতে দ্বিগুণ হৈল ধান্য।।
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ হ’ল অবনীতে।।
প্রথমে গার্হস্থ্য ধর্ম তৈলের দোকান।
বাণিজ্য প্রণালী শিক্ষা সবে কৈল দান।।
হাতে করে কাম মনে মুখে করে নাম।
রসরাজ করে তার চরণে প্রণাম।।
পয়ার
বর্ণনা অতীত ঠাকুরের লীলা যত ।
আর দিন হইলেন কৃষিকার্য্যে রত।।
সফলানগরী প্রভু যবে কৈল বাস।
ক্রমে ক্রমে ঈশ্বরত্ব হইল প্রকাশ।।
একদিন শুভদিন রজনী প্রভাত।
তিন ডাক ছাড়ে প্রভু কোথা বিশ্বনাথ।।
মুহূর্ত্তেক পরে বিশ্বনাথ উপস্থিত।
বলে প্রভু ডাক কেন কহ মনোনীত।।
সকলে বিস্ময় মানি আশ্চর্য্য গণিল।
কোথা হ’তে ডাকিল বা কোথা হ’তে এল।।
বহুদিন বিশ্বনাথ হ’ল দেশান্তরী।
শুনিয়াছি বৃন্দাবনে হ’য়েছে ভিখারী।।
বিশ্বনাথ নিকটে কহেন হরিচাঁদ।
ওরে বিশে আমার হ’য়েছে এক সাধ।।
বসিয়া বসিয়া বৃথা গত হল কাল।
আয় মোরা একদিন চাষ করি হাল।।
সর্ব্বকার্য্য হ’তে শ্রেষ্ঠ কৃষিকার্য্য হয়।
এ কার্য্য না করা আমাদের ভাল নয়।।
একদিন হাল ধরি আর না ধরিব।
বলরাম ভক্ত মোরা আজ হ’তে হ’ব।।
বিশ্বনাথ বলে প্রভু যে ইচ্ছা তোমার।
হ’ল ধর হ’য়ে অদ্য শোধিব কড়ার।।
হালুয়ারা হাল ধারে হাসি কয় কথা।
ভাল হ’ল অদ্য পা’ব লাঙ্গলের গাতা।।
প্রভু বলে পা’ব হাল মোরা গিয়ে লই।
আ’জ মোরা সবে গিয়া হলধর হই।।
একবার হ’য়েছিনু তৈলের দোকানী।
হাল ধরা চাষ করা মোরা নহে জানি।।
সর্ব্ব কর্ম করা ভাল গৃহীজন পক্ষে।
গৃহস্থের করা ভাল সর্ব্ব কার্য্য শিক্ষে।।
মোরা যে যোগাল দেই তোরা নিস হাল।
মোরা আজ হাল ধরি তোরা দে যোগাল।।
এত বলি মহাপ্রভু নিজে হাল নিল।
বিশ্বনাথ এক হাল স্কন্ধেতে করিল।।
গোগৃহের গরু যত বাহির করিয়া।
ধেনু বৎস্য বলদ লইল চালাইয়া।।
একবন্দ জমি দুই বিঘা পরিমাণ।
বহুদিন সে জমিতে নাহি হয় ধান।।
সব জমি মধ্য হ’তে লোণা উথলিয়া।
বুনাইলে ধান্য যায় করা’টে হইয়া।।
চারিবর্ষ সে জমিতে হাল চাষে নাই।
সেই জমি চাষ কর্ত্তে লাগিল গোঁসাই।।
লোকে বলে এ জমিতে ধান্য নাহি ফলে।
বৃথা পরিশ্রম প্রভু কর বা কি বলে।।
এত শুনি হাসি মুখে কহেন গোঁসাই।
অফলা জমিতে আমি সুফল ফলাই।।
যশোমন্ত পুত্র আমি নাম হরিচাঁদ।
এবার করিব যত পতিত আবাদ।।
এদেশে আবাদী তোরা চিনিলি না কেহ।
মাটী যে অফলা থাকে এ বড় সন্দেহ।।
পতিত আবাদ জন্য আশা এ দেশেতে।
কি ফল ফলিবে টের পাবি ভবিষ্যতে।।
খাটি মাটি হ’লে ফল নাহয় বিফল।
ভক্তি করে ডাকে তারে দেই প্রেমফল।।
যে ফল চাহিবি তোরা সে ফল পাইবি।
কল্প-বৃক্ষমূলে যদি প্রার্থনা করিবি।।
সফলা নগরী রই যে চাহে যে ফল।
বিফল না হয় ফল সে পায় সে ফল।।
বীজ আন বুনি ধান ফল পাবি শেষে।
ধান্যসতী তার পতি আছে এই দেশে।।
যেদিন করিল চাষ সেদিন বুনিল।
বুনাইয়া পুন চাষ আরম্ভ করিল।।
এমন সময় হ’ল মেঘের লক্ষণ।
ঘন ঘন ঘন করে ভীষণ গর্জ্জন।।
উত্তরে যাইয়া মেঘ বেগ বহে বাতে।
ঘোর অন্ধকার নিশি হইল দিবাতে।।
চিকি চিকি তড়িৎ তাহাতে আলোময়।
বিদ্যুৎজ্যোতি ঠাকুরের অঙ্গে লীন হয়।।
প্রভুর অঙ্গেতে জ্যোতি এক একবার।
মাঝে মাঝে ঝলসিছে বিদ্যুৎ আকার।
বরষণ ঘন ঘন হয় বহু বহু।
শীলাপাত বজ্রাঘাত হয় মূহুর্মূহু।।
চতুর্দ্দিকে হয় বৃষ্টি ঠাকুর যে ভূমে।
একবিন্দু পাত নাহি হয় কোন ক্রমে।।
ভাদ্রমাসে স্রোত যেন মহাবেগে ধায়।
তেমনি বৃষ্টির ধারা পতিত ধরায়।।
চতুর্দ্দিকে বৃষ্টিজলে স্রোত বহি যায়।
প্রভু যে জমিতে জল নাহি প্রবেশয়।।
সে ভূমি হইতে উচ্চ বিঘত প্রমাণ।
বহে জল ঠাকুরের ভুমিতে না জান।।
হাল উঠাইয়া যবে চাষ হ’ল সারা।
তখন জমিতে বহে বিন্দু বিন্দু ধারা।।
বীজ বপনের হ’ল সুযোগ তাহাতে।
ধান্যাঙ্কুর উপজিল সপ্তম দিনেতে।।
এমেত হইল সব চারার পত্তন।
রহে পরিষ্কার ভূমি না হইল বন।।
আউস হইল আর হইল আমান্য।
দুই বিঘা জমিতে দ্বিগুণ হৈল ধান্য।।
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ হ’ল অবনীতে।।
প্রথমে গার্হস্থ্য ধর্ম তৈলের দোকান।
বাণিজ্য প্রণালী শিক্ষা সবে কৈল দান।।
হাতে করে কাম মনে মুখে করে নাম।
রসরাজ করে তার চরণে প্রণাম।।
নিষ্কাম বা আত্ম সমর্পণ
পয়ার
এইমত ঠাকুরের হইল প্রকাশ।
পরে এসে ওঢ়াকাঁদি করিলেন বাস।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রভুর যে শ্রীগুরুচরণ।
তাহার অনুজ নাম শ্রীউমাচরণ।।
বাস কৈল ওঢ়াকাঁদি আমভিটা খ্যাত।
পুরাতন ভিটা ছিল না ছিল বসত।।
ঠাকুরের পুত্র কন্যা কিছু না জন্মিতে।
অলৌকিক লীলা সব করেন ক্রমেতে।।
আমভিটা ঘর করি মহাপ্রভু কয়।
দেখি কার্য্য না করে কি খেতে পাওয়া যায়।।
দিবারাত্রি খাটি কেহ না পারে আটাতে।
অন্নহীন যায় দিন ভ্রমে পথে পথে।।
কর্ম ক্ষেত্রে কর্ম করে আশা হয় হানি।
দোকান পাতিয়া লভ্য না পায় দোকানী।।
অর্থ লোভে কার্য্যক্ষেত্রে জীবন কাটায়।
আত্মস্বার্থ খাটাইয়া লভ্য কই পায়।।
কেহ না করিয়া কার্য্য রাজ্যপ্রাপ্ত হয়।
কোটি লোকে দাস হ’য়ে পড়ে তার পায়।।
সুখদুঃখ সংসারের যত বাহ্য কার্য্য।
যে করায় তারে কেহ নাহি করে গ্রাহ্য।।
যখন গৌরাঙ্গ প্রভু লীলা প্রকাশিল।
কি কার্য্য করিল সবে কেবা খেতে দিল।।
মুনি ঋষি যোগী ন্যাসী তপস্যা করিত।
কহ দেখি কে কোথায় না খেয়ে মরিত।।
বহু জীব মীন পাখী কীট পতঙ্গম।
আত্মস্বার্থ কর্মত্যাগী নিষ্কাম নিয়ম।।
আজ হতে কাজ কর্ম সব ত্যাজিলাম।
পবিত্র চরিত্র নামে রুচি রাখিলাম।।
যদ্যপি আমরা নহে সে কাজের কাজি।
পাই কিনা পাই খেতে ব’সে থেকে বুঝি।।
এত বলি মহাপ্রভু নামধ্বনি দিল।
ভক্তগণে হরি বলি নাচিতে লাগিল।।
এ ভবসংসারে প্রভু বৃথা দিন যায়।
রসনা-বাসনা পাদ-পদ্ম মধু পায়।।
পয়ার
এইমত ঠাকুরের হইল প্রকাশ।
পরে এসে ওঢ়াকাঁদি করিলেন বাস।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রভুর যে শ্রীগুরুচরণ।
তাহার অনুজ নাম শ্রীউমাচরণ।।
বাস কৈল ওঢ়াকাঁদি আমভিটা খ্যাত।
পুরাতন ভিটা ছিল না ছিল বসত।।
ঠাকুরের পুত্র কন্যা কিছু না জন্মিতে।
অলৌকিক লীলা সব করেন ক্রমেতে।।
আমভিটা ঘর করি মহাপ্রভু কয়।
দেখি কার্য্য না করে কি খেতে পাওয়া যায়।।
দিবারাত্রি খাটি কেহ না পারে আটাতে।
অন্নহীন যায় দিন ভ্রমে পথে পথে।।
কর্ম ক্ষেত্রে কর্ম করে আশা হয় হানি।
দোকান পাতিয়া লভ্য না পায় দোকানী।।
অর্থ লোভে কার্য্যক্ষেত্রে জীবন কাটায়।
আত্মস্বার্থ খাটাইয়া লভ্য কই পায়।।
কেহ না করিয়া কার্য্য রাজ্যপ্রাপ্ত হয়।
কোটি লোকে দাস হ’য়ে পড়ে তার পায়।।
সুখদুঃখ সংসারের যত বাহ্য কার্য্য।
যে করায় তারে কেহ নাহি করে গ্রাহ্য।।
যখন গৌরাঙ্গ প্রভু লীলা প্রকাশিল।
কি কার্য্য করিল সবে কেবা খেতে দিল।।
মুনি ঋষি যোগী ন্যাসী তপস্যা করিত।
কহ দেখি কে কোথায় না খেয়ে মরিত।।
বহু জীব মীন পাখী কীট পতঙ্গম।
আত্মস্বার্থ কর্মত্যাগী নিষ্কাম নিয়ম।।
আজ হতে কাজ কর্ম সব ত্যাজিলাম।
পবিত্র চরিত্র নামে রুচি রাখিলাম।।
যদ্যপি আমরা নহে সে কাজের কাজি।
পাই কিনা পাই খেতে ব’সে থেকে বুঝি।।
এত বলি মহাপ্রভু নামধ্বনি দিল।
ভক্তগণে হরি বলি নাচিতে লাগিল।।
এ ভবসংসারে প্রভু বৃথা দিন যায়।
রসনা-বাসনা পাদ-পদ্ম মধু পায়।।
বৈশ্য দস্যুর প্রস্তাব
পয়ার
নবরূপে লীলা জীবশিক্ষার কারণ।
শিখাইল জীবগণে আত্মসমর্পণ।।
বসিতেন মহাপ্রভু ভক্তগণ ল’য়ে।
কেহ এসে নিয়া যেত নিমন্ত্রণ দিয়ে।।
পথে যেতে ভক্তগণ নামগান করে।
কত লোক কাঁদিতেন প্রভুপদ ধরে।।
কেহ বা দাঁড়া’ত পথে হস্ত প্রসারিয়া।
বাঞ্ছা পুরাইত তার গৃহেতে যাইয়া।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত অন্ন পায়স পিষ্টক।
ভক্তমনোনীত দ্রব্য যত আবশ্যক।।
কোন দিন মহাপ্রভু ভক্তগণ সঙ্গে।
থাকিতেন সুধাময় কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।
নাম গান প্রেম কথা সর্ব্বদা আনন্দ।
ডাকিয়া হাকিয়া বলে বল রে গোবিন্দ।।
একদিন হরিচাঁদ বসিয়া বিরলে।
নিষ্কাম প্রবন্ধে পুরাতন কথা বলে।।
শুন শুন ভক্তগণ কথা পুরাতন।
রাঢ় দেশে ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে বড়ই দুঃখিত।
ব্রাহ্মণ সে দস্যু, জ্ঞান নাহি হিতাহিত।।
বনমধ্যে গিয়া চুরি ডাকাইতি করে।
ধন সব লুটে লয় লোকে মরে ডরে।।
রাজা টের পেল দুরিত ব্রাহ্মণ।
দস্যুবৃত্তি করি করে ধন উপার্জ্জন।।
মহারাজ একদিন মহাক্রোধ করি।
লোক দিয়া লুঠিল সে ব্রাহ্মণের বাড়ী।।
নিযুক্ত করিল গ্রামে চারিটি সিপাই।
কোন খানে ব্রাহ্মণে যেতে সাধ্য নাই।।
ভিখারী হইয়া ভিক্ষা করিবারে যায়।
দস্যু বলি কেহ তারে ভিক্ষা নাহি দেয়।।
এখানে তাহাকে কেহ ভয় নাহি করে।
নির্ভয় হইল সবে দস্যু মরে ডরে।।
ব্রাহ্মণের ঘরে আর নাহি মিলে অন্ন।
দূর দূর করে সবে গেলে ভিক্ষা জন্য।।
উপায় নাহিক আর অন্ন নাহি পায়।
অন্ন বিনে দৈন্য দশা জীর্ণ শীর্ণ কায়।।
ব্রাহ্মনী কহিছে এবে উপায় কি করি।
অন্নকষ্টে ইচ্ছা হয় ফাঁসী ল’য়ে মরি।।
ব্রাহ্মণ কহিছে তবে ব্রাহ্মণীর ঠাই।
তিষ্ঠ তিষ্ঠ অদ্য আমি ভিক্ষা লাগি যাই।।
যদি ভিক্ষা নাই পাই মরিব পরাণে।
শেষে তুমি প্রাণ ত্যাজ মম মৃত্যু শুনে।।
এত বলি দস্যু কাননেতে চলে গেল।
গলে ফাঁস ল’য়ে দ্বিজ ঝুলিতে লাগিল।।
তাহা দেখি রাজদূত ফিরাইয়া আনে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে দিল রাজা স্থানে।।
হুকুম হইল এরা সাত দিন তরে।
বন্ধিভাবে থাকিবেক রাজ কারাগারে।।
আর সাতদিন এরা বাটিতে থাকিবে।
রাজদূত সঙ্গে করি ভিক্ষা মেগে খাবে।।
এই ভাবে কষ্ট করে কালের হরণ।
জীয়ন্তে মরণ সম না হয় মরণ।।
কাঞ্চিগ্রামে এক বিপ্র বৈষ্ণব সুজন।
লীলাজী বলিয়া নাম প্রেম মহাজন।।
সেই গ্রামে বৈশ্য সাধু এক সদাগর।
সাধু বৈষ্ণবের সেবা করে নিরন্তর।।
বৈশ্য সাধু বাড়ী সাধু আসে আর যায়।
অন্য ঠাই ভ্রমি আসে সাধুর আলয়।।
সাধু বৈশ্য বৈষ্ণব সেবায় মন কৈল।
শত শিষ্য সঙ্গে করি লীলাজী চলিল।।
দস্যু দুষ্ট বৃদ্ধ দ্বিজ ভেবেছেন মনে।
এ সব লোকেরে সাধু খেতে দেয় কেনে।।
পায়স পিষ্টক ঘৃত দুগ্ধাদি শাল্যণ্য।
লুচি পুরী ছানা দধি জল পান জন্য।
মালা ল’য়ে সাধু হ’য়ে অঙ্গে করে ফোঁটা।
কি বুঝিয়া খেতে দেয় সদাগর বেটা।।
এবে আমি সাধু হয়ে ভুলাইব লোক।
ভিক্ষা করি খেতে পা’ব পরিয়া তিলক।।
লীলাজী যাইতে পথে দস্যু ধরে পায়।
বলে প্রভু এক ছড়া মালা দেও আমায়।।
লীলাজী বলেন তোর মালাতে কি কাজ।
দস্যু বলে সাধু হ’ব ল’ব সাধু সাজ।।
হাসিয়া দিলেন সাধু এক খন্ড মালা।
ব্রাহ্মণ বলেন মোর গেল ভব জ্বালা।।
মালাটি লইয়া গলে লইলেন ফোঁটা।
চুল ফিরাইয়া মাথে বাঁধে উভ ঝুটা।।
হরি হরি বলি ছাড়ে ঘন ঘন ডাক।
সদাগর ভবনেতে দিল গিয়া হাক।।
সদাগর ভাবিলেন দস্যু এ ব্রাহ্মণ।
এর যদি হ’য়ে থাকে হরিনামে মন।।
বেশী করি সমাদর করিবে উহারে।
তাতে যদি দস্যুবৃত্তি হ’তে মন ফিরে।।
সেবা শুশ্রূষাদি বহু মতে তারে কৈল।
তাহাতে দস্যুর আরো গাঢ় ভক্তি হৈল।।
ভাবে মনে বহু দিন করি দস্যুবৃত্তি।
এই মত খেতে দিয়া কেবা করে ভক্তি।।
অন্নাভাবে দুটা ভাত খাইবার লাগি।
ভাব ধরে হইয়াছি কপট বৈরাগী।।
তাহাতে না খেতে মেলে কহন না যায়।
প্রকৃত বৈরাগী হ’লে আরো কিবা হয়।।
অন্বেষী কাঁচের পাত্র প্রাপ্ত হৈনু সোনা।
সাধুপদরজ বাঞ্ছে তারক রসনা।।
পয়ার
নবরূপে লীলা জীবশিক্ষার কারণ।
শিখাইল জীবগণে আত্মসমর্পণ।।
বসিতেন মহাপ্রভু ভক্তগণ ল’য়ে।
কেহ এসে নিয়া যেত নিমন্ত্রণ দিয়ে।।
পথে যেতে ভক্তগণ নামগান করে।
কত লোক কাঁদিতেন প্রভুপদ ধরে।।
কেহ বা দাঁড়া’ত পথে হস্ত প্রসারিয়া।
বাঞ্ছা পুরাইত তার গৃহেতে যাইয়া।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত অন্ন পায়স পিষ্টক।
ভক্তমনোনীত দ্রব্য যত আবশ্যক।।
কোন দিন মহাপ্রভু ভক্তগণ সঙ্গে।
থাকিতেন সুধাময় কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।
নাম গান প্রেম কথা সর্ব্বদা আনন্দ।
ডাকিয়া হাকিয়া বলে বল রে গোবিন্দ।।
একদিন হরিচাঁদ বসিয়া বিরলে।
নিষ্কাম প্রবন্ধে পুরাতন কথা বলে।।
শুন শুন ভক্তগণ কথা পুরাতন।
রাঢ় দেশে ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে বড়ই দুঃখিত।
ব্রাহ্মণ সে দস্যু, জ্ঞান নাহি হিতাহিত।।
বনমধ্যে গিয়া চুরি ডাকাইতি করে।
ধন সব লুটে লয় লোকে মরে ডরে।।
রাজা টের পেল দুরিত ব্রাহ্মণ।
দস্যুবৃত্তি করি করে ধন উপার্জ্জন।।
মহারাজ একদিন মহাক্রোধ করি।
লোক দিয়া লুঠিল সে ব্রাহ্মণের বাড়ী।।
নিযুক্ত করিল গ্রামে চারিটি সিপাই।
কোন খানে ব্রাহ্মণে যেতে সাধ্য নাই।।
ভিখারী হইয়া ভিক্ষা করিবারে যায়।
দস্যু বলি কেহ তারে ভিক্ষা নাহি দেয়।।
এখানে তাহাকে কেহ ভয় নাহি করে।
নির্ভয় হইল সবে দস্যু মরে ডরে।।
ব্রাহ্মণের ঘরে আর নাহি মিলে অন্ন।
দূর দূর করে সবে গেলে ভিক্ষা জন্য।।
উপায় নাহিক আর অন্ন নাহি পায়।
অন্ন বিনে দৈন্য দশা জীর্ণ শীর্ণ কায়।।
ব্রাহ্মনী কহিছে এবে উপায় কি করি।
অন্নকষ্টে ইচ্ছা হয় ফাঁসী ল’য়ে মরি।।
ব্রাহ্মণ কহিছে তবে ব্রাহ্মণীর ঠাই।
তিষ্ঠ তিষ্ঠ অদ্য আমি ভিক্ষা লাগি যাই।।
যদি ভিক্ষা নাই পাই মরিব পরাণে।
শেষে তুমি প্রাণ ত্যাজ মম মৃত্যু শুনে।।
এত বলি দস্যু কাননেতে চলে গেল।
গলে ফাঁস ল’য়ে দ্বিজ ঝুলিতে লাগিল।।
তাহা দেখি রাজদূত ফিরাইয়া আনে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে দিল রাজা স্থানে।।
হুকুম হইল এরা সাত দিন তরে।
বন্ধিভাবে থাকিবেক রাজ কারাগারে।।
আর সাতদিন এরা বাটিতে থাকিবে।
রাজদূত সঙ্গে করি ভিক্ষা মেগে খাবে।।
এই ভাবে কষ্ট করে কালের হরণ।
জীয়ন্তে মরণ সম না হয় মরণ।।
কাঞ্চিগ্রামে এক বিপ্র বৈষ্ণব সুজন।
লীলাজী বলিয়া নাম প্রেম মহাজন।।
সেই গ্রামে বৈশ্য সাধু এক সদাগর।
সাধু বৈষ্ণবের সেবা করে নিরন্তর।।
বৈশ্য সাধু বাড়ী সাধু আসে আর যায়।
অন্য ঠাই ভ্রমি আসে সাধুর আলয়।।
সাধু বৈশ্য বৈষ্ণব সেবায় মন কৈল।
শত শিষ্য সঙ্গে করি লীলাজী চলিল।।
দস্যু দুষ্ট বৃদ্ধ দ্বিজ ভেবেছেন মনে।
এ সব লোকেরে সাধু খেতে দেয় কেনে।।
পায়স পিষ্টক ঘৃত দুগ্ধাদি শাল্যণ্য।
লুচি পুরী ছানা দধি জল পান জন্য।
মালা ল’য়ে সাধু হ’য়ে অঙ্গে করে ফোঁটা।
কি বুঝিয়া খেতে দেয় সদাগর বেটা।।
এবে আমি সাধু হয়ে ভুলাইব লোক।
ভিক্ষা করি খেতে পা’ব পরিয়া তিলক।।
লীলাজী যাইতে পথে দস্যু ধরে পায়।
বলে প্রভু এক ছড়া মালা দেও আমায়।।
লীলাজী বলেন তোর মালাতে কি কাজ।
দস্যু বলে সাধু হ’ব ল’ব সাধু সাজ।।
হাসিয়া দিলেন সাধু এক খন্ড মালা।
ব্রাহ্মণ বলেন মোর গেল ভব জ্বালা।।
মালাটি লইয়া গলে লইলেন ফোঁটা।
চুল ফিরাইয়া মাথে বাঁধে উভ ঝুটা।।
হরি হরি বলি ছাড়ে ঘন ঘন ডাক।
সদাগর ভবনেতে দিল গিয়া হাক।।
সদাগর ভাবিলেন দস্যু এ ব্রাহ্মণ।
এর যদি হ’য়ে থাকে হরিনামে মন।।
বেশী করি সমাদর করিবে উহারে।
তাতে যদি দস্যুবৃত্তি হ’তে মন ফিরে।।
সেবা শুশ্রূষাদি বহু মতে তারে কৈল।
তাহাতে দস্যুর আরো গাঢ় ভক্তি হৈল।।
ভাবে মনে বহু দিন করি দস্যুবৃত্তি।
এই মত খেতে দিয়া কেবা করে ভক্তি।।
অন্নাভাবে দুটা ভাত খাইবার লাগি।
ভাব ধরে হইয়াছি কপট বৈরাগী।।
তাহাতে না খেতে মেলে কহন না যায়।
প্রকৃত বৈরাগী হ’লে আরো কিবা হয়।।
অন্বেষী কাঁচের পাত্র প্রাপ্ত হৈনু সোনা।
সাধুপদরজ বাঞ্ছে তারক রসনা।।
দস্যুর দীক্ষা গ্রহণ
পয়ার
লীলাজীর কাছে গিয়া কেঁদে কেঁদে কয়।
প্রভু মোরে শিষ্য করি দেহ পদাশ্রয়।।
লীলাজী তাহাকে দিল কৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষে।
বলে আমি হরি বলে মেগে খাব ভিক্ষে।।
সদাগর ভবনেতে ছিল যে বৈষ্ণব।
হরি হরি বলে উঠে নৃত্য করে সব।।
সবে বলে চেয়ে দেখ বৈষ্ণবের গণ।
বৈষ্ণব হইয়া গেল এ দস্যু ব্রাহ্মণ।।
সদাগর ভাবে ডাকাইত এ ব্রাহ্মণ।
দায় ঠেকে হরি বলে পাইতে ভোজন।।
অধিকাংশ ধন দিলে বলিবেক হরি।
খেতে পেলে আর নাহি করিবেক চুরি।।
এত ভাবি সদাগর তারে দিল ধন।
রজত সহস্রমুদ্রা করিল অর্পণ।।
আশাতীত ধন পেয়ে আনন্দ বাড়িল।
দৃঢ় করে ব্রাহ্মণ বলিছে হরি বল।।
ধন লয়ে ভক্ত হ’য়ে দ্বিজ গেল বাড়ী।
ব্রাহ্মনীকে কহে পূর্ব্ব বুদ্ধি দিনু ছাড়ি।।
হরি বলে ধন পাই আরো পাই খেতে।
ইচ্ছা নাই আর যাই ডাকাতি করিতে।।
ব্রাহ্মণ বৃত্তান্ত তারে কহিল সকল।
ব্রাহ্মণব্রাহ্মনী মিলে বলে হরিবল।।
রাজ দূত তাহা শুনি রাজাকে জানায়।
শুনিয়া রাজার মন হরষিত হয়।।
রাজা বলে প্রজা যদি হইল বৈরাগী।
রাজভেট উপহার লও তার লাগি।।
দুই রাজদূত দুই রাজভেট ল’য়ে।
স্তব করে ব্রাহ্মণেরে রাজভেট দিয়ে।।
দ্বিজ ভাবে বৈষ্ণবের সাজের কি গুণ।
বেশ দেখে বৈশ্য মোর সেবায় নিপুণ।।
আরো যবে কৃষ্ণমন্ত্র করিনু গ্রহণ।
তাহা দেখি সদাগর মোরে দিল ধন।।
পরম বৈষ্ণব ধর্ম ধন্য ধন্য মানি।
রাজা দিল ভেট দূতে কহে স্তুতি বাণী।।
বিশুদ্ধ বৈরাগী আমি যখনে হইব।
নাহি জানি তখনে কি হ’ব কিনা হ’ব।।
এ হেন বৈরাগ্য আমি কবে বা পাইব।
কবে ব্রজে যাব আমি কবে দীন হ’ব।।
এ হেন বৈষ্ণব ধর্ম আমাকে ছাড়িয়া।
কোথা ছিল হরিনাম আমাকে বঞ্চিয়া।।
যখন হইল মম দস্যুবৃত্তি মন।
কোথায় বৈষ্ণব ধর্ম ছিলরে তখন।।
যে নামে জগৎ ভুলে প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
সেই নাম মোরে ত্যাজে ছিল লুকাইয়ে।।
পেয়েছি তোমাকে যদি আর কি ছাড়িব।
যে দেশে তোমাকে পাব সেই দেশে যাব।।
আর না করিব আমি কর্ম দুরাচার।
অভেদ নাম-নামীন বুঝিলাম সার।।
দস্যুবৃত্তি করি নিত্য ভুঞ্জিয়াছি দুঃখ।
এক দিন বৈরাগী হইয়া কত সুখ।।
কল্য যারা আমাকে ক’রেছে দূর দূর।
তাহারা আদরে বলে বৈষ্ণব ঠাকুর।।
রাজ দূত দন্ড দিত আমাকে ধরিয়া।
রাজা মোরে দন্ড দিছে কারাগারে নিয়া।।
সেই রাজা সেই দূতে ব’য়ে দেয় ভেট।
বোধ হয় যমরাজা মাথা করে হেট।।
কিবা মন্ত্র লীলাজী দিলেন শিখাইয়া।
জগৎ বৈষ্ণব হো’ক আমাকে দেখিয়া।।
কিবা বৈষ্ণবের গুণ কহা নাহি যায়।
বেশ ধরিলেই মাত্র চোর সাধু হয়।।
একদিন মাত্র আমি সাধু সাজ পরি।
আর ফিরে মোর মনে না আইসে চুরি।।
একবার নাম নিলে যত পাপ হরে।
পাপীর কি শক্তি আছে তত পাপ করে।।
এই জন্যে নামে হ’ল ব্রহ্মাদেব দীক্ষে।
অভেদ নাম নামীন পাইনু পরীক্ষে।।
এই জন্যে নামে হৈল বৈষ্ণবী পার্বতী।
এই জন্য রত্নাকর ছাড়ে দস্যুবৃত্তি।।
নারায়ণ অংশে রত্নাকর জন্ম ধরে।
নামের নাহাত্ম্য জানাইতে পাপ করে।।
যার নাম সেই এই মাহাত্ম্য জানা’ল।
আর এক কথা মোর মনেতে হইল।।
জেনে তত্ত্ব নামে মত্ত শঙ্কর গোঁসাই।
যার নাম তার অঙ্গ তারাই তারাই।।
পাপী করে পাপ তাপ সাধুসঙ্গ লয়।
একবার নাম নিলে সর্ব্ব পাপ ক্ষয়।।
অন্ন কষ্ট ছলা করে বেশ ধরিলাম।
অনিচ্ছাতে নাম ল’য়ে বৈষ্ণব হৈলাম।।
আমি যে বৈষ্ণব হই আমি কেন কই।
ইহাতে কি আমি বড় অপরাধী হই।।
আমি যে বৈষ্ণব আমি যদি নাহি কই।
তাহা না বলিলে নামে গুণ থাকে কই।।
লীলাজী গুরু যে মম তার গুণ কই।
পরশ পরশে আমি বৈষ্ণব যে হই।।
পরশ পরশে যেন লৌহ হয় সোনা।
বৈষ্ণব পরশে কেন বৈষ্ণব হ’ব না।।
হাতে তালি দিয়া বলিল যে সাধু সব।
চোর ছিল দিজসুত হইল বৈষ্ণব।।
বৈষ্ণবের মুখপদ্ম বাক্য অখন্ডিত।
অই বলে আমি সাধু হইনু নিশ্চিত।।
খেতে সুতে বসিতে আমার চিন্তা নাই।
ভুক্তি দাসী লক্ষ্মীমাতা কুবের সেবাই।।
জীব সৃষ্টি করে সে কি আহার দিবে না।
নিরবধি কৃষ্ণপ্রেম করহ ভাবনা।।
যে কিছু দেখহ ভাই কৃষ্ণের সকল।
আর সব ধাঁ ধাঁ বাজী বল হরিবল।।
একদিন লীলাজীউ মহোৎসবে যেতে।
সদাগর বাটী যায় বহু শিষ্য সাথে।।
লীলাজীর মন হ’ল দস্যু ব্রাহ্মণেরে।
দিয়াছিনু মন্ত্র দেখে যাই সে কি করে।।
এতেক ভাবিয়া সাধু বাহুড়ী চলিল।
দস্যু শিষ্য বাটী এসে উপনীত হ’ল।।
দূরে থেকে লীলাজীকে করি দরশন।
উর্দ্ধবাহু করি নৃত্য করে’ছে ব্রাহ্মণ।।
ক্ষণে কক্ষবাদ্য ক্ষণে করে দন্ডবৎ।
লীলাজী চরণে নত হ’ল দন্ডবৎ।।
লীলাজীকে স্কন্ধে করি নাচিতে নাচিতে।
হরি হরি বলি ল’য়ে চলিল বাটিতে।।
রাজ ভেট সামগ্রী যতেক ছিল ঘরে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী তাতে গুরু সেবা করে।।
গ্রাম্য লোকে করে সুখে জয় জয় ধ্বনি।
খাও খাও লও লও এই মাত্র শুনি।।
ব্রাহ্মণের প্রেম দেখি বৈষ্ণব সকল।
গ্রাম্য লোক সঙ্গে মিশে বলে হরিবল।।
নগরবাসিনী রামাগণে বলে হরি।
সাধুসেবা জন্য আনে চা’ল তরকারী।।
সাধুসেবা মহোৎসব তাহাতে হইল।
দ্রব্যাদি উদ্বৃর্ত্ত আরো কতোই রহিল।।
সদাগরদত্ত সহস্রেক মুদ্রা ছিল।
লীলাজী চরণে দস্যু সব এনে দিল।।
লীলাজী বলিল সব দিলে যে আমায়।
খাইতে পরিতে বাপু তোর কি উপায়।।
বিপ্র বলে এতদিন দেখেছি খাইয়া।
খাইয়া ফুরাতে নারি আপনার দয়া।।
যে ধন আমারে প্রভু করেছেন দান।
ত্রিভুবনে ধন নাই তাহার সমান।।
সত্যভামা ব্রতকালে দান নিল মুনি।
উদ্ধব লিখিয়া দিল নাম চিন্তামণি।।
সে ধনমিশ্রিত রস যে বা করে পান।
সুস্বাদ নাহিক আর সে সুধা সমান।।
দয়া করি সেই সুধা খেতে দিলে মোরে।
পেট ভরে খেলে সুধা আরো ক্ষুধা বাড়ে।।
হেন যদি জ্ঞান করি আমি বড় দীন।
উচ্চ শৃঙ্গে টেনে তুলে তোমার কপিন।।
ভবগৃহে তব ভাবশয্যায় শয়ন।
নিদ্রা দেবী চৌকি দেন থাকিয়া চেতন।।
তব আশীর্ব্বাদে মোর বাস বহির্ব্বাস।
বাসে বাসে দেশে দেশে গৌরদেশে বাস।
রাজদূতে দণ্ড দিত ঘোর চোর জেনে।
দূত রাজাভেট দেয় রাজলক্ষ্মী সনে।।
তোমার মহিমা প্রভু জানিল সকলে।
কল্য চোর অদ্য সাধু তব কৃপা বলে।।
তব মন্ত্র বল এবে হইল প্রকাশ।
ব্রহ্মপদ হ’তে উচ্চপদ কৃষ্ণদাস।।
এ সব বৈভব দেখে মনে হয় হাসি।
ভক্তি সহ মুক্তি দেবী হইয়াছে দাসী।।
এত শুনি লীলাজীউ ধরি দিল কোল।
প্রেমানন্দে সাধুগণে বলে হরিবোল।।
গুরু কহে এবে কর তীর্থ পর্য্যটন।
দ্বিজ কহে তীর্থ-রাজ তব শ্রীচরণ।।
গুরু কহে সব লোকে করে গিয়া তীর্থ।
গয়া ধামে পিণ্ড দিলে ত্রিকুল পবিত্র।।
শিষ্য বলে কর্ণে মন্ত্র দিয়াছে যে মাত্র।
তদবধি কোটি কুল স্বর্গে করে নৃত্য।।
পতিতপাবন যত বৈষ্ণবসমাজ।
গেল দিন কহে দীন কবি-রসরাজ।।
পয়ার
লীলাজীর কাছে গিয়া কেঁদে কেঁদে কয়।
প্রভু মোরে শিষ্য করি দেহ পদাশ্রয়।।
লীলাজী তাহাকে দিল কৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষে।
বলে আমি হরি বলে মেগে খাব ভিক্ষে।।
সদাগর ভবনেতে ছিল যে বৈষ্ণব।
হরি হরি বলে উঠে নৃত্য করে সব।।
সবে বলে চেয়ে দেখ বৈষ্ণবের গণ।
বৈষ্ণব হইয়া গেল এ দস্যু ব্রাহ্মণ।।
সদাগর ভাবে ডাকাইত এ ব্রাহ্মণ।
দায় ঠেকে হরি বলে পাইতে ভোজন।।
অধিকাংশ ধন দিলে বলিবেক হরি।
খেতে পেলে আর নাহি করিবেক চুরি।।
এত ভাবি সদাগর তারে দিল ধন।
রজত সহস্রমুদ্রা করিল অর্পণ।।
আশাতীত ধন পেয়ে আনন্দ বাড়িল।
দৃঢ় করে ব্রাহ্মণ বলিছে হরি বল।।
ধন লয়ে ভক্ত হ’য়ে দ্বিজ গেল বাড়ী।
ব্রাহ্মনীকে কহে পূর্ব্ব বুদ্ধি দিনু ছাড়ি।।
হরি বলে ধন পাই আরো পাই খেতে।
ইচ্ছা নাই আর যাই ডাকাতি করিতে।।
ব্রাহ্মণ বৃত্তান্ত তারে কহিল সকল।
ব্রাহ্মণব্রাহ্মনী মিলে বলে হরিবল।।
রাজ দূত তাহা শুনি রাজাকে জানায়।
শুনিয়া রাজার মন হরষিত হয়।।
রাজা বলে প্রজা যদি হইল বৈরাগী।
রাজভেট উপহার লও তার লাগি।।
দুই রাজদূত দুই রাজভেট ল’য়ে।
স্তব করে ব্রাহ্মণেরে রাজভেট দিয়ে।।
দ্বিজ ভাবে বৈষ্ণবের সাজের কি গুণ।
বেশ দেখে বৈশ্য মোর সেবায় নিপুণ।।
আরো যবে কৃষ্ণমন্ত্র করিনু গ্রহণ।
তাহা দেখি সদাগর মোরে দিল ধন।।
পরম বৈষ্ণব ধর্ম ধন্য ধন্য মানি।
রাজা দিল ভেট দূতে কহে স্তুতি বাণী।।
বিশুদ্ধ বৈরাগী আমি যখনে হইব।
নাহি জানি তখনে কি হ’ব কিনা হ’ব।।
এ হেন বৈরাগ্য আমি কবে বা পাইব।
কবে ব্রজে যাব আমি কবে দীন হ’ব।।
এ হেন বৈষ্ণব ধর্ম আমাকে ছাড়িয়া।
কোথা ছিল হরিনাম আমাকে বঞ্চিয়া।।
যখন হইল মম দস্যুবৃত্তি মন।
কোথায় বৈষ্ণব ধর্ম ছিলরে তখন।।
যে নামে জগৎ ভুলে প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
সেই নাম মোরে ত্যাজে ছিল লুকাইয়ে।।
পেয়েছি তোমাকে যদি আর কি ছাড়িব।
যে দেশে তোমাকে পাব সেই দেশে যাব।।
আর না করিব আমি কর্ম দুরাচার।
অভেদ নাম-নামীন বুঝিলাম সার।।
দস্যুবৃত্তি করি নিত্য ভুঞ্জিয়াছি দুঃখ।
এক দিন বৈরাগী হইয়া কত সুখ।।
কল্য যারা আমাকে ক’রেছে দূর দূর।
তাহারা আদরে বলে বৈষ্ণব ঠাকুর।।
রাজ দূত দন্ড দিত আমাকে ধরিয়া।
রাজা মোরে দন্ড দিছে কারাগারে নিয়া।।
সেই রাজা সেই দূতে ব’য়ে দেয় ভেট।
বোধ হয় যমরাজা মাথা করে হেট।।
কিবা মন্ত্র লীলাজী দিলেন শিখাইয়া।
জগৎ বৈষ্ণব হো’ক আমাকে দেখিয়া।।
কিবা বৈষ্ণবের গুণ কহা নাহি যায়।
বেশ ধরিলেই মাত্র চোর সাধু হয়।।
একদিন মাত্র আমি সাধু সাজ পরি।
আর ফিরে মোর মনে না আইসে চুরি।।
একবার নাম নিলে যত পাপ হরে।
পাপীর কি শক্তি আছে তত পাপ করে।।
এই জন্যে নামে হ’ল ব্রহ্মাদেব দীক্ষে।
অভেদ নাম নামীন পাইনু পরীক্ষে।।
এই জন্যে নামে হৈল বৈষ্ণবী পার্বতী।
এই জন্য রত্নাকর ছাড়ে দস্যুবৃত্তি।।
নারায়ণ অংশে রত্নাকর জন্ম ধরে।
নামের নাহাত্ম্য জানাইতে পাপ করে।।
যার নাম সেই এই মাহাত্ম্য জানা’ল।
আর এক কথা মোর মনেতে হইল।।
জেনে তত্ত্ব নামে মত্ত শঙ্কর গোঁসাই।
যার নাম তার অঙ্গ তারাই তারাই।।
পাপী করে পাপ তাপ সাধুসঙ্গ লয়।
একবার নাম নিলে সর্ব্ব পাপ ক্ষয়।।
অন্ন কষ্ট ছলা করে বেশ ধরিলাম।
অনিচ্ছাতে নাম ল’য়ে বৈষ্ণব হৈলাম।।
আমি যে বৈষ্ণব হই আমি কেন কই।
ইহাতে কি আমি বড় অপরাধী হই।।
আমি যে বৈষ্ণব আমি যদি নাহি কই।
তাহা না বলিলে নামে গুণ থাকে কই।।
লীলাজী গুরু যে মম তার গুণ কই।
পরশ পরশে আমি বৈষ্ণব যে হই।।
পরশ পরশে যেন লৌহ হয় সোনা।
বৈষ্ণব পরশে কেন বৈষ্ণব হ’ব না।।
হাতে তালি দিয়া বলিল যে সাধু সব।
চোর ছিল দিজসুত হইল বৈষ্ণব।।
বৈষ্ণবের মুখপদ্ম বাক্য অখন্ডিত।
অই বলে আমি সাধু হইনু নিশ্চিত।।
খেতে সুতে বসিতে আমার চিন্তা নাই।
ভুক্তি দাসী লক্ষ্মীমাতা কুবের সেবাই।।
জীব সৃষ্টি করে সে কি আহার দিবে না।
নিরবধি কৃষ্ণপ্রেম করহ ভাবনা।।
যে কিছু দেখহ ভাই কৃষ্ণের সকল।
আর সব ধাঁ ধাঁ বাজী বল হরিবল।।
একদিন লীলাজীউ মহোৎসবে যেতে।
সদাগর বাটী যায় বহু শিষ্য সাথে।।
লীলাজীর মন হ’ল দস্যু ব্রাহ্মণেরে।
দিয়াছিনু মন্ত্র দেখে যাই সে কি করে।।
এতেক ভাবিয়া সাধু বাহুড়ী চলিল।
দস্যু শিষ্য বাটী এসে উপনীত হ’ল।।
দূরে থেকে লীলাজীকে করি দরশন।
উর্দ্ধবাহু করি নৃত্য করে’ছে ব্রাহ্মণ।।
ক্ষণে কক্ষবাদ্য ক্ষণে করে দন্ডবৎ।
লীলাজী চরণে নত হ’ল দন্ডবৎ।।
লীলাজীকে স্কন্ধে করি নাচিতে নাচিতে।
হরি হরি বলি ল’য়ে চলিল বাটিতে।।
রাজ ভেট সামগ্রী যতেক ছিল ঘরে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী তাতে গুরু সেবা করে।।
গ্রাম্য লোকে করে সুখে জয় জয় ধ্বনি।
খাও খাও লও লও এই মাত্র শুনি।।
ব্রাহ্মণের প্রেম দেখি বৈষ্ণব সকল।
গ্রাম্য লোক সঙ্গে মিশে বলে হরিবল।।
নগরবাসিনী রামাগণে বলে হরি।
সাধুসেবা জন্য আনে চা’ল তরকারী।।
সাধুসেবা মহোৎসব তাহাতে হইল।
দ্রব্যাদি উদ্বৃর্ত্ত আরো কতোই রহিল।।
সদাগরদত্ত সহস্রেক মুদ্রা ছিল।
লীলাজী চরণে দস্যু সব এনে দিল।।
লীলাজী বলিল সব দিলে যে আমায়।
খাইতে পরিতে বাপু তোর কি উপায়।।
বিপ্র বলে এতদিন দেখেছি খাইয়া।
খাইয়া ফুরাতে নারি আপনার দয়া।।
যে ধন আমারে প্রভু করেছেন দান।
ত্রিভুবনে ধন নাই তাহার সমান।।
সত্যভামা ব্রতকালে দান নিল মুনি।
উদ্ধব লিখিয়া দিল নাম চিন্তামণি।।
সে ধনমিশ্রিত রস যে বা করে পান।
সুস্বাদ নাহিক আর সে সুধা সমান।।
দয়া করি সেই সুধা খেতে দিলে মোরে।
পেট ভরে খেলে সুধা আরো ক্ষুধা বাড়ে।।
হেন যদি জ্ঞান করি আমি বড় দীন।
উচ্চ শৃঙ্গে টেনে তুলে তোমার কপিন।।
ভবগৃহে তব ভাবশয্যায় শয়ন।
নিদ্রা দেবী চৌকি দেন থাকিয়া চেতন।।
তব আশীর্ব্বাদে মোর বাস বহির্ব্বাস।
বাসে বাসে দেশে দেশে গৌরদেশে বাস।
রাজদূতে দণ্ড দিত ঘোর চোর জেনে।
দূত রাজাভেট দেয় রাজলক্ষ্মী সনে।।
তোমার মহিমা প্রভু জানিল সকলে।
কল্য চোর অদ্য সাধু তব কৃপা বলে।।
তব মন্ত্র বল এবে হইল প্রকাশ।
ব্রহ্মপদ হ’তে উচ্চপদ কৃষ্ণদাস।।
এ সব বৈভব দেখে মনে হয় হাসি।
ভক্তি সহ মুক্তি দেবী হইয়াছে দাসী।।
এত শুনি লীলাজীউ ধরি দিল কোল।
প্রেমানন্দে সাধুগণে বলে হরিবোল।।
গুরু কহে এবে কর তীর্থ পর্য্যটন।
দ্বিজ কহে তীর্থ-রাজ তব শ্রীচরণ।।
গুরু কহে সব লোকে করে গিয়া তীর্থ।
গয়া ধামে পিণ্ড দিলে ত্রিকুল পবিত্র।।
শিষ্য বলে কর্ণে মন্ত্র দিয়াছে যে মাত্র।
তদবধি কোটি কুল স্বর্গে করে নৃত্য।।
পতিতপাবন যত বৈষ্ণবসমাজ।
গেল দিন কহে দীন কবি-রসরাজ।।
শাপভ্রষ্টা ব্রাহ্মণীর টিকটিকি রূপ ধারণ ও মোক্ষণ।
পয়ার।
গুরু সঙ্গে শিষ্য কহে মধুর বচন।
হেনকালে শুন এক আশ্চর্য ঘটন।।
দৈবে চাল হ’তে এক টিকটিকি পড়ি।
গর্ভিণী অবস্থা গেল পেট ফেটে মরি।।
টিকটিকি মরে গুরু সাক্ষাতে পড়িয়া।
দ্বিজ কৃষ্ণদাস কাঁদে গড়াগড়ি দিয়া।।
গুরুর সম্মুখে কেন জীব হত্যা হ’ল।
পেট ফেটে গড়াগড়ি কত কষ্টে ম’ল।।
তাহাতে এতেক কষ্ট টিকটিকি পেল।
কি হ’ল কি হ’ল বলে কাঁদিতে লাগিল।।
এত কষ্টে গুরু হে জ্যোষ্ঠির মৃত্যু হয়।
দেখে দুঃখে বুক ফাটে প্রাণ বাহিরায়।।
হরি হরি বলি দ্বিজ কাঁদিতে লাগিল।
ভগ্ন ডিম্ব হ’তে ছানা বাহির হইল।।
গুরু কহে ছানা বাঁচে আর কাঁদ বৃথা।
বিপ্র বলে কষ্ট পেল এই মম ব্যথা।।
লীলাজী বলেন বাছা আর কাঁদ মিছে।
কষ্ট নহে জ্যেষ্ঠি মরে কৃষ্ণ পাইয়াছে।।
সাধু সঙ্গে মধুমাখা কৃষ্ণ আলাপন।
হেন মরা ভবে বল মরে কোন জন।।
বিপ্র বলে তবে ওর সার্থক জীবন।
মৃতদেহ সৎকার করহ এখন।।
গুরু বলে মৃতদেহ দেহ গঙ্গাজলে।
বিপ্র দিল সাধু পদ ধৌত জলে ফেলে।।
অমনি জ্যেষ্ঠির দেহ হ’য়ে গেল লয়।
মৃতদেহ না দেখিয়া সকলে বিস্ময়।।
কেহ বলে মৃতদেহ কি হ’ল কি হ’ল।
কেহ বলে পাদোদকে প্লাবিত হইল।।
বলিতে বলিতে জল শুকাইয়া যায়।
মৃতদেহ না দেখিয়া সকলে বিস্ময়।।
বৈষ্ণবেরা বলে দেহ মিশে গেল নীরে।
হরি বলে প্রেমানন্দে সবে নৃত্য করে।।
এমন সময় শূন্যে হ’ল দৈববাণী।
আমি জ্যেষ্ঠি পূর্ব জন্মে ছিলাম ব্রাহ্মণী।।
স্বামী নাম ছিল রাম কেবল ব্রাহ্মণ।
সর্বদা করিত সাধু বৈষ্ণব সেবন।।
বড় রূপবতী আমি তখনে ছিলাম।
রূপের গৌরবে স্বামী নাহি মানিতাম।।
বৈষ্ণব সেবায় আমি ছিলাম কপট।
সর্বদা স্বামীর সঙ্গে করিতাম হট।।
একদিন মাধ্যাহ্নিক ভোজনান্ত কালে।
এক সাধু গৃহে এসে উপনীত হ’লে।।
স্বামী গিয়া বৈষ্ণবের পূজিল চরণ।
আমাকে বলিল শীঘ্র করগে রন্ধন।।
আমি বলি এই আমি করিনু রন্ধন।
অগ্নিতাপ আর মম না সহে এখন।।
স্বামী সঙ্গে ক্রোধভরে কথোপকথন।
বৈষ্ণব সহিতে করি স্বামীকে ভর্ৎসন।।
স্বামী কহে সাধুসেবা জন্যে টকটকি।
জন্মান্তরে নিশ্চয় হইবি টিকটিকি।।
কতদিন পরে মম হইল মরণ।
এবে জ্যেষ্ঠিরূপে মোর জনম ধারণ।।
নানা ঠাই ভ্রমিয়া আইনু এই ঘরে।
দেখি এই বিপ্র সাধু সাধুসেবা করে।।
সাধু সঙ্গে নাম সংকীর্তন যবে হয়।
সেই প্রেম নাম এসে লাগে মোর গায়।।
শরীর দ্রবিল মম বলে হরি হরি।
ইচ্ছা হ’ল এই প্রেমমধ্যে পড়ে মরি।।
নামমন্ত্র বীজ রস ঢোকে ঢোকে খাই।
ইচ্ছাতে হইল ডিম্ব সঙ্গ করি নাই।।
ইচ্ছা হ’ল সংকীর্তনে পরমাণু থাক।
উদর হইতে মম ডিম্ব পড়ে যাক।।
আছাড়িয়া অঙ্গ ছাড়ি পড়িনু প্রত্যক্ষে।
সে ফল পাইনু সাধুসঙ্গ কল্প বৃক্ষে।।
এই আমি সেই মুনি পত্নী যে ছিলাম।
নিজ মনসিজ বীজ কীর্তনে গেলাম।।
উদকে পড়িয়া দেহ উদকে মিশিল।
ধনঞ্জয় বায়ু মোরে উর্দ্ধে আকর্ষিল।।
এবে আমি দিব্য দেহ করিয়া ধারণ।
পুষ্পরথে চড়ি করি বৈকুণ্ঠে গমন।।
এই কথা প্রভুর মুখে করিয়া শ্রবণ।
নৃত্য করে প্রভুর যতেক ভক্তগণ।।
প্রভুর ভকত এক নামেতে মঙ্গল।
কক্ষবাদ্য করি বলে জয় হরিবল।।
রামচাঁদ আর রামকুমার ভকত।
ধরণী লু’টায়ে কাঁদে শুনি কথামৃত।।
গোবিন্দ মতুয়া করে বাহু আস্ফোটন।
নৃত্য করে হরি বলে করেন রোদন।।
প্রেম সম্বরণ করি বাটীর নিম্নেতে।
নিভৃতে বসিল পরে গম্ভীর ভাবেতে।।
উথলিল ভক্তদের চিন্তা তরঙ্গিণী।
কবি কহে সাধু মুখে মধু রস বাণী।।
প্রভুর ধর্ম কন্যার বিবরণ।
পয়ার।
ওলপুর ছিল এক দাসী দুশ্চারিণী।
চৌধুরী বাটীতে সেই ছিল চাকরাণী।।
বাড়ীর কর্তার সঙ্গে বিবাদ করিয়া।
বের হ’ল মোটা মালা তিলক পরিয়া।।
কক্ষে এক ভিক্ষাঝুলি করিয়া ধারণ।
ভিক্ষা করি সেই নারী করয় ভ্রমণ।।
বৈষ্ণবী বেশ ধরি হ’য়ে পরিপাটি।
উপনীত হ’ল গিয়া ঠাকুরের বাটী।।
দণ্ডবৎ করে গিয়া লক্ষ্মীমার পায়।
বলে মাগো কিছুদিন থাকিব হেথায়।।
একা একা কর মাগো সংসারের কার্য।
আমাকে করগো দাসী কর না ত্যজ্য।।
তোমার নিকটে থাকি ঘুচাইব তাপ।
তুমি মম জননী ঠাকুর মম বাপ।।
শুনি লক্ষ্মীমাতা বলে ঠাকুরের ঠাই।
এসেছে মেয়েটি এরে রাখিবারে চাই।।
ঠাকুর বলেন প্রিয়ে! যে ইচ্ছা তোমার।
থাকে থাক যায় যাক যে ইচ্ছা উহার।।
দাসী বলে এসেছিত অবশ্যই থাকিব।
হেন মাতা পিতা আর কোথা গিয়া পা’ব।।
আমার বলিতে আর নাহিক জগতে।
ঠাকুরাণী মাতা মম তুমি মোর পিতে।।
মহাপ্রভু বলে তবে শান্তি দেবী ঠাই।
তোমার ইচ্ছে যেমন মম ইচ্ছা তাই।।
মেয়ে ছেলে আমি তার নাহি ধারি ধার।
রাখ বা না রাখ এরে যে ইচ্ছা তোমার।।
ঠাকুরাণী বলে পিতা বলেছে তোমায়।
আমাকে বলিয়া মাতা লোটাইল পায়।।
তাতে এত বেশী লোক নাহি তব ঘরে।
অবশ্য রাখিতে হয় শরণাগতরে।।
ঠাকুরাণী বলে বাছা তুমি মম মেয়ে।
গৃহে যাও খাও লও কাজ কর গিয়ে।।
অমনি উঠিয়া দাসী গৃহে প্রবেশিল।
কাজ করে খায় পরে কত দিন গেল।।
আপন ভাবিয়া দাসী করে প্রাণপণ।
গৃহকার্য করে যেন আপন আপন।।
এইভাবে দাসী থাকে কিছুদিন যায়।
দাসীর নিকটে মাতা নানা কথা কয়।।
শরীক বিভাগকালে যে টাকা পাইল।
ধর্ম মেয়ে কাছে মাতা সকল বলিল।।
বাহির করিল মাতা মেয়ের সাক্ষাতে।
টাকা তিনশত রাখে পুরিয়া থলিতে।।
বড় এক হাঁড়ি মাঝে টাকা রাখে সেরে।
তাহার মধ্যেতে রাখে ধান্য পূর্ণ করে।।
নীচের হাঁড়িতে টাকা তাতে ধান্য পূর্ণ পুরে।
আর দুই ভাণ্ড রাখে তাহার উপরে।।
কাজ কর্ম করে মাতা কহে নানা কথা।
কন্যার প্রতি মাতার বাড়িল মমতা।।
যে খানেতে তিনশত টাকা সেরে রাখে।
সময় সময় গিয়ে মায় ঝিয়ে দেখে।।
এইভাবে কন্যাকে রাখেন সমাদরে।
নিজের কন্যার মত মা ভাবেন তারে।।
আড়াই প্রহরকালে ভোজন করিয়ে।
বসিলেন প্রভু যত ভক্তবৃন্দ ল’য়ে।।
নামপদ গানে হৃষ্ট ইষ্ট গোষ্ঠ করে।
কন্যা গৃহে রাখি মাতা যান কার্যান্তরে।।
বেলা প্রহরেক আছে এমন সময়।
ধর্মকন্যা দাসী ছিল একা সে আলয়।।
যে হাঁড়িতে ধান্য ছিল তাহা ভূমে ঢালি।
দাসী কন্যা টাকা ঝা’ল লয়ে গেল চলি।।
ঝা’ল কোমরেতে বাঁধে এমন সময়।
লক্ষ্মীমাতা গৃহদ্বারে হ’লেন উদয়।।
মাতা ব’লে ধান্য ঢালি কি করিস ঘরে।
বলিতে বলিতে দাসী চলিল বাহিরে।।
বাহিরিতে গিয়া দাসী দ্রুত গতি ধায়।
দৌড় দিয়া পড়িল সে বাড়ীর নীচায়।।
বৃক্ষ আদি নাহি আর নাহি তৃণ বন।
বসতি বাটীর নীচে ধান্য উপার্জন।।
পালাইতে নাহি পারে বেগে চলি যায়।
দু’চারি পা যায় আর ফিরে ফিরে চায়।।
লক্ষ্মীমাতা বলে এত করিয়া মমতা।
মোরে থুয়ে টাকা ল’য়ে তুই যাস কোথা।।
আরো বেগে ধায় দাসী উত্তর না দেয়।
ঠাকুরাণী গিয়া তাহা ঠাকুরে জানায়।।
আপনি আছেন হেথা দাসী ছিল ঘরে।
আমি গিয়াছিনু মেয়ে রেখে কার্যান্তরে।।
শূন্য ঘর পেয়ে গেল টাকা ল’য়ে চলি।
ধান্যভাণ্ডে টাকা ছিল ধান্য ফেলি ঢালি।।
অই যায় চোরা কন্যা টাকা ল’য়ে যায়।
দ্রুতগতি যায় আর ফিরে ফিরে চায়।।
এই জন্য বুঝি মাতা পিতা ব’লেছিল।
তিনশত টাকা ল’য়ে অই যে চলিল।।
কেহ বলে টাকা নিল চোর ধরে আনি।
ঠাকুর বলেন নাহি বল হেন বাণী।।
পিতার থাকিলে ধন পুত্র কন্যা পায়।
ধন ধান্যে ইহা বই আর কিবা হয়।।
ছিল ধন নিল কন্যা তাতে কিবা ক্ষতি।
দেখি ধন বিনা মোর কিবা হয় গতি।।
নিজ কন্যা হ’তে আরো ধর্মকন্যা ভারি।
কন্যা নিল পিতৃধন কেবা কয় চুরি।।
ধর্ম কন্যা ধর্মে দিল ধর্মে নিল ধন।
ধর্মের নিকটে নাহি অধর্ম কখন।।
ধর্ম করিয়াছে কর্ম অধর্ম এ নয়।
কন্যাকে বলিলে চোর অধর্ম সঞ্চয়।।
আগে কন্যা বলি যারে করিলা বিশ্বাস।
এবে চোরা বলিলে বিশ্বাস ধর্ম নাশ।।
লক্ষ্মীদেবী থাকে সদা ধর্মের আশ্রয়।
ধর্মের সহিত লক্ষ্মী অর্থ সে যোগায়।।
এই ধন ছিল সেই লক্ষ্মীর গোচরে।
সেই লক্ষ্মী এই ধন দেখাইল তারে।।
সর্বান্তর্যামিনী লক্ষ্মী সব জানতে পারে।
যেনে সেই লক্ষ্মী কেন যান স্থানান্তরে।।
যবে টাকা ল’য়ে যায় লক্ষ্মী দৃষ্টি করে।
দেখে কেন সে লক্ষ্মী ধরিল না তারে।।
ধর্ম মাতা পিতা যার লক্ষ্মী নারায়ণ।
সে কেন পাবে না বল এ সামান্য ধন।।
কন্যা নিল টাকা তাত’ পরে লয় নাই।
তব মনে যাহা প্রিয়ে মম মনে তাই।।
ধন উপার্জন করে বসিয়া খাইতে।
দেখি মোরা ধন বিনে পাই কিনা খেতে।।
খেতে কি দেবে না কৃষ্ণ সৃষ্টি করে জীব।
এই ধন বিনা মোরা হব কি গরীব।।
কোথা হতে আসে ধন কোথা চলে যায়।
কেবা দেয় কেবা লয় কে চিনে তাহায়।।
এই ধন ফিরিতেছে সব ঘরে ঘরে।
কোথাকার ধন ইহা কেবা রক্ষা করে।।
ধনেশ কুবের ছিল কনক লঙ্কায়।
ধনচ্যুত করি তাকে রাবণ তাড়ায়।।
রাবণের গৃহে লক্ষ্মী করিত রন্ধন।
ইন্দ্র মালাকার অশ্ব রক্ষক শমন।।
বিষ্ণু অবতার রাম রাজার কুমার।
ভার্যাসহ বনবাসী চৌদ্দ বৎসর।।
কার লঙ্কা কার হ’ল কেবা নিল ধন।
কোথা সে ত্রিলোকজয়ী লঙ্কেশ রাবণ।।
রাজপুত্রবধূ রাজকন্যা সেই সীতা।
বৈকুণ্ঠ-ঈশ্বরী দেবী শ্রীরাম বণিতা।।
কোথা র’ল রাজ্য ধন কোথা র’ল পতি।
আজন্ম বনবাসিনী কতই দুর্গতি।।
যদি বলি ঈশ্বরের লীলা এ সকল।
সত্য কিন্তু কর্ম অনুসারে ফলে ফল।।
একই মানুষ সব একই শহরে।
একই ব্যবসা করে একই বাজারে।।
কেহ দুঃখী কেহ সুখী কেহ পরাধীন।
কেহ লক্ষপতি হয়, কার হয় ঋণ।।
অর্থে কিংবা স্বার্থ শুধু অনর্থের গোল।
কৃষ্ণপদ স্বার্থ ভেবে বল হরি বল।।
একদিন লক্ষ্মীমাতা বাক্যের প্রসঙ্গে।
মধুমাখা বাক্যে ঠাকুরকে বলে রঙ্গে।।
লক্ষ্মীমাতা বলে প্রভু নাহি কর কার্য।
পুত্র কন্যা জন্মিয়াছে নাহি কর গ্রাহ্য।।
ঠাকুরালী কর সদা ল’য়ে ভক্তগণ।
কেমনে চলিবে এদের ভরণ পোষণ।।
ইহাদের কি হইবে নাহি ভাব মনে।
আমি একা কি করিব তব দয়া বিনে।।
ঠাকুর বলেন আমি কি কার্য করিব।
যাহা করে জগবন্ধু গৃহে ব’সে রব।।
জমি ভূমি কৃষিকার্য কিছুই না মানি।
জনমে জনমে মাত্র গরুরাখা জানি।।
জমি জমা চাষ কার্য কিছু না করিব।
এইমত ঠাকুরালী করিয়া ফিরিব।।
দেখি ঈশ্বরের দয়া হয় কিনা হয়।
দেখি প্রভু মোরে খেতে, দেয় কিনা দেয়।।
ইহা বলি মহাপ্রভু ফিরিয়া ঘুরিয়া।
দুই তিন দিন ওঢ়াকাঁদিতে রহিয়া।।
নিজবাটী না আইসে রহে অন্য ঘর।
চারিদিন পরে গেল রাউৎখামার।।
রাউৎখামার রামচাঁদ বাড়ী যান।
রামচাঁদ প্রভুকে করেন হরিজ্ঞান।।
রাউৎখামার প্রভুর বিহার বিরাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
রাউৎখামার গ্রামে প্রভুত্ব প্রকাশ ও ভক্তসঙ্গে নিজালয় গমন।
পয়ার
আত্মা সমর্পিয়া ভক্তি করে রামচাঁদ।
ভক্তিতে হ’লেন বাধ্য প্রভু হরিচাঁদ।।
শ্রীবংশীবদন আর শ্রীরাম সুন্দর।
বাঁশীরাম কাশীরাম শ্রীরাম কিশোর।।
বালাদের বাড়ী দিন দুদিন থাকিল।
বালারা সগণসহ মাতিয়া উঠিল।। (স্বজনসহ)
ভক্তগণ সঙ্গে করি হরিপ্রেম রসে।
নাম গান ভাবে মত্ত মনের উল্লাসে।।
দেশ ভরি শব্দ হ’ল মধুর মধুর।
যশোমন্ত ছেলে হরি হ’য়েছে ঠাকুর।।
রোগযুক্ত লোক যত প্রভুর স্থানে যায়।
কীর্তনের ধুলা অঙ্গে মাখিবারে কয়।।
অমনি সারিয়া ব্যাধি করে সংকীর্তন।
কেহ বা লোটায়ে ধ’রে প্রভুর চরণ।।
কেহ কেহ মনে মনে করেন মানসা।
ব্যাধিমুক্ত হোক মোর পূর্ণ হোক আশা।।
হরিলুঠ দেব এনে শ্রীহরির স্থানে।
কেহ কেহ মুদ্রা দিব মনে মনে মানে।।
কীর্তনে আসিয়া কেহ গায়ে মাখে ধুলি।
রোগমুক্ত হ’য়ে নাচে দুই বাহু তুলি।।
কখন কখন প্রভু নিজ ভক্ত সঙ্গে।
হাসে কাঁদে নাচে গায় কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।
কখন কখন প্রভু নিশ্চিন্ত থাকয়।
কোন ব্যাধিযুক্ত লোক এমন সময়।।
রোগীরা মানসা সব করিত হরিষে।
আরোগ্য হইলে ব্যাধি দাস হ’ব এসে।।
কেহ বা কহিত দাস হইনু এখনে।
মনঃপ্রাণ দেহ সপিলাম শ্রীচরণে।।
দেহের এ রোগ মম হউক আরোগ্য।
অর্থ কিছু তাম্রমুদ্রা দিয়া যাব শীঘ্র।।
কেহ বা কহিত দিব সোয়া পাঁচ আনা।
কেহ বা কহিত আমি দিব সোয়া আনা।।
কেহ বা কহিত আমি দিব পাঁচসিকা।
কেহ বা কহিত দিব সোয়া পাঁচসিকা।।
কেহ বা যাইত মনে মানসা করিয়া।
আরোগ্য হইলে ব্যাধি দিতেন আনিয়া।।
প্রভুর মুখের বাক্যে রোগমুক্ত হয়।
এইমত রোগী কত আসে আর যায়।।
পাঁচ সাত গ্রামে ক্রমে শব্দ হ’ল ভারি।
কত লোক আসিত দেখিব বলে হরি।।
যেখানে থাকিত প্রভু ল’য়ে ভক্তগণ।
চাউল মজুদ হত দুই তিন মণ।। (হ’ল)
টাকাগুলি যত সব রোগীরা আনিত।
কতক হইত ব্যয় কতক থাকিত।।
প্রভুর সম্মুখে এনে হাজির করিত।
ঠাকুর তাহার কিছু হাতে না ধরিত।।
ভক্তগণ রাখিতেন আর আর স্থানে।
হরিলুঠ কতজনে দিত সংকীর্তনে।।
এইভাবে প্রভু রহিলেন তিনমাস।
একদিন ভক্তগণে বসি প্রভু পাশ।।
প্রভুর নিকটে কহে করজোড় করি।
যাইব আমরা সবে আপনার বাড়ী।।
প্রভু বলে কেবা আত্ম কেবা কার পর।
আমি কার কে আমার মায়া বাড়ী ঘর।।
ভক্তগণে বলে প্রভু! দয়া হয় যদি।
ল’য়ে চল সকলে শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
শুনিয়া হাসিয়া কয় প্রভু ইচ্ছাময়।
কর ইচ্ছা যাহা তোমাদের ইচ্ছা হয়।।
হ’য়ে তুষ্ট মহাহৃষ্ট পরস্পর কয়।
হ’য়ে তুষ্ট মহাহৃষ্ট পরস্পর কয়।
শ্রীধামে কে যাবি তোরা আয় আয় আয়।।
এত বলি সবে মিলি সাজাল তরণী।
যার বাড়ী যাহা ছিল দ্রব্য দিল আনি।।
তাম্রমুদ্রা রৌপ্যমুদ্রা কেহ দিল ধান্য।
কেহ দধি কেহ ঘৃত পাত্র পরিপূর্ণ।।
কেহ দিল তরকারি কুষ্মাণ্ড কদলী।
পক্ক রম্ভা থোড় মোচা পদমূল কলি।।
ছোলা বুট মুগ মাস মটর ডাউল।
বস্তা দশ পরিপূর্ণ নূতন চাউল।।
ছানা দধি সন্দেশাদি গুড় দশখান।
আতপ তণ্ডুল দশমণ পরিমাণ।।
দুইশত নারিকেল হাজার সুপারী।
পাঁচ হাত মুখে এক সাজাইল তরী।।
তরী পরিপূর্ণ করি ঠাকুরে উঠায়।
হরি বলে তরী খুলে ওঢ়াকাঁদি যায়।।
ওঢ়াকাঁদি ঘাটে তরী লাগাইল এসে।
ভক্তগণে দ্রব্য আনে ঠাকুরের বাসে।।
প্রভু যায় আগু আগু পিছে ভক্তগণ।
যাইতে আসিতে পথে করে সংকীর্তন।।
ঠাকুর আসিয়া বসিলেন নিজ ঘরে।
ভক্তগণ দ্রব্য এনে রাখে ভারে ভারে।।
টাকা সিকি আধুলী তাম্রের মুদ্রা যত।
সব সুদ্ধ পরিমাণ টাকা একশত।।
প্রিয়ভক্ত রামচাঁদ সেই টাকা ল’য়ে।
লক্ষ্মীমার নিকটেতে দিলেন আনিয়ে।।
ঠাকুর বলেন তবে ইহা তুলে লও।
কি তব বাসনা মনে আর কিবা চাও।।
লক্ষ্মীমাতা বলে মম বাসনা কি আর।
চিরদাসী অভিলাষী শ্রীপদ তোমার।।
ঐশ্বর্য প্রকাশ হল ভকত সমাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
আদি খণ্ড
ষষ্ট তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
[embed]https://www.youtube.com/watch?v=9wbM_Xw8Vz8[/embed]জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
ভক্তগণের মহাসংকীর্তনোচ্ছাস
পয়ার
এইভাবে হরিচাঁদ করে ঠাকুরালী।
প্রভু-সঙ্গে ভক্ত সদা থাকে মেলা মেলি।।
ঐশ্বর্য্য প্রকাশি, প্রভু আসিলেন বাসে।
লক্ষ্মীমাতা পদসেবা করিল হরিষে।।
রন্ধন করিয়া ভক্তগণে ডাক দিল।
ভক্তগণে হরি বলে ভোজনে বসিল।।
ঠাকুরানী ডাক দিয়া রামচাঁদে বলে।
তিন চারি মাস বাপ কোথায় বেড়া’লে।।
তোমরা বেড়াও সদা ব’লে হরি বোল।
কোথায় পাইলে বল এ দ্রব্য সকল।।
রামচাঁদ বলে তুমি শুন লক্ষ্মীমাতা।
তোমার কৃপায় পাই আর পা’ব কোথা।।
প্রভু বলে রামচাঁদ বল তোর মাকে।
সর্ব ফল ফলে এক কৃষ্ণকল্প বৃক্ষে।।
শূন্যে রহে কল্প বৃক্ষ ঈশ্বর ইচ্ছায়।
কল্পবৃক্ষ কৃষ্ণভক্তে কল্পনা করয়।।
কৃষ্ণপ্রেম রসিকের রসময় দেহে।
সে দেহের ছায়া সেই কল্পবৃক্ষে চাহে।।
মাতা বলে অর্থে আর নাহি প্রয়োজন।
জন্মে জন্মে চাই তব যুগল চরণ।।
শুনি সব ভক্তগনে বলে হরিবোল।
অর্থত্যাগী প্রেমন্মত্ত ভাবের পাগল।।
প্রেম অনুরাগে সব ভকত জুটিল।
‘মতুয়া’ বলিয়া দেশে ঘোষণা হইল।।
মঙ্গল নাটুয়া বিশে পূর্ব পারিষদ।
ওঢ়াকাঁদিবাসী পারিষদ রামচাঁদ।।
ভজরাম চৌধুরীর ছোট ভাই যেই।
ঠাকুরের ঐকান্তিক পারিষদ সেই।।
কুবের বৈরাগী রামকুমার ভকত।
প্রভুর ভকত সেই হয়েছে ব্যকত।।
গোবিন্দ মতুয়া আর স্বরূপ চৌধুরী।
প্রেমাবেশে ভাবে মেতে বলে হরি হরি।।
চূড়ামণি বুধই বৈরাগী দুই ভাই।
হরিচাঁদ পেয়ে আনন্দের সীমা নাই।।
জগবন্ধু বলে ডাক ছাড়িত যখন।
সুমেরুর চূড়া যেন হইত পতন।।
মঙ্গল যখন হরি কীর্তন করিত।
সম্মুখেতে মহাপ্রভু বসিয়া থাকিত।।
মঙ্গলের নাসা অগ্রে কফ বাহিরিত।
প্রেমে অশ্রুপূর্ণ হয়ে বক্ষ ভেসে যেত।।
ক্ষণে দিত গড়াগড়ি ক্ষণে উঠে বসে।
ক্ষণে নেচে ভেসে যেত প্রেমসিন্ধু রসে।।
ক্ষণে বীর অবতার ক্ষণেক বিমর্ষ।
উত্তরাক্ষ রুদিত বিকট ভঙ্গি হাস্য।।
গাইতে গাইতে শ্লেষ্মা উঠিত মুখেতে।
ঘন মুখ ফিরাইত ডান বাম ভিতে।।
উর্দ্ধ অধঃ মুখ ঝাকি করতালি দেয়।
বালকেতে অগ্নিদন্ড যেমন ঘুরায়।।
তাতে মাত্র দেখা যায় অগ্নির মণ্ডল।
দণ্ড না দেখায় অগ্নি দেখায় কেবল।।
তেমনি মঙ্গল যবে ঘুরাইত মুখ।
এক মঙ্গলের দেখাইত শত মুখ।।
বড় প্রেম উথলিয়া পড়িত গোবিন্দ।
কক্ষবাদ্য করি হেলি দুলিয়া আনন্দ।।
পিছেতে প্রভুকে রাখি বিমুখ হইয়া।
প্রভুর মুখেতে মুখ থাকিত চাহিয়া।।
প্রেমে ঝাঁকাঝাঁকি নাকে শ্লেষ্মা উঠিয়া।
প্রভু অঙ্গে পড়িত যে ছুটিয়া ছুটিয়া।।
নাকে মুখে চোখে যাহা যেখানে পড়িত।
যত্ন করি প্রভু তাহা অঙ্গেতে মাখিত।।
কক্ষবাদ্য করি রামকুমার ভকত।
কীর্তন মধ্যেতে হেলে দুলিয়া পড়িত।।
এইরূপে ভক্তবৃন্দ হয়ে একতর।
দিক নাই কে পড়িত কাহার উপর।।
মহাভাবে চিত্তানন্দ হৃদয় আহ্লাদ।
গম্ভীর প্রকৃতি যেন প্রভু হরিচাঁদ।।
ভক্তগণে প্রেমন্মত্ত হইত যখন।
বিকৃতি আকার প্রভু হইত তখন।।
ক্ষণে কৃষ্ণবর্ণ ক্ষণে গৌরাঙ্গ বরণ।
রক্তজবা তুল্য হ’ত যুগল লোচন।।
ক্ষণে দূর্বাদল শ্যাম ক্ষণে পাটল।
ক্ষণে নীলোৎপল বর্ণ নয়ন যুগল।।
ভক্তগণে হুঙ্কারিত বলে হরিচাঁদ।
সে ধ্বনি শ্রবণে যেন মত্ত সিংহনাদ।।
সবলোক মত্ত হয়ে দিত হরিধ্বনি।
তাহাতে হইত যেন কম্পিতা মেদিনী।।
কেহ না জানিত দিবা কি ভাবেতে গেল।
না জানিত যামিনী কিভাবে গত হল।।
প্রেমানন্দ সদানন্দ আনন্দে বিভোল।
ভণে শ্রীতারকচন্দ্র বল হরি বল।।
প্রভুর নতুন বাটী বসতি।
পয়ার
একদা প্রভুর জ্যেষ্ঠ নামে কৃষ্ণদাস।
ঠাকুরকে কহে দেকে শুন হরিদাস।।
আমরা সকলে থাকিলাম এক বাড়ী।
তুমি বা একাকী কেন থাক সবে ছাড়ি।।
এস সবে একত্রেতে সুখে করি বাস।
তাহা শুনি মহাপ্রভু যেতে কৈল আশ।।
এ সময় জমিদার এসে ওঢ়াকাঁদি।
পূর্ববাড়ী যাইবারে করে কাঁদাকাঁদি।।
না হইল পঞ্চভাই তাহাতে স্বীকার।
কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরে গেল জমিদার।।
আমভিটা ত্যাজি প্রভু পোদ্দার বাটিতে।
পাঁচ ভাই বসতি করিল একসাথে।।
নড়াইলবাসী বাবু নাম রামরত্ন।
জমিদার বসাইল করি বহু যত্ন।।
রামরত্ন হরনাথ আর সীতানাথ।
এ তিনের নাম নিলে হয় সুপ্রভাত।।
তেলীহাটী পরগনে ইহারা মালেক।
আমিরাবাত ওঢ়াকাঁদি জমিদার এক।।
এই ওঢ়াকাঁদি প্রভু করেন বসতি।
সমাদরে জমিদার করিলেন স্থিতি।।
ভকত ভবনে প্রভু যাতায়াত করে।
ভক্ত সঙ্গে থাকে রঙ্গে আনন্দ অন্তরে।।
ওঢ়াকাঁদি আর ঘৃতকাঁদি মাচকাঁদি।
কুমারিয়া চন্দ্রদ্বীপ আর আড়োকাঁদি।।
ইত্যাদি অনেক গ্রাম চতুঃপার্শ্বে রয়।
ভক্তি করি যে ডাকে তাহার বাড়ী যায়।।
ভক্তবৃন্দ পান করে কৃষ্ণ প্রেমরস।
হাসে কাঁদে নাচে গায় অন্তরে উল্লাস।।
দুই পুত্র তিন কন্যা ল’য়ে ঠাকুরানী।
সুখের সাগরে ভাসে লোচন নন্দিনী।।
ভকত ভবনে ফিরে প্রভু হরিচাঁদ।
বাঞ্ছাপূর্ণ করে হরি যার যেই সাধ।।
যেখানে যেখানে আছে প্রভুর ভকত।
ক্রমে এসে এক ঠাই হয়েন একত্র।।
এইভাবে ওঢ়াকাঁদি কালাতিবাহিত।
ভক্তগণে আসে যায় হয়ে হরষিত।।
কোন কোন প্রভু ভক্তগণে লয়ে।
পুষ্করিণী তীরে গিয়ে থাকেন বসিয়ে।।
পরিধান একবস্ত্র অর্ধাংশ গলায়।
শীত গ্রীষ্মে সমভাব ছেড়া কন্থা গায়।।
শয্যাহীন দূর্বাসনে থাকিত বসিয়া।
একে একে ভক্ত সব মিলিত আসিয়া।।
কখন বসিত প্রভু তৃণাসন করি।
ভক্তগণ বসিয়া বলিত হরি হরি।।
ভাব যেন দীন হীন পথের কাঙ্গাল।
ভাব যেন দীন হীন পথের কাঙ্গাল।
ডাকিতেন কোথা কৃষ্ণ যশোদা দুলাল।।
হা কৃষ্ণ গোকুলচন্দ্র করুণানিধান।
ভক্তভাব প্রকাশিত নিজে ভগবান।।
কভু হরি, বলি হরি হইত বিস্মৃতি।
কখনও বদনে হ’ত সূর্যসম জ্যোতি।।
এইভাবে ওঢ়াকাঁদি লীলা প্রকাশয়।
ঐশ্বর্য্যয়ের মধ্যে শুধু মাধুর্য লুকায়।।
গার্হস্থ্য প্রশস্ত ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
দীননাথ হরি অবতীর্ণ অবনীতে।।
ভক্তগণ অনুক্ষণ নাহি ছাড়ে সঙ্গ।
ক্রমে ক্রমে বাড়িতেছে লীলার প্রসঙ্গ।।
কিছুদিন একবাড়ী সুখে করি বাস।
শ্রীবৈষ্ণবদাস আর শ্রীস্বরূপদাস।।
দুই ভাই পদ্মবিলা করিল বসতি।
তিন ভাই থাকিলেন ওঢ়াকাঁদি স্থিতি।।
ওঢ়াকাঁদি বাস না করিত বহুদিন।
একমাস মধ্যে মাত্র দুই এক দিন।।
আর সদা থাকিতেন ভক্তের আলয়।
যেখানে সেখানে থাকি হরিগুণ গায়।।
মুহূর্তেক প্রভু যদি কোথা বসিতেন।
ব্যাধিযুক্ত রোগযুক্ত লোক আসিতেন।।
যারা হ’ত রোগমুক্ত মানসা করিয়া।
মানসিক মুদ্রা সব দিতেন আনিয়া।।
সেই মুদ্রা ভক্তগণ লইয়া সাদরে।
আনিয়া দিতেন লক্ষ্মীমাতার গোচরে।।
অল্পদিন রহে প্রভু নিজ ভদ্রাসনে।
অধিকাংশ রহে প্রভু ভক্তের ভবনে।।
অল্প সময় থাকে অন্য ভক্ত ঘরে।
সদা ব্যস্ত যাইতে সে রাউৎখামারে।।
হরিচাঁদ চরিত্র পবিত্র সুধাভাণ্ড।
কবি কহে শ্রবণেতে খণ্ডে যম দণ্ড।।
রোগের ব্যবস্থা।
পয়ার
লোক আসে প্রভুস্থানে হ’য়ে রোগযুক্ত।
সংকীর্তনে গড়ি দিলে হয় রোগমুক্ত।।
রোগ জানাইয়া সবে বলিত কাতরে।
রোগমুক্ত হ’ত প্রভু দিলে আজ্ঞা করে।।
প্রভু বলিতেন যদি রোগমুক্তি চাও।
যে রোগের বৃদ্ধি যাতে তাই গিয়া খাও।।
তিন সন্ধ্যা ধুলি মাখ তুলসীর তলা।
জ্বর হ’লে পথ্য দেন তেঁতুলের গোলা।।
বেদনা অজীর্ণ বমি কিংবা অম্ল পিত্তে।
তেঁতুল গুলিয়া খায় পিতলের পাত্রে।।
মহারোগে অঙ্গে মাখে গোময় গোমূত্র।
কেহ বা আরোগ্য হয় প্রভু আজ্ঞামাত্র।।
রোগ জানাইয়া যায় মানসা করিয়ে।
মানসিক টাকা দেয় রোগমুক্ত হ’য়ে।।
মানসা করিত লোকে যার যেই শক্তি।
একান্ত মনেতে যার যেইরূপ ভক্তি।।
মুদ্রাপানে প্রভু নাহি চাহিয়া ফিরিয়া।
উঠে যাইতেন প্রভু সে মুদ্রা ফেলিয়া।।
ভক্তে জিজ্ঞাসিত প্রভু কোথা রাখি ধন।
প্রভু বলে যার ধন তাহার সদন।।
ভক্তগণ এইসব ইঙ্গিত বুঝিয়া।
লক্ষ্মীর নিকট ধন দিতেন আনিয়া।।
পৌষেতে আমন ধান্য কাটিয়া কাটিয়া।
মোচন করিয়া ভক্ত দিত পাঠাইয়া।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত নানাবিধ তরকারি।
পায়স পিষ্টক চিনি সন্দেশ মিছরী।।
কমলা কদলী কুল দাড়িম্ব সুন্দর।
আম জাম নারিকেল খাদ্য মনোহর।।
ভক্তগণে দ্রব্য আনে প্রভুর সেবায়।
লক্ষ্মীর নিকটে সব আনন্দে যোগায়।।
কালেতে যখন যে নূতন দ্রব্য পেত।
ভক্তগণে এনে তা ওঢ়াকাঁদি দিত।।
কেহ কেহ লয়ে যেত আপন বাসরে।
নিজগৃহে লইয়া প্রভুর সেবা করে।।
নূতন আমন ধান্য হইলে বিপুল।
আগ্ ধান্য রাখে কেহ আতপ তণ্ডুল।।
প্রভুভক্ত সুচরিত যেন শুধু মধু।
কবি কহে কর্ণ ভরি পিও সব সাধু।।
রাম কুমারের অঙ্গে কাল সর্পঘাত।
পয়ার
এইভাবে হইতেছে কালের হরণ।
একদিন শুন সবে দৈব নির্বন্ধন।।
প্রভু প্রিয় ভক্ত রামকুমার ভকত।
তার বাড়ী যান প্রভু ভক্ত সঙ্গে কত।।
তৃতীয় প্রহর রাত্রি নাম সংকীর্তন।
কীর্তনান্তে করিলেন গৃহেতে গমন।।
সকল ভকতগণ বিদায় করিয়া।
গৃহে যান প্রভু রামকুমারে লইয়া।।
গোবিন্দ মতুয়া সঙ্গে হইয়া মিলন।
কীর্তনের ভাব অঙ্গে আছে তিন জন।।
গোবিন্দ পিছেতে ধায় মধ্যেতে কুমার।
সকলের অগ্রেতে ঠাকুর অগ্রসর।।
গোবিন্দ নিকটবর্তী প্রভু কিছু দূরে।
হেনকালে সর্পঘাত করিল কুমারে।।
থর থর করি গাত্র কাঁপিতে লাগিল।
বলে প্রভু কাল সাপে আমারে কাটিল।।
প্রভু বলে কি সর্প তা জানিলে কেমনে।
গোক্ষুর কি কাল সাপ দেখেছ নয়নে।।
কুমার বলিল জ্যোস্নায় দেখা যায়।
অই সেই সর্প মোরে দংশে চ’লে যায়।।
ঠাকুর বলেন তার বুকে দিয়া কর।
গাত্র যেন কাঁপে তোর বুক ধড়ফড়।।
সর্পের দংশনে তোর কেন হল ভয়।
দেখ সাপ ধরে আনি কেমনে দংশায়।।
দাঁড়া তুই আমি সেই সর্প ধরে আনি।
যার বিষ চুমুকিয়া লবে সেই ফণী।।
কহিছে রামকুমার তাহা না পারিব।
পুনঃ সাপ দেখে শঙ্কায় মরিব।।
ঠাকুর কহিছে তুই আয় মম কাছে।
দেখি তোর কোনখানে সাপে দংশিয়াছে।।
দেখাইয়া দিল ঘা ভকত মহাশয়।
দেখে দংশিয়াছে বাম পায়ের পাতায়।।
দক্ষিণ পদ অঙ্গুলি ঠাকুর তখনে।
সর্পকাটা ঘায় ছোঁয়াইল ততক্ষণে।।
সর্প কোথা বিষ কোথা কেনরে ভাবিস।
সর্পের নিকটে থাকে মানুষের বিষ।।
ব্রহ্মার কুমার দক্ষ মানুষ অবতার।
সবে জানে ষাটি কন্যা জন্মিল তাহার।।
মানুষ কশ্যপ মুনি তের কন্যা লয়।
যুগ ধর্ম অষ্ট কন্যা করে পরিণয়।।
একাদশ কন্যা তার রুদ্রে বিয়া করে।
সাতাইশ কন্যা দিল নিশাকর করে।।
নবরূপ প্রজাপতি জাতিতে মানুষ।
তার কন্যা বিয়ে করে অনাদি পুরুষ।।
দক্ষপুরে সতী ত্যাগ করিল জীবন।
শব শিরে করি শিব করিল রোদন।।
নয়ন জলেতে সেই বিষ বাহিরিল।
সমুদ্র মন্থনকালে সে বিষ উঠিল।।
জাতি সর্প অনন্ত বাসুকী যারে কয়।
মানুষ কশ্যপ মুনি তার পিতা হয়।।
বাসুকী বন্ধন দড়ি তখনে হইল।
সমুদ্র মন্থনকালে বিষ উগারিল।।
বিষে বিষ মিশিল খাইল শূলপাণি।
পার্বতীর দুগ্ধপানে নির্বিষ অমনি।।
বিষহরি বিষ হরি নিল সে সময়ে।
জটাচার্ব্ব বংশে জরৎকারু করে বিয়ে।।
সেই পদ্মা বিষকর্ত্রী তার কাছে বিষ।
বিষ মানুষের নারী ভয় কি করিস।।
মহতের কোপে হয় বিষ উপার্জন।
সাপে কি করিতে পারে করিয়া দংশন।।
বিষ খাইয়াছে সর্প তোমাকে দংশিয়া।
মরিবে ও সর্প কল্য দেখিও আসিয়া।।
শেষে গিয়া বসিলেন প্রভুর শ্রীধামে।
যামিনী প্রভাত হ’ল কৃষ্ণকথা প্রেমে।।
প্রাতঃকৃত্য করি হরি কথার আলাপ।
বলে চল দেখে আসি কামড়ানে সাপ।।
ঠাকুরের সঙ্গেতে গিয়ে ভক্ত মহাশয়।
দেখে গিয়া সেইখানে সর্প মরে রয়।।
ঠাকুর বলেন সর্প বিষ খাইয়াছে।
তোর অঙ্গবিষে সর্প মরে রয়েছে।।
যখন করিল কৃষ্ণ কালীয়া দমন।
কৃষ্ণ অঙ্গে রাগে নাগে করিল দংশন।।
কালীয়ের ফণা ভাঙ্গি করিল দমন।
শিরে দিল পদচিহ্ন কালীয় দমন।।
সেই হ’তে গরুড়ের ভয় তার গেল।
বিনতানন্দন তারে কিছু না বলিল।।
গরুড়ে আরূঢ় হইতেন ভগবান।
সে গরুড় মনিপত্নী বিনতাসন্তান।।
কৃষ্ণভক্ত গরুড়ের সহায় সংসারে।
সাপের কামড়ে কোথা কৃষ্ণভক্ত মরে।।
কংস যবে পুতনাকে ব্রজে পাঠাইল।
পুতনা রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখাইল।।
কংস দিল আজ্ঞা করে সাপুড়িয়াগণে।
কালকূট বিষ পুতনাকে দেও এনে।।
আজ্ঞা পেয়ে সাপুড়িয়া কালফণী ধরে।
দন্তভেঙ্গে সাপুড়িয়া বিষ বের করে।।
যে কালে সর্পের গলা চাপিয়া ধরিল।
এ সময় কালসর্প কাঁদিতে লাগিল।।
তবু দন্ত ভেঙ্গে বিষ করিল বাহির।
কাঁদিয়া সে ফণীবর হইল অস্থির।।
দূত বলে ওরে সর্প কাঁদ কি লাগিয়া।
দন্তভঙ্গ এইটুকু বেদনা পাইয়া।।
রাজকার্য তোমা হ’তে সাহায্য হইবে।
ঔষধ লাগায়ে দিলে বেদনা ঘুচিবে।।
সর্প বলে ওরে দূত মনে দেখ ভেবে।
সামান্য বেদনা পেয়ে সর্প কাঁদে কবে।।
তবে যে কেঁদেছি আমি চক্ষে বহে বারি।
এই ব্যাথা হ’তে মম ব্যাথা আছে ভারি।।
এই বিষ পুতনা মাখিয়া যা’বে স্তনে।
বিষমাখা দুগ্ধ খাওয়াবে ভগবানে।।
যে মুখে যশোদা দেয় ক্ষীর-সর-ননী।
সেই মুখে বিষ দিবে কংস নৃপমণি।।
এতদিন বিষ ধরি আমি বিষধর।
এ বিষ করিবে পান হরি বিষহর।।
তাহা বলে নাহি কাঁদি ভাঙ্গিবে দশন।
কৃষ্ণমুখে বিষ দিবে কাঁদি সে কারণ।।
সাধন ভজন কিছু করিবারে নারি।
আরো মম বিষ পান করিবেন হরি।।
এজন্য আমাকে সৃজিলেন জগদীশ।
অমল কমল মুখে দিবি মম বিষ।।
ভাবিয়া দেখিনু মম জনম বিফল।
এই মনোদুঃখে মম চক্ষে পড়ে জল।।
আমারে ধরিলি আমি কোন অপরাধী।
জগদীশ খা’বে বিষ এই দুঃখে কাঁদি।।
সেই সর্প অইদুঃখে করিল বিলাপ।
তোমারে দংশিল এই কোন দেশী সাপ।।
নিজে কৃষ্ণে কষ্ট পেলে কষ্ট নাহি তায়।
ভক্তে কষ্ট পেলে তার কষ্ট অতিশয়।।
ক্রুরজাতি সর্প ওর পাপ উপজিল।
বিনা অপরাধে তোরে দংশি ম’রে গেল।।
সর্পের দংশনে কভু সজ্জন মরে না।
সজ্জনের কোপ হ’লে সর্পই বাঁচে না।।
যে কালেতে কালীদহে কালীয়ের বিষ।
সেই বিষ উর্দ্ধগামী যোজন পঁচিশ।।
পক্ষী উড়ে কালীদহ পার হ’তে নারে।
কালীয়ের বিষে পুড়ে পক্ষী যেত মরে।।
সেই কালীদহ তীরে কদম্বের বৃক্ষ।
অদ্যপি বাঁচিয়া আছে কে বা তার পক্ষ।।
গরুড় যে কালে স্বর্গে ইন্দ্রজয়ী হয়।
চন্দ্র আসি জননীরে দাসত্ব ঘুচায়।।
গরুড়ের মুখ হ’তে সুধা বিন্দু পড়ে।
তাহাতে অমর বৃক্ষ এখনো না মরে।।
সুধার গুণেতে বাঁচে কদম্বের দ্রুম।
যাহার শরীরে আছে কৃষ্ণভক্তি প্রেম।।
কৃষ্ণপ্রেম মহারস সুধা যেবা খায়।
সে কেন মরিবে সর্প বিষের জ্বালায়।।
কি ছার সে স্বর্গ সুধা যথা প্রেমসুধা।
প্রেমসুধা খাইলে নিবৃত্তি ভব ক্ষুধা।।
তার নিদর্শন দেখ মরিয়াছে সর্প।
হরি বল দূরে গেল শমনের দর্প।।
শমনের দর্প সর্প মাররে সকলে।
খাণ্ডাও বিষয় বিষ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে।।
মুখে খাও কৃষ্ণরস হাতে কর কাজ।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
ভক্তগণের উদার ভাব।
দীর্ঘ-ত্রিপদী
রাউৎখামার গ্রামে, শ্রীরামসুন্দর নামে,
প্রভুর এক ভকত মহান।
ভক্তগণ ল’য়ে সাথ, তার ঘরে যাতায়াত,
সদা করে হরিগুণ গান।।
একদিন সবে মেলি, নাচে গায় বাহু তুলি,
গোবিন্দ মতুয়া সঙ্গে রয়।
কোলেতে বালক ছিল, এক ঘরে শোয়াইল,
এক কন্যা সে ঘরে আছয়।।
ভগবান প্রেমরসে, নাচে গায় কাঁদে হাসে,
ভাববেগে মত্ত মাতোয়াল।
গাইয়া যশোদা উক্তি, কেহ বা করয় ভক্তি,
ননী খাও বাপরে গোপাল।।
কেহ নিজ স্তন ধরে, একজন বলে আরে,
গ্রীবা ধরে বলে বাপধন।
শুকায়েছে চন্দ্রমুখ, দেখে মুখ ফাটে বুক,
কোলে বসি পান করে স্তন।।
আর জন কহে বাণী, শুনগো যশোদারাণী,
তোর কৃষ্ণ খেল তোর স্তন।
আমার বলাই সঙ্গে, গোচারণে গিয়া রঙ্গে,
গোবর্দ্ধনে চরা’ল গোধন।।
একজন কেঁদে কহে, এত কি পরাণে সহে,
তোর কৃষ্ণ চোর-শিরোমণি।
কল্য গেল মোর ঘরে, না জানি কেমন করে,
ভাণ্ডভেঙ্গে খেয়ে এল ননী।।
কেহ কেহ কেঁদে কহে, তোর কৃষ্ণ কালীদহে,
ডুবিয়াছে গিয়া দৈব দোষে।
বিষজল করি পান, আছে কি ত্যজেছে প্রাণ,
কিংবা কালীনাগে গ্রাসে।।
ফলে স্বপনের ফল, ব্রতের ফল বিফল,
কর্মফলে হারালি কানাই।
ডাক মা কাত্যায়নীরে, চল কালীদহ তীরে,
কানায়েরে পাই কি না পাই।।
বলরামে লও সঙ্গে, বলা বাজাউক শিঙ্গে,
তাতে যদি পাই কৃষ্ণধনে।
তবে সে পাইবে ত্রাণ, নতুবা ত্যাজিব প্রাণ,
কালীদহে বিষজল পানে।।
কেহ ধরি কার হাত, শিরে হানি করাঘাত,
আছাড়িয়া লোটায় ধরণী।
মঙ্গল কহিছে ডেকে, বলাই দাদার ডাকে,
পাইলাম তোর নীলমণি।।
ঠাকুর কহিছে ডাকি, আমি না কিছুই দেখি,
কোথা কৃষ্ণ রাখালাদিগণ।
গান ক’রে হরি বলে, করেছিস গোষ্ঠলীলে,
এই কি তোদের বৃন্দাবন।।
কি বলিতে কি বলিস, কি কহিতে কি কহিস,
এ তোদের প্রেমের প্রলাপ।
আমি যে কি দেখিলাম, নিজে যে কি হইলাম,
ভয় বেশী করিতে আলাপ।।
আমি মৃগ গোচারণে, চরাইতে গেনু বনে,
খেতে যাই মলয়ার পত্র।
কল্যকার একজনে, আমারে বিধিল বাণে,
বলে আমি শ্রীকৃষ্ণের পুত্র।।
সে বনে এসেছে সীতে, বিপ্রলম্ব জাল পেতে,
জাল হাতে মোরে বাঁধে তথা।
এ বনে নাহিক ফল, এ বনে নাহিক খল,
সুনির্মল পত্র ভক্তি লতা।।
প্রেমতরু ফলদানে, ফলভোগী ভক্তগণে,
ফলে ফল ভক্তি লতিকায়।
শ্রীআনন্দ তরুবরে, আশাপত্র শোভা করে,
সে পত্র হরিণে লুঠে খায়।।
ইহাবলি কৃপাডোরে, হাতে গলে বাঁধে মোরে,
বলে হারে কোথায় পালাবি।
করি যজ্ঞ জীবোদ্ধার, হরিনাম মন্ত্র তার,
সহজাগ্নি শূন্যে যায় হবি।।
যজ্ঞকর্তা শ্রীগৌরাঙ্গ, হোতা গোলক ত্রিভঙ্গ,
যজ্ঞেশ্বরী সেই রাধারাণী।
তোমারে আহুতি নিতে, রহিয়াছে হাত পেতে,
আত্মাধিক আত্ম করি আনি।।
আমি তারে ব’লে ক’য়ে, আসিয়াছি ছাড়াইয়ে,
ছুটিয়া না যাব রক্ষাং কুরু।
করি যত কাঁদাকাঁদি, হারায়েছি বাঁধাবাঁধি,
আর না লুঠিব পত্র তরু।।
নাম সংকীর্তন ক্ষান্ত, প্রলাপের হ’ল অন্ত,
রাত্রি পোহাইল এই দিকে।
হরি হরি হরি বলে, যাত্রা করে সবে মিলে,
গোবিন্দ উঠিল সেই ঝোঁকে।।
গোবিন্দ মতুয়া ছেলে, যে বিছানে রেখেছিলে,
তথা ছিল গৃহস্থের মেয়ে।
প্রেম প্রলাপের ঝোঁকে, নিজপুত্র তথা রেখে,
চলিলেন সেই মেয়ে লয়ে।।
আসিয়া কতক দূরে, কহে মৃদু মধু স্বরে,
গোবিন্দকে দয়াল ঠাকুর।
দেখ দেখি দৃষ্টিকরে, কি আনিলে কোলে করে,
হাটিয়া আসিলে এতদূর।।
শুনিয়া প্রভুর বাক্য, বালিকার প্রতিলক্ষ্য,
কারে বলে আনিয়াছি কায়।
কি আনিতে কারে আনি, এযে কাহার নন্দিনী,
এ বালিকা মম পুত্র নয়।।
সবে করে পরিহাস্য, ভাবাবেশে এ ঔদাস্য,
যস্য কন্যা তস্যস্থানে লৈয়া।
কন্যা রাখিয়া নন্দনে, লইয়া ঠাকুর স্থানে,
সংকীর্তনে মিলিল আসিয়া।।
এইভাবে করে লীলা, ভক্তগণ সঙ্গে লইয়া,
করে দীন দয়াল আমার।
হরিচাঁদ লীলাসুধা, পানে নাশে ভব ক্ষুধা,
কহে দীন রায় সরকার।।
রাজমাতার প্রভু-মাতার নিকট অনুনয়।
পয়ার
ঠাকুরের ঠাকুরালী হ’তেছে প্রকাশ।
তিন ভাই করিছেন ওঢ়াকাঁদি বাস।।
প্রভুমাতা অন্নপূর্ণা মাতা ঠাকুরাণী।
জ্যেষ্ঠপুত্র কৃষ্ণদাস সাধু শিরোমণি।।
তাহার ভক্তিতে বাধ্য হইলেন মাতা।
শ্রীকৃষ্ণদাসের প্রতি হইল মমতা।।
ক্রমে সবে পৃথক হইয়া করে বাস।
অন্নপূর্ণা মাকে সেবা করে কৃষ্ণদাস।।
কৃষ্ণদাস একান্নে র’য়েছে অন্নপূর্ণা।
এ দিকেতে জমিদার ক’রেছে ভাবনা।।
পার্বতীচরণ মফঃস্বলে আসে যায়।
কখন সফলডাঙ্গা কাছারীতে রয়।।
ঠাকুরের ঠাকুরত্ব প্রকাশ জানিয়া।
পার্বতী কহেন সূর্যমণি স্থানে গিয়া।।
বড় কর্তা শুন বার্তা কহি মূল সূত্র।
বড় ঠাকুরালী করে যশোমন্ত পুত্র।।
কার্য দেখে জ্ঞান হয় স্বয়ং অবতার।
বার কি আশ্রয় নহে লীলা বুঝা ভার।।
মুখের কথায় মহাব্যাধি দূর হয়।
কতলোক সারিতেছে বলা নাহি যায়।।
পালাক্রান্ত রোগাক্রান্ত লোক যত ছিল।
হরিনামে পাপ তাপ রোগ বিনাশিল।।
নন্দসুত মিশ্র পুত্র হ’ল নদীয়ায়।
তেমতি হয়েছে যশোমন্তের তনয়।।
শব্দে শুনি রামকান্ত দিয়াছিল বর।
যশোমন্ত পুত্র হবে বাসুদেবেশ্বর।।
অনুরাগী সাধু রামকান্ত মহাভাগ।
শালগ্রামে প্রণমিলে হ’ত অষ্টভাগ।।
কার্য দেখে বিশ্বাস হতেছে মোর তাই।
করেছি অধর্ম দাদা আর রক্ষা নাই।।
ওঢ়াকাঁদি বসতি ক’রেছে তিন ভাই।
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্ধৈত গোঁসাই।।
দাদাগো এমন প্রজা গিয়াছে ছাড়িয়া।
অপযশ হইয়াছে জগৎ জুড়িয়া।।
অধর্ম হ’য়েছে বড় নষ্ট পরকাল।
পাপের নাহিক সীমা ভেঙ্গেছে কপাল।।
সময় সময় প্রাণ কাঁদে তাই ভেবে।
আমাদের জমিদারী বুঝি না থাকিবে।।
দুই ভাই এইরূপ কথোপকথন।
এই কথা রাজমাতা করিল শ্রবণ।।
বৃদ্ধা ঠাকুরাণী কহে কি কহ কি কহ।
বিস্তারিয়া সব কথা আমাকে বলহ।।
বিশেষ বৃত্তান্ত তবে শুনি ঠাকুরাণী।
কহিলেন কি করেছ ওরে সূর্যমণি।।
মহৎ হউক কিংবা হউক দরিদ্র।
কিংবা সে ঠাকুর হোক কিংবা হোক ক্ষুদ্র।।
রাজা হ’য়ে প্রজার করিলে অত্যাচার।
প্রজাদ্রোহী রাজার যে রাজ্য রাখা ভার।।
তোমরা থাকহ বাপ আমি একা যাই।
বলিব সে কৃষ্ণদাস হরিদাস ঠাই।।
আমি ব্রাহ্মণের কন্যা যাইব তথায়।
তারা যদি না শুনে বলিব তার মায়।।
এত বলি ঠাকুরাণী করিল গমন।
পথে যেতে ঠাকুরাণী ভাবে মনে মন।।
ধরিয়া প্রজার ধার শোধ নাহি দেয়।
এই অপরাধ করে মম পুত্রদ্বয়।।
প্রজা হ’য়ে রাজার করিল অপমান।
এই অপরাধে তারা ত্যাজে বাসস্থান।।
কহিব এ সব কথা ঠাকুর গোচরে।
দেখি অপরাধ ক্ষমা করে কি না করে।।
ঠাকুরাণী উত্তরিল এসে ওঢ়াকাঁদি।
মহাপ্রভু সে দিন ছিলেন মল্লকাঁদি।।
যথোচিত বলিলেন কৃষ্ণদাস ঠাই।
পূর্ব ভদ্রাসনে চল এই ভিক্ষা চাই।।
কৃষ্ণদাস ব্রাহ্মণীর চরণ ধরিয়া।
কহিলেন বহুমত বিনয় করিয়া।।
না গো মাতা পূর্ববাটী আমরা যাব না।
কি দোষে ছাড়িব ভিটা ভাবিয়া দেখনা।।
পুণ্যাত্মা মহান বাবু রামরত্ন রায়।
ভালোবাসি দিয়াছেন মোদের আশ্রয়।।
দুই ভাই করিয়াছে পদ্মবিলা ঘর।
আমরা এখানে আছি তিন সহোদর।।
এখনে এ ঘর বাড়ী ত্যাজিব কেমনে।
কেমনে যাইব মোরা পূর্ব ভদ্রাসনে।।
ব’লনা এমন বাণী করি তাই মানা।
তোমার এ বাক্য রাখা কিছুতে হবে না।।
এত শুনি ঠাকুরাণী ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
উপস্থিতা হৈলা মাতা অন্নপূর্ণা পাশ।।
কহিছে ব্রাহ্মণ কন্যা অন্নপূর্ণা ঠাই।
শুনগো মা তব ঠাই এই ভিক্ষা চাই।।
অপরাধ করিয়াছে মম পুত্রদ্বয়।
দোষ ক্ষমা করি চল নিজালয়।।
মাতা অন্নপূর্ণা বলে কি কথা বলহ।
এ কথা বলিলে হয় অনর্থ কলহ।।
দ্বিজকন্যা কহে অতি মিনতি করিয়া।
তব পুত্রগণ আসে বসতি ছাড়িয়া।।
তব পুত্রে মম পুত্র করে অপমান।
সেই রাগে তাদের ছাড়াল বাসস্থান।।
ধারিয়া প্রজার ধার নাহি করে শোধ।
পুত্র অপরাধী তাই করি অনুরোধ।।
এই তুচ্ছ অপরাধ মোরে কর ক্ষমা।
তব নিজ আশ্রমে এখনে চলগো মা।।
কহিছেন প্রভুমাতা হ’য়ে অসন্তোষ।
তোমার পুত্রের এইভাব, তুচ্ছ দোষ।।
এ হ’তে কি বড় অপরাধ আছে এ ধরায়।
এ দোষ ধরিতে ধরা স্বীকার না হয়।।
বিশ্বাস ঘাতকী দোষ শাস্ত্রে আছে দেখি।
মহাপাপী যেইজন বিশ্বাস ঘাতকী।।
অত্যাচারে ভিটাছাড়ি মনে হ’য়ে দুঃখী।
শেষে ঋণ শোধ দিলে পাপ হ’ত নাকি।।
কহিলেন দ্বিজকন্যা কটু না বলিও।
কর বা না কর ক্ষমা যা ইচ্ছা করিও।।
জন্মিয়াছি ব্রহ্মবংশে ব্রাহ্মণের কন্যে।
করিলাম অনুরোধ নিন্দহ কি জন্যে।।
বাক্য যদি নাহি মান আমি ফিরে যাই।
আমি মন্যু করিলে তাতে কি ভয় নাই।।
কহিছেন প্রভুমাতা মন্যু আর কিসে।
রাজকোপে দেশ ছাড়া কত কষ্ট শেষে।।
এক্ষণেতে মন্যু কর কিংবা দেও শাপ।
তাতে কোন তাপ নাই করি নাই পাপ।।
যে হউক সে হউক তবে আমি বলি এই।
তুমি বা কি শাপ দিবে আমি শাপ দেই।।
যেমন আমার পুত্র হ’ল দেশান্তরী।
হউক তোমার পুত্র কড়ার ভিখারী।।
মম পুত্রগণে পায় দেশ ছেড়ে ক্লেশ।
তেমন তোমার পুত্র ছাড়া হোক দেশ।।
এতশুনি রাজমাতা গেলেন ফিরিয়া।
অশ্রুপূর্ণা নেত্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া।।
কালক্রমে সেই শাপ আসিয়া ফলিল।
সেই ঠাকুরাণীর দুই পৌত্র যে ছিল।।
দু’জনার নাম হ’ল বিনোদ বিহারী।
ঋণদায়ী হইয়া গেল সে জমিদারী।।
ঘৃতকাঁদি আসিলেন হ’য়ে দেশান্তরী।
একাকী আছেন মাত্র সব গেছে মরি।।
অবশ্য মহৎ বাক্য নহে ব্যভিচারী।
অধর্মের প্রাদুর্ভাব দিন দুই চারি।।
যথা ধর্ম তথা জয় চরাচরে ব্যাপ্ত।
অতলে ভূতলে আর আছে স্বর্গ সপ্ত।।
অধর্ম কারণে রাজপুত্র দুই জন।
রাজ্যভ্রষ্ট তাহাও দেখিল সর্বজন।।
কালক্রমে ধর্মাধর্মে ফলে ফলাফল।
কহিছে তারকচন্দ্র হরি হরি বল।।
ভক্তগণের মতুয়া খ্যাতি বিবরণ।
পয়ার
ওঢ়াকাঁদি রাউৎখামার মল্লকাঁদি।
ভ্রমণ করেন হরিচাঁদ গুণনিধি।।
সঙ্গে ভক্তগণ ফিরে পরম আনন্দে।
নাম সংকীর্তন গান হ’তেছে স্বচ্ছন্দে।।
নিজ গ্রামে শ্রীধামের পশ্চিম অংশেতে।
উপনীত হইলেন দাসের বাটীতে।।
একে একে বহুভক্ত আসিয়া মিলিল।
সভা করি ভক্তগণ সকলে বসিল।।
হরি কথা কৃষ্ণ কথা নামপদ গায়।
মধ্যবর্তী মহাপ্রভু বসিয়া সভায়।।
একে একে গ্রামের অনেক লোক আসি।
সভা করি বসিলেন যত গ্রামবাসী।।
পূর্বদিকে মহাপ্রভু পশ্চিমাভিমুখে।
গ্রামীলোক দক্ষিণে প্রভু বামদিকে।।
পশ্চিম দিকেতে বসি ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।
ভক্তগণ প্রেমাবেশে করে ঢলা ঢলি।।
কিছুদূর উত্তরে বসিয়া বামাগণ।
হুলুধ্বনি দিতেছে শুনিয়া সংকীর্তন।।
হেনকালে তিন জন ব্রাহ্মণ আসিল।
সভামধ্যে আসিয়া তাহারা দণ্ডাইল।।
সবে বলে বসুন বিছানা আছে অই।
তারা বলে হরিচাঁদ প্রভু তিনি কই।।
ভক্তগণ বলে যদি নাহি চিন কই।
জগতের ঠাকুর বসিয়া তিনি অই।।
একদৃষ্টে তাহারা প্রভুর পানে চায়।
তপস্বী বৈরাগী ওঠে হেনকালে কয়।।
দেখিলে ঠাকুর ওরে ঠাকুর তনয়।
ঠাকুর দেখিলে ওরে প্রণমিতে হয়।।
তিন বিপ্রের একজন মধ্যমবয়স।
আর দু’টি বয়সেতে পৌগণ্ডের শেষ।।
এই দুই ব্রাহ্মণ তাহার একজন।
ঠাকুরে প্রণাম করে শুনি সে বচন।।
একটি প্রণামে দাঁড়াইয়া আর জন।
কৈশোর প্রথমাবস্থা সেই যে ব্রাহ্মণ।।
চাহিয়া ঠাকুরপানে নেত্র তার স্থির।
সেই ব্রাহ্মণের ছিল অসুস্থ শরীর।।
তপস্বী বৈরাগী তবে উঠে সভা হ’তে।
ব্যাধিযুক্ত ব্রাহ্মণেরে লাগিল কহিতে।।
ঠাকুর দেখিতে এলে প্রণমিতে হয়।
দেখিলেত ঐ বিপ্র প্রণমিল পায়।।
এখন পর্যন্ত কেন দাঁড়াইয়া রও।
ঠাকুর দেখিয়া কেন প্রণাম না হও।।
এতেক বলিয়া ব্রাহ্মণের গ্রীবা ধরি।
মত্ত মাতালের প্রায় বলে হরি হরি।।
গ্রীবা ধরি চাপ মারি ভূমিতে ফেলায়।
বলে বাবা দেরে সেবা ঠাকুরের পায়।।
চাপ পেয়ে যেই দ্বিজ প্রণাম করিল।
মঙ্গল দাড়া’য়ে বলে হরি হরি বল।।
হরিচাঁদ পদ হতে পদরজঃ এনে।
ব্রাহ্মণের মস্তকেতে দেয় টেনে টেনে।।
এইমত তিনবার ধুলি দিয়া গায়।
অঙ্গেতে যে ব্যাধি ছিল তাহা সেরে যায়।।
ব্যাধিমুক্ত হ’য়ে দ্বিজ সভাজনে কয়।
অবতীর্ণ সামান্য মানুষ ইনি নয়।।
ক্ষণেক থাকিয়া তবে দ্বিজেরা চলিল।
সভাসদ বিপ্র যত রাগান্বিত হ’ল।।
গ্রামবাসী বহিরঙ্গ লোক যত ছিল।
তাহাদের অতিশয় রাগ উপজিল।।
ব্রাহ্মণে লইয়া করে বিরোধাচরণ।
ইহাদিগে কৃষ্ণভক্ত বলে কোন জন।।
কি পেয়েছে কি হ’য়েছে ঠাকুরালী করে।
ঠাকুর বলয় যশোমন্তের কুমারে।।
অবৈধ সকল কাজ বিধি নাহি মানে।
সমাজের বাধ্য নয় এই কয় জনে।।
শুন সবে প্রতিজ্ঞা করিনু আজ হ’তে।
ইহাদের সঙ্গে না করিব সমাজিতে।।
নাহি মানে দেব দ্বিজ আলাহিদা পথ।
ইহারা হ’য়েছে এক হরিবোলা মত।।
আহারাদি না করিব ইহাদের সঙ্গ।
অদ্য হ’তে গ্রাম্যভাব করিলাম ভঙ্গ।।
সে হইতে গ্রামবাসী হৈল ভিন্নদল।
সে অবধি হরিবোলা পৃথক সকল।।
বিবাদীরা বলে ওরা হ’য়েছে পাগল।
কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নাহি বলে হরিবোল।।
হরিবোলা দেখে উপহাস করে কত।
সবে বলে ও বেটারা হরিবোলা ম’তো।।
কেহ বলে জাতিনাশা সকল মতুয়া।
দেশ ভরি শব্দ হ’ল মতুয়া মতুয়া।।
অন্য কেহ যদি হয় হরিনামে রত।
সবে করে উপহাস অই বেটা ম’তো।।
অন্য অন্য গ্রাম আড়োকাঁদি ওঢ়াকাঁদি।
সে হইতে হ’য়ে গেল ‘মতুয়া’ উপাধি।।
তাহা শুনি ডেকে বলে প্রভু হরিচাঁন।
ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা ‘মতুয়া’ আখ্যান।।
মতুয়া উপাধি খ্যাত জগতের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
আদি খণ্ড
সপ্তম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
[embed]https://youtu.be/saGTIqfEylg[/embed]জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
প্রভুর আনারস ভক্ষণ।
পয়ার
রাউৎখামার গ্রামে বংশী মহাভাগ।
ঠাকুরের প্রতি তার দৃঢ় অনুরাগ।।
একদিন হাটে গিয়া সে বংশীবদন।
আনারস দেখে হইল প্রভুর স্মরণ।।
সুমধুর আনারস গোটা দশ কিনে।
সুপক্কটি সেরে রাখে যতনে গোপনে।।
ধান্যের ডোলের মধ্যে কেহ নাহি জানে।
অন্তর্যামী প্রভু তাহা জানিলেন মনে।।
বংশীর বাটীতে প্রভু উপস্থিত হ’ল।
একে একে ভক্তগণ আসিয়া মিলিল।।
আনন্দে বলেছে বংশী প্রভু এল ঘরে।
প্রভুর সঙ্গেতে গিয়ে নামপদ করে।।
প্রভু বলে ওরে বংশী আমারে আনিলি।
এতক্ষণ মধ্যে মোরে খেতে নাহি দিলি।।
ব্যস্ত হ’য়ে বংশী তার রমণীরে কয়।
কি দিবা কি দিবা বল প্রভুর সেবায়।।
বংশীর স্বভাব ছিল দেখিলে গোঁসাই।
বাহ্য স্মৃতি হারাইত আজ হ’ল তাই।।
বংশীর রমণী যায় পাকশালা ঘরে।
আয়োজন করিল রন্ধন করিবারে।।
প্রভু বলে ওরে বংশী আসা যে আশাতে।
বড় ইচ্ছা হৈল মম আনারস খেতে।।
আনারস গৃহেতে বংশীর মনে নাই।
প্রভু বলে আনারস আন, রস খাই।।
শুনি বংশী রমণীকে ডেকে আনে ঘরে।
বলে আনারস খেতে দাও শ্রীপ্রভুরে।।
আনারস বানাইল মনে করি সাধ।
প্রভুর বাসনা যেটা সেটা র’ল বাদ।।
প্রভু বলে এইগুলি পরিপক্ক কম।
এই আনারসে সেবা না হবে উত্তম।।
বংশীর রমণী কহে হ’য়ে করপুট।
এই আনারসে তবে হোক হরিলুঠ।।
যেইমাত্র বংশীর রমণী করে ব্যক্ত।
কাড়াকাড়ি করিয়া খাইল সব ভক্ত।।
প্রভু বলে এই লুঠে আমি তৃপ্ত নই।
আমার লুঠের যেটা সেটা দিলে কই।।
ইহা বলি মহাপ্রভু বলে আন আন।
আনা আছে দিস নাই না দেয়াটা আন।।
এতবলি অন্তর্যামী উঠিল সত্বর।
লম্ফ দিয়া উঠিলেন ডোলের উপর।।
আনারস হাতে করি দিল আর লম্ফ।
ভূমিতে পড়িল যেন যায় ভূমিকম্প।।
বংশীরে বলেন প্রভু শোন তোরে বলি।
নিজে খাইবার জন্য ভালটা রাখিলি।।
এতবলি প্রভু সেই আনারস ধরে।
কামড়া’য়ে সে ফলের রসপান করে।।
চুষিয়া চুষিয়া খায় মুখ ঊর্ধ্ব করি।
প্রেমানন্দে ভক্তগণে বলে হরি হরি।।
বংশীর নয়ন জল অবিরত ঝরে।
দাঁড়াইয়া দৃষ্টি করে বাক্য নাহি সরে।।
রামচাঁদ বলে প্রভু নিবেদি চরণে।
কল্য ভোগ নিতে হবে আমার ভবনে।।
হরিষে বলেন প্রভু হৈল নিমন্ত্রণ।
প্রাতেঃ উঠি চলিলেন ল’য়ে ভক্তগণ।।
দুই তিন বাটী প্রভু ভোজন করিল।
এমন সময় বেলা প্রহরেক হ’ল।।
পরে লইলেন ভক্ত শ্রীরামলোচন।
কবি কহে হরি হরি বল সর্বজন।।
রামলোচনের বাটী মহোৎসব ও চৈতন্য বালার দর্প চূর্ণ।
পয়ার
রামলোচনের বাটী স্বজাতি ভোজন।
গ্রামবাসী সবে আসি করে আয়োজন।।
বামাগণে আসে সবে পাক করিবারে।
চৈতন্য প্রধান জ্ঞানী গ্রামের উপরে।।
সকলে রাখিল ভার তাহার উপর।
যাহাতে হইবে এই কার্য্যের সুসার।।
রামচাঁদ আর রামলোচন বিশ্বাস।
শ্রীনবদ্বীপেতে যেন রামাই শ্রীবাস।।
ভাই ভাই ঠিক যেন তেমতি মিলন।
সেই দিন সেই বাটী প্রভু আগমন।।
মহা সমারোহে হবে স্বজাতি ভোজন।
পাকশালে পাক করে যত বামাগণ।।
এমন সময় প্রভু ভক্তগণ সঙ্গে।
রামলোচনের বাটী উত্তরিল রঙ্গে।।
শ্রীরামলোচন হয় কার্য্যকরণালা।
কার্য্যদক্ষ কর্তৃপক্ষ শ্রীচৈতন্য বালা।।
হুকুম করিছে কার্য্য করিবার তরে।
যাকে যাহা বলিছেন সেই তাহা করে।।
প্রাণপণে খাটিতেছে নাহিক বিরাম।
বাটীর ভিতর হইতেছে ধুমধাম।।
কোন নারী কক্ষে কুম্ভ আনিতেছে বারি।
কেহ ঝাল বাটে কেহ কাটে তরকারি।।
কেহ ভারে ভারে ধৌত করিছে তণ্ডুল।
কেহ দেয় কেহ লয় ধুতেছে ডাউল।।
ঠাকুর আসিল জয় হরিবোল বলে।
ভক্তগণ সংকীর্তন করে কুতূহলে।।
বাটীতে কাজের লোক যেখানে যে ছিল।
চতুর্দিকে হরি হরি বলিতে লাগিল।।
সিংহনাদে ভক্তগণ বলে হরি হরি।
চতুর্দিকে ঘাটে পথে হরি হরি হরি।।
অগনণা বামাগণে দিল হুলুধ্বনি।
স্বর্গ মর্ত ভেদ করি ওঠে জয়ধ্বনি।।
ঠাকুর গেলেন রামলোচনের ঘরে।
নাম গান পদ হয় গৃহে বহির্দ্বারে।।
মেয়েরা যতেক সবে ছিল পাকশালে।
শুনে ধ্বনি সব ধনী ভাসে অশ্রুজলে।।
কিসের রান্নাবান্না কিসের হলুদ্বাটা।
নয়নজলে ভাসে হলুদবাটা পাটা।।
কুলবধু ধাইতেছে হইয়া আকুল।
বাল্য বৃদ্ধ ধাইতেছে সব সমতুল।।
ঠাকুরে দেখিব বলে সকলের মন।
পাকশালে মেয়ে লোক নাহি একজন।।
সকলে বলেছে গিয়ে চৈতন্য বালায়।
অদ্য বুঝি জাতি কুল না থাকে বজায়।।
নিমন্ত্রিত লোক যত সব এল এল।
পাকশালে লোক নাই উপায় কই বল।।
তাহা শুনি ক্রোধ করি বালা মহাশয়।
তর্জন গর্জন করি মেয়েদের কয়।।
ঠাকুরে দেখিয়া কারু নাহি স্মৃতি বাক।
পাকশালে লোক নাই কে করিবে পাক।।
বালাজী করেন রাগ কেহ নাহি মানে।
তর্জন গর্জন করে শুনেও না শুনে।।
কেহ বলে শুন বলি বালা মহাশয়।
জাতি গেল মান গেল কই হবে উপায়।।
সামাজিক লোক সব হ’য়ে একত্তর।
সভা করি বসিলেন বাটীর ভিতর।।
তার মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ বালা মহাশয়।
সবে মিলে পরামিশে করিলেন সায়।।
ঠাকুরের কাছে গিয়া করহ বারণ।
চুপ করে থাক, কেন করে সংকীর্তন।।
কিসের বা হরিধ্বনি কিসের কীর্তন।
চুপ করে না থাকেত তাড়াও এখন।।
সবে বলে কে বলিবে ঠাকুরের ঠাঁই।
নিজে যান বালাজী অন্যের সাধ্য নাই।।
ঠাকুরের নিকটেতে যায় বলিবারে।
বলিব বলিব ভাবে বলিতে না পারে।।
এক এক বার যায় ক্রোধ করি মনে।
এবার তাড়া’ব গিয়া হরিবোলাগণে।।
ধেয়ে ধেয়ে যায় বালা অতি ক্রোধ ভরে।
যেই ঠাকুরের মুখচন্দ্র দৃষ্টি করে।।
আর নাহি থাকে ক্রোধ হয় মহাশান্ত।
মৌণ হয়ে বসে যেন নৈষ্ঠিক মোহান্ত।।
সভাসৎ লোক যত দেখিয়া বিস্ময়।
বলে একি হ’ল বল বালা মহাশয়।।
বড় ক্রোধ করি যাও তাড়াবার তরে।
চুপ করে ফিরে এস বাক্য নাহি সরে।।
দুই তিন বার গেলে হ’য়ে ক্রোধমন।
বলিতে না পার কিছু কিসের কারণ।।
বাণীসুত তুল্য বক্তা বাকযুদ্ধে জয়।
কেন নাহি বাক্য আস্ফলন বা কোথায়।।
বালা মহাশয় বলে তাই ভাবি মনে।
বলা কথা কেন যেন বলিতে পারিনে।।
আমাকে ভুলায় হেন নাহিক ভুবনে।
নিশ্চয় ঠাকুর কি মোহিনী মন্ত্র জানে।।
তাহা শুনি সব লোকে হাসিয়া উঠিল।
কেহ বলে মাতুব্বরের মাতুব্বরি গেল।।
যে মত শ্রীকৃষ্ণ যায় হিত বুঝাইতে।
দুর্য্যোধনে বলে যুধিষ্ঠিরে ভাগ দিতে।।
দুর্য্যোধন নাহি মানে কৃষ্ণ ফিরে যায়।
তার বাড়ী পঞ্চাশ ব্যঞ্জন নাহি খায়।।
একত্রিত শত ভাই দুষ্ট দুর্য্যোধন।
রজ্জু পাকাইল কৃষ্ণে করিতে বন্ধন।।
ভগবান বিশ্বরূপ ধারণ করিল।
কে করে বন্ধন সবে মোহপ্রাপ্ত হ’ল।।
পরে কৃষ্ণ চলিলেন বিদুরের ঘরে।
বিদুরের পুরাতন ক্ষুদ সেবা করে।।
চৈতন্য পাইয়া বলে রাজা দুর্য্যোধন।
কি মোহিনী মন্ত্র জানে দেবকী নন্দন।।
সেই দিন অপমান হ’ল শত ভাই।
কেহ বলে বালাজীর কি হইয়াছে তাই।।
কেহ বলে বালাজী হইয়াছে পাগল।
কেহ বলে বালাজীকে দুর্য্যোধনই বল।।
রামচাঁদ উপনীত ঠাকুরের ঠাঁই।
দণ্ডবৎ করি বলে কি হবে গোঁসাই।।
যত বামা দেখে তোমা না হইল রান্না।
ঠাকুর বলেন পাকঘরে অন্নপূর্ণা।।
ঘর ছাড়ি মহাপ্রভু এসে বাহিরেতে।
মেয়েদের বলিলেন পাকঘরে যেতে।।
দয়ার নিধান হরি প্রাঙ্গণে আসিল।
ভক্তগণ ল’য়ে সভা করিয়া বসিল।।
সভায় বসিয়া হরি ডাকদিয়া কয়।
কোনজন শ্রীচৈতন্য বালা মহাশয়।।
এ গ্রামেতে এতদিন আমি আসি যাই।
এগ্রামের কে কর্তা ব্যক্তি চেনা শুনা নাই।।
সবে বলে অই ব’সে শ্রীচৈতন্য বালা।
প্রভু বলে আবশ্যক দুটা কথা বলা।।
সবে দেখাইয়া দিল বসিয়া সভায়।
অই সেই শ্রীচৈতন্য বালা মহাশয়।।
প্রভু বলে মহাশয় কহ দেখি শুনি।
বলিয়াছ আমি কি মোহিনী মন্ত্র জানি।।
তুমি হও বড় জ্ঞানী সুধাই তোমারে।
শুনেছ মোহিনী মন্ত্র মন্ত্র বলে কারে।।
শুনিয়া কহিছে বাণী বালা মহাশয়।
মুখেতে সরল ভাষা ক্রোধিত হৃদয়।।
আমি এই পরগণে সবে যাহা বলি।
মোর কাছে সবে থাকে হ’য়ে কৃতাঞ্জলি।।
আমি যাই ক্রোধভরে তাড়াইয়া দিতে।
শ্রীমুখ দেখিয়া কিছু না পারি বলিতে।।
সভামধ্যে কথা বলি লক্ষজন মাঝে।
রাজ দরবারে কিংবা স্বজাতি সমাজে।।
কাহার নিকট কিছু শঙ্কা নাহি করি।
আপনার কাছে কিছু বলিতে না পারি।।
তাহাতে এমন আমি মনে অনুমানি।
আপনার যেন জানা আছে কি মোহিনী।।
বাণীনাথ কহে বাণী মৃদু মৃদু হাসি।
মোহিনী হইতে চাহে বৈষ্ণবের দাসী।।
হরিবোলা সাধুদের ভক্তি অকামনা।
তন্ত্র মন্ত্র নাহি জানে ব্রজ উপাসনা।।
বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে।।
শুদ্ধাচার কৃষ্ণমন্ত্র ভক্তে জপ করে।
অন্য মন্ত্র জপ, তপ, পাপ গণ্য করে।।
মোহিনী গণিকা কামবিলাসী পৈশাচী।
তার মন্ত্র হরিভক্তে স্পর্শিলে অশুচি।।
হিংসাবুদ্ধি যারা তারা মিথ্যাভাষী সবে।
সব সভা, জিনে এই মন্ত্রের প্রভাবে।।
পরগণা মধ্যে তুমি বালা মহাশয়।
কোটি জনে কথা মানে তুমি একা জয়।।
ভক্তিশূন্য রসশূন্য ভাষ অপভাষ।
তথাপি সভার মধ্যে পাও বড় যশ।।
অপকথা কও তবু লোকে মানে কেন।
নিশ্চয় মোহিনী মন্ত্র তোমরাই জান।।
ক্রোধ ভরে তুমি কিছু বলিতে নারিলে।
বলিতে পারিবে কেন বলিতে না দিলে।।
দূর হ’তে কতলোক করে আস্ফালন।
আসিলে তোমার ঠাঁই না স্ফুরে বচন।।
তা হ’লে মোহিনী মন্ত্রে তুমি কিসে কম।
আমি জানি মোহিনী এ তব মতিভ্রম।।
সমুদ্র মন্থনকালে যে হ’ল মোহিনী।
দেব দৈত্য ভুলাইল ভুলে শূলপাণি।।
তার মন যে ভুলায় গাঢ় অনুরাগে।
তার ঠাঁই তোমার এ মোহিনী কি লাগে।।
অন্ধকারে জোনাকির আলো হয় বনে।
সে জ্যোতি থাকিবে কেন সুধাংশু কিরণে।।
নিশাকর করে কর তারাগণ ঘিরে।
সবাকার অন্ধকার দিবাকর হরে।।
সেই দিবাকর যার নখরে উদয়।
সেই পাদপদ্ম সদা যাহার হৃদয়।।
দিবাকর নিশাকর এসে তার ঠাঁই।
করজোড়ে স্তব করে বলিয়া গোঁসাই।।
তার সাক্ষী হনুমান রামভক্তি জোরে।
রামকার্য্যে সূর্যদেবে রাখে কর্ণে ভরে।।
ছাড় সব ধাঁধাঁ বাজী কাজে কাজী হও।
হরিপদ ভাবি কাল সুখেতে কাটাও।।
কি দোষ করেছি আমি মেতে হরিপ্রেমে।
বল তব কি ক্ষতি হয়েছে হরিনামে।।
মেয়েরা করে না পাক ক্ষতি কি তাহাতে।
বসাইয়া দেও লোক পায় কি না খেতে।।
এই অবকাশে লক্ষ্মীকান্ত কৃপাযোগে।
এদিকেতে রান্না হইয়াছে দশ ভাগে।।
বালা বলে সবলোক বসাইয়া দিব।
অন্নে না কুলালে ঠাকুরালী দেখাইব।।
অল্প অন্ন অল্প অল্প ডাল তরকারী।
কেহ বাদ না থাকিও বৈস সারি সারি।।
শীঘ্র শীঘ্র ডেকে সব লোক বসাইল।
অবলীলাক্রমে পরিবেষণ হইল।।
খেয়ে সব লোকে বলে অদ্য কিবা রান্না।
জ্ঞান হয় রেঁধেছে কমলা অন্নপূর্ণা।।
অল্প অন্ন বহুলোক হ’বে নাকি জানি।
ত্রিলোক ফুরাতে নারে এবে ইহা মানি।।
জ্ঞানশূন্য শ্রীচৈতন্য বালা মহাশয়।
মজুত অযুত লোক মানিল বিস্ময়।।
বালা মহাশয় কিংবা যত ছিল আর।
মহাপ্রভু পদে সবে করে পরিহার।।
কেহ বলে হরিরূপে হরি অবতীর্ণ।
কেহ বলে নমঃশূদ্র বংশ হ’ল ধন্য।।
শ্রীহরি চরিত্র সুধা যেই করে পান।
কর্মক্ষুধা পাপে তাপে সেই পরিত্রাণ।।
আকাশ ভেদিয়া উঠে হরিনাম ধ্বনি।
হরি হরি ময় ময় আর নাহি শুনি।।
পিও সাধু নাম মধু রসনা আশয়।
দিনান্তে যাবে দুরন্ত কৃতান্ত ভয়।।
তারক রসনা কহে হরিচাঁদ লীলে।
হরিচাঁদ প্রীতে ডাক হরি হরি বলে।।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদের চতুর্ভুজ রূপ ধারণ ও গোস্বামী গোলোকচাঁদের বংশাখ্যান।
পয়ার
যে ভাবেতে উদাসীন হইল গোলোক।
গোলোক চরিত্র কিছু শুন সর্বলোক।।
সাহাপুর পরগণা তাহার অধীনে।
নারিকেলবাড়ী গ্রাম জানে সর্বজনে।।
এই বংশে যত জন সবে মহোদয়।
বংশ অনুরাগ হরিভক্ত অতিশয়।।
মহৎ পুরুষ ছিল কেনাই মণ্ডল।
কৃষ্ণভক্ত চূড়ামণি প্রেমেতে বিহ্বল।।
কেনাইর চারিপুত্র সবে গুণাকর।
প্রথম অযোধ্যা রাম প্রেমের সাগর।।
দ্বিতীয় নন্দন হ’ল হরেকৃষ্ণ নাম।
তৃতীয়তঃ সৃষ্টিধর সাধু অনুপম।।
নয়ন মণ্ডল সর্বানুজ হন তিনি।
করিতেন হরিনাম দিবস রজনী।।
সকলেই কৃষ্ণভক্ত সাধুসেবা মতি।
নয়নের অতি ভক্তি অতিথির প্রতি।।
মধ্যম হরেকৃষ্ণের দুইটি নন্দন।
রামনিধি জ্যেষ্ঠ হয় কনিষ্ঠ বদন।।
জ্যেষ্ঠ অযোধ্যারামের তিনটি নন্দন।
ঠাকুর দাস জ্যেষ্ঠ হয় অতি সুলক্ষণ।।
মধ্যম শ্রীজয়কৃষ্ণ নামে প্রেমে মত্ত।
হরিপ্রেমে মত্ত হ’য়ে করিতেন নৃত্য।।
সবার কনিষ্ঠ হয় চন্দ্রকান্ত নাম।
তিন ভাই হরিভক্ত বলে জয় রাম।।
ঠাকুর দাসের তিন পুত্র গুণাকর।
জ্যেষ্ঠ রাম কুমার মধ্যম বংশীধর।।
কনিষ্ঠ গোলোকচন্দ্র ভক্ত চূড়ামণি।
যার ঘোর হুহুঙ্কারে কম্পিতা মেদিনী।।
শ্রীরামকুমার সংসারের মধ্যে কর্তা।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় মিষ্টভাষী বক্তা।।
গায় কৃষ্ণ বলে কৃষ্ণ করে মহাজনী।
বাণিজ্য করেন আর নৌকার চালানী।।
বংশীধর বংশধর অতি শিষ্টাচারী।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় ধর্ম অধিকারী।।
কভু নাই অনাচার সংসারে সংসারী।
সবে মানে রাজাস্থানে সত্য দরবারী।।
সদা পরহিতে রত গৃহকার্য করে।
রাজা ডাকে রাত্রে যান রাজ দরবারে।।
কনিষ্ঠ গোলোকচন্দ্র হইল গোঁসাই।
গৃহকার্যে রত ছিল এই তিন ভাই।।
গোলোক উন্মত্ত চিত্তে ঠাকুর ভাবিয়া।
উপাধি হইল শেষে পাগল বলিয়া।।
কৃষিকার্য করিতেন গোস্বামী গোলোক।
ধান্যক্ষেত্রে কার্যে ছিল বড়ই পারক।।
হলধর দিয়া চাষে আইলে বসিয়া।
নির্জনে বসিয়া জমি দেখিত চাহিয়া।।
জমিমধ্যে কোন স্থান নিম্ন যদি রয়।
উচ্চস্থান মাটি এনে সে নিম্ন পুরায়।।
উঁচু নিচু না রাখিত জমির মাঝেতে।
সমতল ধান্যক্ষেত্র করিত স্বহস্তে।।
যে জমির ধান্য কাটে আঠার কিষাণে।
তিনি তাই কাটিতেন একা একদিনে।।
বিষয় কার্যেতে ছিল এমত নিযুক্ত।
এবে শুন যেভাবে হইল প্রভুভক্ত।।
কণ্ঠদেশ ফুলিয়া ক্রমশঃ হ’ল ভারি।
শয্যাগত রহিলেন হ’য়ে অনাহারী।।
নাসারন্ধ্রে ঘনশ্বাস বাক্য নাহি সরে।
দুগ্ধ পান আদি বন্ধ হ’ল একেবারে।।
রাউৎখামার রামচাঁদ মহাশয়।
ভক্তশ্রেষ্ঠ ঠাকুর নিকটে আসে যায়।।
রোগযুক্ত রোগী যত রামচাঁদে ধরে।
ঠাকুরের নামেতে রাখিয়া রোগ সারে।।
গোলোকের জ্যেষ্ঠ রামকুমার বিশ্বাস।
দশরথ নিকটেতে করিল প্রকাশ।।
গোস্বামীর খুল্লতাত জয়কৃষ্ণ নাম।
তার পুত্র সহস্রলোচন গুণধাম।।
সাধুসঙ্গ সদামতি হৃদয় আনন্দ।
তাহার কুমার দশরথ মহানন্দ।।
শ্রীরামকুমার কহে দশরথ ঠাঁই।
চল বাপ রামচাঁদে আনিবারে যাই।।
গোলকে দেখিয়া আর স্থির নহে মন।
ঠিক যেন গোলোকের নিকট মরণ।।
শুনেছি রামচাঁদের অপার মহিমে।
রোগ সারে হরিচাঁদ ঠাকুরের নামে।।
বড় বড় রোগে রোগী তার কাছে যায়।
আসা মাত্র রোগমুক্ত যদি দয়া হয়।।
দশরথ দিল মত চল তবে যাই।
খুল্লতাত রোগ সারে এই ভিক্ষা চাই।।
ত্বরা যায় রামচাঁদ ঠাকুরে আনিতে।
উপনীত ত্বরান্বিত রাউৎখামারেতে।।
বালাবাড়ী গেলে মাত্র সর্বজনে কয়।
হেথা বৈস সে ঠাকুর আসিবে হেথায়।।
গিরিধর বালা আছে জ্বরে অচেতন।
রামচাঁদে আনিবারে যাইব এখন।।
পরিশ্রম করি কেন তোমরা যাইবা।
আমরা আনিলে হেথা বসিয়া পাইবা।।
বলিতে বলিতে লোক আনিবারে গেল।
রামচাঁদ ঠাকুরকে সত্বরে আনিল।।
রামচাঁদ ঠাঁই রামকুমার বলেছে।
ভাই মোর গোলোক সে আছে কি না আছে।।
বড় দায় ঠেকে আসিয়াছি দৌড়াদৌড়ি।
দয়া করি যেতে হবে নারিকেলবাড়ী।।
তাহা শুনি রামচাঁদ না করিল বাক্।
বাবা হরিচাঁদ বলে ছেড়ে দিল ডাক।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলে ডাক ছাড়ে।
হুঙ্কারিয়ে দুই হাতে গিরিধরে ঝাড়ে।।
ডাকে বাবা হরিচাঁদ করি করজোড়।
সজোরে গিরির পৃষ্ঠে মারিল চাপড়।।
মুহূর্তেক মধ্যে ব্যাধি আরোগ্য হইল।
রোগমুক্ত গিরিবালা উঠিয়া বসিল।।
রোগমুক্ত হ’ল যদি গিরিধর বালা।
ঝাড়িতে লাগিল রামকুমারের গলা।।
বাবা হরিচাঁদ বলে ঘন ডাক ছাড়ে।
রামকুমারের গলা রামচাঁদ ঝাড়ে।।
দোহাই ওঢ়াকাঁদির বাবা হরিচাঁদ।
গলা ঝাড়ে ডাক ছাড়ে যেন সিংহনাদ।।
দণ্ডমাত্র রামকুমারের গলা ঝাড়ি।
বলে আমি যাইব না নারিকেলবাড়ী।।
তোমরা গৃহেতে যাও আমি গৃহে যাই।
দেখ গিয়ে গোলোকের গলা ফুলা নাই।।
রামচাঁদ যাহা যাহা বলে দিয়াছিল।
বাটীতে আসিয়া সত্য তাহাই দেখিল।।
সেই সব প্রকাশিল বাটীতে আসিয়া।
গোলোক উন্মত্ত হ’ল সে কথা শুনিয়া।।
প্রভুকে দেখিবো বলে ওঢ়াকাঁদি যায়।
লোটাইয়া পড়ে গিয়ে ঠাকুরের পায়।।
প্রভু বলে এতদিন কেন নাহি আলি।
ব্যাধিযুক্ত হ’য়ে কেন এতকষ্ট পা’লি।।
এতদিন পরে যদি এলি মম ঠাঁই।
যাও বাপ গৃহে যাও আর ভয় নাই।।
শুনিয়া গোলোক প্রেমে কম্পিত হইল।
অনিমিষ নেত্রে রূপ দেখিতে লাগিল।।
শঙ্খ চক্র গদাপদ্ম চতুর্ভুজধারী।
পরিধান পীতাম্বর মুকুন্দমূরারী।।
রূপ দেখি ঝোরে আঁখি ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
বলে আমি আর না করিব গৃহবাস।।
গোলোক বলেন আমি কার বাড়ী যা’ব।
চরণে নফর হ’য়ে পড়িয়া রহিব।।
প্রভু বলে ঘরে যাও ওরে বাছাধন।
চিরদিন মোরে বলে থাকে যেন মন।।
গোলকে বলেন হরি চিনেছি তোমায়।
চিরদাস বিক্রিত হইনু তব পায়।।
প্রভু বলে বিকাইলি পাইলাম তোরে।
কর গিয়া গৃহকার্য যাব তোর ঘরে।।
গোলোক চলিল ঘরে প্রভুর কথায়।
সময় সময় ওঢ়াকাঁদি আসে যায়।।
মাসান্তর পক্ষান্তর সপ্তাহ অন্তরে।
মাঝে মাঝে যাইত প্রভুকে দেখিবারে।।
দশরথ মহানন্দ মাতিল তাহাতে।
গ্রাম্য লোক প্রমত্ত হইল সেই মতে।।
হরিচাঁদ গোলোকের ভাব প্রেমবশে।
যাতায়াত করে প্রভু গোলোকের বাসে।।
এইভাবে হরিবোলা হইল গোলোক।
হরি হরি বল সাধু কহিছে তারক।।
বদন গোস্বামীর উপাখ্যান।
পয়ার
গোলোক পাগল হ’ল ঠাকুরের ভক্ত।
ভক্তিভাবে আত্মহারা সদাই উন্মত্ত।।
গাঢ় অনুরাগ অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার।
নাহি মানে বেদবিধি বীর অবতার।।
বীরেতে বীরত্ব যেন তুল্য হনুমান।
ধীর রসে শ্রীঅদ্বৈত শক্তি অধিষ্ঠান।।
উন্মত্ত স্বভাব সদা নাহি ছুটে কভু।
শয়নে স্বপনে ভাবে হরিচাঁদ বিভু।।
অনুক্ষণে আসে প্রভু গোলোকের ঠাঁই।
ক্রমে প্রেমে ভাবাবিষ্ট বদন গোঁসাই।।
গোলোকের খুল্লতাত ‘গোঁসাই’ বদন।
সেই যে বদন হরেকৃষ্ণের নন্দন।।
হইল অসাধ্য ব্যাধি উদরে বেদনা।
অহরহ বেদনায় বিষম যাতনা।।
আয়ুর্বেদ নিদান মতের চিকিৎসা।
খন্ডজ্ঞানী মুষ্টিযোগী সুমন্ত্র পারক।।
অনেকে দেখিল রোগ আরোগ্য না হয়।
অবশেষে দেখিলেন এক মহাশয়।।
তিনি এসে বলিলেন বেদনা সারিব।
উদরেতে ফোঁটা দিয়ে ঘা বান’য়ে দিব।।
গাছড়ার রসদ্বারা দিল ষোল ফোঁটা।
চর্ম ঠোসা পড়ে শেষে ঘা হ’ল ষোলোটা।।
মাসেক পর্যন্ত সেই করে মুষ্টিযোগ।
নিদারুণ জ্বালা হ’ল নাহি সারে রোগ।।
একেত’ ঘায়ের ব্যথা ব্যথা পুরাতন।
উভয় ব্যথার জ্বালা নাহি নিবারণ।।
ক্রমে বৃদ্ধি বেদনাতে অস্থিচর্মসার।
অদ্য কিংবা কল্য মৃত্যু এরূপ আকার।।
কেহ বলে চিকিৎসার নাহি প্রয়োজন।
কেহ বলে বৈদ্যনাথ প্রতি দেহ মন।।
কেহ বলে আর কিছু নাহি হরি বল।
কেহ বলে বাঁচ যদি ওঢ়াকাঁদি চল।।
জগত জীবন তিনি জগতের কর্তা।
মরিলে বাঁচাতে পারে সবে কহে বার্তা।।
আত্ম স্বার্থ সমর্পণ করহ তাহায়।
চল যাই ওঢ়াকাঁদি ঠাকুর কি কয়।।
শুনিয়া বদন বড় হরষিত হ’ল।
বলে সবে মোরে ল’য়ে ওঢ়াকাঁদি চল।।
দশরথ বলে আমি লইয়া যাইব।
ব্যাধিমুক্ত হ’লে মোরা তার দাস হ’ব।।
শয্যাগত মৃতবৎ ওষ্ঠাগত প্রাণ।
ক্ষণে ক্ষণে অচেতন ক্ষণেক অজ্ঞান।।
উত্থান শকতি নাই থাকেন শয্যায়।
তরণী সাজিয়া চলে দুই মহাশয়।।
দুই জন তরী বাহে ত্বরান্বিত হ’য়ে।
বদন রহিল সেই নৌকাপরে শুয়ে।।
দুই জন তরী বাহে হরিগুণ গায়।
অশ্রুজলে বদনের বক্ষ ভেসে যায়।।
মনে ভাবে যদি কিছু সময় পেতাম।
মনোসাধ মিটায়ে নিতাম হরিনাম।।
ভাবিতে ভাবিতে কিছু উপশম পায়।
সকাতরে ধীরে ধীরে হরিনাম লয়।।
ঠাকুরের ঘাটে নৌকা চাপিল যখন।
প্রভু করিলেন অন্তঃপুরে পলায়ন।।
বাহির বাটীতে এসে পড়িল বদন।
ধরায় শয়ন করি ক’রেছে রোদন।।
বদন রোদন করে হইয়া পতন।
দেখা দিয়ে প্রাণ রাখ শ্রীমধুসূধন।।
ক্ষণেক থাকিয়া প্রভু আসিল বাহিরে।
তর্জন গর্জন করে বদনের পরে।।
গালাগালি দিয়া বলে ওঠ বেটা দুষ্ট।
বল দেখি তোর কেন হ’ল এত কষ্ট।।
বেয়েছ বাঁচাড়ি নৌকা পাছা নাচাইয়া।
আড়ঙ্গ করেছ জয় বাহিছ খেলা’য়া।।
দেহ খাটাইয়া লোক ধন উপার্জয়।
সে ধন কাকেরে বকেরে কে খাওয়ায়।।
এখন সে সোর শব্দ রহিল কোথায়।
একা আসা একা যাওয়া সাথী কেবা হয়।।
বদন বলিছে প্রভু মরিয়াছি আমি।
ভগ্ন তরী ডুবে মরি কর্ণধার তুমি।।
ঠাকুর বলেন চিনে সে কান্ডারী ধর।
মরিলি যদ্যপি বেটা ভালো ক’রে মর।।
বদন বলেন মম ডুবু ডুবু তরী।
আর কি চিনিতে যা’ব চিনেছি কান্ডারী।।
বদন বলেন তরী সবে যায় বেয়ে।
ডুবাতরী যেই বাহে তারে বলি নেয়ে।।
বদন বলেন হরি পদতরী দেও।
ছাড়িলাম দেহতরী বাও বা না বাও।।
হরি হরি হরি বলি উঠিল বদন।
ধরণী লোটায়ে ধরে প্রভুর চরণ।।
সঙ্গে আসিয়াছে যারা রহে যোড় করে।
ঠাকুর বলে তোরা ফিরে যারে ঘরে।।
বাটী গিয়া বল সবে মরেছে বদন।
যে দারুণ পেট ব্যাথা না রবে জীবন।।
কেহ যদি থাকে সে করুক শ্রাদ্ধ আদি।
বল গিয়া বদন মরেছে ওঢ়াকাঁদি।।
মৃতদেহ এনে তোরা রাখিলি এখানে।
এখানে মরিবে ওরে কে ফেলা’বে টেনে।।
ইহা বলি তা সবারে পাঠাইল ঘরে।
পদ দিল বদনের পেটের উপরে।।
জীয়ন্তে কাহার পেটে কে করয় ছিদ্র।
পেটের ঘায়ের পর দিল পাদ পদ্ম।।
অমনি পেটের ঘা শুকাইয়া গেল।
হরি হরি হরি বলি বদন উঠিল।।
ঠাকুর বলেন তোর পেটে ছিল যেই।
দেখ বাছা তোর পেটে আছে কি না সেই।।
বদন বলেন মোর পেটে যেই ছিল।
শ্রীপদ পরশে সেই মুক্তি হয়ে গেল।।
হরি ভিন্ন বদনে বলে না অন্য বোল।
নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে হরি বলে’ছে কেবল।।
বায়ু যবে পশে তার হৃদয় মাঝেতে।
শত হরিনাম করে প্রতি নিঃশ্বাসেতে।।
বায়ু যবে বের হয় তাহার সঙ্গেতে।
পঞ্চাশৎ হরিনাম করে সে কালেতে।।
কেহ যদি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করয়।
নাম সঙ্গে কথা কয় নামে করে লয়।।
কোনকালে নাম করা ক্ষান্ত নাহি হয়।
হাতে মুখে চোখে ঈষৎ ইঙ্গিত দেখায়।।
কেহ যদি বলে কিছু খাওরে বদন।
বলে হরি দেও হরি করিব ভোজন।।
ঠাকুর বলেন যদি বাড়ী যেতে বোল।
বলে হরি হে হরি যা’বনা হরিবোল।।
ঠাকুর বলেন তবে মম সঙ্গে আয়।
হরি হরি হরি বলি পিছে পিছে ধায়।।
বাসস্থান পূর্বদিকে ধান্যভূমি ছিল।
তার মধ্যে উচ্চ এক স্থান আছে ভাল।।
সেই স্থানে আছে এক হিজলের গাছ।
পূর্ব মুখ বসিলেন গাছ করি পাছ।।
ঠাকুর বলেন তোর ক্ষুধা লাগে নাই।
বলে হরি বল হরি চল হরি খাই।।
সেখানে দেখিল প্রভু একটি সুড়ঙ্গ।
সুড়ঙ্গ হইতে বের হইল ভুজঙ্গ।।
ঠাকুর বলেন তোর হরিনাম শুনে।
ভুজঙ্গ বাহির হয়ে চলে গেল বনে।।
ভুজঙ্গের মুখে লাল দেখ দৃষ্টি করি।
অবশ্য ভুজঙ্গ কোন ধন অধিকারী।।
হরি বল হরি বল কহিছে বদন।
বল হরি গর্তে হরি আছে হরিধন।।
ঠাকুর বলেন তবে কররে খনন।
হরি হরি বলি মাটি কাটিল বদন।।
দুই চাপ মাটি ফেলে তাহার তলায়।
পাইল ধনের ঘড়া কালুব্যাধ প্রায়।।
ঠাকুর বলেন ধন আনরে বদন।
এই ধন লয়ে গৃহে করহ গমন।।
বহুদিন বেদনায় ভুগিলি বদন।
করিতে নারিলি বাছা ধন উপার্জন।।
সংসারের কার্য কিছু করিতে না পার।
এই ধন লয়ে সংসারের কার্য কর।।
তোর হরি নামেতে প্রহরী তুষ্ট হ’ল।
নিশ্চয় বুঝিনু ধন তোরে দিয়া গেল।।
বদন বলেন হরি হরি বল মুখে।
আমি কি করেছি ধন দিবে সে আমাকে।।
কেন হরি মোরে হরি দেহ এই ধন।
তুচ্ছ হরি ধন হরি দিয়া বুঝ মন।।
ওরে হরি ধনে হরি নাহি প্রয়োজন।
তুচ্ছ হরি ধনে হরি নাহি লয় মন।।
হরি লক্ষ্মী হরিণাক্ষী দৃষ্টি করে যারে।
হরি বল হরি ধন থাকে তার ঘরে।।
হরি বল বিমলা কমলা যার দাসী।
হরি বল যে পদ সেবিকা দিবানিশি।।
হরি বল যেই ধন বিরিঞ্চি বাঞ্চিত।
হরি বল সেই ধনে করনা বঞ্চিত।।
হরি বল সেই ধন করহ অর্পণ।
হরি বল সেই ধন তব শ্রীচরণ।।
হরি বল কত আমি দেখেছি খাটিয়া।
হরি বল দেখিয়াছি ধন উপার্জিয়া।।
হরি বল হেন ঘড়া পূর্ণ ছিল ঘরে।
হরি বল সেই ধন কেবা রক্ষা করে।।
হরি বল কোথা ধন আমি বা কোথায়।
হরি বল খাই নাই মরি বেদনায়।।
হরি বল ক্ষিতি অর্থলোভে কতলোক।
হরি বল খুন করি খাটিছে ফাটক।।
হরি বল হরিবিনে শান্তি নাহি মনে।
হরি বল কিবা হয় ধনে আর জনে।।
হরি বল এ ধনে আমার কার্য নাই।
হরি বল ধন হরি চল হরি যাই।
হরি বলে অর্থ যদি অনর্থ কেবল।
হরি ধন হরি লবে চল হরি বল।।
হরিকে ডাকেন হরি আর অজগর।
হরিধন হরিব না মোরা যাই ঘর।।
শুনি অজগর তবে বাহুড়ি আসিল।
ঠাকুরে প্রণাম করি সুড়ঙ্গে পশিল।।
প্রভু সঙ্গে বদন থাকেন একতর।
কভু ঠাকুরের বাড়ী কভু ভক্তঘর।।
কোন কোন লোক যদি হয় ব্যাধিযুক্ত।
ঠাকুরের কাছে আসে হতে ব্যাধিমুক্ত।।
কারু কারু আজ্ঞা দেন মুষ্টি যোগ করে।
কারু বলে লয়ে যাও বদন ঠাকুরে।।
ঠাকুর বলেন তবে বদন ঠাকুরে।
যেই তুমি সেই আমি একই শরীরে।।
মনুষ্য জীবন মৃত্যু একই সমান।
তুইরে বদন মম ধন মন প্রাণ।।
তোর দেহ নিলাম আমার ইচ্ছামতে।
তোর ইচ্ছা যাহা হয় মোর ইচ্ছা তাতে।।
ঠাকুরের আজ্ঞা শুনি বদন উঠিল।
ঘুরে ফিরে নাচে যেন মত্ত মাতোয়াল।।
চরণ চঞ্চল চিত্ত স্থির নাহি রয়।
হরি হরি হরি বলে দৌড়িয়া বেড়ায়।।
হরি বলি যায় চলি নামে করি ভর।
মুখ ফিরে যায় বাম স্কন্ধের উপর।।
মহাবেগে চলে যান সিংহের সমান।
হরিনাম ক্ষান্ত নাই আড়ল পয়ান।।
ক্ষণেক বিপথে যান ক্ষণে পথে আসে।
ভুজঙ্গ গমন যেন বক্রভাবে বিষে।।
অলসেতে চলি প্রভু করিত শয়ন।
ঈষৎ আবেশে নিদ্রা চৈতন্য জীবন।।
ঈষন্নিদ্রাপূর্ণ চৈতন্য করিত বিশ্রাম।
তার মধ্যে হরিনাম নাহিক বিরাম।।
হরি হরি বলে যবে করিত ভোজন।
মন্ত্র ভুলে হরি বলে আত্ম নিবেদন।।
হরি জল খা’ব ব’লে দেও ব’লে ডাকে।
ভুলে ভোজনের দ্রব্য তুলে দেয় মুখে।।
নামের সহিত দ্রব্য দুই হাতে তুলি।
বদন বদনে দিত হরি হরি বলি।।
এইভাবে উদাসীন হইল বদন।
এইভাবে ঠাকুরের সঙ্গেতে মিলন।।
অবিরাম হরিনাম করে অনুক্ষণ।
ইচ্ছামত করিতেন গমনাগমন।।
কক্ষবাদ্য করতালি কখন কখন।
কভু ওঢ়াকাঁদি কভু গৃহেতে গমন।।
কখন বা রাস্তা দিয়া করিতে পয়ান।
কভু পথ বা বিপথ না থাকিত জ্ঞান।।
হরি বলে কখন চলিত বেগভরে।
খান নাল লম্ফ দিয়া যাইতেন পারে।।
জঙ্গল কণ্টক কিংবা জলমগ্ন স্থান।
আড়ভাবে হরি বলি করিত পয়ান।।
ঘোরাফিরা নাহি ছিল দৌড়াদৌড়ি সোজা।
এমন মহৎভাব নাহি যেত বুঝা।।
মলমূত্র ত্যাগে হরি নাহিক বিশ্রাম।
নাহি ক্ষান্ত অবিশ্রান্ত করে হরিনাম।।
ব্যাধিযুক্ত কেহ যদি হয় নিরুপায়।
কাঁদিয়া ধরিত গিয়া বদনের পায়।।
হরিচাঁদ বলিয়া দিতেন আজ্ঞা ক’রে।
অমনি সারিত ব্যাধি আজ্ঞা অনুসারে।।
বদনের শুভাখ্যান শুনে যেই লোক।
শ্রবণেতে মহাসুখ বিজয়ী ত্রিলোক।।
ওঢ়াকাঁদি শেষ লীলা অলৌকিক কাজ।
ভণে শ্রীতারকচন্দ্র করি রসরাজ।।
মধ্যখণ্ড
প্রথম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
প্রথম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
অথ মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের উপাখ্যান।
পয়ার
মল্লকাঁদি গ্রামে মৃত্যুঞ্জয় মহাভাগ।
যে ভাবে ঠাকুর প্রতি বাড়ে অনুরাগ।।
নিত্যানন্দ মহাসাধু দানধর্মে রত।
কৃষ্ণ ভক্তি সাধুসেবা করে অবিরত।।
তাহার নন্দন হ’ল নাম মৃত্যুঞ্জয়।
সুভদ্রা নামিনী মাতা পতিব্রতা হয়।।
সেই রত্নগর্ভজাত হ’ল মৃত্যুঞ্জয়।
পরম বৈষ্ণবী দেবী সুভদ্রা সে হয়।।
নিত্যানন্দ পরলোকে করিলে গমন।
পতিশোকে সুভদ্রার সতত রোদন।।
পতি ধর্মাশ্রয় করি শিখার মুণ্ডন।
শুদ্ধমতি এক সন্ধ্যা করিত ভোজন।।
শিক্ষা কৈল হরিদাস বাবাজীর ঠাই।
সদা মনে কৃষ্ণ চিন্তা অন্য চিন্তা নাই।।
অঙ্গে ছাপা জপমালা তুলসী সেবন।
তুলসীর বেদী নিত্য করিত লেপন।।
নিশাকালে অল্প নিদ্রা তেমতি বিশ্রাম।
ঘুমেতে থাকিয়া করিতেন হরিনাম।।
ব্রহ্ম মুহূর্তের কালে করি গাত্রোত্থান।
প্রেমভরে ডাকিতেন গৌরাঙ্গরে প্রাণ।।
কোথারে নিতাই মোর কোথা ওরে গৌর।
দাসীকে করহ দয়া দয়াল ঠাকুর।।
বাপরে চৈতন্য মোর বাপরে নিতাই।
দাসীকে করহ দয়া এস দুটি ভাই।।
হরি বলি রোমাঞ্চিত প্রেমেতে পুলক।
প্রাতঃকৃত স্নান করি পরিত তিলক।।
হরিনাম পদছাপা সর্বঅঙ্গে পরি।
নিতাই বলিতে চক্ষে ঝরে অশ্রুবারি।।
তৈল মৎস বিনে নিজ হাতে করি পাক।
নিতাই চৈতন্য বলে ছাড়িতেন ডাক।।
সেই রত্নগর্ভজাত সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
শাস্ত্র শ্লোক বক্তা ছিল ধীর অতিশয়।।
শাস্ত্র আলাপনে অতি ছিলেন সমর্থ।
করিতেন শাস্ত্রের মাঝেতে নিগুঢ়ার্থ।।
সাধু সঙ্গে ইষ্ট গোষ্ঠ করে নিরবধি।
দৈবেতে হইল তার রসপিত্ত ব্যাধি।।
ভাবিলেন আমি হেন লোকের সন্তান।
আমার এব্যাধি হ’ল না রাখিব প্রাণ।।
কোন মুখে এই মুখ লোকেরে দেখা’ব।
ভাবিলেন বিষ খেয়ে জীবন ত্যাজিব।।
ওঢ়াকাঁদি হ’ল হরি ঠাকুর প্রচার।
আশা যাওয়া করে প্রভু রাউৎখামার।।
এ দেশ এ গ্রাম সব ধন্য হইয়াছে।
আমিও যাইব সেই ঠাকুরের কাছে।।
গোলোক মাতিল আর মাতিল বদন।
নারিকেলবাড়ী ধন্য তাদের কারণ।।
ঠাকুর পাইয়া হ’ল জগতে আনন্দ।
মাতিয়াছে দশরথ আর মহানন্দ।।
ইহা দেখি দ্রবীভূত নহে মম মন।
যেমন মানুষ আমি হ’য়েছে তেমন।।
জ্ঞান হয় ওঢ়াকাঁদি স্বয়ং অবতার।
তিনি বিনে পতিতের বন্ধু নাহি আর।।
রাউৎখামার হ’ল প্রেমের বাজার।
প্রেমের পাথারে সবে দিয়েছে সাঁতার।।
ওঢ়াকাঁদি হতে প্রেমবন্যা উথলিল।
আমি বিনে জগতের সকলে ডুবিল।।
মরিলে ঠাকুর দেখে পরকাল পাব।
শেষে বিষ খেয়ে আমি আত্মঘাতী হ’ব।।
বিষ কিনে লইলেন কাপড়ে বাঁধিয়া।
এ বিষ খাইব ঠাকুরের কাছে গিয়া।।
বিষ ল’য়ে ওঢ়াকাঁদি উপনীত হ’ল।
প্রভুর নিকটে গিয়া কাতরে বসিল।।
প্রভু বলে মৃত্যুঞ্জয় এলি ওঢ়াকাঁদি।
পরিধান কাপড়েতে কি আনিলি বাঁধি।।
অমনি বিস্ময়াম্বিত হ’ল মৃত্যুঞ্জয়।
মুখপানে চেয়ে র’ল কথা নাহি কয়।।
বসন টানিয়া প্রভু বিষ খসাইল।
বাহির করিয়া নিজে বিষ পান কৈল।।
এলি এই বিষ খেয়ে মরিবার তরে।
ওঢ়াকাঁদি এলে কিরে বিষে লোক মরে।।
এই বিষ খেয়ে বাছা মরিতে কি তুমি।
এইত’ বিষ খেলাম মরিত’ না আমি।।
মৃত্যুঞ্জয় মনে মনে ভাবিতে লাগিল।
ফাঁকি দিয়ে বেণে বেটা বিষ নাহি দিল।।
বিষ না দিয়ে বণিক দিয়েছে সে কুড়।
বিষ নহে এতে কেন মরিবে ঠাকুর।।
পুনঃভাবে এই বিষে ঠাকুর মরিলে।
প্রহ্লাদ ম’ল না কেন অগ্নি বিষানলে।।
বিষপানে মরিল না ভোলা বিশ্বনাথ।
কালীয় শ্রীকৃষ্ণ অঙ্গে কৈল দন্তাঘাত।।
হইলে সামান্য লোক হইত নিপাত।
নিশ্চয় বুঝিনু ইনি প্রভু জগন্নাথ।।
বিষপানে মরিতেন মানব হইলে।
আমার মনের কথা কেমনে জানিলে।।
আমি যে এনেছি বিষ গোপন করিয়া।
কেহ নাহি জানে আনি কাপড়ে বাঁধিয়া।।
গোপনে রেখেছি কিসে পাইল সন্ধান।
অন্তর্যামী ইনিত স্বয়ং ভগবান।।
প্রভু কয় মৃত্যুঞ্জয় শুনরে বচন।
বিষ খেয়ে মরে যে সে মানুষ কেমন।।
নিজ দেহ প্রতি যার দয়ামায়া নাই।
সে ভালো বাসিবে পরে বিশ্বাস না পাই।।
মৃত্যুঞ্জয় কহে প্রভু তোমার সাক্ষাতে।
মরিব বিষের বিষে ভয় কি তাহাতে।।
প্রভু বলে যদি তোর মরিবার ইচ্ছে।
মরিলি ত’ ভাল ক’রে মর মোর কাছে।।
পড়ে পদে মনোখেদে বলে মৃত্যুঞ্জয়।
দোষ ক্ষমা করি প্রভু রেখ রাঙ্গা পায়।।
দীন দয়াময় দয়া কর একবার।
আমিও তোমার প্রভু এ দেহ তোমার।।
প্রভু বলে যদি মোরে দেহ দিলি ধরি।
ব্যাধিমুক্ত হলি তুই ব’ল হরি হরি।।
শ্রীনাথ শ্রীমুখ বাক্য যখন বলিল।
ব্যাধিমুক্ত মৃত্যুঞ্জয় নাচিতে লাগিল।।
মৃত্যুঞ্জয় ধরি হরি চরণ যুগল।
বলে হরি বল হরি বল হরি বল।।
মৃত্যুঞ্জয় পাইল প্রভুর শ্রীচরণ।
কহিছে তারক হরি বল সর্বজন।।
পয়ার
মল্লকাঁদি গ্রামে মৃত্যুঞ্জয় মহাভাগ।
যে ভাবে ঠাকুর প্রতি বাড়ে অনুরাগ।।
নিত্যানন্দ মহাসাধু দানধর্মে রত।
কৃষ্ণ ভক্তি সাধুসেবা করে অবিরত।।
তাহার নন্দন হ’ল নাম মৃত্যুঞ্জয়।
সুভদ্রা নামিনী মাতা পতিব্রতা হয়।।
সেই রত্নগর্ভজাত হ’ল মৃত্যুঞ্জয়।
পরম বৈষ্ণবী দেবী সুভদ্রা সে হয়।।
নিত্যানন্দ পরলোকে করিলে গমন।
পতিশোকে সুভদ্রার সতত রোদন।।
পতি ধর্মাশ্রয় করি শিখার মুণ্ডন।
শুদ্ধমতি এক সন্ধ্যা করিত ভোজন।।
শিক্ষা কৈল হরিদাস বাবাজীর ঠাই।
সদা মনে কৃষ্ণ চিন্তা অন্য চিন্তা নাই।।
অঙ্গে ছাপা জপমালা তুলসী সেবন।
তুলসীর বেদী নিত্য করিত লেপন।।
নিশাকালে অল্প নিদ্রা তেমতি বিশ্রাম।
ঘুমেতে থাকিয়া করিতেন হরিনাম।।
ব্রহ্ম মুহূর্তের কালে করি গাত্রোত্থান।
প্রেমভরে ডাকিতেন গৌরাঙ্গরে প্রাণ।।
কোথারে নিতাই মোর কোথা ওরে গৌর।
দাসীকে করহ দয়া দয়াল ঠাকুর।।
বাপরে চৈতন্য মোর বাপরে নিতাই।
দাসীকে করহ দয়া এস দুটি ভাই।।
হরি বলি রোমাঞ্চিত প্রেমেতে পুলক।
প্রাতঃকৃত স্নান করি পরিত তিলক।।
হরিনাম পদছাপা সর্বঅঙ্গে পরি।
নিতাই বলিতে চক্ষে ঝরে অশ্রুবারি।।
তৈল মৎস বিনে নিজ হাতে করি পাক।
নিতাই চৈতন্য বলে ছাড়িতেন ডাক।।
সেই রত্নগর্ভজাত সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
শাস্ত্র শ্লোক বক্তা ছিল ধীর অতিশয়।।
শাস্ত্র আলাপনে অতি ছিলেন সমর্থ।
করিতেন শাস্ত্রের মাঝেতে নিগুঢ়ার্থ।।
সাধু সঙ্গে ইষ্ট গোষ্ঠ করে নিরবধি।
দৈবেতে হইল তার রসপিত্ত ব্যাধি।।
ভাবিলেন আমি হেন লোকের সন্তান।
আমার এব্যাধি হ’ল না রাখিব প্রাণ।।
কোন মুখে এই মুখ লোকেরে দেখা’ব।
ভাবিলেন বিষ খেয়ে জীবন ত্যাজিব।।
ওঢ়াকাঁদি হ’ল হরি ঠাকুর প্রচার।
আশা যাওয়া করে প্রভু রাউৎখামার।।
এ দেশ এ গ্রাম সব ধন্য হইয়াছে।
আমিও যাইব সেই ঠাকুরের কাছে।।
গোলোক মাতিল আর মাতিল বদন।
নারিকেলবাড়ী ধন্য তাদের কারণ।।
ঠাকুর পাইয়া হ’ল জগতে আনন্দ।
মাতিয়াছে দশরথ আর মহানন্দ।।
ইহা দেখি দ্রবীভূত নহে মম মন।
যেমন মানুষ আমি হ’য়েছে তেমন।।
জ্ঞান হয় ওঢ়াকাঁদি স্বয়ং অবতার।
তিনি বিনে পতিতের বন্ধু নাহি আর।।
রাউৎখামার হ’ল প্রেমের বাজার।
প্রেমের পাথারে সবে দিয়েছে সাঁতার।।
ওঢ়াকাঁদি হতে প্রেমবন্যা উথলিল।
আমি বিনে জগতের সকলে ডুবিল।।
মরিলে ঠাকুর দেখে পরকাল পাব।
শেষে বিষ খেয়ে আমি আত্মঘাতী হ’ব।।
বিষ কিনে লইলেন কাপড়ে বাঁধিয়া।
এ বিষ খাইব ঠাকুরের কাছে গিয়া।।
বিষ ল’য়ে ওঢ়াকাঁদি উপনীত হ’ল।
প্রভুর নিকটে গিয়া কাতরে বসিল।।
প্রভু বলে মৃত্যুঞ্জয় এলি ওঢ়াকাঁদি।
পরিধান কাপড়েতে কি আনিলি বাঁধি।।
অমনি বিস্ময়াম্বিত হ’ল মৃত্যুঞ্জয়।
মুখপানে চেয়ে র’ল কথা নাহি কয়।।
বসন টানিয়া প্রভু বিষ খসাইল।
বাহির করিয়া নিজে বিষ পান কৈল।।
এলি এই বিষ খেয়ে মরিবার তরে।
ওঢ়াকাঁদি এলে কিরে বিষে লোক মরে।।
এই বিষ খেয়ে বাছা মরিতে কি তুমি।
এইত’ বিষ খেলাম মরিত’ না আমি।।
মৃত্যুঞ্জয় মনে মনে ভাবিতে লাগিল।
ফাঁকি দিয়ে বেণে বেটা বিষ নাহি দিল।।
বিষ না দিয়ে বণিক দিয়েছে সে কুড়।
বিষ নহে এতে কেন মরিবে ঠাকুর।।
পুনঃভাবে এই বিষে ঠাকুর মরিলে।
প্রহ্লাদ ম’ল না কেন অগ্নি বিষানলে।।
বিষপানে মরিল না ভোলা বিশ্বনাথ।
কালীয় শ্রীকৃষ্ণ অঙ্গে কৈল দন্তাঘাত।।
হইলে সামান্য লোক হইত নিপাত।
নিশ্চয় বুঝিনু ইনি প্রভু জগন্নাথ।।
বিষপানে মরিতেন মানব হইলে।
আমার মনের কথা কেমনে জানিলে।।
আমি যে এনেছি বিষ গোপন করিয়া।
কেহ নাহি জানে আনি কাপড়ে বাঁধিয়া।।
গোপনে রেখেছি কিসে পাইল সন্ধান।
অন্তর্যামী ইনিত স্বয়ং ভগবান।।
প্রভু কয় মৃত্যুঞ্জয় শুনরে বচন।
বিষ খেয়ে মরে যে সে মানুষ কেমন।।
নিজ দেহ প্রতি যার দয়ামায়া নাই।
সে ভালো বাসিবে পরে বিশ্বাস না পাই।।
মৃত্যুঞ্জয় কহে প্রভু তোমার সাক্ষাতে।
মরিব বিষের বিষে ভয় কি তাহাতে।।
প্রভু বলে যদি তোর মরিবার ইচ্ছে।
মরিলি ত’ ভাল ক’রে মর মোর কাছে।।
পড়ে পদে মনোখেদে বলে মৃত্যুঞ্জয়।
দোষ ক্ষমা করি প্রভু রেখ রাঙ্গা পায়।।
দীন দয়াময় দয়া কর একবার।
আমিও তোমার প্রভু এ দেহ তোমার।।
প্রভু বলে যদি মোরে দেহ দিলি ধরি।
ব্যাধিমুক্ত হলি তুই ব’ল হরি হরি।।
শ্রীনাথ শ্রীমুখ বাক্য যখন বলিল।
ব্যাধিমুক্ত মৃত্যুঞ্জয় নাচিতে লাগিল।।
মৃত্যুঞ্জয় ধরি হরি চরণ যুগল।
বলে হরি বল হরি বল হরি বল।।
মৃত্যুঞ্জয় পাইল প্রভুর শ্রীচরণ।
কহিছে তারক হরি বল সর্বজন।।
শ্রীহীরামন পাগলের উপাখ্যান।
পয়ার
পয়ার
মৃত্যুঞ্জয় হরিবোলা হ’ল ভাগ্যক্রমে।
যাতায়াত করে প্রভু মল্লকাঁদি গ্রামে।।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনে আসেন হরিচাঁদ।
সস্ত্রীক সেবেন হরিচাঁদের শ্রীপদ।।
দুই চারি দিন বাটী থাকেন নির্জনে।
হরিচাঁদ গুণ গায় শয়নে স্বপনে।।
হরিচাঁদে না দেখিলে প্রাণ উঠে কাঁদি।
ঠাকুরে দেখিতে যেত ক্ষেত্র ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুরের পাদপদ্ম দরশন করে।
কভু মল্লকাঁদি গ্রামে আনে নিজ ঘরে।।
মৃত্যুঞ্জয়ের রমণী কাশীশ্বরী নাম।
সাধ্বী সতী পতিব্রতা জপে হরিনাম।।
ঠাকুর আসিলে তাকে ডাকে মা বলিয়া।
ঠাকুর সেবায় থাকে নিযুক্ত হইয়া।।
একটি পুত্র কামনা হইল অন্তরে।
মুখে না বলিয়া বৈসে ঠাকুর গোচরে।।
অন্তরে জানিয়া তাহা প্রভু অন্তর্যামী।
কাশীশ্বরী মাকে বলে পুত্র তোর আমি।।
মম ভক্ত ভাগবত যত যত হ’বে।
তাহারা সকলে তোরে মা বলে ডাকিবে।।
বহু পুত্র হবে তার মধ্যে একজন।
সেই হ’তে পুত্র কার্য্য হ’বে সমাপন।।
এতেক শুনিয়া দেবী আনন্দিত মনে।
বাৎসল্য মমতা কভু পিতা তুল্য মানে।।
কভু পুত্রভাবে, ভাবে মর্মান্তিক মর্ম।
কভু পুত্রভাবে, ভাবে কভু ভাবে ব্রহ্ম।।
কখন যশোদা ভাব মনেতে আসিয়া।
সস্নেহে ধরেন মাতা বাহু প্রসারিয়া।।
ঠাকুর আসিলে ঘরে খাদ্য দ্রব্য এনে।
নিজ হাতে তুলে দেন শ্রীচন্দ্র-বদনে।।
নিজ হাতে তৈল মাখি দেন শ্রীঅঙ্গেতে।
বসাইয়া ঠাকুরে উত্তম আসনেতে।।
আপনি আনিয়া বারি স্নানাদি করয়।
অঙ্গ ধৌত পাদ ধৌত পাদোদক খায়।।
একদিন প্রভু যান মল্লকাঁদি গায়।
সুগন্ধি অনেক পুষ্প আনে মৃত্যুঞ্জয়।।
পদ্মবন হ’তে আনে শতদল পদ্ম।
পুজিতে শ্রীপাদ শ্রীনাথের পাদপদ্ম।।
দুটি শতদল দিল দুটি কর্ণপরে।
এক কোকনদ পদ্ম দিল শিরোপরে।।
রাউৎখামার বাসী হীরামন নামে।
প্রভু প্রিয় ভক্ত বড় অপার মহিমে।।
কৃষকেরা কৃষিকার্য করিবারে যায়।
সেই সঙ্গে ধান্য জমি আবাদ ইচ্ছায়।।
চলেছেন একগোটা বাঁশ কাঁধে করি।
কৃষাণের সঙ্গে রঙ্গে যায় সারি সারি।।
পাঁচ সাত জন কিংবা দশ বারো জন।
দলে দলে সারি সারি চলে সর্বজন।।
একদলে সাত জন চলে একতরে।
হীরামন সেই সঙ্গে চলে গাতা ধরে।।
মৃত্যুঞ্জয় ফুলসাজে সাজা’য়ে ঠাকুরে।
বসায়েছে উত্তর গৃহের পিড়ি পরে।।
বাটীর দক্ষিণ দিয়া পশ্চিমাভিমুখে।
চ’লে যায় হীরামন পরম কৌতুকে।।
এমন সময় হীরামন ফিরে চায়।
ঠাকুরের অই সজ্জা দেখিবারে পায়।।
সকল কৃষকে ডেকে বলে হীরামন।
চল সবে করি গিয়া ঠাকুর দরশন।।
নহে তোরা অগ্রেতে যা পরে আমি যাব।
নহে তোরা সবে চল ঠাকুর দেখিব।।
এতবলি অগ্রে চলে বালা হীরামন।
বাটীর উপরে গিয়া উঠিল তখন।।
ঠাকুরের মনোহার ফুলসাজ দেখি।
একদৃষ্টে চেয়ে রহে ঠাকুর নিরখি।।
ঠাকুর চাহিয়া বলে হীরামন পানে।
রামাবতারের বীর ছিল কোনখানে।।
আমাকে দেখিবে বলে প্রাঙ্গণে দাঁড়ায়।
রামাবতারের বীর দেখ মৃত্যুঞ্জয়।।
কথা শুনে হীরামন পূর্বস্মৃতি হ’ল।
একদৃষ্টে প্রভু পানে চাহিয়া রহিল।।
মহাপ্রভু ডেকে বলে সেই হীরামনে।
রামাবতারের কথা পড়ে তোর মনে।।
লংকাদগ্ধ বনভঙ্গ সাগর লঙ্ঘন।
রাজপুত্র বনবাসী নারীর কারণ।।
ভেবে দেখ মনে তাহা হয় কিনা হয়।
যে সকল কার্য্য বাছা করিলি ত্রেতায়।।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিরূপাক্ষ সমুদ্ভব।
দ্বিতীয় মহান রুদ্র অযোনী সম্ভব।।
তৃতীয়ে শ্রীহনুমান রামনাম অঙ্গে।
চতুর্থে মুরালীগুপ্ত শচীসুত সঙ্গে।।
পঞ্চমে তুলসীদাস ষষ্ঠে হীরামন।
আদি হি, অন্ত ন, মধ্যে রাম নারায়ণ।।
হনুমান দ্বীনকার এ কোন কারণ।
হীন হ’য়ে হীন মধ্যে শ্রীরাম স্থাপন।।
উমার উকার পঞ্চ জন্ম সঙ্গ করি।
লীলার প্রধান সঙ্গ শক্তিরূপ ধরি।।
যুগে যুগে মহাপ্রভু অপূর্ব মিলন।
বলে কবি গেল রবি হরি বল মন।।
যাতায়াত করে প্রভু মল্লকাঁদি গ্রামে।।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনে আসেন হরিচাঁদ।
সস্ত্রীক সেবেন হরিচাঁদের শ্রীপদ।।
দুই চারি দিন বাটী থাকেন নির্জনে।
হরিচাঁদ গুণ গায় শয়নে স্বপনে।।
হরিচাঁদে না দেখিলে প্রাণ উঠে কাঁদি।
ঠাকুরে দেখিতে যেত ক্ষেত্র ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুরের পাদপদ্ম দরশন করে।
কভু মল্লকাঁদি গ্রামে আনে নিজ ঘরে।।
মৃত্যুঞ্জয়ের রমণী কাশীশ্বরী নাম।
সাধ্বী সতী পতিব্রতা জপে হরিনাম।।
ঠাকুর আসিলে তাকে ডাকে মা বলিয়া।
ঠাকুর সেবায় থাকে নিযুক্ত হইয়া।।
একটি পুত্র কামনা হইল অন্তরে।
মুখে না বলিয়া বৈসে ঠাকুর গোচরে।।
অন্তরে জানিয়া তাহা প্রভু অন্তর্যামী।
কাশীশ্বরী মাকে বলে পুত্র তোর আমি।।
মম ভক্ত ভাগবত যত যত হ’বে।
তাহারা সকলে তোরে মা বলে ডাকিবে।।
বহু পুত্র হবে তার মধ্যে একজন।
সেই হ’তে পুত্র কার্য্য হ’বে সমাপন।।
এতেক শুনিয়া দেবী আনন্দিত মনে।
বাৎসল্য মমতা কভু পিতা তুল্য মানে।।
কভু পুত্রভাবে, ভাবে মর্মান্তিক মর্ম।
কভু পুত্রভাবে, ভাবে কভু ভাবে ব্রহ্ম।।
কখন যশোদা ভাব মনেতে আসিয়া।
সস্নেহে ধরেন মাতা বাহু প্রসারিয়া।।
ঠাকুর আসিলে ঘরে খাদ্য দ্রব্য এনে।
নিজ হাতে তুলে দেন শ্রীচন্দ্র-বদনে।।
নিজ হাতে তৈল মাখি দেন শ্রীঅঙ্গেতে।
বসাইয়া ঠাকুরে উত্তম আসনেতে।।
আপনি আনিয়া বারি স্নানাদি করয়।
অঙ্গ ধৌত পাদ ধৌত পাদোদক খায়।।
একদিন প্রভু যান মল্লকাঁদি গায়।
সুগন্ধি অনেক পুষ্প আনে মৃত্যুঞ্জয়।।
পদ্মবন হ’তে আনে শতদল পদ্ম।
পুজিতে শ্রীপাদ শ্রীনাথের পাদপদ্ম।।
দুটি শতদল দিল দুটি কর্ণপরে।
এক কোকনদ পদ্ম দিল শিরোপরে।।
রাউৎখামার বাসী হীরামন নামে।
প্রভু প্রিয় ভক্ত বড় অপার মহিমে।।
কৃষকেরা কৃষিকার্য করিবারে যায়।
সেই সঙ্গে ধান্য জমি আবাদ ইচ্ছায়।।
চলেছেন একগোটা বাঁশ কাঁধে করি।
কৃষাণের সঙ্গে রঙ্গে যায় সারি সারি।।
পাঁচ সাত জন কিংবা দশ বারো জন।
দলে দলে সারি সারি চলে সর্বজন।।
একদলে সাত জন চলে একতরে।
হীরামন সেই সঙ্গে চলে গাতা ধরে।।
মৃত্যুঞ্জয় ফুলসাজে সাজা’য়ে ঠাকুরে।
বসায়েছে উত্তর গৃহের পিড়ি পরে।।
বাটীর দক্ষিণ দিয়া পশ্চিমাভিমুখে।
চ’লে যায় হীরামন পরম কৌতুকে।।
এমন সময় হীরামন ফিরে চায়।
ঠাকুরের অই সজ্জা দেখিবারে পায়।।
সকল কৃষকে ডেকে বলে হীরামন।
চল সবে করি গিয়া ঠাকুর দরশন।।
নহে তোরা অগ্রেতে যা পরে আমি যাব।
নহে তোরা সবে চল ঠাকুর দেখিব।।
এতবলি অগ্রে চলে বালা হীরামন।
বাটীর উপরে গিয়া উঠিল তখন।।
ঠাকুরের মনোহার ফুলসাজ দেখি।
একদৃষ্টে চেয়ে রহে ঠাকুর নিরখি।।
ঠাকুর চাহিয়া বলে হীরামন পানে।
রামাবতারের বীর ছিল কোনখানে।।
আমাকে দেখিবে বলে প্রাঙ্গণে দাঁড়ায়।
রামাবতারের বীর দেখ মৃত্যুঞ্জয়।।
কথা শুনে হীরামন পূর্বস্মৃতি হ’ল।
একদৃষ্টে প্রভু পানে চাহিয়া রহিল।।
মহাপ্রভু ডেকে বলে সেই হীরামনে।
রামাবতারের কথা পড়ে তোর মনে।।
লংকাদগ্ধ বনভঙ্গ সাগর লঙ্ঘন।
রাজপুত্র বনবাসী নারীর কারণ।।
ভেবে দেখ মনে তাহা হয় কিনা হয়।
যে সকল কার্য্য বাছা করিলি ত্রেতায়।।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিরূপাক্ষ সমুদ্ভব।
দ্বিতীয় মহান রুদ্র অযোনী সম্ভব।।
তৃতীয়ে শ্রীহনুমান রামনাম অঙ্গে।
চতুর্থে মুরালীগুপ্ত শচীসুত সঙ্গে।।
পঞ্চমে তুলসীদাস ষষ্ঠে হীরামন।
আদি হি, অন্ত ন, মধ্যে রাম নারায়ণ।।
হনুমান দ্বীনকার এ কোন কারণ।
হীন হ’য়ে হীন মধ্যে শ্রীরাম স্থাপন।।
উমার উকার পঞ্চ জন্ম সঙ্গ করি।
লীলার প্রধান সঙ্গ শক্তিরূপ ধরি।।
যুগে যুগে মহাপ্রভু অপূর্ব মিলন।
বলে কবি গেল রবি হরি বল মন।।
মহাপ্রভুর শ্রীরাম মূর্তি ধারণ
পয়ার
পয়ার
অদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া হীরামন।
অবারিত অশ্রুধারে ভেসেছে বয়ন।।
হীরামন হীরামন আর বাক্য নাই।
শিথিল সবল দেহ ঘন ছাড়ে হাই।।
অনিমিষ নেত্র রূপ দেখে হীরামন।
যশোমন্ত রূপ হরি লুকা’ল তখন।।
অভিনব রূপ নব দূর্বাদল শ্যাম।
দেখিতে দেখিতে হ’ল দাশরথি রাম।।
আর যত লোক ঠাকুরের ঠাই ছিল।
সবে দেখে প্রভু হরিচাঁদ দাঁড়াইল।।
হীরামন দেখিল সাক্ষাৎ সেই রাম।
শিরে জটা বাকলাটা সুন্দর সুঠাম।।
একা হীরামন দেখে রাম দয়াময়।
সে রূপের আভা মাত্র দেখে মৃত্যুঞ্জয়।।
বামপার্শ্বে কুক্ষিমধ্যে দেখে ধনুর্গুণ।
কটিতে বাকল শিরে জটা কক্ষে তুণ।।
বনবাসে যেই বেশে যান ঋষ্যমুখে।
তেম্নি অপরূপ রূপ হীরামন দেখে।।
রামরূপে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া ছিল।
হীরামন পানে চাহি অমনি বসিল।।
হীরামন পানে প্রভু একদৃষ্টে চায়।
নিরিখ ধরিয়া হীরামন চেয়ে রয়।।
হীরামন স্কন্ধে ছিল বাঁশ একখণ্ড।
থোড়াবাঁশ ধান্য তৃণ আকর্ষণী দণ্ড।।
স্পন্দহীন বাক্যরোধ ভুজে নাহি বল।
পড়ে গেল থোড়াবাঁশ চক্ষে বহে জল।।
লোমকূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটন আকার।
স্বেদ বহে শরীরে চমকে বার বার।।
অবশ হইল অঙ্গ পড়িল ধরায়।
প্রভু বলে ওরে ধর ধর মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে ধরে তার হাতে।
বসাইল আনিয়া প্রভুর সম্মুখেতে।।
দ্বিমুহূর্ত মূর্ছাপ্রাপ্ত ছিল হীরামন।
রাম রাম বলে পরে মেলিল লোচন।।
আত্মহারা হীরামন বাক্য নাহি মুখে।
থেকে থেকে ক্ষণে উঠে চমকে চমকে।।
প্রহরেক জড় প্রায় রহিল বসিয়া।
থেকে থেকে মাঝে মাঝে উঠে শিহরিয়া।।
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ক্রমে হ’য়ে এল বন্ধ।
মুখে না নিঃস্বরে বাণী কণ্ঠ হ’ল রুদ্ধ।।
এমন সময় মহাপ্রভু ডেকে কয়।
ফিরে প’ল হীরে ওরে ধর মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়া হীরামনে স্পর্শ করে।
অস্থিরতা ঘুচে সাধু শান্ত হইল পরে।।
মৃত্যুঞ্জয় কর্ণেতে শুনায় হরিনাম।
হীরামন বলে কোথা পূর্ণব্রহ্ম রাম।।
হীরামন বলে প্রভু মোরে দেখা দাও।
আরবার রামরূপ আমারে দেখাও।।
প্রভু কহে কহি তোরে ওরে হীরামন।
যদি কেহ কারু কিছু করে দরশন।।
অস্মভব দেখে জ্ঞানী প্রকাশ না করে।
শুনিলে সন্দেহ হয় লোকের অন্তরে।।
শৈল মাঝে অগ্নি থাকে জানে সর্বলোক।
ঠক্নি লোহঘাতে জ্ব’লে উঠে সে পাবক।।
তেমনি পাথর মাঝে রহিয়াছে অগ্নি।
দেখিতে পাইবা পুনঃ যদি থাকে ঠুক্নি।।
কিন্তু সে আগুন যদি জ্বালাইয়া লয়।
শীলাকাষ্ঠ পুড়ে যায় কিছু নাহি রয়।।
তুমি আছ আমি আছি তাতে কিবা ভয়।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে যাও নিজালয়।।
প্রভু বাক্যে হীরামন গৃহেতে চলিল।
তারক কহিছে সাধু হরি হরি বল।।
অবারিত অশ্রুধারে ভেসেছে বয়ন।।
হীরামন হীরামন আর বাক্য নাই।
শিথিল সবল দেহ ঘন ছাড়ে হাই।।
অনিমিষ নেত্র রূপ দেখে হীরামন।
যশোমন্ত রূপ হরি লুকা’ল তখন।।
অভিনব রূপ নব দূর্বাদল শ্যাম।
দেখিতে দেখিতে হ’ল দাশরথি রাম।।
আর যত লোক ঠাকুরের ঠাই ছিল।
সবে দেখে প্রভু হরিচাঁদ দাঁড়াইল।।
হীরামন দেখিল সাক্ষাৎ সেই রাম।
শিরে জটা বাকলাটা সুন্দর সুঠাম।।
একা হীরামন দেখে রাম দয়াময়।
সে রূপের আভা মাত্র দেখে মৃত্যুঞ্জয়।।
বামপার্শ্বে কুক্ষিমধ্যে দেখে ধনুর্গুণ।
কটিতে বাকল শিরে জটা কক্ষে তুণ।।
বনবাসে যেই বেশে যান ঋষ্যমুখে।
তেম্নি অপরূপ রূপ হীরামন দেখে।।
রামরূপে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া ছিল।
হীরামন পানে চাহি অমনি বসিল।।
হীরামন পানে প্রভু একদৃষ্টে চায়।
নিরিখ ধরিয়া হীরামন চেয়ে রয়।।
হীরামন স্কন্ধে ছিল বাঁশ একখণ্ড।
থোড়াবাঁশ ধান্য তৃণ আকর্ষণী দণ্ড।।
স্পন্দহীন বাক্যরোধ ভুজে নাহি বল।
পড়ে গেল থোড়াবাঁশ চক্ষে বহে জল।।
লোমকূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটন আকার।
স্বেদ বহে শরীরে চমকে বার বার।।
অবশ হইল অঙ্গ পড়িল ধরায়।
প্রভু বলে ওরে ধর ধর মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে ধরে তার হাতে।
বসাইল আনিয়া প্রভুর সম্মুখেতে।।
দ্বিমুহূর্ত মূর্ছাপ্রাপ্ত ছিল হীরামন।
রাম রাম বলে পরে মেলিল লোচন।।
আত্মহারা হীরামন বাক্য নাহি মুখে।
থেকে থেকে ক্ষণে উঠে চমকে চমকে।।
প্রহরেক জড় প্রায় রহিল বসিয়া।
থেকে থেকে মাঝে মাঝে উঠে শিহরিয়া।।
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ক্রমে হ’য়ে এল বন্ধ।
মুখে না নিঃস্বরে বাণী কণ্ঠ হ’ল রুদ্ধ।।
এমন সময় মহাপ্রভু ডেকে কয়।
ফিরে প’ল হীরে ওরে ধর মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়া হীরামনে স্পর্শ করে।
অস্থিরতা ঘুচে সাধু শান্ত হইল পরে।।
মৃত্যুঞ্জয় কর্ণেতে শুনায় হরিনাম।
হীরামন বলে কোথা পূর্ণব্রহ্ম রাম।।
হীরামন বলে প্রভু মোরে দেখা দাও।
আরবার রামরূপ আমারে দেখাও।।
প্রভু কহে কহি তোরে ওরে হীরামন।
যদি কেহ কারু কিছু করে দরশন।।
অস্মভব দেখে জ্ঞানী প্রকাশ না করে।
শুনিলে সন্দেহ হয় লোকের অন্তরে।।
শৈল মাঝে অগ্নি থাকে জানে সর্বলোক।
ঠক্নি লোহঘাতে জ্ব’লে উঠে সে পাবক।।
তেমনি পাথর মাঝে রহিয়াছে অগ্নি।
দেখিতে পাইবা পুনঃ যদি থাকে ঠুক্নি।।
কিন্তু সে আগুন যদি জ্বালাইয়া লয়।
শীলাকাষ্ঠ পুড়ে যায় কিছু নাহি রয়।।
তুমি আছ আমি আছি তাতে কিবা ভয়।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে যাও নিজালয়।।
প্রভু বাক্যে হীরামন গৃহেতে চলিল।
তারক কহিছে সাধু হরি হরি বল।।
হীরামনের জ্বর ও জ্ঞাতি কর্তৃক ত্যাগ ও পুনর্জীবন।
পয়ার
রাম রূপ হেরি হ’ল জীবন চঞ্চল।
সে হইতে সংসারের কার্য ছাড়ি দিল।।
কৃষাণী কার্যেতে ছিল পারক অত্যন্ত।
কার্যেতে প্রবর্ত হ’লে নাহি দিত ক্ষান্ত।।
স্বাভাবিক যাহারা করেন কৃষিকার্য।
তাহা হ’তে দশগুণ, না ছিল অধৈর্য।।
এই মত কার্য করিতেন মহাভাগ।
এবে সংসারের কার্য করিলেন ত্যাগ।।
জ্ঞাতি বন্ধু সব লোকে ভাবে মনে মনে।
এ বেটা সংসার কার্য তেয়াগিল কেনে।।
কেহ বলে যে দিন ঠাকুর দেখতে যায়।
সেই দিন পাগল করেছে মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় বাড়ীতে ঠাকুর এসেছিল।
মৃত্যুঞ্জয় গৃহিণী ঠাকুরে সাজাইল।।
মৃত্যুঞ্জয় এনেছিল শতদল পদ্ম।
সেই ফুলে পূজে ঠাকুরের পাদপদ্ম।।
পরমা বৈষ্ণবী সেই মৃত্যুঞ্জয় মাতা।
ঠাকুরে পূজিয়াছিল শুনিয়াছি কথা।।
সে ঠাকুরে দেখিবারে গিয়েছিল হীরে।
মূর্ছা হ’য়ে পড়েছিল দেখে সে ঠাকুরে।।
মৃত্যুঞ্জয় ওর কর্ণে দিয়েছিল হরিবোল।
সেই হ’তে হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
রাউৎখামার গ্রামে মেতেছে সকল।
তারা সবে প্রেমে মেতে বলে হরিবোল।।
কেহ বলে দুর্লভ মধুর হরিবোল।
তবে কেন হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
সবে মিলি দেখিয়াছি ঠাকুরের রূপ।
আমরা জানি যে তিনি স্বয়ং স্বরূপ।।
সব হরিবোলা করে সংসারের কার্য।
হীরামন কি জন্য করিল কার্য ত্যাজ্য।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ করে কানাকানি।
যাহার যেমন মন সে কহে তেমনি।।
কেহ বলে ও দেখেছে প্রভু হরিচাঁদ।
স্বয়ং দর্শনে হ’ল কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।।
হীরামন কার্য ত্যাগী দেখিয়া বিশেষ।
ঠাকুরের প্রতি কারু জন্মিল বিদ্বেষ।।
শ্রীচৈতন্য বালা হীরামনের সে খুড়া।
ঠাকুরের প্রতি দ্বেষ করে সেই বুড়া।।
শ্রীঅক্রুরচন্দ্র বালা শ্রীগুরুচরণ।
কনিষ্ঠ শ্রীকোটিশ্বর অতি সুলক্ষণ।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত তিন সহোদর।
তাহারা বলেন প্রভু স্বয়ং অবতার।।
প্রভুর সঙ্গেতে তারা ভ্রমে সর্বক্ষণ।
প্রভুর সঙ্গেতে করেন নাম সংকীর্তন।।
ভক্তি বাধ্য মহাপ্রভু সেই বাড়ী যান।
তাহারা বলেন ইনি স্বয়ং ভগবান।।
মনে নাহি কোন দ্বেষ হীরামন ব’লে।
তারা বলে বংশের ভাজন এই ছেলে।।
রত্নগর্ভে জন্মিয়াছে মহারাজ পুত্র।
এ হইতে বালাবংশ হইবে পবিত্র।।
কার্যত্যাগী হীরামন করে হরিনাম।
কতদিনে দৈবযোগে হইল ব্যারাম।।
জ্বর হ’য়ে ছ’মাস পর্যন্ত হ’ল ভোগ।
উদরে হইল প্লীহা যকৃতাদি রোগ।।
অদ্য মরে কল্য মরে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
এই রোগে ক্রমে ক্রমে হ’ল মৃতবত।।
একদিন ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
পাগলারে ল’য়ে তোরা ওঢ়াকাঁদি ফেলা।।
রোগে মরে তবু বেটা ঔষধ না খায়।
আমাদের কথা নাহি শুনে দুরাশয়।।
আমাদের সংসারে কার্য নাহি করে।
আমরা কেহত’ নয় ও কার বাড়ী মরে।।
অসার সংসার বলে কেহ কারু নয়।
যত বেটা মতুয়ারা এই কথা কয়।।
মতুয়া হইল এরা কি ধন পাইয়া।
বেদবিধি না মানে ফিরিছে লাফাইয়া।।
কেবা কার, কেবা কার, কার জন্য কাঁদে।
আত্ম স্বার্থ সমর্পণ বাবা হরিচাঁদে।।
হরি বলে দিন রাতি করে সোরা সোরি।
বাবা যদি হরিচাঁদ যাক সেই বাড়ী।।
খুড়া জেঠা ভাই বন্ধু কেহ কারু নয়।
দেখি ওর কোন বাবা এখানে কুলায়।।
হয় নেও ওঢ়াকাঁদি নয় মল্লকাঁদি।
ও মরুক ম’তোরা করুক কাঁদাকাঁদি।।
হরিচাঁদ মৃত্যুঞ্জয় দোহে নাকি ব্রহ্ম।
এ মরা বাঁচাতে পারে তবে জানি মর্ম।।
মরা গরু বাঁচাইয়া জহুরি প্রকাশ।
এই মরা বাঁ’চায়ে লউক হরিদাস।।
শুনিয়া এতেক বাণী কেহ কেহ কয়।
ভাল কথা বলেছ হে বালা মহাশয়।।
উহার কারণে মায়া করা নিরর্থক।
গতপ্রাণী জন্যে আর করিও না শোক।।
ডুবু তরী যদি হরিচাঁদ করে রক্ষা।
কেমন ঠাকুর তবে বুঝিব পরীক্ষা।।
তিলক মণ্ডল ভৃত্য সেই ডেকে বলে।
পাগলারে ওঢ়াকাঁদি আমি আসি ফেলে।।
এতবলি তিলক সে সাজাইল তরী।
হীরামনে ল’য়ে গেল ওঢ়াকাঁদি বাড়ী।।
প্রভুর নিকটে গিয়া উপনীত হ’ল।
তাহা দেখি প্রভু গিয়া গৃহে লুকাইল।।
সেইখানে তিলক সে কাহারে না দেখে।
হীরামনে তুলে এক গাছতলা রাখে।।
ভজন পোদ্দার বলে বাড়ী তোর কোথা।
মরা শব ফেলাইয়া যা’স কেন হেথা।।
তিলক মণ্ডল শুনি উঠিল নৌকায়।
ত্বরা করি খুলে তরী পালাইল ভয়।।
ভজন বলেছে কোথা যাস কুলাঙ্গার।
সবে কয় কোথা যায় শীঘ্র ওরে ধর।।
বড় কর্তা কৃষ্ণদাস অগ্রজ প্রভুর।
বলে ওরে ধরে আন যায় কতদূর।।
এত বলি বড়কর্তা ধাবমান হয়।
মহাপ্রভু এসে তথা অগ্রজে শান্তায়।।
প্রভু বলে দেখ দাদা হ’য়ে আগুয়ান।
একেবারে মরেছে কি? আছে ওর প্রাণ।।
বড়কর্তা দেখে গিয়া নাকে শ্বাস নাই।
কণ্ঠদেশে বামপার্শ্বে ল’ড়ে দেখে তাই।।
মহাপ্রভু এসে চটকার গাছতলা।
দেখে বলে এ দেখি সে হীরামন বালা।।
বসিলেন হীরামনে রাখিয়া সম্মুখে।
রহিলেন মহাপ্রভু উত্তরাভিমুখে।।
প্রভু কহে দেখে হে পোদ্দার মহাশয়।
প্রাণ আছে একেবারে মরা শ’ব নয়।।
বড়কর্তা বলে হরি ব্রজা মরে গেছে।
মরা যে বাঁ’চাতে সে ত’ নাই বেঁচে।।
মরা গরু বাঁচাইল তোর সঙ্গী ব্রজা।
পার যদি হও মরা বাঁচাবার ওঝা।।
রাউৎখামারের লোক মরা ফেলে যায়।
বালা গুষ্ঠি এত বৃদ্ধি পেয়েছে কোথায়।।
প্রভু হরিচাঁদ তবে কহেন অগ্রজে।
এরা যেন মরা ফেলে গেছে কি গরজে।।
একরাত্রে নির্জনেতে বলি হরি হরি।
এ রোগী চিকিৎসা আমি করিবারে পারি।।
কৃষ্ণদাস বলে কর পার যদি ভাই।
রাউৎখামার লোকের কোন দোষ নাই।।
যাও তথা, খাও তথা, তথা কর লভ্য।
তাহারা তোমার বাটী আনে কত দ্রব্য।।
সেই গ্রামে হরিবোলা মতুয়ার দল।
ভকত বাঁচাও ভাই ভক্তবৎসল।।
কিন্তু যদি এ মরা বাঁচাতে নার ভাই।
বালার বালাহী যাবে আর রক্ষা নাই।।
মাতুব্বর চ’তে বালার এত কি আস্পর্ধা।
কৃষ্ণদাস নাম বুঝি শোনে নাই গাধা।।
কার মরা এনে ফেলাইল কার বাড়ী।
বাঁচাতে পার’ত যশ হবে দেশ ভরি।।
যদি বাঁচাতে না পার ব’লে হরি হরি।
বালাদের নামে আমি করব ফৌজদারি।।
প্রভু কহে বড়কর্তা দেখ বিদ্যমান।
একেবারে মরে নাই দেহে আছে প্রাণ।।
নাসাগ্রে ঈষৎমাত্র বহিতেছে শ্বাস।
বাঁচিলে বাঁচিতে পারে হ’তেছে বিশ্বাস।।
কথোপকথনে হ’ল দিবা অবসান।
হেনকালে লক্ষ্মীমাতা এল সেই স্থান।।
মাতা বলে তবে কেন ক’রেছ বিলম্ব।
নিশ্চয় চৈতন্য বালা করেছে এ কর্ম।।
আপনার ঠাকুরালী তথায় বেড়েছে।
পরীক্ষা করার জন্য ইহা করে গেছে।।
প্রভু বলে যাহা হউক সবে যাহ ঘরে।
আমি দেখি চেষ্টা করি ঈশ্বর কি করে।।
সবে গেল প্রভু মাত্র রহিল একেলা।
মরা হীরামন ল’য়ে সেই গাছতলা।।
যামিনীর শেষ যামে সঞ্চারিল প্রাণ।
নীরোগ শরীর হ’ল পূর্ণ শক্তিমান।।
উঠিয়া চরণ ধরি বলে ওহে নাথ।
এ অধমে কৃপা করি কর আত্মসাৎ।।
যেদিন তোমার দেখা পাই মল্লকাঁদি।
পিঞ্জিরা রাউৎখামার পাখি ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুর বলেন, আমি জানি তা সকল।
সে কথায় কাজ নাই হরি হরি বল।।
এমত আমার কর্ম রোগ ভোগ দিয়ে।
সংসার হইতে তোরে নিলাম উঠা’য়ে।।
তোর প্রতি আর কারু থাকিল না দাবি।
মায়াতীত হ’লি, এবে হরিগুণ গা’বি।।
হেথা হ’তে লুকাইয়া যারে বেদভিটে।
তথা হ’তে যাস কল্য অন্য নায় উঠে।।
এখানে থাকিলে তুই জনরব হ’বে।
প্রতিষ্ঠা বাড়িলে মোরে কেহ না ছাড়িবে।।
যুগে যুগে বাঁধা আছি আমি তোর ঠাই।
তোমা আমা একদেহ ভিন্ন ভেদ নাই।।
সংসারের মাঝে তুই কারু দায়ী নাই।
একমাত্র দায়ী রৈলি রমণীর ঠাই।।
যাও বাছা দিন কত করগে সংসার।
শোধ দিয়া এস গিয়া রমণীর ধার।।
জন্মিলে একটি পুত্র তাহার গর্ভেতে।
রমণীর ধার তবে পা’র শোধ হ’তে।।
গোলোক নাথের বাক্য শুনে শান্ত হ’ল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
সভক্তি অন্তরে যেবা করেন শ্রবণ।
ধনে বংশে বৃদ্ধি অন্তে গোলোকে গমন।।
হীরামন দেহে পুনর্জীবন সঞ্চার।
হরি বল কহিছে তারক সরকার।।
পয়ার
রাম রূপ হেরি হ’ল জীবন চঞ্চল।
সে হইতে সংসারের কার্য ছাড়ি দিল।।
কৃষাণী কার্যেতে ছিল পারক অত্যন্ত।
কার্যেতে প্রবর্ত হ’লে নাহি দিত ক্ষান্ত।।
স্বাভাবিক যাহারা করেন কৃষিকার্য।
তাহা হ’তে দশগুণ, না ছিল অধৈর্য।।
এই মত কার্য করিতেন মহাভাগ।
এবে সংসারের কার্য করিলেন ত্যাগ।।
জ্ঞাতি বন্ধু সব লোকে ভাবে মনে মনে।
এ বেটা সংসার কার্য তেয়াগিল কেনে।।
কেহ বলে যে দিন ঠাকুর দেখতে যায়।
সেই দিন পাগল করেছে মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় বাড়ীতে ঠাকুর এসেছিল।
মৃত্যুঞ্জয় গৃহিণী ঠাকুরে সাজাইল।।
মৃত্যুঞ্জয় এনেছিল শতদল পদ্ম।
সেই ফুলে পূজে ঠাকুরের পাদপদ্ম।।
পরমা বৈষ্ণবী সেই মৃত্যুঞ্জয় মাতা।
ঠাকুরে পূজিয়াছিল শুনিয়াছি কথা।।
সে ঠাকুরে দেখিবারে গিয়েছিল হীরে।
মূর্ছা হ’য়ে পড়েছিল দেখে সে ঠাকুরে।।
মৃত্যুঞ্জয় ওর কর্ণে দিয়েছিল হরিবোল।
সেই হ’তে হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
রাউৎখামার গ্রামে মেতেছে সকল।
তারা সবে প্রেমে মেতে বলে হরিবোল।।
কেহ বলে দুর্লভ মধুর হরিবোল।
তবে কেন হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
সবে মিলি দেখিয়াছি ঠাকুরের রূপ।
আমরা জানি যে তিনি স্বয়ং স্বরূপ।।
সব হরিবোলা করে সংসারের কার্য।
হীরামন কি জন্য করিল কার্য ত্যাজ্য।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ করে কানাকানি।
যাহার যেমন মন সে কহে তেমনি।।
কেহ বলে ও দেখেছে প্রভু হরিচাঁদ।
স্বয়ং দর্শনে হ’ল কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।।
হীরামন কার্য ত্যাগী দেখিয়া বিশেষ।
ঠাকুরের প্রতি কারু জন্মিল বিদ্বেষ।।
শ্রীচৈতন্য বালা হীরামনের সে খুড়া।
ঠাকুরের প্রতি দ্বেষ করে সেই বুড়া।।
শ্রীঅক্রুরচন্দ্র বালা শ্রীগুরুচরণ।
কনিষ্ঠ শ্রীকোটিশ্বর অতি সুলক্ষণ।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত তিন সহোদর।
তাহারা বলেন প্রভু স্বয়ং অবতার।।
প্রভুর সঙ্গেতে তারা ভ্রমে সর্বক্ষণ।
প্রভুর সঙ্গেতে করেন নাম সংকীর্তন।।
ভক্তি বাধ্য মহাপ্রভু সেই বাড়ী যান।
তাহারা বলেন ইনি স্বয়ং ভগবান।।
মনে নাহি কোন দ্বেষ হীরামন ব’লে।
তারা বলে বংশের ভাজন এই ছেলে।।
রত্নগর্ভে জন্মিয়াছে মহারাজ পুত্র।
এ হইতে বালাবংশ হইবে পবিত্র।।
কার্যত্যাগী হীরামন করে হরিনাম।
কতদিনে দৈবযোগে হইল ব্যারাম।।
জ্বর হ’য়ে ছ’মাস পর্যন্ত হ’ল ভোগ।
উদরে হইল প্লীহা যকৃতাদি রোগ।।
অদ্য মরে কল্য মরে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
এই রোগে ক্রমে ক্রমে হ’ল মৃতবত।।
একদিন ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
পাগলারে ল’য়ে তোরা ওঢ়াকাঁদি ফেলা।।
রোগে মরে তবু বেটা ঔষধ না খায়।
আমাদের কথা নাহি শুনে দুরাশয়।।
আমাদের সংসারে কার্য নাহি করে।
আমরা কেহত’ নয় ও কার বাড়ী মরে।।
অসার সংসার বলে কেহ কারু নয়।
যত বেটা মতুয়ারা এই কথা কয়।।
মতুয়া হইল এরা কি ধন পাইয়া।
বেদবিধি না মানে ফিরিছে লাফাইয়া।।
কেবা কার, কেবা কার, কার জন্য কাঁদে।
আত্ম স্বার্থ সমর্পণ বাবা হরিচাঁদে।।
হরি বলে দিন রাতি করে সোরা সোরি।
বাবা যদি হরিচাঁদ যাক সেই বাড়ী।।
খুড়া জেঠা ভাই বন্ধু কেহ কারু নয়।
দেখি ওর কোন বাবা এখানে কুলায়।।
হয় নেও ওঢ়াকাঁদি নয় মল্লকাঁদি।
ও মরুক ম’তোরা করুক কাঁদাকাঁদি।।
হরিচাঁদ মৃত্যুঞ্জয় দোহে নাকি ব্রহ্ম।
এ মরা বাঁচাতে পারে তবে জানি মর্ম।।
মরা গরু বাঁচাইয়া জহুরি প্রকাশ।
এই মরা বাঁ’চায়ে লউক হরিদাস।।
শুনিয়া এতেক বাণী কেহ কেহ কয়।
ভাল কথা বলেছ হে বালা মহাশয়।।
উহার কারণে মায়া করা নিরর্থক।
গতপ্রাণী জন্যে আর করিও না শোক।।
ডুবু তরী যদি হরিচাঁদ করে রক্ষা।
কেমন ঠাকুর তবে বুঝিব পরীক্ষা।।
তিলক মণ্ডল ভৃত্য সেই ডেকে বলে।
পাগলারে ওঢ়াকাঁদি আমি আসি ফেলে।।
এতবলি তিলক সে সাজাইল তরী।
হীরামনে ল’য়ে গেল ওঢ়াকাঁদি বাড়ী।।
প্রভুর নিকটে গিয়া উপনীত হ’ল।
তাহা দেখি প্রভু গিয়া গৃহে লুকাইল।।
সেইখানে তিলক সে কাহারে না দেখে।
হীরামনে তুলে এক গাছতলা রাখে।।
ভজন পোদ্দার বলে বাড়ী তোর কোথা।
মরা শব ফেলাইয়া যা’স কেন হেথা।।
তিলক মণ্ডল শুনি উঠিল নৌকায়।
ত্বরা করি খুলে তরী পালাইল ভয়।।
ভজন বলেছে কোথা যাস কুলাঙ্গার।
সবে কয় কোথা যায় শীঘ্র ওরে ধর।।
বড় কর্তা কৃষ্ণদাস অগ্রজ প্রভুর।
বলে ওরে ধরে আন যায় কতদূর।।
এত বলি বড়কর্তা ধাবমান হয়।
মহাপ্রভু এসে তথা অগ্রজে শান্তায়।।
প্রভু বলে দেখ দাদা হ’য়ে আগুয়ান।
একেবারে মরেছে কি? আছে ওর প্রাণ।।
বড়কর্তা দেখে গিয়া নাকে শ্বাস নাই।
কণ্ঠদেশে বামপার্শ্বে ল’ড়ে দেখে তাই।।
মহাপ্রভু এসে চটকার গাছতলা।
দেখে বলে এ দেখি সে হীরামন বালা।।
বসিলেন হীরামনে রাখিয়া সম্মুখে।
রহিলেন মহাপ্রভু উত্তরাভিমুখে।।
প্রভু কহে দেখে হে পোদ্দার মহাশয়।
প্রাণ আছে একেবারে মরা শ’ব নয়।।
বড়কর্তা বলে হরি ব্রজা মরে গেছে।
মরা যে বাঁ’চাতে সে ত’ নাই বেঁচে।।
মরা গরু বাঁচাইল তোর সঙ্গী ব্রজা।
পার যদি হও মরা বাঁচাবার ওঝা।।
রাউৎখামারের লোক মরা ফেলে যায়।
বালা গুষ্ঠি এত বৃদ্ধি পেয়েছে কোথায়।।
প্রভু হরিচাঁদ তবে কহেন অগ্রজে।
এরা যেন মরা ফেলে গেছে কি গরজে।।
একরাত্রে নির্জনেতে বলি হরি হরি।
এ রোগী চিকিৎসা আমি করিবারে পারি।।
কৃষ্ণদাস বলে কর পার যদি ভাই।
রাউৎখামার লোকের কোন দোষ নাই।।
যাও তথা, খাও তথা, তথা কর লভ্য।
তাহারা তোমার বাটী আনে কত দ্রব্য।।
সেই গ্রামে হরিবোলা মতুয়ার দল।
ভকত বাঁচাও ভাই ভক্তবৎসল।।
কিন্তু যদি এ মরা বাঁচাতে নার ভাই।
বালার বালাহী যাবে আর রক্ষা নাই।।
মাতুব্বর চ’তে বালার এত কি আস্পর্ধা।
কৃষ্ণদাস নাম বুঝি শোনে নাই গাধা।।
কার মরা এনে ফেলাইল কার বাড়ী।
বাঁচাতে পার’ত যশ হবে দেশ ভরি।।
যদি বাঁচাতে না পার ব’লে হরি হরি।
বালাদের নামে আমি করব ফৌজদারি।।
প্রভু কহে বড়কর্তা দেখ বিদ্যমান।
একেবারে মরে নাই দেহে আছে প্রাণ।।
নাসাগ্রে ঈষৎমাত্র বহিতেছে শ্বাস।
বাঁচিলে বাঁচিতে পারে হ’তেছে বিশ্বাস।।
কথোপকথনে হ’ল দিবা অবসান।
হেনকালে লক্ষ্মীমাতা এল সেই স্থান।।
মাতা বলে তবে কেন ক’রেছ বিলম্ব।
নিশ্চয় চৈতন্য বালা করেছে এ কর্ম।।
আপনার ঠাকুরালী তথায় বেড়েছে।
পরীক্ষা করার জন্য ইহা করে গেছে।।
প্রভু বলে যাহা হউক সবে যাহ ঘরে।
আমি দেখি চেষ্টা করি ঈশ্বর কি করে।।
সবে গেল প্রভু মাত্র রহিল একেলা।
মরা হীরামন ল’য়ে সেই গাছতলা।।
যামিনীর শেষ যামে সঞ্চারিল প্রাণ।
নীরোগ শরীর হ’ল পূর্ণ শক্তিমান।।
উঠিয়া চরণ ধরি বলে ওহে নাথ।
এ অধমে কৃপা করি কর আত্মসাৎ।।
যেদিন তোমার দেখা পাই মল্লকাঁদি।
পিঞ্জিরা রাউৎখামার পাখি ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুর বলেন, আমি জানি তা সকল।
সে কথায় কাজ নাই হরি হরি বল।।
এমত আমার কর্ম রোগ ভোগ দিয়ে।
সংসার হইতে তোরে নিলাম উঠা’য়ে।।
তোর প্রতি আর কারু থাকিল না দাবি।
মায়াতীত হ’লি, এবে হরিগুণ গা’বি।।
হেথা হ’তে লুকাইয়া যারে বেদভিটে।
তথা হ’তে যাস কল্য অন্য নায় উঠে।।
এখানে থাকিলে তুই জনরব হ’বে।
প্রতিষ্ঠা বাড়িলে মোরে কেহ না ছাড়িবে।।
যুগে যুগে বাঁধা আছি আমি তোর ঠাই।
তোমা আমা একদেহ ভিন্ন ভেদ নাই।।
সংসারের মাঝে তুই কারু দায়ী নাই।
একমাত্র দায়ী রৈলি রমণীর ঠাই।।
যাও বাছা দিন কত করগে সংসার।
শোধ দিয়া এস গিয়া রমণীর ধার।।
জন্মিলে একটি পুত্র তাহার গর্ভেতে।
রমণীর ধার তবে পা’র শোধ হ’তে।।
গোলোক নাথের বাক্য শুনে শান্ত হ’ল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
সভক্তি অন্তরে যেবা করেন শ্রবণ।
ধনে বংশে বৃদ্ধি অন্তে গোলোকে গমন।।
হীরামন দেহে পুনর্জীবন সঞ্চার।
হরি বল কহিছে তারক সরকার।।
হীরামনের স্তব ও পুনঃ রামরূপ দর্শন।
পয়ার
পুনর্বার লুটাইয়া শ্রীনাথ চরণে।
স্তব করে অশ্রুধারা বহে দ্বিনয়নে।।
যে রূপে আমার মন করিলে হরণ।
আর বার সেই রূপ করহ ধারণ।।
পয়ার
পুনর্বার লুটাইয়া শ্রীনাথ চরণে।
স্তব করে অশ্রুধারা বহে দ্বিনয়নে।।
যে রূপে আমার মন করিলে হরণ।
আর বার সেই রূপ করহ ধারণ।।
লঘু ত্রিপদী
তব তত্ত্ব জানে মাত্র দেব শূলপাণি।
আমি অজ্ঞ অসৌভাগ্য কিছুই না জানি।।
তুমি হর্তা তুমি কর্তা সৃষ্টি অধিকারী।
তুমি আদি গুণনিধি ক্ষীরোদবিহারী।।
ক্ষীরোদেতে যে কালেতে ছিলেহে শয়নে।
দেবগণ উচাটন তোমার কারণে।।
দেব সব করে স্তব রাবণের ভয়।
লঙ্কানাথ শঙ্কাতাত করহ অভয়।।
অবনীতে অযোধ্যাতে রামরূপ ধরে।
জনমিলে ক্ষত্রকুলে দশরথ ঘরে।।
সূর্যবংশে চারি অংশে শ্যামল সুন্দর।
দূর্বাদল নীলোৎপল নব জলধর।।
চারুপদ কোকনদ জিনি শতদল।
মীন অক্ষ রোম সূক্ষ্ম ভ্রুযুগ শ্যামল।।
দেহগতি সীতাপতি ভকত বৎসল।
ত্যজিবাস পীতবাস পিন্ধহে বল্কল।।
রক্তকর ধনুঃশর শোভাকরে করে।
রিপু বংশ কর ধ্বংস গিয়া লঙ্কাপুরে।।
নাম বলে ভাসে শিলে সাগর ভিতর।
তব গুণে বাধ্য বনে ভল্লুক বানর।।
পশুগণ অনুক্ষণ রামগুণ গায়।
কি গুণেতে সাথে সাথে কাঁদিয়া বেড়ায়।।
কিমাশ্চার্য্য দয়া ধৈর্য দেখা’লে সকলে।
মিতা বলে গিয়াছিলে চণ্ডালের কোলে।।
ব’লে মিত্র সুপবিত্র সুগ্রীবে করিলে।
ঋষ্যমুখে এ দাসকে প্রেমভক্তি দিলে।।
যে রূপেতে প্রথমেতে ভুলাইলে মন।
সেই রূপে মন সঁপে পবন নন্দন।।
বায়ু ছেলে জিজ্ঞাসিলে কিবা তব নাম।
তার স্থলে বলেছিলে মম নাম রাম।।
বীজ বর্ণ শুনি কর্ণ সদ্য কর্ণ দিয়ে।
রামনাম গুণধাম দিলে শুনাইয়ে।।
পুনঃছলে জিজ্ঞাসিলে কি নাম তোমার।
গুণধাম সেই নাম বল আরবার।।
পুনর্বার সেই নাম বাম কর্ণ মূলে।
যত্ন করি রাবণারি উচ্চৈঃস্বরে বলে।।
তব তত্ত্ব জানে মাত্র দেব শূলপাণি।
আমি অজ্ঞ অসৌভাগ্য কিছুই না জানি।।
তুমি হর্তা তুমি কর্তা সৃষ্টি অধিকারী।
তুমি আদি গুণনিধি ক্ষীরোদবিহারী।।
ক্ষীরোদেতে যে কালেতে ছিলেহে শয়নে।
দেবগণ উচাটন তোমার কারণে।।
দেব সব করে স্তব রাবণের ভয়।
লঙ্কানাথ শঙ্কাতাত করহ অভয়।।
অবনীতে অযোধ্যাতে রামরূপ ধরে।
জনমিলে ক্ষত্রকুলে দশরথ ঘরে।।
সূর্যবংশে চারি অংশে শ্যামল সুন্দর।
দূর্বাদল নীলোৎপল নব জলধর।।
চারুপদ কোকনদ জিনি শতদল।
মীন অক্ষ রোম সূক্ষ্ম ভ্রুযুগ শ্যামল।।
দেহগতি সীতাপতি ভকত বৎসল।
ত্যজিবাস পীতবাস পিন্ধহে বল্কল।।
রক্তকর ধনুঃশর শোভাকরে করে।
রিপু বংশ কর ধ্বংস গিয়া লঙ্কাপুরে।।
নাম বলে ভাসে শিলে সাগর ভিতর।
তব গুণে বাধ্য বনে ভল্লুক বানর।।
পশুগণ অনুক্ষণ রামগুণ গায়।
কি গুণেতে সাথে সাথে কাঁদিয়া বেড়ায়।।
কিমাশ্চার্য্য দয়া ধৈর্য দেখা’লে সকলে।
মিতা বলে গিয়াছিলে চণ্ডালের কোলে।।
ব’লে মিত্র সুপবিত্র সুগ্রীবে করিলে।
ঋষ্যমুখে এ দাসকে প্রেমভক্তি দিলে।।
যে রূপেতে প্রথমেতে ভুলাইলে মন।
সেই রূপে মন সঁপে পবন নন্দন।।
বায়ু ছেলে জিজ্ঞাসিলে কিবা তব নাম।
তার স্থলে বলেছিলে মম নাম রাম।।
বীজ বর্ণ শুনি কর্ণ সদ্য কর্ণ দিয়ে।
রামনাম গুণধাম দিলে শুনাইয়ে।।
পুনঃছলে জিজ্ঞাসিলে কি নাম তোমার।
গুণধাম সেই নাম বল আরবার।।
পুনর্বার সেই নাম বাম কর্ণ মূলে।
যত্ন করি রাবণারি উচ্চৈঃস্বরে বলে।।
যেই রূপ নামরূপ শুনা’লে দাসেরে।
সে রূপেতে মনোরথে উর দয়া করে।।
তুমি রাম ভৃগুরাম বামনাবতার।
দ্বাপরেতে মথুরাতে জনম তোমার।।
নিশিকালে গোপকুলে গেলে নন্দ ঘরে।
বাল্য খেলা গোষ্ঠলীলা ব্রজরাজ পুরে।।
মথুরায় দ্বারকায় লীলা চমৎকার।
ব্রহ্মদেশে হলে শেষে বুদ্ধ অবতার।।
কলিকালে জনমিলে শচীগর্ভমাঝে।
জীব দায় এ ধরায় ভক্তভাব সেজে।।
সার্বভৌম মনোরম দেখে ষড়ভুজ।
রামরূপ সুধাকূপ দেখিলে সে দ্বিজ।।
শ্রীমুরারী বিশ্বহরি রামরূপ দেখে।
সেই রূপ সে স্বরূপ দেখালে দাসেকে।।
এবে লীলে প্রকাশিলে বড়ই অদ্ভুত।
শান্ত দান্ত কৃপাবন্ত যশোমন্ত সুত।।
আমি অতি মুঢ়মতি মরিয়াছিলাম।
ভগবান প্রাণদান এবে পাইলাম।।
কোথা যাব কার হ’ব আর কেহ নাই।
এ বিপদে ও শ্রীপদে দাসে দেহ ঠাই।।
রোগযুক্ত ক’লে মুক্ত পাশ মুক্ত কর।
বিশ্বরূপ অপরূপ রামরূপ ধর।।
যে রূপেতে প্রথমেতে মোহিলে আমায়।
মল্লকাঁদি কাঁদি কাঁদি দেখিনু তোমায়।।
স্তব শুনে ততক্ষণে রামরূপ হ’ল।
ধনু ধরি’ জটাধারী অমনি দাঁড়াল।।
সৌম তনু রম্যজানু করি দরশন।
স্থির নেত্র বায়ু পুত্র হইল তখন।।
নবঘন রূপঘন নিরীক্ষণ করে।
চাতকিনী কুতুকিনী যথা ঘন হেরে।।
রাম হ’য়ে দেখা দিয়ে পুনঃ লুকাইলে।
বতাহত বৃক্ষবৎ মূর্ছিত হইল।।
দয়া করি করে ধরি হীরামনে তোলে।
বলে হীরে কেন ফিরে ভাস অশ্রুজলে।।
আমি তোর তুই মোর কিছু নাহি আন।
তবে কেন হ’লি হেন তুই মোর প্রাণ।।
সঙ্গোপনে হীরামনে প্রভু কন বাণী।
বাছাধন যা এখন থাকিতে যামিনী।।
এ তারক অপারক পীতে এই সুধা।
ভক্তলোকে পিয় সুখে যাবে ভব ক্ষুধা।।
সে রূপেতে মনোরথে উর দয়া করে।।
তুমি রাম ভৃগুরাম বামনাবতার।
দ্বাপরেতে মথুরাতে জনম তোমার।।
নিশিকালে গোপকুলে গেলে নন্দ ঘরে।
বাল্য খেলা গোষ্ঠলীলা ব্রজরাজ পুরে।।
মথুরায় দ্বারকায় লীলা চমৎকার।
ব্রহ্মদেশে হলে শেষে বুদ্ধ অবতার।।
কলিকালে জনমিলে শচীগর্ভমাঝে।
জীব দায় এ ধরায় ভক্তভাব সেজে।।
সার্বভৌম মনোরম দেখে ষড়ভুজ।
রামরূপ সুধাকূপ দেখিলে সে দ্বিজ।।
শ্রীমুরারী বিশ্বহরি রামরূপ দেখে।
সেই রূপ সে স্বরূপ দেখালে দাসেকে।।
এবে লীলে প্রকাশিলে বড়ই অদ্ভুত।
শান্ত দান্ত কৃপাবন্ত যশোমন্ত সুত।।
আমি অতি মুঢ়মতি মরিয়াছিলাম।
ভগবান প্রাণদান এবে পাইলাম।।
কোথা যাব কার হ’ব আর কেহ নাই।
এ বিপদে ও শ্রীপদে দাসে দেহ ঠাই।।
রোগযুক্ত ক’লে মুক্ত পাশ মুক্ত কর।
বিশ্বরূপ অপরূপ রামরূপ ধর।।
যে রূপেতে প্রথমেতে মোহিলে আমায়।
মল্লকাঁদি কাঁদি কাঁদি দেখিনু তোমায়।।
স্তব শুনে ততক্ষণে রামরূপ হ’ল।
ধনু ধরি’ জটাধারী অমনি দাঁড়াল।।
সৌম তনু রম্যজানু করি দরশন।
স্থির নেত্র বায়ু পুত্র হইল তখন।।
নবঘন রূপঘন নিরীক্ষণ করে।
চাতকিনী কুতুকিনী যথা ঘন হেরে।।
রাম হ’য়ে দেখা দিয়ে পুনঃ লুকাইলে।
বতাহত বৃক্ষবৎ মূর্ছিত হইল।।
দয়া করি করে ধরি হীরামনে তোলে।
বলে হীরে কেন ফিরে ভাস অশ্রুজলে।।
আমি তোর তুই মোর কিছু নাহি আন।
তবে কেন হ’লি হেন তুই মোর প্রাণ।।
সঙ্গোপনে হীরামনে প্রভু কন বাণী।
বাছাধন যা এখন থাকিতে যামিনী।।
এ তারক অপারক পীতে এই সুধা।
ভক্তলোকে পিয় সুখে যাবে ভব ক্ষুধা।।
হীরামনের নিজালয়ে গমন।
দীর্ঘ ত্রিপদী
ঠাকুরের বাণী শুনি নৈষ্ঠিকের শিরোমণি
বীররাগে করি বীরদাপ।
রাম রাম রাম বলে ভেসেছে নয়ন জলে
অগাধ সলিলে দিল ঝাঁপ।।
যবে পদ দিল জলে মৃত্তিকা ঠেকিল তলে
পদতরী হ’ল ভাসমান।
বিমানে উড়িতে পারে ডুবেনা অগাধ নীরে
পূর্বরূপ হইল শক্তিমান।।
পূর্বে বেদভিটা যেটা নামজাদে আম ভিটা
তারাচাঁদ মালু দুটি ভাই।
প্রভুদের নিজ জ্ঞাতি সেখানে করে বসতি
ভাই ভাই সম্পর্ক সবাই।।
জলে হ’ল ভাসমান মনে করে অনুমান
জাহিরীতে নাহি প্রয়োজন।
জপ জপ শব্দ করে চলেছে অগাধ নীরে
লোক এলে করে সন্তরণ।।
কভু পদতল জল কভু হয় কটি জল
কখন বা হয় জানু জল।
জলে চলে মহাভাগ বুকে ছিল জলদাগ
জন্মদেশে বিখ্যাত সকল।।
হরে রাম হরে রাম জয় রাম সীতা রাম
অবিরাম গায় নাম গীত।
আমভিটা সেই বাটী প্রভু জ্ঞাতি ভাই দুটি
সে বাটীতে হ’ল উপনীত।।
ব্রাহ্ম মুহূর্ত সময় তারাচাঁদ বের হয়
দাদা বলি মালুকে ডাকিল।
জপ জপ করি নীরে হরিনাম জপ করে
বাড়ীপরে কে যেন উঠিল।।
হীরামনে গিয়া ধরে দু’ভাই সুধায় তারে
বলে কেরে তুই মহাবল।
বল দেখি মন খুলে আজ এই রাত্রিকালে
কি কারণে আলি তাহা বল।।
হীরামনে কহে কথা কি কব মম বারতা
শুন খুল্লতাত তারাচাঁদ।
অঞ্জনা আমার মাতা বানর কিশোরী পিতা
প্রাণদাতা বাবা হরিচাঁদ।।
রামদাস বায়ু পুত্র মহারাজ বালা ক্ষেত্র
অনুচর সুগ্রীব রাজার।
হিয়া নাহি হয় ধৈর্য জ্ঞান নাহি অন্তর্বাহ্য
ত্যাজ্য আর্য্য চৈতন্য বালার।।
কি বলিতে কিবা বলি বুঝিতে নারি সকলি
না জানি জলে কি স্থলে যাই।
হরিচাঁদ রূপরসে দেহ তরী ডুবে ভাসে
ভাটী খেলি আবার উজাই।।
হরিচাঁদ ইচ্ছাময় সকলি তাঁর ইচ্ছায়
না জানি কি ইচ্ছা তাঁর মনে।
সেই ভ্রমাইলে ভ্রমি দেখিতে জনম ভূমি
স্ব-নৌকায় চলেছি দক্ষিণে।।
ঘাসকাটা নায় চড়ি যাব বালাদের বাড়ী
দিন কত আসা যাওয়া সার।
ইচ্ছিল শ্রীহরিচাঁদ করিতে পতিত আবাদ
বালাবাড়ী, বাড়ীও খামার।।
তারাচাঁদ মালুরাম বলে বাছা চিনিলাম
তোরে ল’য়ে হ’ল হুড়াহুড়ি।
তুই ছিলি মরা শব জুটিয়া বালারা সব
তোরে ফেলে যায় অই বাড়ী।।
শব ছিলি এই রাত্রে প্রাণপ্রাপ্ত এইমাত্রে
এ মাহাত্ম্য সে মেজ দাদার।
প্রতিষ্ঠা বাড়িবে বলে তোরে ভাসায়েছে জলে
মনে তোর রাম অবতার।।
হরিচাঁদ রূপনীরে বাছাধন সে পাথারে
একেবারে দিয়াছিল ঝাঁপ।
যাহা কহ তাহা ঠিক শুনিতে যেন বিদিক
রামলীলা ভাবের প্রলাপ।।
দন্ডেক নিশি থাকিতে হীরামন তথা হ’তে
গৃহে যায় এক নায় উঠে।
মল্লকাঁদি গ্রামে এসে খালকূলে নেমে শেষে
রাউৎখামার যায় হেটে।।
হীরামনে দরশনে সকলে আশ্চর্যগণে
হইল হৃদয় প্রফুল্লিত।
রামাগণে বামাস্বরে হুলুধ্বনি সবে করে
জ্ঞাতি বন্ধু সবে পুলকিত।।
হীরামন প্রাণ পান ব্যাধিমুক্ত দেশে যান
শ্রীহরি চরিত্র সুধাধার।
এ দুস্তার ভবার্ণবে হরি-তরী কর সবে
কহে দীন রায় সরকার।।
দীর্ঘ ত্রিপদী
ঠাকুরের বাণী শুনি নৈষ্ঠিকের শিরোমণি
বীররাগে করি বীরদাপ।
রাম রাম রাম বলে ভেসেছে নয়ন জলে
অগাধ সলিলে দিল ঝাঁপ।।
যবে পদ দিল জলে মৃত্তিকা ঠেকিল তলে
পদতরী হ’ল ভাসমান।
বিমানে উড়িতে পারে ডুবেনা অগাধ নীরে
পূর্বরূপ হইল শক্তিমান।।
পূর্বে বেদভিটা যেটা নামজাদে আম ভিটা
তারাচাঁদ মালু দুটি ভাই।
প্রভুদের নিজ জ্ঞাতি সেখানে করে বসতি
ভাই ভাই সম্পর্ক সবাই।।
জলে হ’ল ভাসমান মনে করে অনুমান
জাহিরীতে নাহি প্রয়োজন।
জপ জপ শব্দ করে চলেছে অগাধ নীরে
লোক এলে করে সন্তরণ।।
কভু পদতল জল কভু হয় কটি জল
কখন বা হয় জানু জল।
জলে চলে মহাভাগ বুকে ছিল জলদাগ
জন্মদেশে বিখ্যাত সকল।।
হরে রাম হরে রাম জয় রাম সীতা রাম
অবিরাম গায় নাম গীত।
আমভিটা সেই বাটী প্রভু জ্ঞাতি ভাই দুটি
সে বাটীতে হ’ল উপনীত।।
ব্রাহ্ম মুহূর্ত সময় তারাচাঁদ বের হয়
দাদা বলি মালুকে ডাকিল।
জপ জপ করি নীরে হরিনাম জপ করে
বাড়ীপরে কে যেন উঠিল।।
হীরামনে গিয়া ধরে দু’ভাই সুধায় তারে
বলে কেরে তুই মহাবল।
বল দেখি মন খুলে আজ এই রাত্রিকালে
কি কারণে আলি তাহা বল।।
হীরামনে কহে কথা কি কব মম বারতা
শুন খুল্লতাত তারাচাঁদ।
অঞ্জনা আমার মাতা বানর কিশোরী পিতা
প্রাণদাতা বাবা হরিচাঁদ।।
রামদাস বায়ু পুত্র মহারাজ বালা ক্ষেত্র
অনুচর সুগ্রীব রাজার।
হিয়া নাহি হয় ধৈর্য জ্ঞান নাহি অন্তর্বাহ্য
ত্যাজ্য আর্য্য চৈতন্য বালার।।
কি বলিতে কিবা বলি বুঝিতে নারি সকলি
না জানি জলে কি স্থলে যাই।
হরিচাঁদ রূপরসে দেহ তরী ডুবে ভাসে
ভাটী খেলি আবার উজাই।।
হরিচাঁদ ইচ্ছাময় সকলি তাঁর ইচ্ছায়
না জানি কি ইচ্ছা তাঁর মনে।
সেই ভ্রমাইলে ভ্রমি দেখিতে জনম ভূমি
স্ব-নৌকায় চলেছি দক্ষিণে।।
ঘাসকাটা নায় চড়ি যাব বালাদের বাড়ী
দিন কত আসা যাওয়া সার।
ইচ্ছিল শ্রীহরিচাঁদ করিতে পতিত আবাদ
বালাবাড়ী, বাড়ীও খামার।।
তারাচাঁদ মালুরাম বলে বাছা চিনিলাম
তোরে ল’য়ে হ’ল হুড়াহুড়ি।
তুই ছিলি মরা শব জুটিয়া বালারা সব
তোরে ফেলে যায় অই বাড়ী।।
শব ছিলি এই রাত্রে প্রাণপ্রাপ্ত এইমাত্রে
এ মাহাত্ম্য সে মেজ দাদার।
প্রতিষ্ঠা বাড়িবে বলে তোরে ভাসায়েছে জলে
মনে তোর রাম অবতার।।
হরিচাঁদ রূপনীরে বাছাধন সে পাথারে
একেবারে দিয়াছিল ঝাঁপ।
যাহা কহ তাহা ঠিক শুনিতে যেন বিদিক
রামলীলা ভাবের প্রলাপ।।
দন্ডেক নিশি থাকিতে হীরামন তথা হ’তে
গৃহে যায় এক নায় উঠে।
মল্লকাঁদি গ্রামে এসে খালকূলে নেমে শেষে
রাউৎখামার যায় হেটে।।
হীরামনে দরশনে সকলে আশ্চর্যগণে
হইল হৃদয় প্রফুল্লিত।
রামাগণে বামাস্বরে হুলুধ্বনি সবে করে
জ্ঞাতি বন্ধু সবে পুলকিত।।
হীরামন প্রাণ পান ব্যাধিমুক্ত দেশে যান
শ্রীহরি চরিত্র সুধাধার।
এ দুস্তার ভবার্ণবে হরি-তরী কর সবে
কহে দীন রায় সরকার।।
হীরামনের দেশাগমনে সকলের শ্রীহরির প্রতি ঐশিভাব প্রকাশ ও হীরামনের পুত্রের জন্ম ও মৃত্যু।
পয়ার
হীরামন দরশনে শ্রীচৈতন্য বালা।
কহে হরি ঠাকুরের কি আশ্চর্য লীলা।।
এ কভু সামান্য নহে পুরুষ প্রধান।
এখনে আমার যে হ’তেছে ব্রহ্মজ্ঞান।।
নলিয়া জামালপুরে হয়েছিল বার।
সেই হরি ওঢ়াকাঁদী হ’ল অবতার।।
নলিয়া, যখন বার হইল বিখ্যাত।
মুখের কথায় কত ব্যাধি সেরে যেত।।
তদধিক রূপে এই হরি বর্তমান।
মরা গরু বাঁচে মরা দেহে পায় প্রাণ।।
ইতিপূর্বে বার হ’ল সফলাডাঙ্গায়।
সফলাডাঙ্গার বার হরিচাঁদ পায়।।
হরি এসে হরিচাঁদে আবির্ভূত হ’ল।
মরা হীরামনে হরি তাই সে বাঁচাল।।
নলিয়া যে বার মোর মনে হেন লয়।
সেই বার এসেছিল সফলাডাঙ্গায়।।
তারপর সেই বার হরিচাঁদ পায়।
বেশী দিন থাকে হেন বিশ্বাস না হয়।।
মৃদুভাষে হেসে হেসে হীরামন বলে।
চিনেও চিনিতে নারে দূরদৃষ্টি হ’লে।।
দেশে এসে হীরামন গৃহকর্ম করে।
এক ছেলে হ’ল তার কিছুদিন পরে।।
প্রভু আজ্ঞা নারী ঋণ শোধ হ’লে পরে।
ত্যাজিয়া সকল কার্য হরিনাম করে।।
সবে বলে এ কেন বাঁচিয়া এল দেশে।
মরিলেই ভাল হ’ত এই সর্বনেশে।।
দিবসেতে ঘরে থাকে দ্বার বন্ধ করি।
ঝুঁকি ঝুঁকি গায় গুণ বলে হরি হরি।।
নিশাভাগে থাকে যোগে গিয়া সে শ্মশানে।
কখনে কি করে তাহা কেহ নাহি জানে।।
হিরার রমণী যত মেয়েদিকে কয়।
তোমরা না জান উনি রাত্রে কোথা রয়।।
কোথা যায় নিশিতে না থাকে মোর কাছে।
কার সঙ্গে যেন ওর গুপ্ত প্রেম আছে।।
সব নারী বলে হীরামনের নারীকে।
তুই কেন দেখিস না কোথা গিয়া থাকে।।
যখন উঠিয়া যায় টের যদি পাস।
অলক্ষিতে তুই ওর সাথে সাথে যা’স।।
তাই শুনি সেই ধনি জাগরীতা রয়।
যখনে সে হীরামন শ্মশানেতে যায়।।
লুকাইয়া পিছে পিছে সঙ্গে সঙ্গে গেল।
দেখিলেন পতি গিয়া শ্মশানে বসিল।।
গৃহে এসে সেই নারী সকলে বলেছে।
শ্মশানেতে থাকে ওরে ভূতে পাইয়াছে।।
শেষ রাত্রে হীরা এসে ডাকে ঘনে ঘনে।
তার নারী জাগরীতা ডাক নাহি শুনে।।
ঘুচাইতে দ্বারে হীরামন মারে লাথি।
তবু দ্বার ছাড়িল না সেই দুষ্টামতি।।
হীরামন শান্ত মন র’ল বাহিরিতে।
সে ধনির ছিল এক বালক কোলেতে।।
সকালে হইল ব্যাধি দিন গত হয়।
শ্বাসবদ্ধ মৃত্যু হ’ল সন্ধ্যার সময়।।
সবে বলে হীরামনে পাগলামি কর।
মরিয়াছে পুত্র তব পা’র যদি সার।।
নহে এই ছেলে ল’য়ে ওঢ়াকাঁদী যাও।
যে মতে বাঁচিলে তুমি সে মতে বাঁচাও।।
সে কথা শুনিয়া হীরামন গৃহে গেল।
গৃহদ্বার বন্ধ করি যোগেতে বসিল।।
কেমনে সারিব পুত্র মনেতে ভেবেছে।
যোগবলে প্রাণ দিব বাঁচে কিনা বাঁচে।।
এত বলি হরি বলি প্রহরেক পরে।
ছেলের জীবন দিতে মাথা চেপে ধরে।।
হীরামনের রমণী কহিছে তাহারে।
মরা ছেলে রাখ কেন ফেলে এস ওরে।।
মুখ কাছে মুখ দিয়া দেহে দিবে প্রাণ।
বালকের মুখ যবে করিছে ব্যাদন।।
তাহা দেখি সেই ধনি করিছে চিৎকার।
মরা খায় মরা খায় একি ব্যবহার।।
আমাদের উহারে যে পাইয়াছে ভূতে।
মরা ছেলে হা করিয়া লেগেছিল খেতে।।
এতেক শুনিয়া সাধুর ক্রোধ উপজিল।
বালক ত্যাজিয়া তবে বাহিরে আসিল।।
বালকে লইয়া সবে ফেলাইয়া দিল।
ক্রোধেতে চৈতন্যবালা কহিতে লাগিল।।
আমরা ভেবেছি সবে বেঁচে এল হীরে।
হরিচাঁদ বাঁচায়েছে হরিনাম জোরে।।
তাহা কভু নহে ওরে ভূতে পাইয়াছে।
নিশা কিংবা ব্রহ্মদৈত্য জীবন দিয়াছে।।
নাহি করে গৃহকার্য মানুষ এ নয়।
মানুষ হইলে গৃহকার্যে মন লয়।।
হীরার যে রীতিনীতি সব গেল বোঝা।
ভূত ছাড়াইতে আন খণ্ডজ্ঞানী ওঝা।।
হরিপ্রেম বিকারেতে হীরামন রোগী।
কবি কহে ভব ব্যস্ত এ রোগের লাগি।।
পয়ার
হীরামন দরশনে শ্রীচৈতন্য বালা।
কহে হরি ঠাকুরের কি আশ্চর্য লীলা।।
এ কভু সামান্য নহে পুরুষ প্রধান।
এখনে আমার যে হ’তেছে ব্রহ্মজ্ঞান।।
নলিয়া জামালপুরে হয়েছিল বার।
সেই হরি ওঢ়াকাঁদী হ’ল অবতার।।
নলিয়া, যখন বার হইল বিখ্যাত।
মুখের কথায় কত ব্যাধি সেরে যেত।।
তদধিক রূপে এই হরি বর্তমান।
মরা গরু বাঁচে মরা দেহে পায় প্রাণ।।
ইতিপূর্বে বার হ’ল সফলাডাঙ্গায়।
সফলাডাঙ্গার বার হরিচাঁদ পায়।।
হরি এসে হরিচাঁদে আবির্ভূত হ’ল।
মরা হীরামনে হরি তাই সে বাঁচাল।।
নলিয়া যে বার মোর মনে হেন লয়।
সেই বার এসেছিল সফলাডাঙ্গায়।।
তারপর সেই বার হরিচাঁদ পায়।
বেশী দিন থাকে হেন বিশ্বাস না হয়।।
মৃদুভাষে হেসে হেসে হীরামন বলে।
চিনেও চিনিতে নারে দূরদৃষ্টি হ’লে।।
দেশে এসে হীরামন গৃহকর্ম করে।
এক ছেলে হ’ল তার কিছুদিন পরে।।
প্রভু আজ্ঞা নারী ঋণ শোধ হ’লে পরে।
ত্যাজিয়া সকল কার্য হরিনাম করে।।
সবে বলে এ কেন বাঁচিয়া এল দেশে।
মরিলেই ভাল হ’ত এই সর্বনেশে।।
দিবসেতে ঘরে থাকে দ্বার বন্ধ করি।
ঝুঁকি ঝুঁকি গায় গুণ বলে হরি হরি।।
নিশাভাগে থাকে যোগে গিয়া সে শ্মশানে।
কখনে কি করে তাহা কেহ নাহি জানে।।
হিরার রমণী যত মেয়েদিকে কয়।
তোমরা না জান উনি রাত্রে কোথা রয়।।
কোথা যায় নিশিতে না থাকে মোর কাছে।
কার সঙ্গে যেন ওর গুপ্ত প্রেম আছে।।
সব নারী বলে হীরামনের নারীকে।
তুই কেন দেখিস না কোথা গিয়া থাকে।।
যখন উঠিয়া যায় টের যদি পাস।
অলক্ষিতে তুই ওর সাথে সাথে যা’স।।
তাই শুনি সেই ধনি জাগরীতা রয়।
যখনে সে হীরামন শ্মশানেতে যায়।।
লুকাইয়া পিছে পিছে সঙ্গে সঙ্গে গেল।
দেখিলেন পতি গিয়া শ্মশানে বসিল।।
গৃহে এসে সেই নারী সকলে বলেছে।
শ্মশানেতে থাকে ওরে ভূতে পাইয়াছে।।
শেষ রাত্রে হীরা এসে ডাকে ঘনে ঘনে।
তার নারী জাগরীতা ডাক নাহি শুনে।।
ঘুচাইতে দ্বারে হীরামন মারে লাথি।
তবু দ্বার ছাড়িল না সেই দুষ্টামতি।।
হীরামন শান্ত মন র’ল বাহিরিতে।
সে ধনির ছিল এক বালক কোলেতে।।
সকালে হইল ব্যাধি দিন গত হয়।
শ্বাসবদ্ধ মৃত্যু হ’ল সন্ধ্যার সময়।।
সবে বলে হীরামনে পাগলামি কর।
মরিয়াছে পুত্র তব পা’র যদি সার।।
নহে এই ছেলে ল’য়ে ওঢ়াকাঁদী যাও।
যে মতে বাঁচিলে তুমি সে মতে বাঁচাও।।
সে কথা শুনিয়া হীরামন গৃহে গেল।
গৃহদ্বার বন্ধ করি যোগেতে বসিল।।
কেমনে সারিব পুত্র মনেতে ভেবেছে।
যোগবলে প্রাণ দিব বাঁচে কিনা বাঁচে।।
এত বলি হরি বলি প্রহরেক পরে।
ছেলের জীবন দিতে মাথা চেপে ধরে।।
হীরামনের রমণী কহিছে তাহারে।
মরা ছেলে রাখ কেন ফেলে এস ওরে।।
মুখ কাছে মুখ দিয়া দেহে দিবে প্রাণ।
বালকের মুখ যবে করিছে ব্যাদন।।
তাহা দেখি সেই ধনি করিছে চিৎকার।
মরা খায় মরা খায় একি ব্যবহার।।
আমাদের উহারে যে পাইয়াছে ভূতে।
মরা ছেলে হা করিয়া লেগেছিল খেতে।।
এতেক শুনিয়া সাধুর ক্রোধ উপজিল।
বালক ত্যাজিয়া তবে বাহিরে আসিল।।
বালকে লইয়া সবে ফেলাইয়া দিল।
ক্রোধেতে চৈতন্যবালা কহিতে লাগিল।।
আমরা ভেবেছি সবে বেঁচে এল হীরে।
হরিচাঁদ বাঁচায়েছে হরিনাম জোরে।।
তাহা কভু নহে ওরে ভূতে পাইয়াছে।
নিশা কিংবা ব্রহ্মদৈত্য জীবন দিয়াছে।।
নাহি করে গৃহকার্য মানুষ এ নয়।
মানুষ হইলে গৃহকার্যে মন লয়।।
হীরার যে রীতিনীতি সব গেল বোঝা।
ভূত ছাড়াইতে আন খণ্ডজ্ঞানী ওঝা।।
হরিপ্রেম বিকারেতে হীরামন রোগী।
কবি কহে ভব ব্যস্ত এ রোগের লাগি।।
গোস্বামী হীরামনের প্রতি কালাচাঁদ ফকিরের অত্যাচারের বিবরণ।
পয়ার
সাহাপুর মধ্যেতে আঁধারকোটা গ্রাম।
সেখানে ফকির আছে কালাচাঁদ নাম।।
সে ফকির পরিচয় কহিব এখন।
নাম কালাচাঁদ নমঃশূদ্রের নন্দন।।
বাওয়াল করিত গিয়া বাওয়ালীর সনে।
শিক্ষা তার মুসলমান ফকিরের স্থানে।।
লক্ষ্মীকালা ফকির সে ব্রাহ্মণের ছেলে।
বাদায় থাকিত সেও ফকিরামী নিয়ে।।
তাহার নিকটে শিক্ষা করে কালাচাঁদ।
ফকিরামী শিখে বাদা করেন আবাদ।।
আদি যে ফকির সেও মুসলমান ছিল।
সে ফকির হইতে ইহারা শিক্ষা নিল।।
চকে গিয়া দিত গাজী কালুর দোহাই।
চকে চকে বনে বনে নামিত সবাই।।
কালীর দোহাই দিত মনসা পূজিত।
বরকোত বিবি, লক্ষ্মীকালাকে ডাকিত।।
মাদার মুরসিদ বলি ছাড়িত জিগীর।
খোদার ফকির মুই আল্লাহ ফকির।।
আল্লা আলী হজরত আর লক্ষ্মীকালা।
হিন্দু ছেলে দিত গলে তছমীর মালা।।
হেলেল্লা হেলেল্লা বলে হইত আকুল।
হাতে ছিল লক্ষ্মীকালা দত্ত এক রুল।।
চকে গিয়া লোকে সুন্দরী কাঠ কাটিত।
রুল দিয়া গাছে এক আঘাত করিত।।
সেই আঘাতের শব্দ যতদূরে যেত।
তাহার মধ্যেতে সব সুন্দরী ছেদিত।।
দূরে গিয়া একজনে শব্দ শুনিত। (একেকজনে)
চারিদিকে চারি জন দাঁড়ায়ে রহিত।।
যতদূর শব্দ করি উঠিত সে রুল।
তাহার মধ্যেতে নাহি থাকিত শার্দূল।।
এই ধর্ম ছিল তার লোকমুখে শুনি।
হিন্দুধর্ম কিয়দংশ সকল যাবনি।।
শুকর কচ্ছপ নাহি করিত ভোজন।
মেষ অজা পেজ রসুন কুকুড়া ভক্ষণ।।
কচ্ছপ বরাহ মাংস বলিত হারাম।
রুলের আঘাতে করে রোগের আরাম।।
জ্ঞাতিগণে ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
এই ফকিরকে এনে সার এ পাগলা।।
লোক পাঠাইয়া সেই ফকির আনিল।
লোক সঙ্গে করিয়া সে ফকির আসিল।।
বাটীর উপরে যবে উঠিল ফকির।
হক আল্লা বলিয়া সে ছাড়িল জিগীর।।
যথা ছিল হীরামন সেইখানে যায়।
রুলখানা ধরি হীরামনকে দেখায়।।
এক এক বার রুল ঊর্ধ্বেতে ফেলায়।
ফেলাইয়া শূন্য হতে পুনঃ ধরি লয়।।
লোফা লোফী করে রুল হীরামন আগে।
দর্প করি হীরামনে কহে রাগে রাগে।।
হারে রে পাগলা কেন কর পাগলাই।
তোরে সারিবারে এল লক্ষ্মীকালা সাঁই।।
রুলাঘাতে করিব যে পাগলাই দূর।
দেখিব কেমন তুই পাইলি ঠাকুর।।
মম বাক্য না রাখিস করিস বাড়াবাড়ি।
পাগলামি করিলে মারিব রুলের বাড়ী।।
সারিবি কি না সারিবি বলরে এখন।
শুনিবি কি না শুনিবি আমার বচন।।
দৃকপাত তাতে নাহি করে হীরামন।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম সংকীর্তন।।
প্রেমোন্মত্ত হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
ফকিরের পানে হীরে ফিরে ফিরে চায়।।
ফকির কহিছে তুই আয় হীরামন।
বাহিরে আসিয়া বাছা লওরে আসন।।
তাহা শুনি হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
আসন পাতিয়া এসে বসিল তথায়।।
ফকির তখন রুল হস্তেতে করিয়া।
মাটিতে আঘাত করে হক আল্লা বলিয়া।।
পুনঃ পুনঃ করে রুল মাটিতে আঘাত।
হীরামন তাতে নাহি করে দৃষ্টিপাত।।
ফকির বলেন তুই এসেছিস কেরে।
হকের বাজারে মোরে পরিচয় দেরে।।
কথা শুনি হীরামন চাহে একদৃষ্টে।
ফকির রুলের বাড়ী মারে তার পৃষ্ঠে।।
তাহাতেও হীরামন কিছুই না বলে।
পুনশ্চঃ আঘাত করে বাহুসন্ধি স্থলে।।
তাহাতেও হীরামন মৃদু মৃদু হাসে।
স্থির হ’য়ে থাকে সাধু আসনেতে বসে।।
ফকির সে হীরামনে ওঠ ওঠ কয়।
অমনি সে হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।।
ফকির যখনে বলে বয় বয় বয়।
হীরামন আসনে বসেন সে সময়।।
ফকির বলেন তবে সবারে ডাকিয়া।
দেখ সবে গেছে এর পাগল সারিয়া।।
যাহা কহি তাহা করে ব্যাধিমুক্ত হ’ল।
বিদায় করহ মোরে বিপদ ঘুচিল।।
তা শুনি চৈতন্য বালা ফকিরকে কয়।
অদ্য থাক কল্য মোরা করিব বিদায়।।
সংসারে কার্য হীরে করিবে যখন।
তোমাকে বিদায় মোরা করিব তখন।।
ফকির বলিল হীরে দণ্ডবৎ কর।
আসন ছাড়িয়া বাছা উঠে যারে ঘরে।।
পরদিন ফকিরকে বলে সব বালা।
পাগল সেরেছে নাকি দেখ লক্ষ্মীকালা।।
হীরামনে ডাক দিয়া আনহ প্রত্যক্ষে।
আরোগ্য হ’য়েছে কিনা দেখহ পরীক্ষে।।
হীরামনে ডাক দিয়া তখনে আনিল।
আসন উপরে হীরামন বার দিল।।
ফকির বলেছে বাছা কহ শুনি কথা।
হেট মুণ্ডে রহে সাধু নাহি তুলে মাথা।।
মাথা নাহি তুলে সাধু শ্বাস ছাড়ে দীর্ঘ।
সবে বলে কই হ’ল রোগের আরোগ্য।।
রুষিয়া উঠিল তবে ফকির বর্বর।
বড়শী পোড়ায়ে ধরে গ্রীবার উপর।।
সারিয়া না সারিস করিস অপযশ।
এরূপে যাতনা দেয় সপ্তম দিবস।।
ফকিরকে কহে সবে যদি নাহি পার।
তবে আর কেন মিছে পরিশ্রম কর।।
ফকির একথা শুনি দড়ি পাকাইল।
পিটমোড়া দিয়ে হীরামনকে বাঁধিল।।
দল কাটা বেকী অস্ত্র পোড়ায়ে আগুনে।
গ্রীবার উপরে অম্নি ধরিল তখনে।।
কিছু নাহি কহে হীরামন মৃদু হাসে।
ফকির কহিছে ইহা সহে কই মানুষে।।
ইহাকে সারিতে আমি হইলাম ত্যাক্ত।
সারা বড় কষ্ট হ’ল দৃষ্টি বড় শক্ত।।
ইহাকে যে ধরেছে করিব তারে ধ্বংস।
খাওয়াইতে হবে কাঁচা কচ্ছপের মাংস।।
চেষ্টা করি কাঠা আন আর আন ঢালো।
তারে খাওয়াইব এবে যে এসে ধরিল।।
আনিয়া কচ্ছপ মাংস তাহাকে খাওয়ায়।
হাত পেতে এনে মাংস গ্রাসে গ্রাসে খায়।।
তবু হীরামন নাহি হয়েন সদ্ভাব।
ফকির বলেছে এযে বড় অসম্ভব।।
পুনঃ পৃষ্ঠমোড়া দিয়া দুবাহু বাঁধিল।
হস্তদ্বয় বাঁধি তার একত্র করিল।।
সূক্ষ্ম তন্তু দিয়া তার বাঁধিল যে কর।
দুই দুই আঙ্গুল করিয়া একতর।।
ওঝা বলে ছেড়ে যাবি কিনা যাবি বোঝ।
এত বলি আঙ্গুলির মধ্যে মারে গোঁজ।।
খর্জূর কন্তক তবে চারিটি আনিয়া।
নখতলে মাংস মধ্যে দিল বিঁধাইয়া।।
ভাল রজ্জু দিয়া দিল পিঠ মোড়া বাঁধা।
নাহি তাতে হা হা হুঁ হুঁ নাহি তাতে কাঁদা।।
কেহ যদি বলে কেন এত কষ্ট কর।
ওঝা বলে তোমরা তা বুঝিবারে নার।।
হা হা হুঁ হুঁ নাহি করে পাও নাহি দিশে।
যার দৃষ্টি তার কষ্ট ওর কষ্ট কিসে।।
হীরাতে কি হীরা আছে সে হীরা এ নয়।
তা হ’লে কি হারামের কাঁচা মাংস খায়।।
পুনর্বার বেকী অস্ত্র আগুনে পোড়ায়।
পোড়া ঘা উপরে যবে ধরিবারে যায়।।
এমন সময় উঠি হুঙ্কার করিয়া।
গাত্রমোড়া দিয়া দড়া ফেলিল ছিঁড়িয়া।।
হাত ঝাড়া দিলে কাঁটা খসিয়া পড়িল।
আঙ্গুল বন্ধন হাত মোড়ায়ে ছিঁড়িল।।
স্বাভাবিক ভাবে যে শরীর তার ছিল।
ভয়ঙ্কর দেহ তার দিগুণ বাড়িল।।
বেকী অস্ত্র কাড়িয়া লইল অতি কোপে।
আরক্তলোচন ক্রোধে ওষ্ঠাধর কাঁপে।।
দাঁড়াইল হীরামন অপরূপ দেহ।
যে দেখিল সে হইল জ্ঞান হারা মোহ।।
ভূমিকম্প প্রায় বাড়ী লড়িয়া উঠিল।
স্ত্রী পুরুষ নাহি হুশ ঢলিয়া পড়িল।।
ছিল সে চৈতন্য বালা পীড়ির উপরে।
তার দিকে ধেয়ে যায় বেকী অস্ত্র ধরে।।
কতদিনে শাস্তিভোগী মনে বড় কোপ।
ক্রোধভরে চৈতন্যরে মারে এক কোপ।।
সে কোপ লাগিল গিয়া চালের উপরে।
চাল কাটি খাম্বা কাটি লাগে তার শিরে।।
চেঁচায়ে চৈতন্য বলে রক্ষা করে কেবা।
রাখরে রাখরে ওরে কালাচাঁদ বাবা।।
কিয়দংশ কোপ লাগে চৈতন্যরে শিরে।
রক্ত বয় মোহ যায় বাক্য নাহি সরে।।
মোহপ্রাপ্ত ফকির সে চৈতন্য পাইল।
বাবারে চাচারে বলে চেঁচায়ে দৌড়িল।।
ফকিরের প্রতি পরে হইল ধাবমান।
ফেলিয়া মারিল সেই বেকী অস্ত্র খান।।
পাও কাটে ফকিরের বেকী অস্ত্র পশি।
দৌড়িয়া ফকির গেল চারি পাঁচ রসি।।
রুধিরের ধারা বহে পাও গেল কাটি।
অজ্ঞান হইয়া ভূমে করে ছটফটি।।
এল এল বলে ওঝা ওঠে আর পড়ে।
কৃষকেরা বলে শালা দূর পাতি নেড়ে।।
দলে দলে কৃষাণ রয়েছে মাঠ জুড়ে।
বসে বলে দূর দূর শালা পাতি নেড়ে।।
ফকির তাড়ায়ে পড়ে গৃহেতে প্রস্থান।
হীরামনে দেখে সবে ভয়ে কম্পমান।।
সবে চিত ভয়ে ভিত ভূতবৎ রয়।
সবে ভাবে যেন কবে প্রমাদ ঘটায়।।
সাধুজনে বলে এযে কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।
এ জনার মন রহিয়াছে হরিচাঁদ।।
অক্রুর গুরুচরণ আর কোটিশ্বর।
তারা বলে এ মানুষ রুদ্র অবতার।।
মন মানুষেতে মন হ’য়েছে ইহার।
সামান্য মানুষ নহে উগ্র কলেবর।।
যে ভাবে ঘটেছে সেই ভাবেতে থাকুক।
কেহ কিছু না বলিও যা ইচ্ছা করুক।।
বিনয় চৈতন্য বলে শুন ওরে বাপ।
অপরাধী তোর ঠাই করিয়াছি পাপ।।
শুনি কথা হীরামন মৃদুভাষে বলে।
লাফিয়া প্রস্রাব কর কমলের দলে।।
হারে কটা ভেক বেটা কর কট্ কট্।
ষট্ পদে সুধাস্বাদে তুমি কর হট্।।
এইভাবে কিছুদিন নিজালয় থেকে।
চলিলেন হীরামন উত্তরাভিমুখে।।
হরি হরি হরি হরি হরি হরি বল।
হরি বলি রসনা শ্রীহরিধামে চল।।
পয়ার
সাহাপুর মধ্যেতে আঁধারকোটা গ্রাম।
সেখানে ফকির আছে কালাচাঁদ নাম।।
সে ফকির পরিচয় কহিব এখন।
নাম কালাচাঁদ নমঃশূদ্রের নন্দন।।
বাওয়াল করিত গিয়া বাওয়ালীর সনে।
শিক্ষা তার মুসলমান ফকিরের স্থানে।।
লক্ষ্মীকালা ফকির সে ব্রাহ্মণের ছেলে।
বাদায় থাকিত সেও ফকিরামী নিয়ে।।
তাহার নিকটে শিক্ষা করে কালাচাঁদ।
ফকিরামী শিখে বাদা করেন আবাদ।।
আদি যে ফকির সেও মুসলমান ছিল।
সে ফকির হইতে ইহারা শিক্ষা নিল।।
চকে গিয়া দিত গাজী কালুর দোহাই।
চকে চকে বনে বনে নামিত সবাই।।
কালীর দোহাই দিত মনসা পূজিত।
বরকোত বিবি, লক্ষ্মীকালাকে ডাকিত।।
মাদার মুরসিদ বলি ছাড়িত জিগীর।
খোদার ফকির মুই আল্লাহ ফকির।।
আল্লা আলী হজরত আর লক্ষ্মীকালা।
হিন্দু ছেলে দিত গলে তছমীর মালা।।
হেলেল্লা হেলেল্লা বলে হইত আকুল।
হাতে ছিল লক্ষ্মীকালা দত্ত এক রুল।।
চকে গিয়া লোকে সুন্দরী কাঠ কাটিত।
রুল দিয়া গাছে এক আঘাত করিত।।
সেই আঘাতের শব্দ যতদূরে যেত।
তাহার মধ্যেতে সব সুন্দরী ছেদিত।।
দূরে গিয়া একজনে শব্দ শুনিত। (একেকজনে)
চারিদিকে চারি জন দাঁড়ায়ে রহিত।।
যতদূর শব্দ করি উঠিত সে রুল।
তাহার মধ্যেতে নাহি থাকিত শার্দূল।।
এই ধর্ম ছিল তার লোকমুখে শুনি।
হিন্দুধর্ম কিয়দংশ সকল যাবনি।।
শুকর কচ্ছপ নাহি করিত ভোজন।
মেষ অজা পেজ রসুন কুকুড়া ভক্ষণ।।
কচ্ছপ বরাহ মাংস বলিত হারাম।
রুলের আঘাতে করে রোগের আরাম।।
জ্ঞাতিগণে ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
এই ফকিরকে এনে সার এ পাগলা।।
লোক পাঠাইয়া সেই ফকির আনিল।
লোক সঙ্গে করিয়া সে ফকির আসিল।।
বাটীর উপরে যবে উঠিল ফকির।
হক আল্লা বলিয়া সে ছাড়িল জিগীর।।
যথা ছিল হীরামন সেইখানে যায়।
রুলখানা ধরি হীরামনকে দেখায়।।
এক এক বার রুল ঊর্ধ্বেতে ফেলায়।
ফেলাইয়া শূন্য হতে পুনঃ ধরি লয়।।
লোফা লোফী করে রুল হীরামন আগে।
দর্প করি হীরামনে কহে রাগে রাগে।।
হারে রে পাগলা কেন কর পাগলাই।
তোরে সারিবারে এল লক্ষ্মীকালা সাঁই।।
রুলাঘাতে করিব যে পাগলাই দূর।
দেখিব কেমন তুই পাইলি ঠাকুর।।
মম বাক্য না রাখিস করিস বাড়াবাড়ি।
পাগলামি করিলে মারিব রুলের বাড়ী।।
সারিবি কি না সারিবি বলরে এখন।
শুনিবি কি না শুনিবি আমার বচন।।
দৃকপাত তাতে নাহি করে হীরামন।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম সংকীর্তন।।
প্রেমোন্মত্ত হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
ফকিরের পানে হীরে ফিরে ফিরে চায়।।
ফকির কহিছে তুই আয় হীরামন।
বাহিরে আসিয়া বাছা লওরে আসন।।
তাহা শুনি হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
আসন পাতিয়া এসে বসিল তথায়।।
ফকির তখন রুল হস্তেতে করিয়া।
মাটিতে আঘাত করে হক আল্লা বলিয়া।।
পুনঃ পুনঃ করে রুল মাটিতে আঘাত।
হীরামন তাতে নাহি করে দৃষ্টিপাত।।
ফকির বলেন তুই এসেছিস কেরে।
হকের বাজারে মোরে পরিচয় দেরে।।
কথা শুনি হীরামন চাহে একদৃষ্টে।
ফকির রুলের বাড়ী মারে তার পৃষ্ঠে।।
তাহাতেও হীরামন কিছুই না বলে।
পুনশ্চঃ আঘাত করে বাহুসন্ধি স্থলে।।
তাহাতেও হীরামন মৃদু মৃদু হাসে।
স্থির হ’য়ে থাকে সাধু আসনেতে বসে।।
ফকির সে হীরামনে ওঠ ওঠ কয়।
অমনি সে হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।।
ফকির যখনে বলে বয় বয় বয়।
হীরামন আসনে বসেন সে সময়।।
ফকির বলেন তবে সবারে ডাকিয়া।
দেখ সবে গেছে এর পাগল সারিয়া।।
যাহা কহি তাহা করে ব্যাধিমুক্ত হ’ল।
বিদায় করহ মোরে বিপদ ঘুচিল।।
তা শুনি চৈতন্য বালা ফকিরকে কয়।
অদ্য থাক কল্য মোরা করিব বিদায়।।
সংসারে কার্য হীরে করিবে যখন।
তোমাকে বিদায় মোরা করিব তখন।।
ফকির বলিল হীরে দণ্ডবৎ কর।
আসন ছাড়িয়া বাছা উঠে যারে ঘরে।।
পরদিন ফকিরকে বলে সব বালা।
পাগল সেরেছে নাকি দেখ লক্ষ্মীকালা।।
হীরামনে ডাক দিয়া আনহ প্রত্যক্ষে।
আরোগ্য হ’য়েছে কিনা দেখহ পরীক্ষে।।
হীরামনে ডাক দিয়া তখনে আনিল।
আসন উপরে হীরামন বার দিল।।
ফকির বলেছে বাছা কহ শুনি কথা।
হেট মুণ্ডে রহে সাধু নাহি তুলে মাথা।।
মাথা নাহি তুলে সাধু শ্বাস ছাড়ে দীর্ঘ।
সবে বলে কই হ’ল রোগের আরোগ্য।।
রুষিয়া উঠিল তবে ফকির বর্বর।
বড়শী পোড়ায়ে ধরে গ্রীবার উপর।।
সারিয়া না সারিস করিস অপযশ।
এরূপে যাতনা দেয় সপ্তম দিবস।।
ফকিরকে কহে সবে যদি নাহি পার।
তবে আর কেন মিছে পরিশ্রম কর।।
ফকির একথা শুনি দড়ি পাকাইল।
পিটমোড়া দিয়ে হীরামনকে বাঁধিল।।
দল কাটা বেকী অস্ত্র পোড়ায়ে আগুনে।
গ্রীবার উপরে অম্নি ধরিল তখনে।।
কিছু নাহি কহে হীরামন মৃদু হাসে।
ফকির কহিছে ইহা সহে কই মানুষে।।
ইহাকে সারিতে আমি হইলাম ত্যাক্ত।
সারা বড় কষ্ট হ’ল দৃষ্টি বড় শক্ত।।
ইহাকে যে ধরেছে করিব তারে ধ্বংস।
খাওয়াইতে হবে কাঁচা কচ্ছপের মাংস।।
চেষ্টা করি কাঠা আন আর আন ঢালো।
তারে খাওয়াইব এবে যে এসে ধরিল।।
আনিয়া কচ্ছপ মাংস তাহাকে খাওয়ায়।
হাত পেতে এনে মাংস গ্রাসে গ্রাসে খায়।।
তবু হীরামন নাহি হয়েন সদ্ভাব।
ফকির বলেছে এযে বড় অসম্ভব।।
পুনঃ পৃষ্ঠমোড়া দিয়া দুবাহু বাঁধিল।
হস্তদ্বয় বাঁধি তার একত্র করিল।।
সূক্ষ্ম তন্তু দিয়া তার বাঁধিল যে কর।
দুই দুই আঙ্গুল করিয়া একতর।।
ওঝা বলে ছেড়ে যাবি কিনা যাবি বোঝ।
এত বলি আঙ্গুলির মধ্যে মারে গোঁজ।।
খর্জূর কন্তক তবে চারিটি আনিয়া।
নখতলে মাংস মধ্যে দিল বিঁধাইয়া।।
ভাল রজ্জু দিয়া দিল পিঠ মোড়া বাঁধা।
নাহি তাতে হা হা হুঁ হুঁ নাহি তাতে কাঁদা।।
কেহ যদি বলে কেন এত কষ্ট কর।
ওঝা বলে তোমরা তা বুঝিবারে নার।।
হা হা হুঁ হুঁ নাহি করে পাও নাহি দিশে।
যার দৃষ্টি তার কষ্ট ওর কষ্ট কিসে।।
হীরাতে কি হীরা আছে সে হীরা এ নয়।
তা হ’লে কি হারামের কাঁচা মাংস খায়।।
পুনর্বার বেকী অস্ত্র আগুনে পোড়ায়।
পোড়া ঘা উপরে যবে ধরিবারে যায়।।
এমন সময় উঠি হুঙ্কার করিয়া।
গাত্রমোড়া দিয়া দড়া ফেলিল ছিঁড়িয়া।।
হাত ঝাড়া দিলে কাঁটা খসিয়া পড়িল।
আঙ্গুল বন্ধন হাত মোড়ায়ে ছিঁড়িল।।
স্বাভাবিক ভাবে যে শরীর তার ছিল।
ভয়ঙ্কর দেহ তার দিগুণ বাড়িল।।
বেকী অস্ত্র কাড়িয়া লইল অতি কোপে।
আরক্তলোচন ক্রোধে ওষ্ঠাধর কাঁপে।।
দাঁড়াইল হীরামন অপরূপ দেহ।
যে দেখিল সে হইল জ্ঞান হারা মোহ।।
ভূমিকম্প প্রায় বাড়ী লড়িয়া উঠিল।
স্ত্রী পুরুষ নাহি হুশ ঢলিয়া পড়িল।।
ছিল সে চৈতন্য বালা পীড়ির উপরে।
তার দিকে ধেয়ে যায় বেকী অস্ত্র ধরে।।
কতদিনে শাস্তিভোগী মনে বড় কোপ।
ক্রোধভরে চৈতন্যরে মারে এক কোপ।।
সে কোপ লাগিল গিয়া চালের উপরে।
চাল কাটি খাম্বা কাটি লাগে তার শিরে।।
চেঁচায়ে চৈতন্য বলে রক্ষা করে কেবা।
রাখরে রাখরে ওরে কালাচাঁদ বাবা।।
কিয়দংশ কোপ লাগে চৈতন্যরে শিরে।
রক্ত বয় মোহ যায় বাক্য নাহি সরে।।
মোহপ্রাপ্ত ফকির সে চৈতন্য পাইল।
বাবারে চাচারে বলে চেঁচায়ে দৌড়িল।।
ফকিরের প্রতি পরে হইল ধাবমান।
ফেলিয়া মারিল সেই বেকী অস্ত্র খান।।
পাও কাটে ফকিরের বেকী অস্ত্র পশি।
দৌড়িয়া ফকির গেল চারি পাঁচ রসি।।
রুধিরের ধারা বহে পাও গেল কাটি।
অজ্ঞান হইয়া ভূমে করে ছটফটি।।
এল এল বলে ওঝা ওঠে আর পড়ে।
কৃষকেরা বলে শালা দূর পাতি নেড়ে।।
দলে দলে কৃষাণ রয়েছে মাঠ জুড়ে।
বসে বলে দূর দূর শালা পাতি নেড়ে।।
ফকির তাড়ায়ে পড়ে গৃহেতে প্রস্থান।
হীরামনে দেখে সবে ভয়ে কম্পমান।।
সবে চিত ভয়ে ভিত ভূতবৎ রয়।
সবে ভাবে যেন কবে প্রমাদ ঘটায়।।
সাধুজনে বলে এযে কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।
এ জনার মন রহিয়াছে হরিচাঁদ।।
অক্রুর গুরুচরণ আর কোটিশ্বর।
তারা বলে এ মানুষ রুদ্র অবতার।।
মন মানুষেতে মন হ’য়েছে ইহার।
সামান্য মানুষ নহে উগ্র কলেবর।।
যে ভাবে ঘটেছে সেই ভাবেতে থাকুক।
কেহ কিছু না বলিও যা ইচ্ছা করুক।।
বিনয় চৈতন্য বলে শুন ওরে বাপ।
অপরাধী তোর ঠাই করিয়াছি পাপ।।
শুনি কথা হীরামন মৃদুভাষে বলে।
লাফিয়া প্রস্রাব কর কমলের দলে।।
হারে কটা ভেক বেটা কর কট্ কট্।
ষট্ পদে সুধাস্বাদে তুমি কর হট্।।
এইভাবে কিছুদিন নিজালয় থেকে।
চলিলেন হীরামন উত্তরাভিমুখে।।
হরি হরি হরি হরি হরি হরি বল।
হরি বলি রসনা শ্রীহরিধামে চল।।
গোস্বামীর শ্রীধামে গমন।
পয়ার
সোজা সুজি চলিলেন উত্তার নয়নে।
পথ কি বিপথ তাহা কিছুই না জানে।।
বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে থেকে কিছুক্ষণ।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম উচ্চারণ।।
পরিধান বস্ত্র ফেলে কিঞ্চিৎ ছিঁড়িয়া।
চলিলেন মাত্র এক লেংটি পরিয়া।।
সম্মুখে বাঁধিল অগ্রে বিল খাগাইল।
মল্লবিল হাটঝাড়া, তালতলা বিল।।
বেথুড়িয়া ঘৃতকাঁদি বিল খাল যত।
কতক হাঁটিয়া পার সাঁতরেতে কত।।
জপিতে গাইতে হরে কৃষ্ণ রাম নাম।
উপনীত ওঢ়াকাঁদি প্রভুর শ্রীধাম।।
বীররসে রাগাত্মিকা ভাবের উদয়।
দেখি প্রভু হীরামনে ক্রোড়েতে বসায়।।
হীরামনে পুকুরের ঘাটে ল’য়ে পরে।
শ্রীকরেতে শ্রীনাথ শ্রীঅঙ্গ ধৌত করে।।
কর্দম শৈবাল অঙ্গে লেগে রহিয়াছে।
কমল-কণ্টক অঙ্গ ক্ষত করিয়াছে।।
ধৌত করি হস্ত ধরি গৃহেতে লইল।
কর্পূর মিশ্রিত তৈল অঙ্গে মাখাইল।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে ওরে হীরামন।
কেমনে করিলি সহ্য যবন পীড়ন।।
এতকষ্ট দিল দুষ্ট পাপিষ্ঠ যবন।
এত মান্য নেড়েরে করিলি কি কারণ।।
ঘৃণা কি হ’ল না কিছু ওরে বাছাধন।
কচ্ছপের কাঁচা মাংস করিতে ভোজন।।
হীরামন বলে মন সকলইত জান।
জেনে শুনে তবে আর জিজ্ঞাসিলে কেন।।
সকলে কেবল কহে ফকির ফকির।
হক আল্লা বলে নেড়ে ছাড়িল জিগির।।
আমি ভাবি হক আল্লা বলিল মুখেতে।
হক ছাড়া না হক সে করিবে কি মতে।।
পোড়াইয়া দিল অঙ্গ তাহা করি সহ্য।
তবু ভাবি এই বুঝি করে হক কার্য।।
পোড়া অস্ত্র ধরে গ্রীবা মেরুদণ্ড পর।
তবু আমি ভাবি এত আল্লার নফর।।
আল্লার ফকির বলে আগে মানিলাম।
ঠক মানিলাম শুনে হক আল্লা নাম।।
আল্লা রূপা রাধা আল্লা কৃষ্ণ আহ্লাদিনী।
প্রণয় বিকৃতি রাধা কৃষ্ণ প্রণয়নী।।
‘কামবীজ কৃষ্ণ’ ‘কাম গায়ত্রী রাধিকা’।
কৃষ্ণমন্ত্রবীজ রাধা প্রধানা নায়িকা।।
কৃষ্ণ বীজ কলিম রহিম বীজ শক্তি।
‘ক’ কারে ‘ল’ কার ‘ই’ কার চন্দ্রবিন্দু যুক্তি।।
‘ক’ ‘ল’ ‘ই’ বিন্দু আর বিসর্গ অনুস্বার।
‘ম’ কারে অনুস্বার ইহা কৈলে একতর।।
তাতে হয় কৃষ্ণবীজ বীজরূপা রাধা।
কলিম শক্তির বীজ শ্রীকৃষ্ণ আরাধা।।
পয়ার
সোজা সুজি চলিলেন উত্তার নয়নে।
পথ কি বিপথ তাহা কিছুই না জানে।।
বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে থেকে কিছুক্ষণ।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম উচ্চারণ।।
পরিধান বস্ত্র ফেলে কিঞ্চিৎ ছিঁড়িয়া।
চলিলেন মাত্র এক লেংটি পরিয়া।।
সম্মুখে বাঁধিল অগ্রে বিল খাগাইল।
মল্লবিল হাটঝাড়া, তালতলা বিল।।
বেথুড়িয়া ঘৃতকাঁদি বিল খাল যত।
কতক হাঁটিয়া পার সাঁতরেতে কত।।
জপিতে গাইতে হরে কৃষ্ণ রাম নাম।
উপনীত ওঢ়াকাঁদি প্রভুর শ্রীধাম।।
বীররসে রাগাত্মিকা ভাবের উদয়।
দেখি প্রভু হীরামনে ক্রোড়েতে বসায়।।
হীরামনে পুকুরের ঘাটে ল’য়ে পরে।
শ্রীকরেতে শ্রীনাথ শ্রীঅঙ্গ ধৌত করে।।
কর্দম শৈবাল অঙ্গে লেগে রহিয়াছে।
কমল-কণ্টক অঙ্গ ক্ষত করিয়াছে।।
ধৌত করি হস্ত ধরি গৃহেতে লইল।
কর্পূর মিশ্রিত তৈল অঙ্গে মাখাইল।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে ওরে হীরামন।
কেমনে করিলি সহ্য যবন পীড়ন।।
এতকষ্ট দিল দুষ্ট পাপিষ্ঠ যবন।
এত মান্য নেড়েরে করিলি কি কারণ।।
ঘৃণা কি হ’ল না কিছু ওরে বাছাধন।
কচ্ছপের কাঁচা মাংস করিতে ভোজন।।
হীরামন বলে মন সকলইত জান।
জেনে শুনে তবে আর জিজ্ঞাসিলে কেন।।
সকলে কেবল কহে ফকির ফকির।
হক আল্লা বলে নেড়ে ছাড়িল জিগির।।
আমি ভাবি হক আল্লা বলিল মুখেতে।
হক ছাড়া না হক সে করিবে কি মতে।।
পোড়াইয়া দিল অঙ্গ তাহা করি সহ্য।
তবু ভাবি এই বুঝি করে হক কার্য।।
পোড়া অস্ত্র ধরে গ্রীবা মেরুদণ্ড পর।
তবু আমি ভাবি এত আল্লার নফর।।
আল্লার ফকির বলে আগে মানিলাম।
ঠক মানিলাম শুনে হক আল্লা নাম।।
আল্লা রূপা রাধা আল্লা কৃষ্ণ আহ্লাদিনী।
প্রণয় বিকৃতি রাধা কৃষ্ণ প্রণয়নী।।
‘কামবীজ কৃষ্ণ’ ‘কাম গায়ত্রী রাধিকা’।
কৃষ্ণমন্ত্রবীজ রাধা প্রধানা নায়িকা।।
কৃষ্ণ বীজ কলিম রহিম বীজ শক্তি।
‘ক’ কারে ‘ল’ কার ‘ই’ কার চন্দ্রবিন্দু যুক্তি।।
‘ক’ ‘ল’ ‘ই’ বিন্দু আর বিসর্গ অনুস্বার।
‘ম’ কারে অনুস্বার ইহা কৈলে একতর।।
তাতে হয় কৃষ্ণবীজ বীজরূপা রাধা।
কলিম শক্তির বীজ শ্রীকৃষ্ণ আরাধা।।
শ্লোক
রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহলাদিনী শক্তিহ্রস্ব-
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদৌ গতৌ
তৌ, চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা,
রাধাভাব দ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।
রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহলাদিনী শক্তিহ্রস্ব-
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদৌ গতৌ
তৌ, চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা,
রাধাভাব দ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।
পয়ার
সেই’ত হলাদিনী শক্তি সবাকার হক।
সেই হক তুমি হরি সবার জনক।।
যার মনে যেই মত সেই পথে ধায়।
যেভাবে যেভাবে ডাকে, ডাকে হে তোমায়।।
তাহাতেই মানিলাম তুমি আল্লা হক।
তোমাকে ডাকিল ভাবি তোমার সেবক।।
তাই ভাবি মানিয়া অমান্য কিসে করি।
যাহা কহে তাহা করি থাকি ধৈর্য ধরি।।
এ বুঝি হকের কার্য হয় ফকিরের।
তাই ভেবে কাঁচা মাংস খাই কচ্ছপের।।
প্রভু কহে তবে কেন মারিলিরে বাপ।
মানিয়া না মানিলে ত’ হতে পারে পাপ।।
হীরামন বলে পাপ পুণ্য নাহি জানি।
আমি জানি তুমি হর্তা কর্তা রঘুমণি।।
সে বলে যে পাগলারে খাওয়ারে হারাম।
তার বাক্য শুনে মনে জাগে সীতারাম।।
হারাম শুনিয়া রসনায় বাড়ে ক্ষুদা।
দিল মাংস খাইলাম সুধাধিক সুধা।।
পিটমোড়া দিয়া টেনে বাঁধে দুই কর।
বাঁধিয়া মারিল গোঁজা নখের ভিতর।।
এই মত শাস্তি দিল যবনের বেটা।
নখতলে বিঁধাইল খেজুরের কাঁটা।।
তথাপি ভাবিনু যেই বলে আল্লা হক।
সে মেরেছে এতে নয় খ’সে যাবে নখ।।
বেকী দা পোড়ায়ে যবে আনে পুনর্বার।
এ দেহে তখনে সহ্য না হইল আর।।
এ সময় তোমাকে দেখিনু গদাধর।
গদা ধরি দাঁড়াইলা মস্তক উপর।।
ক্রোধে কাঁপে ওষ্ঠাধর আজ্ঞা দিলে মোরে।
মার ফকিরেরে মার চৈতন্য বালারে।।
তব শ্রীমুখের আজ্ঞা যদি পায় হীরে।
ব্রহ্মাণ্ড ডুবা’তে পারে গোষ্পদের নীরে।।
ত্রেতাযুগে তব শ্রীমুখের আজ্ঞা পাই।
আঠার বর্ষের পথ এক লম্ফে যাই।।
আনিনু গন্ধমাদন তব কৃপাগুণে।
কপি তনু ধরি হনু ভানুকে শ্রবণে।।
ব্রাহ্মণ অগস্ত্য মুনি তব কৃপালেশে।
সপ্ত সমুদ্রের জল খাইল গণ্ডূষে।।
চন্দ্র সূর্য শূন্যে চলে অচল সচল।
বাসুকিরে দিলে শিরে ধরা ধরা বল।।
মম শিরে দাঁড়াইয়া আজ্ঞা দিলে তাই।
যবনে মানিস কেন ওতে কিছু নাই।।
তব পাদপদ্ম দৃষ্টি করি দয়াময়।
ঝাঁকি দিলে কণ্টক বন্ধন খ’সে যায়।।
কোপ দৃষ্টে কটা ভেক পানেতে চাহিয়া।
কোপ দিলে ভেক বেটা পড়িল শুইয়া।।
ঈষৎ আঘাত মাত্র লাগিল মাথায়।
লাগিল সামান্য কোপ ফকিরের পায়।।
মারিতে দিলেনা প্রভু তুমি কৈলে মানা।
মারিতে আমার মনে হ’ল বড় ঘৃণা।।
সকল তোমার খেলা কি খেলা খেলাও।
করিয়া করাও রঙ্গ মারিয়া মারাও।।
মহাপ্রভু বলে আর কহিতে হবে না।
জানি সব তবু ইচ্ছা তোর মুখে শুনা।।
বাছা তোর অঙ্গ ধৌত করেছি যখন।
বাহু নখ ব্যাথা মম ঘুচেছে তখন।।
পোড়া অস্ত্রে অঙ্গ পুড়ে করে কৃষ্ণবর্ণ।
চেয়ে দেখ মম অঙ্গে সেই সব চিহ্ন।।
তাহা দেখি হীরামন কেঁদে ছাড়ে হাই।
এই জন্য আমি কোন কষ্ট পাই নাই।।
হীরামন বলে আজ্ঞা কর শ্রীনিবাস।
যবনেরে সবংশেতে করিব বিনাশ।।
প্রভু বলে তোর কিছু হবে না করিতে।
স্বকর্মে হইবে ধ্বংস আপন পাপেতে।।
মম প্রাণাধিক তুই উত্তম পুরুষ।
পরাধীন নহ বাছা খাসের মানুষ।।
যথা তথা আছ বাছা তথা আমি আছি।
তোর কাছে বাছা আমি বিক্রিত হয়েছি।।
ত্রেতাযুগে বিভীষণে বলে ভগবান।
সাধুর জীবন মৃত্যু উভয় সমান।।
অমনি বাহির হ’ল বিবর্ত পাগল।
অনুক্ষণ মহাভাবে থাকেন বিহ্বল।।
অদ্ভুত করুণ হাস্য রসেতে বিভোলা।
কভু থাকে গৃহেতে কখন বৃক্ষতলা।।
কভু থাকে শ্মশানে কখন থাকে জলে।
কভু থাকে বনে কভু ধান্য ভূমি আ’লে।।
কখন বসিয়ে থাকে কখন শুইয়ে।
অবিরাম করে নাম ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে।।
যেচে দিলে কিছু খায় নৈলে অনাহার।
অন্ন ব্রহ্ম জ্ঞান নাহি জাতির বিচার।।
প্রখর রৌদ্র বর্ষণে নাহি ছায়া ছত্র।
শীতে গ্রীষ্মে সমভাব নাহি পাখা বস্ত্র।।
কখন উলঙ্গ কভু পরে মাত্র লেংটি।
বিল খাল নদ নদী পার হয় হাঁটী।।
ভাদ্রমাসে মধুমতি বানস্রোত বয়।
হিল্লোল কল্লোল করে দেখে লাগে ভয়।।
সেই জলে হীরামন হেটে পার হয়।
তরঙ্গ উঠিলে মাত্র জানু ডুবে যায়।।
কভু বিল মধ্যে দিয়া হেটে পার হয়।
কভু বক্ষ ডুবে কভু সাতারিয়া যায়।।
জলে ভাসে হীরামন হংসের আকার।
কেহ বলে গোঁসাই উঠহে নৌকাপর।।
ধরিতে পারেনা কেহ বলেন গোঁসাই।
কার নৌকা বাহিব নিজের খানা বাই।।
এইভাবে গোস্বামীর বিহার বিরাজ।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
ফকিরের শেষ বিবরণ।
পয়ার
ফকির বাওয়ালে গিয়া রুল বাজাইত।
রুল শব্দে ব্যাঘ্র স্তব্দ বাওয়াল করিত।।
হীরামনে শাস্তি দিয়া গেল বা’য়ালেতে।
পারিল না চক মধ্যে লোক নামাইতে।।
গাছেতে আঘাত করে ধরে সেই রুল।
শব্দ নাহি হয় ক্রোধে হুংকারে শার্দূল।।
কাঠ কাটিবারে নারে আইল ফিরিয়ে।
দেশে এসে রহিল সে ব্যাধিযুক্ত হ’য়ে।।
দেখিলে সে ফকিরেরে নাহি মানে লোকে।
রোগ না সারিতে পারে কেহ নাহি ডাকে।।
হীরামনে মেরে হইয়াছে মহাপাপী।
রোগে ভোগে ক্রমে ক্রমে জনমিল হাপী।।
প্লীহা হ’য়ে ক্রমে হ’ল প্লীহা আমরেখী।
গণ্ডস্থল খসে প’ল জিহ্বা লকলকি।।
রস পৈত্তিকের রোগে হাতে ঘা হইয়ে।
আঙ্গুলি খসিয়া প’ড়ে গেল সে মরিয়ে।।
একেবারে ফকিরের হইল নির্বংশ।
বাতি দিতে না রহিল পরিবার ধ্বংস।।
কেহ কেহ বলে ভাই দেখরে সকল।
হীরামনে হিংসা করে ধ’রেছে কি ফল।।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।
সাধু হিংসা যে করে তাহার মুণ্ডে বাজ।।
পয়ার
ফকির বাওয়ালে গিয়া রুল বাজাইত।
রুল শব্দে ব্যাঘ্র স্তব্দ বাওয়াল করিত।।
হীরামনে শাস্তি দিয়া গেল বা’য়ালেতে।
পারিল না চক মধ্যে লোক নামাইতে।।
গাছেতে আঘাত করে ধরে সেই রুল।
শব্দ নাহি হয় ক্রোধে হুংকারে শার্দূল।।
কাঠ কাটিবারে নারে আইল ফিরিয়ে।
দেশে এসে রহিল সে ব্যাধিযুক্ত হ’য়ে।।
দেখিলে সে ফকিরেরে নাহি মানে লোকে।
রোগ না সারিতে পারে কেহ নাহি ডাকে।।
হীরামনে মেরে হইয়াছে মহাপাপী।
রোগে ভোগে ক্রমে ক্রমে জনমিল হাপী।।
প্লীহা হ’য়ে ক্রমে হ’ল প্লীহা আমরেখী।
গণ্ডস্থল খসে প’ল জিহ্বা লকলকি।।
রস পৈত্তিকের রোগে হাতে ঘা হইয়ে।
আঙ্গুলি খসিয়া প’ড়ে গেল সে মরিয়ে।।
একেবারে ফকিরের হইল নির্বংশ।
বাতি দিতে না রহিল পরিবার ধ্বংস।।
কেহ কেহ বলে ভাই দেখরে সকল।
হীরামনে হিংসা করে ধ’রেছে কি ফল।।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।
সাধু হিংসা যে করে তাহার মুণ্ডে বাজ।।
মধ্যখণ্ড
দ্বিতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
[embed]https://youtu.be/0jwKpt4MwBM[/embed]জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
মহা সংকীর্তনে শমনাবির্ভাব
পয়ার
ঠাকুরের আগমন রাউৎখামারে।
হরি সংকীর্তন হয় প্রতি ঘরে ঘরে।।
প্রভু সঙ্গে ফিরে ভক্ত সকল সময়।
হাসে কাঁদে নাচে গায় প্রফুল্ল হৃদয়।।
ওঢ়াকাঁদি হ’তে যান রাউৎখামার।
মাস পক্ষ সপ্তাহ থাকিয়া যান ঘর।।
প্রভু অল্প সময় থাকেন নিজ ঘর।
বেশী থাকে মল্লকাঁদি রাউৎখামার।।
মল্লকাঁদি মৃত্যুঞ্জয় ভক্ত শিরোমণি।
কাশীশ্বরী নাম ধরে তাহার গৃহিণী।।
তাহার সেবায় বাধ্য প্রভু অহর্নিশি।
প্রভু সেবা কার্য করে যেন সেবাদাসী।।
দুই তিন দিন কিংবা সপ্তাহ পর্যন্ত।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনে থাকেন শান্তি-কান্ত।।
মল্লকাঁদি রাউৎখামার দুই গ্রামে।
থাকিতেন যতদিন সদামত্ত প্রেমে।।
যে দিন থাকিত ঠাকুর যা’র আলয়।
তাহার হইত চিত্ত প্রেমানন্দময়।।
আন কথা আন শব্দ না ছিল কেবল।
ঘরে ঘরে পরস্পরে সুধা হরিবোল।।
কৃষিকার্য কৃষকেরা করে দলে দলে।
সতত সবাই মুখে হরি হরি বলে।।
গৃহকার্য সমাধা করিত দিবসেতে।
প্রভুর নিকট যেত সন্ধ্যার অগ্রেতে।।
যে গৃহেতে ঠাকুরের ভোজন হইত।
হইত লোকের ঘটা দুই তিন শত।।
কৃষ্ণকথা হরিনাম সংকীর্তন রঙ্গে।
সারারাত্রি কাটাইত ঠাকুরের সঙ্গে।।
এক ঠাই হ’য়ে লোক দুই তিন শত।
নাম সংকীর্তন রঙ্গে রাত্রি কাটাইত।।
এই মত নাম গান হইত যে স্থান।
কেমনে যামিনী গত না থাকিত জ্ঞান।।
কখন হইত ভানু উদিত গগণে।
ভাবে মত্ত তাহা না জানিত কোন জনে।।
খেয়েছে কি না খেয়েছে তাহা মনে নাই।
চৈতন্য হইয়া বলে দেও দেও খাই।।
সময় সময় হেন হইত উতলা।
কেহ বলে ভাইরে ঘুচিল ভব জ্বালা।।
কেহ বলে পেয়েছিরে মনের মানুষ।
কেহ বা হুঁশেতে বলে কেহ বা বিহুঁশ।।
গড়াগড়ি পড়াপড়ি জড়াজড়ি হয়।
কেহ কার গায় পড়ে কেহ বা ধরায়।।
ঢলাঢলি ফেলাফেলি কোলাকোলি হয়।
ধরাধরি করি কেহ কাহারে ফেলায়।।
কে বলে পড়িয়াছি আর উঠা নাই।
পড়িয়াছি ভব কূপে তুলে নেরে ভাই।।
কেহ বলে কি শুনালি কহিলি কিরূপ।
হরি প্রেম বাজারে কি আছে ভবকূপ।।
কেহ বলে কি কহিলি হারাইলি দিশে।
এসেছে দয়াল হরি ভব কূপ কিসে।।
বীররসে কেহ করে বীরত্ব প্রকাশ।
কেহ বলে শমনের লেগেছে তরাস।।
কেহ বলে ওরে ভাই আমি যে শমন।
মম ত্রাস নাই তার সার্থক জীবন।।
কেহ বা প্রলাপ করে হইয়া পুলক।
কেহ বলে কিসে তোর জনম সার্থক।।
এতবলি কেহ ধরে শমনের চুল।
আজরে শমন তোরে করিব নির্মূল।।
সে জন কহিছে ভাই মেরনা আমারে।
কি দোষ করেছি আমি তোদের গোচরে।।
যে জন করয় পাপ তারে দেই সাজা।
পবিত্র চরিত্র যার তারে করি পূজা।।
কোন জন বলে জম কি কহিলি কথা।
পতিতপাবন এল পাপ আছে কোথা।।
তুই না করিতি যম পাপীর তাড়ন।
তেঁই তোরে বেঁধেছিল লঙ্কার রাবণ।।
রাবণ মারিয়া তোরে যে করে উদ্ধার।
সেই প্রভু হরিচাঁদ দয়াল অবতার।।
যে হরি করেছে তোর এত উপকার।
তার উপকার কিবা করিলি এবার।।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ হয়েছে প্রকাশ।
পাপ তাপ দূরে গেল তিমির বিনাশ।।
হরিনামে জয়ডঙ্কা বেজেছে সংসারে।
এ দেশে পাতকী নাই নিবি তুই কারে।।
কহিছে শমন যেবা করে হরিনাম।
তাহার শ্রীপদে মম অনন্ত প্রণাম।।
গিয়াছে আমার গর্ব মেরনারে ভাই।
কি দোষ করেছি আমি হরিভক্ত ঠাই।।
এসেছে দয়াল হরি বলা’য়েছে হরি।
তোমাদের স্পর্শ হেতু হরিনাম করি।।
উপকারী হই আমি অপকারী কিসে।
হরিভক্ত হয় মানুষ আমার তরাসে।।
হরিভক্ত হয়ে কেন ধর মম চুল।
আমি হই হরিপদ ভজনের মূল।।
মম ডরে সবে করে সাধন ভজন।
হরিভক্ত রক্ষাকারী আমি একজন।।
যে জন প্রভুর ভক্ত যুগেতে যুগেতে।
অহৈতুকী হরিভক্ত বিনা আকাংখ্যাতে।।
ব্রহ্মত্ব ইন্দ্রত্ব পদ তুচ্ছ তার আগে।
আছি কিনা আছি আমি মনেও না জাগে।।
তার সাক্ষী শুন ভাই পাণ্ডব গীতায়।
কুন্তী যে প্রার্থনা করে শ্রীকৃষ্ণের পায়।।
শ্লোক
স্বকর্মফলনির্দিষ্টাং যাং যাং যোনীং ব্রজাম্যহম্।
তস্যাং তস্যাং হৃষীকেশ ত্বয়ার্ভক্তির্দৃঢ়াস্ত্ত মে।।
পয়ার
কলিরাজ্যে পাপ কার্যে সবে হ’ত বশ।
আমার ভয়েতে কেহ না করে সাহস।।
আমি যদি রাজ কার্যে না থাকিরে ভাই।
হরিভক্ত চূর্ণ হ’ত পাপীদের ঠাই।।
এনেছি তুলসী দল মিশ্রিত চন্দন।
ছেড়ে দেরে পূজি হরিচাঁদের চরণ।।
হরিভক্ত সঙ্গে অদ্য হইব মিলন।
করিব মধুর হরি নাম সংকীর্তন।।
সবে বলে যম এসে কীর্তনে মাতিল।
শমনের প্রতি ভাই হরি হরি বলি।।
অপিচ বৃদ্ধার বাচনিক ও মৃত্যু কন্যার আবির্ভাব
পয়ার
এ হেন কীর্তন হয় মৃত্যুঞ্জয় বাড়ী।
দৈবে কোথা হতে এসে নাচে এক বুড়ি।।
সে কহিছে যমভগ্নি আমি মৃত্যু কন্যে।
এসেছি দয়াল বাবা দেখিবার জন্যে।।
কর্ণেতে কলম দিয়া যমের মহুরী।
সংকীর্তনে নৃত্য করে বলে হরি হরি।।
দেখিব দয়াল হরি দু’নয়ন ভরি।
মুখে বলে হরি হরি হরি হরি হরি।।
বৃন্দাবন রাউৎখামার মল্লকাঁদি।
নবদ্বীপ ওঢ়াকাঁদি করজোড়ে বন্দি।।
মহাভাবে এইরূপ প্রলাপাদি হয়।
তার মধ্যে দুইজন উঠিয়া দাঁড়ায়।।
তারা কহে মোরা দোঁহে শমনের দূত।
সান্দীপানি মুনিবংশ ব্রাহ্মণের সুত।।
আর এক মেয়ে নাচে হ’য়ে প্রেম স্ফূর্তি।
বলে আমি যম ভার্যা নাম মোর মূর্তি।।
যমপুরী শূন্য করি আসি পুরিশুদ্ধ।
আমরা পূজিব হরিচাঁদ পাদপদ্ম।।
শূন্যে থেকে দৈববাণী হইল দৈবাৎ।
আবির্ভাবে হরিপদে করি প্রণিপাত।।
কমলে পূজিব হরি শ্রীপদ কমল।
প্রেমানন্দে তোরা সবে হরি হরি বল।।
রাউৎখামার মল্লকাঁদি দুই গ্রাম।
এই মত মত্ত হ’য়ে করে হরিনাম।।
ক্রমে বন্যা বেগে চলে হ’ল ধন্য ধন্য।
উঁচু নীচু ভেদ নাই দেশ পরিপূর্ণ।।
দিবা রাত্রি গত হয় হ’য়ে জ্ঞানশূন্য।
কীর্তন ছাড়িয়া লোক পাইল চৈতন্য।।
আয়োজন দশ বিশ জনের রন্ধন।
শতেক দ্বিশত লোকে করিল ভোজন।।
ঘরে কিংবা বাহিরে কি ঘাটে আর পথে।
হরি বল হরি বল সবার মুখেতে।।
মনোভৃঙ্গে মধুপায়ী শ্রীহরিপাদাব্জে।
পিপাসু তারকচন্দ্র কবি রসরাজে।।
ভক্ত দশরথ বৈরাগীর উপাখ্যান
পয়ার
সাধুসুত দশরথ উপাধি বৈরাগী।
রাউৎখামারবাসী মহা অনুরাগী।।
প্রভু যবে লীলা খেলা করে এই মতে।
এ সময় দশরথ প্রেমে যায় মেতে।।
প্রভুর সঙ্গেতে ফিরে সেই দশরথ।
হইলেন প্রভুর প্রিয় পরম ভকত।।
প্রভু স্থানে আসে লোক হ’য়ে ব্যাধিযুক্ত।
প্রভুর আজ্ঞায় তারা হয় ব্যাধিমুক্ত।।
তাহা দেখি মনে দুঃখী দশরথ ভক্ত।
রোগাভক্ত প্রভুকে করয় বড় ত্যক্ত।।
মনোদুঃখে দশরথ গিয়া প্রভুস্থানে।
করজোড়ে নিবেদিল প্রভুর চরণে।।
বহু লোক রোগযুক্ত হ’য়ে বহু দেশে।
রোগমুক্তি পাইতে তোমার ঠাই আসে।।
আত্মসুখী রোগাভক্ত ব্যাধিমুক্তে তুষ্ট।
তাহাতে আমার মনে হয় বড় কষ্ট।।
আমার মনের ইচ্ছা যত লোক রোগী।
সবাকার রোগ ল’য়ে আমি একা ভোগী।।
ওহে দয়াময় হরি আজ্ঞা কর তাই।
সবাকার রোগ ল’য়ে একা কষ্ট পাই।।
রোগী না থাকিলে ভবে কেহ আসিবেনা।
তোমাকে ওরূপ করে ত্যাক্ত করিবেনা।।
অহৈতুক ভক্তিমান ভক্ত আছে যারা।
প্রেমের পিপাসু হ’য়ে আসিবেক তারা।।
সেই সঙ্গে হ’বে সুখে প্রেম আলাপন।
দয়া করি বল নৈলে ত্যজিব জীবন।।
প্রভু বলে দশরথ একি কথা কও।
সংসারের রোগ কি উঠায়ে নিতে চাও।।
কর্মক্ষেত্র সংসারেতে কর্ম মহাবল।
সকলেই পায় কর্ম অনুযায়ী ফল।।
তবে তোর বাঞ্ছাহেতু দিব তোরে রোগ।
বার বছরের পরে হ’বে তোর ভোগ।।
পাইয়া প্রভুর আজ্ঞা হইল সন্তুষ্ট।
বার বছরের পরে হ’ল তার কুষ্ঠ।।
ঠাকুর বলেন বাছা আর কিবা চাও।
সংসার ছাড়িয়া এবে ভিক্ষা করে খাও।।
কতদিনে এইভাবে ভিক্ষায় প্রবৃত্ত।
আজ্ঞামতে করে নিল অযাচক বৃত্ত।।
একদা ঠাকুর তারে বলিল গোপনে।
ভিক্ষার্থে বেড়াও বাছা যেই যেই স্থানে।।
চাহিয়া কহিয়া ভিক্ষা করনা কখন।
হেঁটে যেতে সেধে দিলে করিও গ্রহণ।।
তাই ল’য়ে সন্ধ্যাকালে নৌকায় আসিও।
তাহাই রন্ধন করি একবেলা খেও।।
বর্ষা আর শরৎ হেমন্ত গত হ’লে।
পদব্রজে ভিক্ষা মেগে খাইও সেকালে।।
বেড়াইও পদব্রজে ভিক্ষার নিমিত্ত।
যাচিয়া না লইও এ অযাচক বৃত্ত।।
বাকবন্ধ করিয়া থাকিবা ছয়মাস।
মারিলেও কিছু নাহি করিও প্রকাশ।।
রাত্রিতে থাকিও এক গৃহস্থ আলয়।
বাহিরে থাকিও এক কন্থা দিয়া গায়।।
একমাত্র ডোর আর একটি কপিন।
খুলিও না পরিয়া থাকিবা রাত্রিদিন।।
যে ডোর কপিন কন্থা করিবা ধারণ।
অন্য বস্ত্র কন্থা না পরিবা কদাচন।।
ছয়মাস গত হ’লে দিবসে বেড়াইও।
ভাবের ভাবুক হ’লে তার বাড়ী যেও।।
নিশিতে থাকিয়া তার সঙ্গে বল কথা।
তাহা ভিন্ন অন্য কথা না কহিও কোথা।।
দশরথ বলে যাহা ‘চাই দিলে তাই’।
প্রভু বলে ‘আমি তোর বাসনা পুরাই’।।
তোর যে ভাবনা আছে বহুদিন হ’তে।
ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধি পারিলে ভাবিতে।।
যে যাহা ভাবনা করে ঠাকুরের স্থান।
অবশ্য অভীষ্ট পূর্ণ করে ভগবান।।
মোর ঠাই যেই ইচ্ছা করে সেই জন।
আমি তা জানিতে পারি সকল কারণ।।
যে যাহা প্রার্থনা করে এসে মম ঠাই।
সেই গীত আমি তার সাথে সাথে গাই।।
কর্মকর্তা ফলভোগে না হ’য়ে কি যায়।
সুকর্ম দুষ্কর্ম ফল অবশ্যই হয়।।
তা না হ’লে ঈশ্বরের ব্যবস্থা থাকেনা।
কিন্তু দৈবে সাধুসঙ্গ পায় যেই জনা।।
তার কাটে কর্মসূত্র সাধুর কৃপায়।
কর্মপাশ মুক্ত সেই দৈব ভাগ্যে হয়।।
নিঃস্বার্থ ভাবেতে যেই পর উপকারী।
অকামনা শুদ্ধ প্রেম তারে ব্যাখ্যা করি।।
আত্মসুখে কর্ম করে তাকে বলি কাম।
পরসুখে কর্ম করে ধরে প্রেম নাম।।
মম কষ্ট ভেবে মম সুখের নিমিত্তে।
তব ইচ্ছা সদা পর উপকার অর্থে।।
শ্লোক
আলোচ্য সর্ব্বশাস্ত্রাণি বিচার্য চ পুনঃ পুন।
ইদমের সুনিস্পন্নং ধ্যেয়ো নারায়ণঃ সদা।।
পয়ার
ভাগবত তুমি তাহা জানিলাম সত্য।
তোমার প্রেমেতে আমি হইনু বিক্রীত।।
সর্বত্যাগী সর্বরোগী সর্বভোগী যেই।
মাধুর্যের পাত্র মহাভাগবত সেই।।
সর্ব ত্যাগ করে বাছা পরিলে কৌপিন।
সর্ব ত্যাগ সর্বভোগী হ’লে উদাসীন।।
কি ব্যাখ্যা করিব তোরে নাহি বলাবল।
কি ফল ব্যাখ্যিব তোরে নাহি ফলাফল।।
শুনিয়া পড়িল সাধু দণ্ডবৎ করি।
শ্রী হরি বলিয়া অম্নি করিল শ্রীহরি।।
দশরথ বলে আমি বড়ই জঘন্য।
তব বাক্য সত্য আমি আজ হ’তে ধন্য।।
অযাচক বৃত্তি ভিক্ষা প্রবৃত্ত হইল।
দেশে দেশে অইভাবে ভ্রমিতে লাগিল।।
ভ্রমণ করেন ঠাকুরের আজ্ঞামত।
সেভাবে জীবিকা রক্ষা করে অবিরত।।
ছেঁড়া কাঁথা গায় ডোর কৌপিন পরিয়া।
ছেঁড়াকানি মস্তকেতে চিবরী বান্ধিয়া।।
বাক বন্ধ অন্তরে জপিত হরিবোল।
ভিক্ষা করিতেন করে করি কমুন্ডল।।
মল্লকাঁদি ছিলেন বিশ্বাস মৃত্যুঞ্জয়।
মল্লকাঁদি ছেড়ে কালী নগরে উদয়।।
মাঝে মাঝে ঠাকুর আসেন মল্লকাঁদি।
অনুক্ষণ মৃত্যুঞ্জয় যান ওঢ়াকাঁদি।।
একদিন ঠাকুর বলেন মৃত্যুঞ্জয়।
করগে কালীনগরে বসতি আশ্রয়।।
তাহাতে ত্যাজিয়া মল্লকাঁদির বাসর।
ভিটা ছাড়ি করে বাড়ী সে কালীনগর।।
দৈবযোগে একদিন সেই ভদ্রাসনে।
দশরথ উপনীত দিবা অবসানে।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ সূর্যনারায়ণ।
তার মধ্যে হইলাম আমি একজন।।
কহিতেছে দশরথ হরষিত মনে।
কল্য বাছা আমারে যে মেরেছে যবনে।।
মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসিল কেমনে মারিল।
হাসিতে হাসিতে সাধু কহিতে লাগিল।।
ঠাকুরের কথা আছে কথা না কহিব।
অযাচক বৃত্তি দ্বারা জীবন রাখিব।।
আউচ পাড়া যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ভবনে।
উপস্থিত হইলাম দিবা অবসানে।।
বাক বন্ধ প্রভু আজ্ঞা কথা নাহি বলি।
পাগল বলিয়া সবে হাতে দেয় তালি।।
রাখালে জিজ্ঞাসা করে আসিয়া নিকটে।
কথা নাহি বলি, তারা সবে মারে ইটে।।
রাখালের যন্ত্রণায় হইনু অস্থির।
আমাকে দেখিতে পায় সেই যুধিষ্ঠির।।
রাখালে তাড়িয়া দিয়া মোরে ডেকে লয়।
তিনি কন এ কখন পাগল ত নয়।।
সেখানেতে ছিল রামকুমারের ভগ্নী।
নড়াইল নিবাসী ভবানী নামিনী।।
তিনি ক’ন আমি চিনি পাগল নহেত’।
মোদের ওঢ়াকাঁদি ঠাকুরের ভক্ত।।
যুধিষ্ঠির যত্ন করি করান ভোজন।
শল্যান্ন ও দধি দুগ্ধ সঘৃত ব্যঞ্জন।।
ভোজন হইল বেলা অপরাহ্ণ কালে।
প্রতিষ্ঠার ভয়ে আমি আসিলাম চলে।।
দিন ভরি ভিক্ষা করি যাই কলাবাড়ী।
সন্ধ্যাকালে গিয়াছিনু মিয়াদের বাড়ী।।
ঠাকুরের বাক্য আছে গৃহে যেতে মানা।
মিয়াদের বাড়ীতে কাছারী একখানা।।
সেই বাড়ী যখন হইনু অধিষ্ঠান।
মেয়েরা সকলে বলে এল ম্যাজমান।।
তাহারা বলিছে কাছারীতে ব’স এসে।
আমি বসে রহিলাম খেড়পালা পাশে।।
মেয়েরা সকলে এসে সুধায় আমায়।
বাড়ী কোথা বল তব যাইবা কোথায়।।
আমি নাহি কথা বলি হইয়া কাতর।
এক মিয়া বলে বেটা হবে বুঝি চোর।।
দশ বার জনে ঘিরে করে গণ্ডগোল।
কেহ চোর কেহ কহে বোবা কি পাগল।।
ধর চোর মার চোর করে হুড়াহুড়ি।
এক মিয়া এসে মোর টেনে ধরে দাড়ি।।
মিয়া কহে হ্যারে চোরা কথা না কহিলি।
গরু চুরি করিবারে বসিয়া রহিলি।।
মিয়া মোর দাড়ি টেনে ধরিল যখনে।
আমি চাই উঠে যেতে দাড়ি ধ’রে টানে।।
মিয়া বলে গরুচোর পালাইতে চায়।
দাড়ি ছাড়ি ধরি চুল পৃষ্ঠেতে কিলায়।।
কিল খেয়ে পালাইতে চাই শীঘ্রগতি।
আর মিয়া এসে মোর পৃষ্ঠে মারে লাথি।।
আর মিয়া এসে মোর দাড়ি ছাড়াইল।
ঘাড়ঘুল্লা দিয়ে মোরে ঠেলিয়া আনিল।।
সেই মোর গ্রীবা ধরে যবে দেয় ঠেলা।
সে মিয়া কহিছে এর গলে দেখি মালা।।
সে মিয়া কহিছে এর মালা মোটা মোটা।
এ দেখি বৈরাগী এরে চোর বলে কেটা।।
হাতে দেখি ভিক্ষা হাঁড়ি তাহাতে চাউল।
ভিক্ষুক বৈরাগী হ’বে নেড়া কি বাউল।।
ইহাকে মারিতে মম হ’তেছে মমতা।
এত অপমান করি নাহি কয় কথা।।
কাহাকে মারিলি তোরা ধরে দাড়ি চুল।
কাহাকে মারিলি তোরা হারে নামাকুল।।
টানিয়া লইল মোরে বাড়ীর উপরে।
ফেলিয়া গায়ের কাঁথা দেখে দীপ ধরে।।
এত যে মারিনু তবু হা হা হুঁ হুঁ নাই।
এ কোন মহৎ হবে মনে ভাবি তাই।।
চোর যদি কুষ্ঠ ব্যাধি কেন ওর গায়।
এ ভাব ধ’রেছে কোন মহতের কথায়।।
রস পৈতৃকের ঘা দেখি যে গাত্র ভরা।।
এই দায় ঠেকে বুঝি এই ভাব ধরা।।
না জেনে আমারে মারে আরো করে রোষ।
মনে মনে বলি হরি না লইও দোষ।।
সংসারের দুঃখ দেখি লইয়াছি রোগ।
মেয়াদের দোষ হ’লে মোরে দেও ভোগ।।
হেসে হেসে দশরথ এই কথা কয়।
তাহা শুনি হাসিয়া কহেন মৃত্যুঞ্জয়।।
সাধে সেধে নিলে ব্যাধি হইলে আতুর।
ঠাকুর পরীক্ষা করে সহ্য কতদূর।।
এইভাবে দশরথ ভ্রমে ঠাই ঠাই।
রসনা বাসনা হরি হরি বল ভাই।।
দেবী জানকী কর্তৃক মহাপ্রভুর ফুলসজ্জা
পয়ার
নিত্যানন্দ শ্রীচৈতন্য আর শ্রীঅদ্বৈত।
তিন সহোদর হয় অতি সুচরিত।।
নিত্যানন্দ জ্যেষ্ঠা কন্যা নামে কলাবতী।
চণ্ডীচরণের নারি অতি সাধ্বী সতী।।
পদুমা নিবাসী রামমোহন মল্লিক।
তাহার তনয় চণ্ডীচরণ নৈষ্ঠিক।।
নিত্যানন্দের আর এক কন্যা রসবতী।
মৃত্যুঞ্জয়ের কনিষ্ঠা অতি সাধ্বী সতী।।
গোবিন্দ মতুয়া প্রভু ভক্ত শিরোমণি।
রসবতী সতী হয় তাহার ঘরণী।।
অষ্ট সাত্ত্বিক বিকারী গোবিন্দ মতুয়া।
হরিনাম করিতেন নাচিয়া নাচিয়া।।
প্রভাতী গাইত যবে প্রভাত সময়।
শুনিয়া সবার চিত্ত হ’ত দ্রবময়।।
গোগৃহে থাকিত গরু ঊর্ধ্ব মুখ চেয়ে।
নয়ন জলেতে তারা যাইত ভাসিয়ে।।
পক্ষীগণ এসে সব উড়িয়া পড়িত।
বৃক্ষপরে পক্ষীগণ বসিয়া শুনিত।।
পক্ষী সব দিত স্বর গানের স্বরেতে।
জ্ঞান হ’ত পক্ষী গান করে সাথে সাথে।।
ভাস্কর উঠিলে শেষে গান ভঙ্গ হ’ত।
পক্ষীগণ চিঁ চিঁ কুচি রবে উড়ে যেত।।
হেন-ই গায়ক ছিল গোবিন্দ মতুয়া।
নাচিত কীর্তনমাঝে যেমন নাটুয়া।।
রসবতী সতীর কনিষ্ঠা সহোদরা।
সাধ্বী সতী সুকেশা সুন্দরী মধুস্বরা।।
সবার কনিষ্ঠা ধনী জানকী নামেতে।
তার বিয়া হ’ল গৌরচন্দ্রের সঙ্গেতে।।
শ্রাবণ মাসেতে বিকশিতা কৃষ্ণকলি।
ফুল দেখে জানকী হইল কুতূহলী।।
ভেবেছেন এই ফুল গেঁথে বিনাসুতে।
এ হার দিতাম হরিচাঁদের গলেতে।।
এমত জানকী দেবী মনেতে ভাবিয়া।
ফুলপানে এক দৃষ্টে রহিল চাহিয়া।।
দেখে ফুল প্রাণাকুল হ’লে উত্তরাক্ষ।
চক্ষের জলেতে তার ভেসে যায় বক্ষ।।
অবসন্নমনা ফুল কাছে উপনীত।
মনে মনে কহে ফুল কেন বিকশিত।।
প্রভু এলে তুই যদি বিকশিতা হ’তি।
তা’হলে প্রভুর গলে যাইতে পারিতি।।
অদ্য বিকশিত হ’লি কল্য হ’বি বাসি।
ঝরিয়া পড়িবি তুই জলে যাবি ভাসি।।
পুস্পপানে চেয়ে র’ল না পালটে আঁখি।
পিছে হাঁটি পিছাইয়া চলিল জানকী।।
ঘরের পিড়ির প’র বসিল তখনে।
আত্ম হারাইয়া চেয়ে আছে ফুল পানে।।
তথা বসি মনে মনে গাঁথিলেন হার।
ধবল লোহিত ফুল হরিদ্রা আকার।।
তিন বর্ণে ফুল তুলে বর্ণে বর্ণে গাঁথি।
থরে থরে গাঁথনি করিল সাধ্বী সতী।।
চারি চারি সাদা ফুল চারি চারি লাল।
চারিটি হরিদ্রা ফুলে করিয়া মিশাল।।
এইভাবে পুস্পহার করিয়া গ্রন্থন।
প্রভুর শ্রীকণ্ঠে দিল করিয়া যতন।।
হরিচাঁদে ফুলসাজে সাজিয়া জানকী।
মনোহর রূপ দেখে অনিমেশ আঁখি।।
আরোপে শ্রীরূপ দেখে স্পন্দহীনা রয়।
ঠিক যেন ধ্যান ধরা যোগিনীর ন্যায়।।
প্রহরেক কালগত এরূপে বসিয়া।
এইভাবে একেশ্বরী আছেন চাহিয়া।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছিল দক্ষিণ পাড়ায়।
এসে গৃহে এইভাব দেখিবারে পায়।।
সম্বোধিয়া কহে মৃত্যুঞ্জয়ের রমণী।
প্রহরেক এইভাবে তোমার ভগিনী।।
অঙ্গের স্পন্দন নাহি শ্বাস আছে মাত্র।
চক্ষের নিমিষ নাহি যেন শিবনেত্র।।
দক্ষিণাভিমুখ ছিল দণ্ড চারি ছয়।
উত্তরাভিমুখ এই দণ্ড দুই হয়।।
আহারান্তে ননদিনী ছিলেন শয়নে।
নিদ্রাভঙ্গে গিয়াছিল ফুলের বাগানে।।
বিকশিতা কৃষ্ণকলি দেখিল চাহিয়া।
ফিরে না আসিল গৃহে এল পিছাইয়া।।
জানকীর সেই ভাব মৃত্যুঞ্জয় দেখি।
উচ্চঃস্বরে ডাকে তারে জানকী জানকী।।
চিৎকার ঈষৎ মাত্র শুনিল জানকী।
জ্ঞান নাই অঙ্গে মাত্র দিল এক ঝাঁকি।।
এক ডাক দুই ডাক তিন ডাক দেয়।
তিনবার অঙ্গ কম্প যোগ ভঙ্গ নয়।।
সুভদ্রা কহিছে ডেকনারে মৃত্যুঞ্জয়।
এ যেন কৃষ্ণ আরোপ হেন জ্ঞান হয়।।
মৃত্যুঞ্জয় জানকীকে কহে কাঁদি কাঁদি।
জানকীরে দেখ আমি যাই ওঢ়াকাঁদি।।
ওঢ়াকাঁদি প্রভুধামে যান মৃত্যুঞ্জয়।
উপনীত হ’ল গিয়া সন্ধ্যার সময়।।
ঘোর হয় নাই সন্ধ্যা দ্বীপ জ্বলে ঘরে।
ঠাকুর বসিয়াছেন গৃহের বাহিরে।।
প্রণমিল মৃত্যুঞ্জয় ঠাকুরের পায়।
অপরূপ ফুলসজ্জা দেখিবারে পায়।।
কৃষ্ণকলি পুষ্পহার প্রভুর গলায়।
কি শোভা হয়েছে তাহা কহা নাহি যায়।।
চারি চারি শ্বেত পুষ্প চারি চারি লাল।
চারিটি হরিদ্রা বর্ণ তাহাতে মিশাল।।
চারি পুষ্প শ্বেত আর চারি পুষ্প লাল।
চারিটি হরিদ্রা বর্ণ থরে থরে মাল।।
এই মালা দুই সারি প্রভুর গলায়।
আর দুই সারি মালা দিয়াছে মাথায়।।
মস্তকের পার্শ্ব দিয়া আকর্ণ বেষ্টিত।
ঝুমুকা আকার হার গলেতে দোলিত।।
এক সারি বক্ষঃপর রয়েছে সাজান।
আর এক সারি নাভি পর্যন্ত ঝুলান।।
অপরূপ তাহাতে হয়েছে কিবা সাজ।
গোপীরা সাজায় যেন কুঞ্জ বন মাঝ।।
ফুলহার ঈষৎ ঈষৎ ঝুলিতেছে।
তার মাঝে দলগুলি ঈষৎ লড়িছে।।
বহিতেছে মন্দ মন্দ দক্ষিণে বাতাস।
ফুল হতে বহিতেছে অপর্যাপ্ত বাস।।
এতেক শ্রাবণ মাস আরও সন্ধ্যাকালে।
অল্পক্ষণ দিনমণি গেছে অস্তচলে।।
আকাশে বিচিত্র শোভা স্থগিত বরুণ।
এদিকে উদিত যেন দ্বিতীয় অরুণ।।
মৃত্যুঞ্জয় এসে তাই করে দরশন।
অপরূপ রূপ যেন মদন মোহন।।
জ্ঞানহারা প্রায় যেন হইল অধৈর্য।
ভেবেছেন মৃত্যুঞ্জয় এই কি নিকুঞ্জ।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে প্রভু বল বল বল।
কোন গোপী ব্রজভাবে তোমাকে সাজা’ল।।
প্রভু কন মল্লকাঁদি জানকী নামিনী।
আমাকে সাজিয়ে গেল সেই যে গোপিনী।।
তুমি যারে দেখে এলে যেন ধ্যান ধরা।
উত্তার দেখিলে যার নয়নের তারা।।
মানসেতে মনসুতে মালা গেঁথে ফুলে।
মনে মনে মালা গেঁথে দিল মোর গলে।।
আরোপেতে দেখে মোরে বাক্য নাহি স্ফুরে।
এসেছ যাহার ভাব জানাতে আমারে।।
কি কহিবি তার কথা বল বল বল।
দেখিব দেখিব তারে চল চল চল।।
মৃত্যুঞ্জয় ধরায় পড়িল কাঁদি কাঁদি।
প্রভু বলে চল শীঘ্র যাই মল্লকাঁদি।।
মহাপ্রভু নৌকা ‘পরে উঠিল অমনি।
আস্তে আস্তে মৃত্যুঞ্জয় বাহিল তরণী।।
শুক্লাপক্ষ শুভাস্টমী তিথির সময়।
তরী পরে হরি, তরী বাহে মৃত্যুঞ্জয়।।
ক্রমে ক্রমে নিশাকর কর প্রকাশিল।
ঈশানে ঈষৎ মেঘ ক্রমে দেখা দিল।।
গগনে নক্ষত্র সব হ’য়েছে উদয়।
তার মধ্যে চন্দ্রোদয় কিবা শোভা তায়।।
শোভা দেখি মৃত্যুঞ্জয় আনন্দ অপার।
জয়ধ্বনি করে ক্ষণে করে হুহুঙ্কার।।
স্বেদকম্প পুলকিত মৃত্যুঞ্জয় দেহ।
বলে তোরা হেন শোভা দেখিলি না কেহ।।
বিস্মিত হইল ঠাকুরের পানে চেয়ে।
প্রভু কয় যারে বাছা ত্বরা তরী বেয়ে।।
ধীরে ধীরে বাহে তরী মালা দেখি মোহে।
নিরখি নিরখি নীর নিরবধি বহে।।
বহিতেছে বাহিতেছে মোহিতেছে মালা।
উপনীত হল আসি খাল তালতলা।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছেন উড়িয়া নগরী।
আশাপথ চেয়ে তার নারী কাশীশ্বরী।।
নিবাসী নিশ্চিন্তপুর তপস্বী সদ্জ্ঞানী।
দেবী কাশীশ্বরী তার প্রাণের নন্দিনী।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছেন যেই পথ দিয়া।
ঠাকুরানী সেই পথে আছেন বসিয়া।।
প্রাণকান্ত গিয়াছেন প্রাণকান্ত স্থানে।
ভাবে কান্ত হেরি কান্ত আসে কতক্ষণে।।
ক্ষণেক বসিয়া থাকে উত্তরাভিমুখে।
ক্ষণে গৃহকার্য করে পুনঃ গিয়া দেখে।।
গৃহকার্য করি যায় গৃহের বাহিরে।
পুনঃ গৃহ পিছে এসে আশাপথ হেরে।।
আবার আসিয়া গৃহকার্য করে ক্ষণে।
ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি করে জানকীর পানে।।
নিভৃতে বসিল গিয়া গৃহের পশ্চাতে।
আসে কিনা আসে নাথ দেখে আরোপেতে।।
নয়ন মুদিয়া প্রায় অর্ধদণ্ড ছিল।
আরোপে দেখিল প্রভু তালতলায় এল।।
হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল ঠাকুরানী।
সত্বরে আসিল যথা যোগে ননদিনী।।
কহে ডাকি সে জানকী ননদীর ঠাই।
ঠাকুর এসেছে তোর আর চিন্তা নাই।।
কতক্ষণ এইরূপে আরোপে থাকিবা।
অনুমান ছাড়ি কর বর্তমান সেবা।।
কৃষ্ণকলি হার শোভে ঠাকুরের গলে।
সুখে হাতে সৌদামিনী জলদের কোলে।।
বার বার ডাকিতেছে উঠ ঠাকুর-ঝি।
ঠাকুর ঠাকুর ল’য়ে ওই এল বুঝি।।
মৃত্যুঞ্জয় মাতা সে সুভদ্রা ঠাকুরানী।
করিছেন মালা জপ বসি একাকিনী।।
কহিছে বধূর কাছে তোরা কোহিস।
ঠাকুর এসেছে কথা কোথা কি শুনিস।।
বধূ কহে ঠাকুরানী কি কোহিব আর।
ঠাকুর-ঝি গাঁথিয়াছে মালা মনোহর।।
সেই মালা গলে কিবা সেজেছে ঠাকুরে।
অই আসিতেছে নৌকা আর নাহি দূরে।।
হেন মতে হইতেছে কথোপকথন।
মল্লকাঁদি ঘাটে নৌকা আসিল তখন।।
ভকত বৎসল হরি দ্বৈত হরি রূপে।
ইচ্ছিলেন আসিবেন জানকী সমীপে।।
অসম্ভব ক্রিয়া যত তাহাতে সম্ভব।
প্রহ্লাদে রাখিতে যথা স্তম্ভেতে উদ্ভব।।
এক কৃষ্ণ যথা নন্দ গৃহে বন্ধ রয়।
আর কৃষ্ণ কণ্ব মুনি অন্ন মেরে দেয়।।
এক মূর্তি মৃত্যুঞ্জয় নৌকাপরে থাকি।
এক মূর্তি দেখে সুখে সুভদ্রা জানকী।।
ঠাকুরের কথা শুনি সুভদ্রা জননী।
বধূকে কহিল বধূ কহিলি কি বাণী।।
জানকী দিয়াছে মালা ঠাকুরের গলে।
দেখিলি সে মালা তুই তোর ভক্তি বলে।।
তোরা দোঁহে মালা দিয়া কৈলী দেখাদেখি।
আমি অভাগিনী শুধু মালা লয়ে থাকি।।
হেনরূপ হইতেছে কথোপকথন।
উপস্থিত হরিচাঁদ হইল তখন।।
জানকী আসিয়া প্রভু পদে প্রণমিল।
কাশীমাতা গৃহে গিয়া আসন পাতিল।।
গললগ্নী কৃতবাস হইয়া তখনে।
প্রভুকে বলেন বাপ এস হে আসনে।।
শুনিয়া ঠাকুর গিয়া আসনে বসিল।
সুভদ্রা আসিয়া পদে প্রণাম করিল।।
করজোড়ে কহিলেন ঠাকুরের ঠাই।
কি দিয়া জানকী তোমা সা’জাল গোঁসাই।।
ঠাকুর কহিছে তুমি জানিলে কিরূপে।
সুভদ্রা কহিছে বধূ দেখিল আরোপে।।
বধূ কহে হরিচাঁদে সাঁজালে যতনে।
পদ্ম দিয়া পাদপদ্ম সাঁজালে না কেনে।।
বলাবলি উভয়েতে করে ঠারে ঠোরে।
তাই শুনি আমি শেষে জিজ্ঞাসি বধূরে।।
বধূ বলে জানকী যে আরোপেতে ছিল।
কৃষ্ণকলি ফুলহারে তোমারে সাঁজিল।।
এই সেই ফুলহারে সাঁজিলে গোঁসাই।
তব গলে মালা দেখি মানিলাম তাই।।
ওদিকে প্রভুকে ল’য়ে আসেন মৃত্যুঞ্জয়।
মল্লবিলে পদ্মপুষ্প দেখিবারে পায়।।
ভাবিছেন প্রভুকে লইয়া নিজ ঘরে।
এই পদ্ম ফুল দিয়া সাজা’ব ঠাকুরে।।
পদ্মবনে ফুল তোলে বসিয়া নৌকায়।
মহাপ্রভু বলে কি করিস মৃত্যুঞ্জয়।।
মনের মানসা ফুল করিয়া যতন।
চন্দন মাখিয়া ফুলে পূঁজিব চরণ।।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনেতে বসিয়া আসনে।
অন্তর্যামী গোঁসাই ভেবেছে মনে মনে।।
কাশীমাতা হরিচাঁদে বসায়ে শয্যায়।
চরণে চন্দন দেন আনন্দ হৃদয়।।
হেনকালে মৃত্যুঞ্জয় আনিলেন ফুল।
ফুল দেখে কাশীমাতা আনন্দে আকুল।।
চন্দনে মাখিয়া পদ্ম দেন পাদপদ্মে।
তুলসীর দাম দেন তার মধ্যে মধ্যে।।
দেবী কাশী হাসি হাসি কহিছেন বাণী।
ঠাকুরের শোভা কিবা দেখে ঠাকুরানী।।
শুনিয়া সুভদ্রা মাতা একদৃষ্টে চায়।
দ্বিগুণ উজ্জ্বল শোভা দেখিবারে পায়।।
একে জানকী দত্ত আরোপের মাল।
পাদপদ্মে পদ্ম ভক্তি চন্দন মিশাল।।
স্ফটিকের উপরে যেন হীরকের চাকা।
চূড়ার উপরে যেন ময়ূরের পাখা।।
দেখি ঠাকুরানী পড়ে পদে লোটাইয়া।
মৃত্যুঞ্জয় পড়িলেন চরণ ধরিয়া।।
জানকী পতিতা পদে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
প্রেম-বন্যা উথলিয়া চলিল বহিয়া।।
কাশীশ্বরী সবে তোলে ধরিয়া ধরিয়া।
ঠাকুর বলেন সবে লহ উঠাইয়া।।
সকলে বসিল এসে ঠাকুরের ঠাই।
মহাপ্রভু পদধরি কাঁদিছে সবাই।।
এ সময়ে মৃত্যুঞ্জয় প্রেমেতে মাতিয়া।
হরি হরি হরি বলে নাচিয়া নাচিয়া।।
মহাপ্রভু বলে আয় আয় মৃত্যুঞ্জয়।
আমরা এখানে তুই নাচিস কোথায়।।
এত শুনি মৃত্যুঞ্জয় নৃত্য সম্বরিল।
শ্রীহরির শ্রীপদে শ্রীপাদ লোটাইল।।
ক্রমে ক্রমে সকলেই প্রেম সম্বরিল।
ফুলের বাগান দিকে নজর পড়িল।।
সন্ধ্যাগ্রে দেখিছে ফুল শাখা পরিপূর্ণ।
এবে দেখে ফুল নাই শাখা সব শূন্য।।
ফুল ছিল বাগানেতে ঘেরা পরিপাটী।
এবে দেখে মাঝে মাঝে দুটি কি একটি।।
এসে গৃহে মৃত্যুঞ্জয় কহিছেন বাণী।
ধন্য মাতা ধন্য পিতা ধন্য মোর ভগ্নী।।
মাতা মোর রত্নগর্ভা যে গর্ভে ভগিনী।
হেন গর্ভে অগ্রে আমি তাহে ধন্য মানি।।
যে গৃহে অনাথ নাথ গৃহ ধন্য মানি।
যে গৃহে তোমাকে সেবে ধন্য সে গৃহিণী।।
তব পাদপদ্মে প্রভু এই ভিক্ষা চাই।
জনমে জনমে তোমা এইরূপে পাই।।
ঠাকুর বলেন বাছা তুইরে সাধক।
জনমে জনমে তুই আমার সেবক।।
যাবচ্চন্দ্র দিবাকর জনমে জনমে।
তব প্রেমে বাধ্য আমি তোমার আশ্রমে।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে প্রভু আর নাহি চাই।
অহৈতুকী ভক্তি যেন জন্মে জন্মে পাই।।
জানকী আরোপ মনোরম্য ফুলসাজ।
কহিছেন তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
মৃত্যুঞ্জয়ের কালীনগর বসতি
পয়ার
মল্লকাঁদি গ্রাম্য জমি হয়ে গেল জলা।
উর্বরা যতেক জমি হইল অফলা।।
গ্রাম মাঝে কৃষিকার্য করিত যাহারা।
নানারূপ বাণিজ্যাদি করিল তাহারা।।
হরিচাঁদ বলে শুন ওরে মৃত্যুঞ্জয়।
এ দেশে অজন্মা হ’ল কি হবে উপায়।।
সকলে বাণিজ্য করি হইল ব্যাপারী।
তুমিত বেড়াও শুধু বলে হরি হরি।।
জননী তোমার হয় পরমা বৈষ্ণবী।
কিসে হবে মাতৃসেবা মনে মনে ভাবি।।
গৃহস্থের গৃহকর্ম রক্ষা সুবিহিত।
কর্মক্ষেত্র গৃহকার্য করাই উচিত।।
ভার্যা তব সাধ্বী সতী অতি পতিব্রতা।
কার্য কিছু না করিলে খেতে পাবে কোথা।।
তুমি যাও মধুমতি নদীর ওপার।
দিনকতক থাক গিয়া বাছারে আমার।।
থাকগে চণ্ডীচরণ মল্লিকের বাড়ী।
জমি রাখ ধান্য পাবে কৃষিকার্য করি।।
মম অন্তরঙ্গ ভক্ত হবে সে দেশেতে।
তোমারে করিবে ভক্তি একাগ্র মনেতে।।
হরিনাম সংকীর্তন কর দিবা রাত্রি।
তাহা হলে সবে তোমা করিবেক ভক্তি।।
কোকিলা নামিনী রাম সুন্দরের কন্যা।
পদুমা নিবাসী দেবী নারীকুল ধন্যা।।
রামসুন্দরের ভার্যা তিনকড়ি মাতা।
সে বৃদ্ধা পরমা ধন্যা সতী পতিব্রতা।।
গিয়াছিল ক্ষেত্রে জগন্নাথ দরশনে।
জগন্নাথ রূপ তার লাগিল নয়নে।।
জগবন্ধু বলি সদা করিত রোদন।
দেশে এল জগবন্ধু করি দরশন।।
ভোর রাত্রি শুকতারা করি দরশন।
তখন হইত প্রেম ভাব উদ্দীপন।।
সূর্যোদয় অষ্ট সাত্বিক ভাবের উদয়।
স্বেদ পুলকাশ্রু কম্প রৌদ্র বীর ভয়।।
কাঁদিতে কাঁদিতে বৃদ্ধা হয়েন উন্মত্তা।
উত্তার নয়ন হন ধরাতে লুণ্ঠিতা।।
প্রভাতে উদিত হ’ল তরুণ তপন।
দেখেন জগবন্ধুর শ্রীচন্দ্র বদন।।
সেই রত্নগর্ভ জাতা শ্রীকোকিলা দেবী।
সতী অংশে জন্ম সেই পরমা বৈষ্ণবী।।
মায়ে ঝিয়ে তাহারা তোমার ভক্ত হবে।
আত্ম স্বার্থ ত্যজি তোমা ভকতি করিবে।।
তাহা শুনি হৃষ্টচিত্তে কহে মৃত্যুঞ্জয়।
যে আজ্ঞা তোমার প্রভু যাইব তথায়।।
একামাত্র গেল পদুমায় মৃত্যুঞ্জয়।
চণ্ডীচরণের বাটী হইল উদয়।।
বৎসরেক পদুমায় থাকিলেন গিয়া।
নিরবধি হরিগুণ বেড়ান গাহিয়া।।
দিবা মধ্যে প্রহরেক গৃহকার্য করে।
হরি কথা কৃষ্ণ কথা গোষ্ঠে কাল হরে।।
ঠাকুরের যুগধর্ম করিল প্রচার।
ক্রমে সব লোক ভক্ত হইল তাহার।।
সবে বলে আপনাকে যেতে নাহি দিব।
আমরা সেবক হয়ে এদেশে রাখিব।।
পূর্বে প্রভু শ্রীমুখে করিয়াছি ব্যক্ত।
সমাতৃক কোকিলা হইল তার ভক্ত।।
হরিনাম মহামন্ত্র জপে নিরবধি।
অল্পদিনে কোকিলার হইল বাকসিদ্ধি।।
পদুমা আইচপাড়া শ্রীকালীনগর।
প্রভুর ভাবেতে সবে হইল বিভোর।।
কোকিলাকে ভক্তি করে এ দেশে সবায়।
কোকিলার দোঁহাই দিলে ব্যাধি সেরে যায়।।
ওলাওঠা বিসূচিকা জ্বর অতিসার।
রসপিত্ত আর দ্ব্যাহিক ত্রাহ্যিক জ্বর।।
থাকেনা তাহার ব্যাধি অমনি আরাম।
মহাব্যাধি সারে নিলে কোকিলার নাম।।
রোগী শোকী ভোগী যত জ্ঞানী কি অজ্ঞানী।
কোকিলাকে ডাকে সবে মাতা ঠাকুরানী।।
বৎসরেক হরিনাম করিয়া প্রচার।
মৃত্যুঞ্জয় রহিলেন সে কালীনগর।।
সকলে সাহায্য করি তুলে দিল ঘর।
ঠাকুর করহ বাস ইহার ভিতর।।
কাশীশ্বরী ভার্যা তার সুভদ্রা জননী।
দোঁহে আছে মল্লকাঁদি যেন কাঙ্গালিনী।।
মৃত্যুঞ্জয় ওঢ়াকাঁদি যাতায়াত করে।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় সুভদ্রা মায়েরে।।
কাশীশ্বরী মৃত্যুঞ্জয় সুভদ্রা সুমতি।
তিনজন প্রভুর সেবায় আছে ব্রতী।।
মহাপ্রভু আজ্ঞা দিল তাহাদের প্রতি।
সকলে কালীনগরে করগে বসতি।।
অদ্য নিশি গতে কল্য প্রভাত সময়।
শুভক্ষণে কর যাত্রা বুধের উদয়।।
প্রভু আজ্ঞা শিরে ধরি অমনি চলিল।
আসিয়া কালীনগর বসতি করিল।।
গোঁসাই কালীনগর বসতি বিরাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
শ্রীগোলক গোস্বামীর গোময় ভক্ষণ প্রস্তাব
দীর্ঘ ত্রিপদী
মৃত্যুঞ্জয়ের জননী দেবী সুভদ্রা নামিনী
সদা করে নাম সংকীর্তন।
গৌর নিত্যানন্দ বলে ভাসে দু’নয়ন জলে
ডাকে কোথা শচীর নন্দন।।
নিদ্রাতে হ’য়ে বিভোরা বাপরে নিতাই গোরা
ডাকিতেন নয়ন মুদিয়া।
নিদ্রাযোগে অঙ্গে ঝাঁকি ছল ছল দুটি আঁখি
কাঁদিতেন চৈতন্য হইয়া।।
হায় হায় কি হইল দেখা দিয়া লুকাইল
বাপরে আমার নিত্যানন্দ।
ওরূপ করিত যবে রামাগণ এসে তবে
প্রতিবাসী বলিতেন মন্দ।।
কোন কোন নারী আসি বলিতেন হাসি হাসি
বাপ বল কোন নিতাইরে।
বলিত সুভদ্রা ধনী আমার নিতাই মণি
সবাকার বাপ এ সংসারে।।
কেহ বলে জানি আমি নিতাই তোমার স্বামী
রমণী কি স্বামী নাম লয়।
কহ বাবা নিত্যানন্দ তাহাতে পরমানন্দ
নিতাই কি তব বাবা হয়।।
কহে সুভদ্রা বৈষ্ণবী আমি নিতাই বল্লভী
নিত্যানন্দ জীবন বল্লভ।
নিত্যানন্দ দাসী আমি নিত্যানন্দ মম স্বামী
যাহা হতে জগৎ উদ্ভব।।
নিতাই আমার বাপ মাতৃবাপ পিতৃবাপ
পুত্রের কন্যার বাপ হয়।
জগৎ জনার বাপ মোর বাপ তোর বাপ
তারে বাপ বলিতে কি ভয়।।
তোরা সব প্রতিবাসী করিস কি হাসাহাসি
নিত্যানন্দ দাসী হই আমি।
নিতাই জগৎগুরু প্রেমদাতা কল্পতরু
নিত্যানন্দ বাপ ভাই স্বামী।।
হেনভাবে সর্বক্ষণ প্রেমাবিষ্ট তনু মন
নিত্য কৃত প্রাতঃস্নান আদি।
অরুণ উদয়কালে স্নান ক’রে কুতূহলে
নিত্য লেপে তুলসীর বেদী।।
একদা সকাল বেলা লইয়া গোময় গোলা
ঝাঁটা শলা দক্ষিণ করেতে।
লেপিছে বাহির বাড়ী বাম করে গোলাহাঁড়ি
হরি হরি বলেন মুখেতে।।
এ হেন সময়কালে জয় হরি বল বলে
গোঁসাই গোলোক উপনীত।
দেখিলে সকল লোকে পাগল বলে তাহাকে
ভক্ত ওঢ়াকাঁদি ভাবাশ্রিত।।
মলিন বসনধারী অঙ্গে কাঁথা বলে হরি
প্রণমিল সুভদ্রার পায়।
গোময়ের গোলা পদে গোঁসাই মনের সাধে
পদরজ চাটিল জিহ্বায়।।
কহিছে সুভদ্রা ধনী আমি বড় ঠাকুরানী
তুই বড় ভক্তি জানিস।
করিস কি ভারি ভুরি মানিনে ও সাধুগিরি
কি বুঝিয়া আমাকে মানিস।।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ যিনি বৃন্দাবন চাঁদ
গৌর নিতাই চাঁদ যেন।
তার দায় দিয়া ফের ভা’বো হ’য়ে ভাব ধর
মেয়েদের পদ চাট কেন।।
কাঁথাখানি দিয়া গায় হেঁটে বেড়ালে কি হয়
ভাব যে ঠাকুর হইলাম।
খাও মেয়েদের এঠে মেয়েদের পদ চেটে
অষ্ট অঙ্গে করহ প্রণাম।।
আয় দেখি মোর ঠাই দেখি কেমন গোঁসাই
কতদূর ভাবেতে বিভোলা।
পদ চাটি কাঁদা খালি এনেছি গোময় গুলি
খা দেখি এ গোময়ের গোলা।।
এ হেন বাক্য শুনিয়ে গোঁসাই মৃদু হাসিয়ে
দুই কর পাতিল অঞ্জলি।
গোঁসাই না কহে বাণী অমনি সুভদ্রা ধনী
হাঁড়ি ধরে গোলা দেয় ঢালি।।
গোঁসাইর নাহি দুঃখ অমনি দিল চুমুক
সে অঞ্জলি খাইল তখন।
পুনশ্চ অঞ্জলি দিলে সে অঞ্জলিও খাইলে
একবিন্দু হ’ল না পতন।।
পুনশ্চ কহে বৈষ্ণবী কিরে বাছা আরো খাবি
অমনি গোঁসাই পাতে হাত।
দিলেন হাঁড়ি ঢালিয়ে তৃতীয় অঞ্জলি খেয়ে
গোঁসাই করিল প্রণিপাত।।
সুভদ্রা কহিছে ম’তো দেখি তোর ভক্তি কত
হস্ত ধৌত না করিও ধন।
গোঁসাই কহে কি করি বুড়ি কহে শিরোপরি
হস্তদ্বয় করহ মার্জন।।
সুভদ্রা কহিল যাহা গোস্বামী করিল তাহা
উত্তরাভিমুখে চলি যায়।
সদা মুখে হরিনাম আসিল পদুমা গ্রাম
ফেলারাম বিশ্বাস আলয়।।
এদিকে সুভদ্রা গিয়ে হস্তপদ পাখলিয়ে
করেতে লইল জপ মালা।
মালা জপিতে জপিতে কম্প উঠি আকস্মাতে
গৃহমাঝে প্রবেশ করিলা।।
উঠিল পেটে বেদনা তাহা না হয় সান্তনা
সুভদ্রা কহিছে হায় হায়।
উদর বেদনা জ্বালা সেই গোময়ের গোলা
ভেদ আর বমি সদা হয়।।
নিতাই চৈতন্য বলে ভাসে দু’নয়ন জলে
কিছুতেই না হয় প্রতিকার।
যত বলে শ্রীচৈতন্য বেদনা বাড়ে দ্বৈগুণ্য
ভেদ বমি হয় বার বার।।
মৃত্যুঞ্জয় এসে ঘরে তাহা নিরীক্ষণ করে
বলে কিবা হইল মায়ের।
গোময়ের গোলা যত ভেদবমি অবিরত
বুঝিতে না পারি কর্ম ফের।।
মৃত্যুঞ্জয়ের বনিতা বলে কিবা কহিব তা
দুষ্কার্য করেছে ঠাকুরানী।
যেমন করেছে কার্য তাহা নাহি মনে গ্রাহ্য
কর্মফল ফলেছে অমনি।।
গোস্বামী গোলোক এসে মা ব’লে প্রণামি শেষে
ঠাকুরানীর খায় পদধূলা।
ঠাকুরানী ক্রোধ ক’রে মোদের গোঁসাইজীরে
খাওয়াইছে গোময়ের গোলা।।
সেই গোলা উদ্বমন হইতেছে সর্বক্ষণ
ভেদ হইতেছে সেই গোলা।
গলিত ঘর্ম শরীর হ’তেছে ঠাকুরানীর
উদর বেদনা অঙ্গজ্বালা।।
মৃত্যুঞ্জয় শুনে তাই গিয়া জননীর ঠাই
বলে মাতা কহ সমাচার।
শুনিয়া সুভদ্রা ধনী কাতরে কহিছে বাণী
বলে বাবা কি বলিব আর।।
এসেছিল সে গোলোক মাধুর্যভাবের লোক
জলন্ত পাবক প্রায় আজ।
আগে ক’রে দণ্ডবৎ শেষে দিল পায়ে হাত
আমি বলি কি করিস কাজ।।
লইতে পায়ের ধূলা খাইল গোময় গোলা
ভাব ধরে হরি হরি বোলা।
দেখি তোর কত ভক্তি ধূলাতে কতই আর্তি
খা দেখি এ গোময়ের গোলা।।
দিলাম গোময় গুলি খাইল তিনটি অঞ্জলি
জ্বলে মম অস্থি চর্ম মেদ।
হস্তপদ চক্ষু জ্বালা সেই গোময়ের গোলা
হইতেছে বমি আর ভেদ।।
ওরে বাপ মৃত্যুঞ্জয় পাগল গেল কোথায়
সে না এলে আমি মরি প্রাণে।
করেছি যেমন কাজ আমার মুণ্ডেতে বাজ
মরি বাঁচি দেখা তারে এনে।।
নির্মল প্রেমের সাধু আমি তারে শুধু শুধু
করিয়াছি নিন্দন ও ভর্ৎসন।
সাধু নিন্দা মহাপাপ ভুঞ্জিতেছি সেই পাপ
করি তার চরণ বন্দন।।
কথাশুনি মৃত্যুঞ্জয় দ্রুত অন্বেষণে যায়
কোথা সেই গোলোক গোঁসাই।
পদুমায় দেখা পেয়ে পদে দণ্ডবৎ হ’য়ে
জানাইল গোঁসাইর ঠাই।।
গোস্বামী গোলোক গিয়ে নিকটে উদয় হ’য়ে
সুভদ্রাকে দেখা দিয়া কয়।
শুনগো মা ঠাকুরানী আমি কিছু নাহি জানি
সব হরিচাঁদের ইচ্ছায়।।
বৈষ্ণবী কহিছে বাপ আমার হ’য়েছে পাপ
সকলই ত’ প্রভুর ইচ্ছায়।
ভাগবতে বাক্য শুনি আছে মহাপ্রভু বাণী
মহাপাপ বৈষ্ণব নিন্দায়।।
বৈষ্ণব নিন্দুক জন মিথ্যা এ সাধন ভজন
হরি তারে নাহি ফিরে চায়।
জনমে জনমে তার নাহি পাপের উদ্ধার
বল মম কি হবে উপায়।।
দেরে বাপ পদতরী আমার হৃদয়পরি
তরীর বৈষ্ণব অপরাধে।
ক্ষম মম অপরাধ তুলে গোস্বামীর পদ
বৈষ্ণবী ধরিল নিজ হৃদে।।
সব জ্বালা দূরে গেল বৈষ্ণবী ভাল হইল
হরি ব’লে চক্ষে বহে নীর।
কহিছেন কাঁদি কাঁদি ধন্য ধন্য ওঢ়াকাঁদি
শুদ্ধ হ’ল আমার শরীর।।
হরিচাঁদ ভক্ত যারা পতিত পাবন তারা
বিষ্ণু অবতার বিষ্ণু অংশ।
বীর রসে ধীরোত্তম সবে বিষ্ণু পরাক্রম
বিষ্ণু তেজ সব বিষ্ণু বংশ।।
যেমন শ্রীগৌরচন্দ্র আর প্রভু নিত্যানন্দ
ভক্তবৃন্দ সেই অবতার।
হৃদয় শোধন করি বলাইল হরি হরি
এহেন দয়াল নাহি আর।।
সেই প্রেম পেয়েছিল তাহা জীবে পাসরিল
ভুলিল প্রেমের মধুরত্ব।
ত্যজিয়া অমৃত ফল জীব গেল রসাতল
বিষ ফলে হইল প্রমত্ত।।
খণ্ডাইতে কর্ম বন্ধ সেই প্রভু হরিশ্চন্দ্র
এবে হ’ল যশোমন্ত সুত।
হরিচাঁদ নাম ধরি ওঢ়াকাঁদি অবতরী
নাম প্রচারিল প্রেম যুত।।
তার যত ভক্তগণ তারা ভুবন পাবন
ব্রহ্মাণ্ড তারিতে শক্তি ধরে।
আমি’ত অবিশ্বাসিনী শ্রীহরি ভক্ত দ্বেষিণী
শোধিল আমার কলেবরে।।
গোলোক সুভদ্রাখ্যান সুধার সমুদ্রবান
পান কর প্রাণ বাঞ্ছাতরী।
কহিছে তারকচন্দ্র মহানন্দের আনন্দ
সাধু সব পিয় কর্ণভরি।।
মধ্যখণ্ড
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
গোস্বামী দশরথোপাখ্যান
পয়ার
দশরথ নামে সাধু পদ্মবিলাবাসী।
তত্ত্বজ্ঞানী হরিনামে মত্ত অহর্নিশি।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় পুরুষ রতন।
করে একাদশী ব্রত তুলসী সেবন।।
তিন সন্ধ্যা মালা জপ তুলসী ধারণ।
হরিনাম ছাপা অঙ্গে অতি সুশোভন।।
নিত্য নিত্য প্রাতঃকৃত স্নানাদি তর্পণ।
গুরু পূজা কৃষ্ণ পূজা নৈবিদ্য অর্পণ।।
পক্ষে পক্ষে একাদশী শ্রীহরি বাসর।
স্তব পাঠ নাম পাঠ নাহি অবসর।।
চৈতন্য চরিতামৃত পঠে ভাগবত।
সাধুসেবা মহোৎসব করে অবিরত।।
দিবাহারী এক সন্ধ্যা নাহি দ্বিভোজন।
আতপ তণ্ডুল অন্ন লাবড়া ব্যঞ্জন।।
তৈল মৎসত্যাগী ভক্ষে দিনে একবার।
রাত্রে কিছু ফলাহার কভু অনাহার।।
হেন মতে সদা করে বিশুদ্ধ ভজন।
হরিনাম সংকীর্তন সতত মগন।।
দৈবে ব্যধিযুক্ত হ’ল কার্ত্তিক মাসেতে।
জ্বর হ’য়ে ভুগিলেন কতদিন হ’তে।।
পালাজ্বর হ’ল তার দুইমাস পর।
একদিন হয় জ্বর এক দিনান্তর।।
মাঘমাস এই ভাবে গেল গোস্বামীর।
জ্বরের জ্বালায় আর নাহি পান স্থির।।
ফাল্গুন মাসেতে জ্বর বাড়িল অধিক।
চৈত্র মাস শেষে জ্বর হইল ত্রাহিক।।
আরক পাঁচন বটি কত খাইতেছে।
ক্রমশঃ জ্বরের বৃদ্ধি দুর্বল হ’তেছে।।
ভাল বৈদ্য চিকিৎসক কতই আসিল।
বাছিয়া বাছিয়া কত ঔষধ খাইল।।
তবু রোগ শান্তি নাই হইল কাতর।
শক্তি নাই যষ্ঠিমাত্র চলিতে দোষর।।
প্রচলিত হইয়াছে হরিবলা মত।
কতলোকে ওঢ়াকাঁদি করে যাতায়াত।।
ইহা শুনি দশরথ তবু নাহি যায়।
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।।
যারা যায় তারা কয় হরি আবির্ভূত।
শ্রীকান্ত হয়েছে এবে যশোমন্ত সুত।।
গেলে মাত্র রোগ সারে করিলে প্রণতি।
কিংবা প্রভু আজ্ঞা দিলে হয় রোগ মুক্তি।।
মুখের কথায় মাত্র রোগের আরোগ্য।
বৈরাগ্য কেহবা পায় যদি থাকে ভাগ্য।।
শুনে দশরথ কয় বিশ্বাস না হয়।
কোন হরি ওঢ়াকাঁদি হইল উদয়।।
না দেখিলে চক্ষু কর্ণ বিবাদ না ঘুচে।
অবশ্য যাইব দেখিবার ইচ্ছা আছে।।
কি ভাব সে ওঢ়াকাঁদি ভক্ত কিংবা হরি।
হেরিব মহাপুরুষে যদি যেতে পারি।।
কল্য প্রাতেঃ দরশন করিব ঠাকুর।
অদ্য গিয়া নিশিতে থাকিব লক্ষ্মীপুর।।
বুদ্ধিমন্ত বুদ্ধিমন্ত ইহা আমি জানি।
হরিভক্ত জ্ঞানী চূড়ামণি চূড়ামণি।।
শুনিয়াছি তারা যায় ঠাকুরের বাড়ী।
তারা যদি বলে তবে মানিবারে পারি।।
আদি অন্ত বৃত্তান্ত শুনিব সেই স্থানে।
কেমন ঠাকুর তিনি তারা ইহা জানে।।
এতবলি যান চলি লক্ষ্মীপুর গ্রামে।
রহিলেন গিয়া বুদ্ধিমন্তের আশ্রমে।।
ঠাকুরের কথা তথা সকল শুনিল।
শুনিয়া অন্তরে বড় ভক্তি জনমিল।।
প্রাতেঃ উঠি চলিলেন ওঢ়াকাঁদি ধাম।
যষ্ঠিহাতে কষ্টেতে গমন অবিশ্রাম।।
ধীরে ধীরে চলিলেন বলবীর্যহীন।
চলে যায় মনে ভয় পালা সেইদিন।।
জ্বর আসিবার ভয়ে হরি হরি বলে।
হরিচাঁদ ব’লে ডাকে ভাসে অশ্রুজলে।।
হরি হরি বলি উতরিল ওঢ়াকাঁদি।
বস্ত্র গলে চক্ষু জলে দাঁড়াইল কাঁদি।।
ঠাকুর বলেন বাছা কি নাম তোমার।
দশরথ বলে আমি বড় দুরাচার।।
নাম মোর দশরথ পদ্মবিলা বাস।
প্রভু বলে তুমিত’ দশরথ বিশ্বাস।।
তুইত’ বিশ্বাস আমি বড় অবিশ্বাস।
তন্ত্রে মন্ত্রে শৌচাচারে না হয় বিশ্বাস।।
কেন বা আসিলি বাছা আমার নিকটে।
তুই শুদ্ধচারী মোর শৌচ নাই মোটে।।
তিনবেলা সন্ধ্যা কর আর স্নানাহ্নিক।
স্নান পূজা সন্ধ্যাহ্নিক মোর নাই ঠিক।।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।
মোর ঠাই এলি বাছা কিসের কারণ।
কহ শুনি মনোকথা বুঝি তোর মন।।
প্রকাশিয়া বল শুনি ওরে দশরথ।
শুদ্ধাচারী সাধু তোর কিবা মনোরথ।।
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।
কোথাকার হরি এল ওঢ়াকাঁদি গায়।।
নদীয়াতে গৌররূপে গোলোক-বল্লভ।
ওঢ়াকাঁদি জন্ম তার কিসে অসম্ভব।।
মীন হৈনু, কূর্ম হৈনু, বরাহ নৃসিংহ।
তা হ’তে কি হীন হৈনু ল’য়ে নরদেহ।।
মাতাকে কড়ার দিনু নদীয়া ভুবনে।
করিব মা শেষ লীলা ঐশান্য কোণে।।
এই সেই লীলা এই সেই অবতার।
ইহার উপরে পূর্ণ লীলা নাহি আর।।
মন ঠিক কর বাছা চিন্তা নাই আর।
পালিয়েছে পালা আর না হইবে জ্বর।।
শ্রীগুরু চরণচিন্তে ভব ব্যাধি নাশে।
ওঢ়াকাঁদি এলে তার জ্বর থাকে কিসে।।
দশরথ বলে প্রভু বুঝিনু এখন।
নিজ দাস জানি প্রভু ছলা কি কারণ।।
যুগে যুগে ভক্ত মন বুঝিয়া বেড়াও।
জেনে মন বুঝে মন ছলনা করাও।।
কর্ণকে ছলিতে প্রভু বৃদ্ধ বিপ্র বেশে।
পুত্র কেটে দিতে কও পারণা দিবসে।।
খাইবে মনুষ্য মাংস বলিল সেকালে।
ব্রাহ্মণে মানুষ খায় বুঝিতে নারিলে।।
দান ধর্মে রত কর্ণ নির্মল সুজন।
বুঝে না মনুষ্য মাংস খায় কি ব্রাহ্মণ।।
বুঝিতে কর্ণের মন কিবা বাকী ছিল।
স্বর্ণ দগ্ধ পুনঃ পুনঃ ঔজ্জ্বল্য বাড়িল।।
সূর্যবংশে রঘুরায় বুঝি তার মন।
হ’য়েছিলে দ্বিজ ব্যাঘ্র তোমরা দু’জন।।
তুমি হ’লে দ্বিজ, ব্যাঘ্র হ’ল পঞ্চানন।
দ্বিজসুতে খেতে ব্যাঘ্র করে আক্রমণ।।
দ্বিজ শিশু রূপে গেল রঘুরাজ আগে।
বলেছিল রক্ষা কর মোরে খায় বাঘে।।
রঘু বলে ওরে বাঘ বলিরে তোমাকে।
ছাড় ছাড় খেওনারে ব্রাহ্মণ বালকে।।
ব্যাঘ্র বলে যদি আমি রাজ মাংস পাই।
তাহ’লে দ্বিজের সুতে ছেড়ে দিয়ে যাই।।
রাজা বলে আমার অঙ্গের মাংস খাও।
শরণাগত বালকে ছেড়ে দিয়ে যাও।।
তাহা শুনি স্বীকার করিল ব্যাঘ্রবর।
রাজা দেন গাত্রমাংস ব্যাঘ্রে খাইবার।।
খাইল সকল মাংস অস্থিমাত্র সার।
হেনকালে পরিচয় দিল দিগম্বর।।
চেয়ে দেখ আমি ব্যাঘ্র নহে, পঞ্চানন।
মন বুঝিবারে দ্বিজশিশু নারায়ণ।।
বর দিয়া রঘুরাজে গেলে দুইজন।
অন্তর্যামী হ’য়ে কি বুঝিতে হয় মন।।
শ্রীরাম রাঘব নাম নাশিতে রাবণ।
রঘুনাথ হ’তে তার মঙ্গলাচরণ।।
বিশেষতঃ ভক্তগণে জানাইতে ভক্তি।
জগতের শিক্ষাহেতু এই সব যুক্তি।।
এই আমি মনে মনে ভাবি অনুক্ষণ।
গোপীদের মন বুঝা কোন প্রয়োজন।।
যে দিন করিলে হরি বসন হরণ।
জানা মন কি জানিয়ে হরিলে বসন।।
শ্লোক
লজ্জা ঘৃণা তথা ভয় চ্যুতি জুগুস্পা পঞ্চম।
শোকং সুখং তথা জানি অষ্টপাশ প্রকীর্ত্তিত।।
পয়ার
লজ্জা ঘৃণা ভয় ভ্রষ্টা গ্লানি দুঃখ সুখ।
সপ্ত গেছে লজ্জাপাশে পরীক্ষা কৌতুক।।
পতি ত্যজে বনে এসে করে প্রেম সজ্জা।
পরীক্ষিলে গোপীদের আছে কিনা লজ্জা।।
কৃষ্ণ সুখে সুখিনী শ্রীকৃষ্ণ প্রতি আর্তি।
শয়নে স্বপনে জাগরণে কৃষ্ণ স্ফূর্তি।।
যারা যাচে দাসী পদ আপন গরজে।
রাধা বাস হরি’ হরি নিলে কি বুঝে।।
বোঝা মন বুঝিবারে কিবা প্রয়োজন।
সেও বুঝি জগতের শিক্ষার কারণ।।
প্রভু বলে শেষ লীলা বড় চমৎকার।
লীলাকারী যেই তার নিজে বোঝা ভার।।
শুনি দশরথ পড়ে পদে লোটাইয়ে।
কাঁদিতে কাঁদিতে কহে চরণ ধরিয়ে।।
সারে বা না সারে রোগ তাতে নাহি দায়।
দয়া করি হরি মোরে রাখ রাঙ্গা পায়।।
প্রভু কহে এত তোর সাধন ভজন।
শুদ্ধাচারী বৈরাগীর ব্যাধি কি কারণ।।
প্রভু কহে দশরথ তোমারে জানাই।
শৌচাচার ক’রে তোর হ’ল শুচিবাই।।
স্নান না করিয়া কিছু খাওনা কখন।
স্নান না করিয়ে অদ্য করগে ভোজন।।
কল্য ভাত রাঁধিয়া রেখেছে জল দিয়া।
কাঁচা ঝাল দিয়া সেই ভাত খাও গিয়া।।
শুনি অন্তঃপুরে যায় লক্ষ্মীর নিকটে।
মা! মা! বলিয়া সাধু ডাকে করপুটে।।
সাধুর মুখের ঐকান্তিক ডাক শুনি।
দশরথে দেখা দিল জগৎ জননী।।
দশরথ বলে মা দেহি প্রসাদী ভাত।
খেতে আজ্ঞা দিয়াছেন প্রভু জগন্নাথ।।
সাধু ভক্তগণ সব যায় উড়িষ্যায়।
সে আনন্দ বাজারে প্রসাদ মেগে খায়।।
কল্য রাঁধিয়াছ ভাত তাতে দিলে জল।
সেই মাতা লক্ষ্মী তুমি এই সে উৎকল।।
আনন্দ বাজার এই মেগেছি প্রসাদ।
পদ্ম হস্তে দেহ খেয়ে পুরাইব সাধ।।
তব হস্ত রাঁধা অন্ন জগন্নাথ ভোগ।
দেহ অন্ন খাইয়া সারিব ভব রোগ।।
বাহির্দ্দেশে থাকিয়া বলেছে জগন্নাথ।
দশরথে দেহ কাঁচা লঙ্কা পান্তাভাত।।
জগন্মাতা দিল অন্ন আর কাঁচা লঙ্কা।
দশরথ বলে মম গেল মৃত্যু শঙ্কা।।
কি ছাড় ত্র্যাহিক জ্বর ভব রোগ গেল।
অন্নপাত্র ধরি সাধু মস্তকে রাখিল।।
বহুদিন অরুচি না পারে কিছু খেতে।
অদ্য এত রুচি নাহি পারে ধৈর্য হ’তে।।
বড়ই বেড়েছে রুচি বড়ই সুস্বাদ।
সাধু কহে আর বার দেহ মা প্রসাদ।।
ভিড়দিয়া ডাক ছেড়ে কহে দশরথ।
কাঁহা লাবড়া ব্যঞ্জন কাঁহা জগন্নাথ।।
মহাপ্রভু বলে দশরথ এবে আয়।
পাইবি লাবড়া অন্ন মধ্যাহ্ন সময়।।
কিনা কি এ ওঢ়াকাঁদি না পা’লি ভাবিয়ে।
আয় দেখি ক্ষণকাল বসি তোরে লয়ে।।
উপজিল প্রেমভক্তি সেরে গেল জ্বর।
কবি চূড়ামণি কহে হরিনাম সার।।
[embed]https://youtu.be/kbg-zdTc0vY[/embed]
অথ দশরথ সঙ্গে ঠাকুরের ভাবালাপ
পয়ার
ঠাকুর বসিল গিয়া চটকা তলায়।
দশরথ গিয়া শীঘ্র প্রণমিল পায়।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে পরেছ কৌপীন।
কৌপীনের মহিমা না জেনে এতদিন।।
তিন বেলা স্নান করি কে হয় বৈরাগী।
স্নান করে পানকৌড়ি সেও কি বৈরাগী।।
বিবেক বৈরাগ্য তাকি বাহ্য শৌচে হয়।
বনে বনে থাকিলে কি কৃষ্ণ পাওয়া যায়।।
স্নান বল কারে শুধু উপরেতে ধোয়া।
আত্মা শুদ্ধ না হ’লে কি যায় তারে পাওয়া।।
দশরথ বলে এতদিন কি ক’রেছি।
ইতি তত্ত্ব না জানিয়া ডুবিয়ে ম’রেছি।।
অঙ্গ ধৌত বস্ত্র ধৌত ছাপা জপমালা।
বহিরঙ্গ বাহ্যক্রিয়া সব ধূলা খেলা।।
যত দিন নাহি ঘুচে চিত্ত অন্ধকার।
ততদিন শৌচাচার ডুবাডুবি সার।।
ব্যাধিযুক্ত দোষে রসনাতে রুচি নাই।
জল ঢালাঢালি হ’য়েছিল শুচিবাই।।
যত করিয়াছি প্রভু সব শুচিবাই।
তব কৃপাদোক বিনে চিত্তধৌত নাই।।
শ্যাম জলধর বলে চাতক যে হয়।
জলে ডুবে সে কি কভু শুদ্ধ হ’তে চায়।।
স্নান করিয়াছি অন্ন খেতে পারি নাই।
বিনা স্নানে ব্যাধি গেল চতুর্গুণ খাই।।
প্রভু বলে তবে বাপ আর কিবা চাই।
আজ হ’তে আর তোর স্নান পূজা নাই।।
প্রয়োজন নাই তোর ডুবাইতে জলে।
ডঙ্কা মেরে বেড়া গিয়ে হরি হরি বলে।।
হরিনাম ধ্বনি দিয়া মাতা গিয়া দেশ।
শোন বাছা দেই তোরে এক উপদেশ।।
মালাবতী নামে লক্ষ্মীকান্তের ভগিনী।
তারে বিয়া কর গিয়া সে তোর গৃহিণী।।
লক্ষ্মীকান্ত নিকটে বলিলে বিয়া হ’বে।
আমিও বলিয়া দিব ভগিনী সে দিবে।।
তৈলকুপী আখড়ায় চলে যেও তুমি।
তথা আছে লোকনাথ নামেতে গোস্বামী।।
যে ধর্ম জানায় তুমি করিবে সে ধর্ম।
সেই সে পরম ধর্ম তিন প্রভু মর্ম।।
মালাবতী সঙ্গে ধর্ম করিও যাজন।
যারে বলে ব্রজ সাধ্য গোপীর ভজন।।
হেন মতে হইতেছে কথোপকথন।
হইল অধিক লোক প্রভুর সদন।।
যার যে মনন কথা কহিয়া বলিয়া।
স্বীয় স্বীয় স্থানে সব গেলেন চলিয়া।।
মধ্যাহ্ন সময় হ’ল কথোপকথনে।
প্রভু বলে দশরথ যাবি কোনখানে।।
খেতে স্বাদ আছে তোর লাবড়া ব্যাঞ্জন।
চল বাছা খাই গিয়ে হ’য়েছে রন্ধন।।
সেবায় বসিল গিয়া প্রভু হরিচাঁদ।
দশরথ পাতে হাত লইতে প্রসাদ।।
দিলেন প্রসাদ দশরথ খায় সুখে।
হস্ত মুছে মস্তকে কপালে চক্ষে মুখে।।
রেঁধেছিল লাবড়া ঠাকুর ডেকে কয়।
দশরথে দেহ লক্ষ্মী যত খেতে চায়।।
মহাপ্রভু বলে খাও উদর পুরিয়া।
পাইয়াছে মুখে রুচি লহরে খাইয়া।।
জগৎ জননী লক্ষ্মী দিলেন পায়স।
সানন্দে ভোজন করে অন্তরে সন্তোষ।।
স্বহস্তে মা শান্তিদেবী দেন দশরথে।
উদর পুরিয়া সাধু খায় ভালমতে।।
সেবা অন্তে ক্ষণকাল রহিল বসিয়া।
দিলেন ঠাকুর তারে বিদায় করিয়া।।
যাত্রা করে দশরথ যষ্ঠি ল’য়ে হাতে।
প্রভু বলে যষ্ঠি আর হ’বে না ধরিতে।।
ধরিয়া ত্রিশূল শিঙ্গা রক্ষা কর শীল।
যৈছে বোর ধান্য হয় যৈছে হয় তিল।।
কোন মন্ত্র লাগিবে না শুধু হরিনাম।
বাসা কর গিয়া বাছা পাতলার গ্রাম।।
তাহাতে ধান্য তিল পাইবা বৎসর।
সংসার খরচ কার্য চলিবেক তোর।।
প্রভুকে প্রণামী সাধু চলিল হাঁটিয়া।
পুষ্করিণী জলে যষ্ঠি দিলেন ফেলিয়া।।
নিজ বাটী আসিয়া কহিল ভ্রাতাগণে।
বিবাহ হইল শেষে মালাবতী সনে।।
ঠাকুর কহিল লক্ষ্মীকান্ত টীকাদারে।
লক্ষ্মীকান্ত ভগ্নী দিল আজ্ঞা অনুসারে।।
দশরথ বিবরণ মধুমাখা কথা।
কবি কহে হরি বল দিন গেল বৃথা।।
অথ দশরথের বাটী নায়েবের অত্যাচার
পয়ার
কিছুদিন পরে সাধু তৈলকুপি যায়।
গোস্বামীর নিকটেতে ধর্ম শিক্ষা লয়।।
মালাবতী সঙ্গে তাহা করিল যাজন।
অকামনা প্রেমভক্তি ব্রজের ভজন।।
মালাবতী দশরথ মিলে দুইজনে।
মাঝে মাঝে আসে যায় ঠাকুরের স্থানে।।
কোন কোন সময় আসেন একা একি।
ঠাকুরের সঙ্গে এসে করে দেখাদেখি।।
কভু দশরথ ঠাকুরকে ল’য়ে যান।
তিন চারি দিন তথা থাকেন ভগবান।।
কৃষ্ণ গোষ্ঠ নাম পদ সংকীর্তন হয়।
নদীয়াতে যেন শ্রীবাসের আঙ্গিনায়।।
মাতিল অনেক লোক প্রেমে উতরোল।
ঘাটে পথে যেতে খেতে শুতে হরিবোল।।
গ্রামের পাষণ্ডী যারা বাধ্য নাহি তায়।
কাছারিতে নায়েবের কাছে গিয়া কয়।।
কি মত এ গ্রামে আনিয়াছে দশরথ।
গ্রাম্য লোক নষ্ট হ’বে থাকিলে এ মত।।
মেয়ে পুরুষেতে বসি একপাতে খায়।
মেয়েদের এঁটে খায় পদধূলা লয়।।
পুরুষ ঢলিয়া পড়ে মেয়েদের গায়।
মেয়েরা ঢলিয়া পড়ে পুরুষের গায়।।
দিবানিশি হরিনামে পেয়েছে কি মধু।
রাত্রি ঘুম পড়া নাই এ কেমন সাধু।।
ওঢ়াকাঁদি হ’তে হরি ঠাকুরকে আনে।
সে ঠাকুর যেন কোন মোহিনী মন্ত্র জানে।।
বুঝিয়াছি ইহারা নিশ্চয় জানে যাদু।
হরি ব’লে যায় চ’লে সতী কুলবধূ।।
এ গ্রামেতে লেগেছে বাবু বড় হুলস্থূল।
গ্রাম্য নমঃশূদ্রদের গেল জাতি কুল।।
কশ্যপ মুনির বংশ গোত্রজ কাশ্যপ।
দশরথ হ’তে সেই মান্য হয় লোপ।।
ইহার বিচার কর আনিয়া কাছারি।
এই কাণ্ড আপনাকে দেখাইতে পারি।।
ঠাকুর আছেন দশরথের ভবনে।
সকল প্রত্যয় হবে দেখিলে নয়নে।।
রাত্রিকালে হুড়াহুড়ি শুনা যায় শব্দ।
ছয় সাত দিন মোরা হ’য়ে আছি স্তব্ধ।।
নায়েব বলিছে এবে যাওগে সকলে।
আমাকে লইয়া যেও কীর্তনের কালে।।
সূর্যদেব ডুবে গেল সন্ধ্যাকাল এল।
নাম গান কীর্তনেতে সকলে মাতিল।।
পুরুষ যতেক বসা পিড়ির উপরে।
মহাপ্রভু বসেছেন গৃহের ভিতরে।।
দরজার নিকটে খোল করতাল বাজে।
ঠাকুর আছেন বসি কীর্তনের মাঝে।।
রামাগণ অনেক ব’সেছে গৃহভরা।
মাঝে মাঝে হুলুধ্বনি দিতেছে তাহারা।।
কেহ বা প্রভুর অঙ্গে দিতেছে বাতাস।
ঠাকুরের ঠাই বসি পরম উল্লাস।।
নাম গানে যবে প্রেমবন্যা বয়ে যায়।
রামাগণে বামাস্বরে হুলুধ্বনি দেয়।।
গৃহে বসিয়াছে রামাগণ সারি সারি।
প্রভুপার্শ্বে বসিয়াছে মালাবতী নারী।।
কোন নারী ঠাকুরের চরণে লোটায়।
কোন নারী পদ ধরি গড়াগড়ি যায়।।
কোন নারী কেঁদেছে হা হরি জগন্নাথ।
শ্রীপদ ধোয়ায় কেহ ধরি অশ্রুপাত।।
হেনকালে গ্রামীরা নায়েবে ল’য়ে যায়।
বাড়ীর উপরে নিয়া তাহাকে বসায়।।
দুইভাগ করিয়া পীড়ার লোক সবে।
চৌকি পাতি সমাদরে বসায় নায়েবে।।
যে স্থান হইতে ঠাকুরকে দেখা যায়।
এমন স্থানেতে নিয়া নায়েবে বসায়।।
রামাগণ বাহ্যজ্ঞান হারা সবে ঘরে।
নায়েবে বসিয়া সেই ভাব দৃষ্টি করে।।
অজ্ঞান হইয়া কেহ প্রেমে গদগদ।
হা নাথ বলিয়া কেহ শিরে ধরে পদ।।
চতুর্দিকে নারী মালা মালাবতী বামে।
মৃদুস্বরে হরি বলে মত্ত হ’য়ে প্রেমে।।
মালাবতী ভেসেছেন নয়নের জলে।
স্কন্ধে হাত দিয়া হরি কেঁদোনা মা বলে।।
বদনে তাম্বুল চাবা চর্বণ যা ছিল।
কাশীসহ সেই চাবা ঠাকুর ফেলিল।।
মালাবতী হস্তপাতি ধরিল চর্বণ।
মস্তকে পরশ করি করিল ভক্ষণ।।
ভক্ত পদ রজ ভক্ত পদ ধৌত জল।
ভক্ত ভুক্ত শেষে এই তিন মহাবল।।
জগন্নাথ প্রসাদ কুক্কুর মুখ ভ্রষ্ট।
লভিতে বিরিঞ্চি বিষ্ণু শিবের অভীষ্ট।।
স্বয়ং ভগবান মুখ চর্বিত চর্বণ।
মালাবতী সতী তাহা করিল ভক্ষণ।।
শীলা যথা শত কুম্ভ জলে সিক্ত নয়।
প্রেমে দ্রবীভূত নয় পাষণ্ড হৃদয়।।
বিশেষ গ্রামী লোকের ছিল অনুরোধ।
তাহা দেখি নায়েবের উপজিল ক্রোধ।।
ডেকে বলে দশরথ ওরে বনগরু।
মজাইবি দেশ শুদ্ধ ক’রে নিলি শুরু।।
ওরে বেটা ভণ্ড তুই আয় দেখি শুনি।
কি বুঝিয়া ছেড়ে দিলি ঘরের রমণী।।
এত মেয়েলোক কেন দেখি তোর ঘরে।
ঠাকুরে লইয়া কেন এত প্রেম করে।।
ভাল ভাল অই যদি ঠাকুর হইবে।
মেয়েদের সঙ্গে কেন এ রঙ্গ করিবে।।
দশরথ বলে বাবু মোর দোষ কিসে।
যার যার নারী সেই সেই ল’য়ে আসে।।
জেনে শুনে বল বাবু কেবা করে দোষ।
প্রভুকে আনিনু আমি হইয়া সন্তোষ।।
ঠাকুর আছেন মত্ত হরিনাম গানে।
পাষাণ গলিত হয় এ নামের গুণে।।
মেয়েরা এসেছে সব নাম আকর্ষণে।
অগ্নি দেখে পতঙ্গিনী থাকিবে কেমনে।।
নায়েব কহিছে কেন হুলুধ্বনি দেয়।
দশরথ বলে হ’য়ে আনন্দ হৃদয়।।
নায়েব কহিছে কেন পদধরি পড়ে।
দশরথ বলে শুধু গাঢ় ভক্তি করে।।
নায়েব কহিছে তোর নারী কোন প্রমে।
ঠাকুরের কাছে বৈসে মেতে কোন নামে।।
দশরথ কহে ইহা কভু নহে মন্দ।
এ আমার বহু ভাগ্য পরম আনন্দ।।
নায়েব কহিছে ওরে ভণ্ড তপস্বী।
যাহা শুনিয়াছি তাহা দেখিলাম আসি।।
এ হেন কুকর্ম কেবা দেখেছে কোথায়।
ঠাকুরের ত্যজ্য চাবা তোর নারী খায়।।
নারী লোক সঙ্গে করে হরিনাম গান।
শীঘ্র ভণ্ড তপস্বীরে বাহিরেতে আন।।
কোন প্রেম করে নারী লোক সমিভ্যরে।
নিয়া আয় আমি তাই জিজ্ঞাসি ঠাকুরে।।
দশরথ বলে বাবু স্থির কর মন।
আমি সব বলিতেছি ক্রোধ কি কারণ।।
সাধু মুখামৃত খাবে শাস্ত্রে ইহা আছে।
গৌরাঙ্গ লীলায় ইহার প্রমাণ রয়েছে।।
বৈষ্ণব বন্দনা মধ্যে মধুর আখ্যান।
গৌরাঙ্গের নিস্টীবন নারী লোকে খান।।
বন্দিব বৈষ্ণবী শ্রীমাধবী ঠাকুরানী।
প্রভু যারে আলবাটী বলেন আপনি।।
গৌরাঙ্গ যখন নিস্টীবন ফেলাইত।
বদন ব্যাদান করি মাধবী খাইত।।
থু থু করি যখন ফেলিত নিস্টীবন।
মুখে মুখে মাধবী তা করিত গ্রহণ।।
কাকী যে আধার আনি বাছারে খাওয়ায়।
তেমনি মাধবী দেবী খাইত সদায়।।
বিশেষতঃ ভগবান মুখ নিস্টীবন।
মম নারী খেলে তার সফল জীবন।।
নায়েব কহিছে বেটা ভাঙ্গিব ভণ্ডতা।
করেছিস এতদিন আজ যাবি কোথা।।
আন অই ঠাকুরকে কাছারী লইব।
আ’জ অই ঠাকুরের মর্ম কি শুনিব।।
দশরথ বলে আমি প্রাণে যদি মরি।
সেও ভাল প্রভু কেন যাবেন কাছারী।।
করি মানা ঘরে নাহি যেও কোন জন।
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।।
মালাবতী ঘর থেকে শুনিলেন তাই।
ডেকে বলে এখানে আসিলে রক্ষা নাই।।
দশরথ মস্তকেতে ছিল এক টিকি।
নায়েব ধরিয়া তাই দিল এক ঝাঁকি।।
চর্মের পাদুকা ছিল নায়েবের পায়।
গোঁড়া বাঁধা লোহাতে কঠিন অতিশয়।।
সেই জুতা খুলে মারে ক্রোধে পরিপূর্ণ।
দশরথ বলে নাহি ভাবি তার জন্য।।
দশরথ মৃত্তিকায় শুইয়া পড়িল।
নায়েবের পদধরি পিঠ পেতে দিল।।
দশজুতা মারিব তোরে রে দশরথ।
যাহাতে না যা’স আর ঠাকুরের সাথ।।
এতবলি পৃষ্ঠে মারে দশজুতা বাড়ী।
জরিমানা ডেকে দশরথে দিল ছাড়ি।।
জরিমানা করিলাম তোরে দশটাকা।
শীঘ্র ফেলা টাকা নৈলে আরো মা’র খাবি।
টাকা যদি নাহি দিস কাছারী যাইবি।।
প্রভু বলে মালাবতী শীঘ্র ঘরে যাও।
দশ টাকা চাহে ওরে কুড়ি টাকা দেও।।
তাহা শুনি মালাবতী কুড়ি টাকা এনে।
নায়েব নিকটে টাকা দিলেন তখনে।।
ঘর হ’তে ঠাকুর কহেন নায়েবেরে।
আর দশ টাকা আমি দিলাম তোমারে।।
কত নিবে কত খাবে প্রজা বেঁচে রৈলে।
ধনে বংশে মজাইলে যে মা’র মারিলে।।
বারে বারে ইচ্ছা কর মোরে মারিবারে।
এই মা’র আমা ছাড়া মারিয়াছ কারে।।
জরিমানা দিলাম যে দশ টাকা বেশি।
এখন নায়েব বাবু হ’য়েছ কি খুশী।।
এমন মধুর নামে পাষণ্ডী হইও না।
এজন্য দিলাম আমি বেশি জরিমানা।।
এখন আমরা গান করিতে কি পারি।
পরকাল যা’তে রহে বলে হরি হরি।।
নায়েব কহিছে এবে আর কার ভয়।
দিবা নিশি হরি হরি বলহ সদায়।।
অমনি বলিয়া সবে প্রভু হরিচাঁদ।
উচ্চৈঃস্বরে সবে করে নাম গান পদ।।
নামে প্রেমে দিশেহারা মাতিয়া উঠিল।
বিষাদে হরিষ হ’য়ে সুখেতে ভাসিল।।
কারু মনে দুঃখ দশরথরে মেরেছে।
তাহা মনে করি হরি বলে কাঁদিতেছে।।
নায়েবের প্রতি কেহ ক্রোধ করি পড়ে।
সে ভাবেও হরি বলে দম্ভ কড়মড়ে।।
কোন মেয়ে বলে হরি আর ভয় নাই।
আনন্দে বলিল হরি আর কিবা চাই।।
কি করিবে কোন বেটা বলে কোন মেয়ে।
নায়েব দিয়েছে আজ্ঞা জরিমানা নিয়ে।।
কোন মেয়ে বলে সব মঙ্গল কারণ।
কি দিয়ে কি করে হরি বুঝে কোন জন।।
একাকী বিশ্বাস মহাশয় মা’র খেল।
নির্বিঘ্ন হইল দেশ ভয় দূরে গেল।।
হরিনাম লইতে নির্বিঘ্ন যদি হয়।
বিশ জুতা বাড়ী খেলে তাতে কিবা ভয়।।
কোন মেয়ে বলে কেন মোরে মারিল না।
চল্লিশ জুতাতে মোর কিছুই হ’ত না।।
কেহ বলে আমারে মারিলে ভাল হ’ত।
কেন মারিল না মোরে পঞ্চাশৎ জুত।।
শ্রীহরি নামের গুণ বাড়ে যে প্রহারে।
তাহাতে কি ব্যাথা হ’ত আমার অন্তরে।।
ধন্য দশরথ ধন্য নায়েব প্রহার।
হরিনাম বিঘ্ন নাশ করে খেয়ে মা’র।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ হরিচাঁদ বল।
কি করিতে পারে আর পাষণ্ডীর দল।।
পাষণ্ডীর গণ সব এল ত্বরা করি।
দাস হ’য়ে হরি বলে দন্তে তৃণ ধরি।।
তাহা দেখি সবে বলে জয় হরি জয়।
জয় মহাপ্রভু হরিচাঁদ জয় জয়।।
কেহ বলে প্রেমানন্দে হরি হরি বল।
এইভাবে মহাভাবে সবে মেতে গেল।।
লম্ফ ঝম্ফ ভূমিকম্প পুলকিত অঙ্গ।
কেহ বা বেহুঁশ আর নহে প্রেম ভঙ্গ।।
বিপক্ষেরা বলে গিয়ে নায়েবের ঠাই।
বলে বাবু দেখ গিয়া আর রক্ষা নাই।।
নায়েব কহিছে খুব কীর্তন হউক।
প্রেমে মেতে যাহা ইচ্ছা তাহাই করুক।।
তোদের কথায় আমি মিছা করি রোষ।
ঘরে দ্বীপ বহুলোক কিবা করে দোষ।।
পতিব্রতা সতী নারী পতি আছে সাথে।
দোষ যদি করে তাহা করে গোপনেতে।।
এখন তাদের প্রতি নাহিক জুলুম।
নাম গান করিবারে দিয়াছি হুকুম।।
মারিয়াছি দশরথে ভাগ্যে কিবা হয়।
এ ঠাকুর সামান্য ঠাকুর যেন নয়।।
আজানুলম্বিত ভুজ আকর্ণ- নয়ন।
মানুষেতে নাহি মিলে এমন লক্ষণ।।
দশটাকা জরিমানা বিশ টাকা দিছে।
কি জানি ঠাকুর যেন মোরে কি ক’রেছে।।
স্বপ্নে দেখিয়াছি অই ঠাকুর আসিয়া।
হস্তের আঙ্গুলি মোর নিল খসাইয়া।।
আরো দেখিলাম যেন আসিয়াছে পত্র।
গৃহদাহ হইয়াছে ঘর নাহি মাত্র।।
ইতি উতি কত যে কি দেখিনু স্বপনে।
নৃত্য করে বাম অঙ্গ শান্তি নাই মনে।।
ফিরে গেল পাষণ্ডীরা অতি মৌন হয়ে।
এ দিকেতে সংকীর্তন উঠিল মাতিয়ে।।
যামিনী হইল ভোর নাম সংকীর্তনে।
সবে প্রেমে মত্ত, ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই মনে।।
সংকীর্তন হইতেছে কার নাহি হুঁশ।
ভেদাভেদ জ্ঞান নাই নারী কি পুরুষ।।
বৃংহত বৃংহতি রবে হস্তী হস্তী যুঝে।
হেন রব হইতেছে কীর্তনের মাঝে।।
কীর্তনের রব যেন মত্ত সিংহ রব।
শৃগালের মত ভীত পাষণ্ডীরা সব।।
হেনজ্ঞান হইতেছে সময় সময়।
প্রবল ঝঞ্ঝাটে যেন গ্রাম উড়ে যায়।।
ভেক প্রায় ভীরু হ’য়ে হ’য়ে র’য়েছে পাষণ্ড।
এইরূপে বেলা হ’ল পাঁচ ছয় দণ্ড।।
নিশি ভোর পূর্বাকাশে শূন্যে স্থিতি রবি।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গীত গায় কবি।।
মহিলা কাছারী এবং বিচার ও হুকুম
পয়ার
মালাদেবী হুঁশ হ’য়ে সংকীর্তন ভীতে।
বিনয় চরণে ধরি কহে দশরথে।।
নিশি ভোর পূর্বাকাশে উদয় তপন।
ক’রে দেন প্রভুর সেবার আয়োজন।।
আপনার প্রতি কল্য দেখে অত্যাচার।
গত নিশি সকলে রয়েছে অনাহার।।
দশরথ দশাভঙ্গ ভকতের সঙ্গ।
স্থির হ’ল প্রেমনিধি থামিল তরঙ্গ।।
প্রভু কহে মালাবতী পাক কর গিয়া।
কাছারী করিব অদ্য আহার করিয়া।।
মাতাগণ যাও সবে নিজ নিজ ঘরে।
সকালে বিকালে এসে দেখে যেও মোরে।।
মালাদেবী স্নান করি করিল রন্ধন।
আমন্য তণ্ডুল অন্ন ষোড়শ ব্যঞ্জন।।
ডা’ল ডাল্লা শাক শুক্তা ভাজা বড়া বড়ি।
চালিতা অম্বল আমসির চড়চড়ি।।
মহাপ্রভু সেবা করে হ’য়ে হৃষ্টমতি।
দশরথ গান করে ভোজন আরতি।।
ভোজনান্তে মহাপ্রভু শয়ন করিছে।
মেয়েরা আসিয়া কেহ বাতাস দিতেছে।।
পার্শ্ব লগ্ন শয্যার উপরে পৃষ্ঠদেশ।
ক্ষণকাল হইয়াছে নিদ্রার আবেশ।।
এক মেয়ে বলে দিদি পাখা কর ত্যাগ।
ঠাকুরের পৃষ্ঠদেশে দেখ একি দাগ।।
থাগ্ থাগ্ দাগ হেন কভু দেখি নাই।
জমিয়া রয়েছে রক্ত চেয়ে দেখ ভাই।।
নিদ্রা ভঙ্গে গাত্রোত্থান করিল গোঁসাই।
মেয়ে গণে জিজ্ঞাসিল ঠাকুরের ঠাই।।
একি দাগ দেখি প্রভু তব পৃষ্ঠোপরে।
ঠাকুর কহিছে কল্য মেরেছে আমারে।।
দশরথ পৃষ্ঠে জুতা মারিল নায়েব।
আমার পৃষ্ঠেতে রাখিয়াছে গুরুদেব।।
নারীগণে তাহা শুনে কাঁদিয়া উঠিল।
চক্ষুজলে সকলের বসন তিতিল।।
যে অঙ্গ নির্জনে বসি গড়িয়াছে বিধি।
সে অঙ্গে জুতার বাড়ি চেয়ে দেখ দিদি।।
আহারে দারুণ বিধি এই ছিল মনে।
চাঁদেতে কলঙ্ক দিলি বিচার করলিনে।।
তাহা দেখি দশরথ পড়ে ভূমিতলে।
সর্বাঙ্গ তিতিল তার নয়নের জলে।।
জটিলাকে বেত্রাঘাত করে তার গুরু।
সেই দাগ পৃষ্ঠে ধরে বাঞ্ছা কল্পতরু।।
সে মতে আমাকে রক্ষা কৈল ভগবান।
হায় হায় কেন নাহি গেল মোর প্রাণ।।
এই জন্য আমি কোন বেদনা না পাই।
নায়েবে মেরেছে মোরে মনে ভাবি তাই।।
মালা দেবী লুটে পড়ে ঠাকুরের পায়।
ইহার বিচার প্রভু হইবে কোথায়।।
প্রভু বলে তবে তোরা আয় সব নারী।
মিলাইব হাইকোর্ট মহিলা কাছারী।।
ভাল ভাল বস্ত্র দিল চারিদিকে ঘিরে।
চৌকি সিংহাসন করি পাতি দিল ঘরে।।
বেড়ায় সংলগ্ন করি দিলেন পাতিয়া।
তিনটি বালিশ দিল তার পর নিয়া।।
ছাপ এক চাদর পাতিয়া দিল পরে।
নানা পুষ্পমাল্য মালা দিল থরে থরে।।
তারপর বসাইয়া দিল এক মেয়ে।
কুসুম মুকুট তার মস্তকেতে দিয়ে।।
পদ্মপুষ্প মালা গাঁথি গলে দিল তার।
ঝুলাইয়া দিল মালা বক্ষের উপর।।
উকিল মোক্তার হ’ল মেয়েরা সবায়।
হুজুর সেলাম বলি সম্মুখে দাঁড়ায়।।
যেই নারী মহারাণী সেজে বসেছিল।
রাজ-শ্রী রাজ-মুকুট শোভা তার হ’ল।।
মহাপ্রভু হ’য়ে বাদী করি যোড় হস্ত।
জবানবন্দী করিল নালিশী দরখাস্ত।।
দশরথে মেরেছে নায়েব মহাশয়।
সেই প্রহারের দাগ মম পৃষ্ঠে রয়।।
সত্য মিথ্যা স্বচক্ষে দেখুন একবার।
সুবিচার করুণ হে ধর্ম অবতার।।
যে মেয়ে হইল রাণী সেই মেয়ে কয়।
প্রমাণ করহ শীঘ্র বিলম্ব না সয়।।
প্রভু বলে আমি হইয়াছি ফরিয়াদি।
ধর্মতঃ শপথ সত্য মম জবানবন্দী।।
আমার রাজ্যেতে মিথ্যা নাহি কহে কেহ।
আমার প্রমাণ ধর্ম বিচার করহ।।
মেয়েরা বলেছে এই ধর্মের কাছারী।
আমরা দেখিয়াছি গায় মারে দশ বাড়ী।।
রাণী কহে নায়েব সে বড় অত্যাচারী।
মোকর্দ্দমা জয় তব দিলাম এ ডিক্রি।।
এই শাস্তি হ’বে তার বংশের নির্মূল।
কুষ্ঠব্যাধি খসিবেক হস্তের আঙ্গুল।।
গৃহদাহ হইবে নায়েবী কার্য যা’বে।
কল্য কাছারীতে বসি সংবাদ পাইবে।।
এ সব সংবাদ পেয়ে করিবে রোদন।
পরশু করিবে বেটা গৃহেতে গমন।।
সবে বলে হয় শ্রীহরিচাঁদের জয়।
নাম গানে মাতিল কাছারী ভঙ্গ হয়।।
পরদিন বাটী হ’তে পৌছিল পত্র।
গৃহদাহ হইয়াছে ঘর নাহি মাত্র।।
দৈবাৎ মরেছে তার সুযোগ্য নন্দন।
শিরে করাঘাত করি করিছে রোদন।।
লোক সহ পত্র এল রাজ বাটী হ’তে।
বরখাস্ত হ’লে তুমি নায়েবী হইতে।।
কুষ্ঠ ব্যাধি হ’ল গায় চাকা চাকা দাগ।
বাড়ী চলে গেল করে নায়েবতী ত্যাগ।।
হইল গলিত কুষ্ঠ খসিল আঙ্গুল।
স্বধনে সবংশে দুষ্ট হইল নির্মূল।।
সাধু হিংস্র নায়েবের হ’ল সর্বনাশ।
গ্রামবাসী পাষণ্ডের লাগিল তারাস।।
সেই ভাবে সকলে রহিল মনোল্লাসে।
নাম গানে নিশি ভোর হ’ল ভাবাবেশে।।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।
সাধুদ্বেষী যেই তার মুণ্ডে হেন বাজ।।
মহাপ্রভুর জোনাসুর কুঠী যাত্রা
দীর্ঘ ত্রিপদী
হাকিম হুকুম যাহা প্রতক্ষ্যে ফলিল তাহা
নায়েব চলিয়া গেল বাড়ী।
গৃহদাহ বার্তা এল কার্যেতে জবাব হ’ল
ভয় প্রাণ কাঁপে থরহরি।।
বিপক্ষ গ্রামীরা যত রাগে হ’ল জ্ঞান হ’ত
বলে এত জুতা মারি পিঠি।
এত দিল জরিমানা তবু কীর্তন ছাড়ে না
লাফালাফি ক’রে ভাঙ্গে মাটি।।
যত সব জাতিনাশা নাহিক অন্য ব্যবসা
কিসে চলে খায় ব’সে ব’সে।
কেহ অন্ন বস্ত্রহীন বালক যুবা প্রবীণ
কি কৌশলে সবে এসে মিশে।।
নায়েব দিল লাঞ্ছনা বিশ টাকা জরিমানা
কার্য গেল চলে গেল বাটী।
যত সব দুষ্ট খল জুটিয়া পাষণ্ড দল
শেষে যায় জোনাসুর কুঠি।।
নজর দিয়া সবাই ডিক সাহেবের ঠাই
করে এক কেতা দরখাস্ত।
সাহেবের কাছে গিয়ে একে একে দাঁড়াইয়ে
বাচনিক বলিল সমস্ত।।
পাষণ্ডী মুখ নিঃসৃত যত আ’সে কহে তত
ভাল মন্দ নাহি যে বিচার।
যতসব ভাল ক্রিয়ে সেই সকল ত্যজিয়ে
কহে যত কুৎসিত আচার।।
সাহেব শ্রবণ করে বলে তাদের গোচরে
যেই নারী কীর্তনেতে নাচে।
কীর্তনের প্রেমাবেশে যেই নারী মিশে এসে
তাহাদের কেহ কি জেনেছে।।
কহে পাষণ্ডীগণ তাহাদের আত্মজন
অই কার্য বড় ভালবাসে।
সাহেব কহিছে হারে তাহারা যে কার্য করে
মোর মনে মন্দ নাহি আসে।।
সাহেব কহিছে বল না কহিস মিথ্যা ছল
কুকার্য কি করে কোন জনে।
নাচে গায় নিরবধি তার মধ্যে কাঁদে যদি
কুপ্রবৃত্তি জন্মিবে কেমনে।।
সাহেব কহিছে আমি দেখিব কেমন আদমি
যাহ হাম পেয়াদা পাঠাই।
পাষণ্ডীরা গৃহে গেল সাহেব লোক পাঠা’ল
উপনীত দশরথ ঠাই।।
পদ্মবিলা গ্রামে বাস শ্রীরামতনু বিশ্বাস
বুদ্ধিমান অতি বিচক্ষণ।
কাছারী কুঠি মোকামে রাজদ্বারে কিংবা গ্রামে
পরগণে মানে সর্বজন।।
নায়েব যেদিন মারে রামতনু অগোচরে
গোপনেতে করে যত খল।
শেষে সকল শুনিল ক্রোধে পরিপূর্ণ হ’ল
বলে এর দিব প্রতিফল।।
মানিব না উপরোধ দিব এর প্রতিশোধ
ভিটা বাড়ী করিব উচ্ছন্ন।
ঠাকুর বারণ করে বাছাধন বলি তোরে
তুমি কিছু কর না এ জন্য।।
তাহাতে বারণ হ’ল কুঠির পেয়াদা এল
রামতনু জানিবারে পায়।
দশরথ নিকটেতে কহে গিয়ে যোড়হাতে
এতে গুরু নাহি কিছু ভয়।।
রামতনু বাল্যকালে সাধু দশরথ স্থলে
পাঠশালে লেখাপড়া শিখে।
রামতনু সেইজন্য দশরথে করে মান্য
চিরদিন গুরু বলে ডাকে।।
তিনি ক’ন পেয়াদারে কেন আ’লি মরিবারে
বল গিয়া সাহেবের কাছে।
মূলমর্ম নাহি জেনে পেয়াদা পাঠা’লে কেনে
অত্যাচারে নায়েব ম’রেছে।।
রামতনু কুঠি গিয়ে নিরপেক্ষ ভাব ল’য়ে
সত্য জানাইল সাহেবেরে।
সাহেব কহে বিশ্বাস আর নাহি অবিশ্বাস
ঠাকুরে কি দোষ কার্য করে।।
বল শুনি রামতনু আমার জীবন তনু
ঠাকুরে কেন দেখিতে চায়।
শীঘ্র গিয়া কহ তুমি ঠাকুর দেখিব আমি
আসুন আমার কামরায়।।
সাহেবে কড়ার দিয়ে রামতনু গৃহে গিয়ে
গুরুদেব নিকটেতে কয়।
দশরথ পদ ধরে জানাইল ঠাকুরেরে
সাহেবেরে দেখা দিতে হয়।।
মহাপ্রভু শুনি তাই বলে যাব তার ঠাই
করিবারে রাজ দরশন।
যে দেখিতে চায় মোরে আমিও দেখিব তারে
মন চাহে তার সম্মিলন।।
ঠাকুর করিল দিন বল গিয়া আমি দীন
কুঠি যাব তিন দীন পরে।
রামতনু এইকালে বলে দশরথ স্থলে
এবে দণ্ড দিব পাষণ্ডীরে।।
সে কথা ঠাকুর শুনে কহে দশরথ স্থানে
মানা কর তোমার শিষ্যরে।
পাষণ্ডীর কিবা ভয় যারা মম কিছু নয়
তারা মম কি করিতে পারে।।
ঠাকুর কুঠিতে যাবে দিন ধার্য করি তবে
যে স্থানে যে ভক্তগণ ছিল।
প্রধান প্রধান ভক্ত নামগানে অনুরক্ত
আসিতে সবারে আজ্ঞা দিল।।
ঠাকুর সে দিন মত লইয়া ভকত কত
দশরথ ভবনে আসিল।
প্রেমিক প্রবীণ যত নাম বা লইব কত
এসে সবে একত্রিত হ’ল।।
রাউৎখামার বাসী অনেক মিশিল আসি
রামচাঁদ হীরামন বালা।
আইল বদনচন্দ্র কুবের আদি গোবিন্দ
নারিকেল বাড়ীর পাগলা।।
লক্ষ্মীপুর বাসী ভক্ত চূড়ামণি বুদ্ধিমন্ত
আসিলেন তারা দু’টি ভাই।
এল নাটুয়া পাগল ব্রজ নাটুয়া পাগল
হরিবোল বিনে বোল নাই।।
বিশ্বনাথ দরবেশ আসিল পাগলবেশ
নেচে নেচে ধায় আগে আগে।
যতেক ভকতগণ হরিনামেতে মগন
সিংহের প্রতাপে ধায় বেগে।।
গেল দশরথ ঘর সবে হ’ল একতর
ভয়ে ভীত হ’ল দশরথ।
ঠাকুরের সাঙ্গোপাঙ্গো দেখিয়ে হ’ল আতংক
লোক হ’ল দুই তিন শত।।
দশরথ পদ ধরে বলে প্রভুর গোচরে
এত ভক্ত কৈল আগমন।
দৈবে লোক বহুজন করাতে স্নান ভোজন
মম সাধ্য না হবে কখন।।
ঠাকুর কহিছে বাছা কেন তুমি ভাব মিছা
এল যত সাধু মহাজন।
যে করে হরির চিন্তে হরি করে তার চিন্তে
খেতে দিবে যাঁহার সৃজন।।
তুমি কি করিবে ভেবে যার কার্য সে করিবে
স্নান করাইয়া সবে আন।
যাইতে হইবে কুঠি মাথায় লইব মাটি
কেশ মুক্ত বেশই প্রধান।।
বিশ্বনাথ দরবেশে বলে স্নান কর এসে
কেশ ধৌত কর ল’য়ে মাটি।
তুই ফকির মানুষ হ’য়ে দেওনা পুরুষ
চুল ছেড়ে যেতে হ’বে কুঠি।।
মহাপ্রভু স্নান ছলে যান পুষ্করিণী জলে
এ দিকেতে যত নারীগণ।
কলসী লইয়া কাঁখে কেহ জল আনে সুখে
কেহ করে মস্তক মার্জন।।
কেহ বা গাত্র মার্জন কেহ পদ প্রক্ষালন
শ্রীঅঙ্গ মোছায় কোন নারী।
যেখানে যে কার্য করে সবে হরিষ অন্তরে
দলে দলে বলে হরি হরি।।
এদিকে মেয়েরা যত সবে হ’য়ে হরষিত
এসেছেন বিশ্বাসের বাটী।
কোন কোন নারীগণে আশ্চর্য মেনেছে মনে
শুনেছে ঠাকুর যাবে কুঠি।।
শুনেছে বাটী হইতে দশরথের বাটীতে
আসিয়াছে মতুয়া সকল।
কেহ এনেছে চাউল কেহ এনেছে ডাউল
কেহ আনে দধি দুগ্ধ ঘোল।।
কুষ্মাণ্ড কদলী আদি তরকারী নানা বিধি
থোড় মোচা শাক শিম মূল।
আলু কচুক আলাবু কেহ কেহ আনে লেবু
কেহ আনে পদ্মবীজ মূল।।
ব্যঞ্জন লাবড়া পাক সরিষা বাটা শুক্ত শাক
মেয়েরা রন্ধন করে ঘরে।
দৈবে এক মেয়ে এল সেই ঘরে প্রবেশিল
কোন মেয়ে নাহি চিনে তারে।।
তণ্ডুল ঠিক দু’মন পাক হইল যখন
এমন সময় দয়াময়।
গিয়া সেই রসই ঘরে নিষেধিল মেয়েদেরে
পাক ক্ষান্ত কর এ সময়।।
এই অন্নে হ’য়ে যা’বে বসাইয়া দেহ সবে
ক্ষুধার সময় বয়ে যায়।
ঠাকুর বাহিরে এসে বলিলেন হেসে হেসে
খেতে বৈস সাধুরা সবায়।।
যত সব ভক্তগণ ক্ষান্ত করি সংকীর্তন
মহাপ্রভু নামে ভীড় দিল।
করিতে অন্ন ভোজন করি পদ্ম পত্রাসন
তারপরে সকলি বসিল।।
ঠাকুরের প্রিয় দাস দেওড়া গ্রামেতে বাস
নামেতে প্রহ্লাদচন্দ্র ঘোষ।
ল’য়ে ছয় হাঁড়ি দধি গিয়াছিল ওঢ়াকাঁদি
উপনীত হইয়া সন্তোষ।।
কহিছেন হরিচাঁদ কি ক’রেছ রে! প্রহ্লাদ
ক্ষীর কি মাখন আন নাই।
সাধু সেবা হ’বে হেথা শুনিয়াছ এই কথা
তোর দধি বড় ভাল খাই।।
ঘোষ কহে হ’য়ে নত মেয়েরা এনেছে ঘৃত
সেই ঘৃত এবে হবে ব্যয়।
এই সেবা হোক শেষ ক্ষীর মাখন পায়স
আমি দিব বৈকালী সেবায়।।
ছয় হাঁড়ি দধি ছিল দুই হাঁড়ি মথি নিল
মাখন তুলিল সে সময়।
কতকাংশ জ্বাল দিয়া সদ্য ঘৃত বানাইয়া
উঠাইয়ে রাখিল শিকায়।।
মেয়েদের দেয় দুগ্ধ জ্বালাইয়া করি স্নিগ্ধ
ক্ষীর বানাইল কতকাংশে।
দিয়া মালাবতী স্থলে বলে লহ, মা! বৈকালে
দিও ঠাকুরের সেবা রসে।।
হইল পরিবেশন যত সব সাধুগণ
প্রভু প্রতি হরিধ্বনি দিয়া।
উত্তম ভোজন করি সবে বলে হরি হরি
আচমন করিল উঠিয়া।।
যে যে দ্রব্য এনেছিল সিকি মাত্র ব্যয় হ’ল
আর সব রহিল পড়িয়া।
প্রভু ক’ন মালাদেবী তুমি পরমা বৈষ্ণবী
এই সব দ্রব্য রাখ নিয়া।।
যতনে না কর ত্রুটি আমরা যাইব কুঠি
সাধু ভক্তগণ এই সব।
সব ল’য়ে সমিভ্যরে রাত্রি এসে তব ঘরে
পুনশ্চ করিব মহোৎসব।।
সাধ্বীগণ একতরে সবে বসি এই ঘরে
চিন্তা কর মঙ্গল আমার।
ঠাকুরের কুঠি যাত্রা শেষ লীলা শুভবার্তা
কহে দীন রায় সরকার।।
কুঠিতে নাম সংকীর্তন
পয়ার
ভক্তবৃন্দ সঙ্গে ল’য়ে দয়াল ঠাকুর।
চলিলেন সাহেবের কুঠি জোনাসুর।।
মৃদ্ধৌত-মার্জিত কেশ বেঁধে রেখেছিল।
অর্ধ পথে গিয়া সবে চুল ছেড়ে দিল।।
উড়িছে চিকুর যেন ঠিক ব্যোমকেশ।
চলিল কবরী ছাড়ি বিশে দরবেশ।।
আগে যায় বিশ্বনাথ নাচিয়া নাচিয়া।
তার পিছে নেচে যায় গোবিন্দ মতুয়া।।
মাঝে মাঝে গোবিন্দ মতুয়া দেয় লম্ফ।
জ্ঞান হয় তাহাতে হ’তেছে ভূমিকম্প।।
পাগলের দল যায় তার আগে আগে।
হীরামন যায় ঠাকুরের অগ্রভাগে।।
ঠাকুরের পিছে পিছে যায় দশরথ।
পিছেতে মতুয়া জুড়ে ঘাট মাঠ পথ।।
দশরথ গান করে নিজকৃত পদ।
সবে গায় তাহা প্রেমে হয়ে গদগদ।।
মহাপ্রভু পিছে যত ভক্তগণ ধায়।
ঠাকুরের সম্মুখেতে কেহ নাহি যায়।।
আগ্নেয় মেঘেতে যেন উল্কার পতন।
সবাকার কণ্ঠস্বর হ’তেছে তেমন।।
আগে পাছে ঠাকুরের বহুলোক ধায়।
জড়াজড়ি ধরাধরি ধরাতে লোটায়।।
রক্তজবা সম চক্ষু কাল মণি ঘেরা।
তার মধ্যে জ্যোতি যেন আকাশের তারা।।
ঠাকুরের আগে আগে হীরামন ধায়।
ঠিক যেন বীরভদ্র যায় দক্ষালয়।।
ঠাকুরের পিছে চারিখানা খোল বাজে।
অষ্টজোড়া করতাল বাজে তার মাঝে।।
পশ্চিম দিকেতে প্রভু করেছে গমন।
মুখপদ্ম ঝলসিছে সূর্যের কিরণ।।
রক্তবর্ণ চক্ষু কালফণী মণি ঘেরা।
ভুরুধনু মণি র’ক্ষে দিতেছে পাহারা।।
ভালে কোটা শশীছটা হ’য়েছে সংযোগ।
তাহাতে ঘটেছে যেন পুষ্পবন্ত যোগ।।
দূর হতে সাহেব ক’রেছে দরশন।
রামতনু অগ্রে গেল সাহেব সদন।।
সাহেব জিজ্ঞাসা করে রামতনু ঠাই।
ঘোর শব্দ ভীম মূর্তি কি দেখিতে পাই।।
বাজে খোল করতাল হুংকারের রোল।
এতলোক কোথা হতে আসিল সকল।।
রামতনু বিশ্বাস কহিছে সাহেবেরে।
ইচ্ছা করিলেন যে ঠাকুর দেখিবারে।।
সেই প্রভু এসেছেন ল’য়ে ভক্তগণ।
মহাসংকীর্তন যেন ভীষণ গর্জন।।
সাহেব কহিছে তনু এত ভক্ত যার।
সামান্য মানুষ নহে বুঝিলাম সার।।
রাজা রামরত্ন রায় আমি কর্মচারী।
এত লোক একত্রিত করিতে না পারি।।
যদি একত্রিত হয় রাজদণ্ড ভয়।
হেতু বিনা এত লোক ভীর কেন হয়।।
ভক্তবৃন্দ সঙ্গে দেখি চা’র পাঁচ শত।
হেলে দুলে নাচে গায় যেন মদ মত্ত।।
লোকে অসম্ভব এই অলৌকিক কার্য।
ক্ষণ জন্মা লোক ইনি করিলাম ধার্য।।
সাহেবের মাতা ছিল খট্টায় শয়ন।
ডিক কহে মাদার করহ দরশন।।
দেখ মা ঠাকুর এল কামরা বাহিরে।
মতুয়রা উপস্থিত কুঠির উপরে।।
বিশ্বনাথ দরবেশ প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
ধরণী পতিত হয় নাচিয়ে নাচিয়ে।।
দাঁড়াইয়া কামরার দরজা সম্মুখে।
সাহেবেরা মাতা পুত্রে ম’তোদিগে দেখে।।
সাহেবের মাতা যবে করিয়া দরশন।
এমন সময় ক্ষান্ত করিল কীর্তন।।
একে একে সাহেব করিয়া দরশন।
বলে তনু কহত’ ঠাকুর কোন জন।।
সাহেবের মাতা কহে শুন বাছা ডিক।
ঠাকুরে দেখিয়া কি করিতে নার ঠিক।।
আজানুলম্বিত ভুজ চৌরাশ কপাল।
উর্দ্ধরেখা করে চক্ষু কর্ণায়ত লাল।।
চুল ছেড়ে দাঁড়িয়েছে ঠাকুর ঐ জন।
স্বভাবত রূপ যেন ভুবন মোহন।।
ভালমত ঠাকুরকে দেখ হ’য়ে স্থির।
দেখেছ কাঙ্গালী মাকে এই তার পীর।।
মনুষ্যের শরীরে কি এত হয় জ্যোতি।
পবিত্র চরিত্র যেন ঈশ্বর মূরতি।।
আমাদের অধিকারে হেন লোক আছে।
এ ঠাকুর দেখিলে মনের দুঃখ ঘুচে।।
সাহেব কহিছে তনু ঠাকুরকে আন।
নিকটে আসুন উনি দূরে র’ন কেন।।
মাদার চিনেছে ভাব ভঙ্গিতে নিশ্চিতে।
আমিও ঠাকুর চিনে লই ভালমতে।।
ঠাকুর বুঝিয়া সাহেবের অভিপ্রায়।
আগু হ’য়ে সাহেবের নিকটে দাঁড়ায়।।
সাহেবের মাতা দেখে হ’য়ে অনিমিখ।
সাহাবেরে বলে তোম দেখ দেখ ডিক।।
হিন্দু বলে শ্রীহরি যবনে বলে আল্লা।
দরবেশ ফকিরে যারে বলে হেলেল্লা।।
বৌদ্ধ যারে বুদ্ধ কহে খ্রিষ্টে বলে যিশু।
এই তিন নবরূপে উদ্ধারিতে বসু।।
সাহেব আনিয়া দিল চেয়ার পাতিয়া।
ঠাকুরকে বলিলেন বৈঠহ আসিয়া।।
ঠাকুর কহেন একি কহ অসম্ভব।
চেয়ারে কি বৈসে কভু ঠাকুর বৈষ্ণব।।
সাহেব কহে ঠাকুর যে ইচ্ছা তোমার।
যথা ইচ্ছা তথা বৈঠ হাম পরিহার।।
গান ক্ষান্ত দেহ কেন গাও গাও গাও।
নাচিয়া গাহিয়া সবে মেরা পাছ আও।।
কামরার বাহিরেতে সকলে বসিয়া।
পদ ধরি কেহ কেহ উঠিছে নাচিয়া।।
নাচিয়া নাচিয়া করে হরি সংকীর্তন।
কেহ কেহ শিব নেত্র ধরায় পতন।।
নাচে গায় দশরথ দিতেছে চিৎকার।
সিঙ্গাস্বরে বারে বারে করে হুহুঙ্কার।।
লোমকূপ কুণ্ডুলোম কণ্টক আকার।
মস্তকে চৈতন্য শিখা উর্দ্ধ হয় তার।।
ক্ষণে ক্ষণে ধরাতলে পড়ে দশা হ’য়ে।
গোবিন্দ মতুয়া উঠে ফিকিয়ে ফিকিয়ে।।
শয়নে স্বপনে কিংবা মলমূত্র ত্যাগে।
উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম যার মুখে জাগে।।
সে বদন হরি হরি হরি বলে মুখে।
বিকারের রোগী যেন উঠে কালহিক্কে।।
কাঁদে আর নাচে মাথা স্কন্ধে ঘুরাইয়া।
ফিরিয়া ঘুরিয়া নাচে বিমুখ হইয়া।।
উলটিয়ে মাথা নিয়ে পায়ের নিকটে।
সেইভাবে হরি বলি পালটীয়ে উঠে।।
নাচিতে নাচিতে যায় কামরা ভিতর।
শতধারে চক্ষে বারি সাহেবের মার।।
কুবের বৈরাগী নাচে মুখ ফুলাইয়া।
অলাবুর পাত্র দেয় পেটে ঠেকাইয়া।।
গোপীযন্ত্র পরে অম্নি মারিয়া থাপড়।
নাচিতে নাচিতে যায় কামরা ভিতর।।
গোঁসাই গোলোক যেন বাণ বেড়পাক।
ফিরে ঘুরে নাচে যেন কুম্ভাকার চাক।।
দরবেশ বিশ্বনাথ চুল ছেড়ে দিয়ে।
উগ্রচণ্ডা নাচে যেন হাতে খাণ্ডা ল’য়ে।।
নাচিতে নাচিতে যায় পুলকে পূর্ণিত।
অনিমিষ রক্ত চক্ষু করয় ঘূর্ণিত।।
নেচে নেচে যায় সাহেবের মার ঠাই।
ফিরে ঘুরে নাচে যেন দিল্লীর সুবাঈ।।
নেচে নেচে লেংটি খ’সে হইল উলঙ্গ।
মেম আছে কাছে তাতে নাহি ভুরুভঙ্গ।।
অশ্রুপূর্ণ নেত্র সাহেবের মা দেখিয়া।
সাহেবের স্কন্ধ পরে বাহুখানি দিয়া।।
বাম হস্তে সাহেবের গলায় গ্রন্থিক।
ডান হাতে তুলে বলে চেয়ে দেখ ডিক।।
ইহারা নাচিছে সবে হ’য়ে জ্ঞান শূন্য।
বাহ্যজ্ঞান নাহি এরা রহিত চৈতন্য।।
একে রাজবংশ তুমি তাতে জমিদার।
রাজা প্রজা এই ভয় থাকেত’ প্রজার।।
আরো আমি বামালোক আছি সম্মুখেতে।
উলঙ্গ হইতে নারে বিকার থাকিতে।।
নির্বিকার দেহ ঈশ্বরেতে প্রাণ দান।
লজ্জা ঘৃণা মরা বাঁচা একই সমান।।
বেলা অপরাহ্ণ হ’ল যেতে কহ দেশে।
এইসব সাধুদিগে পাষণ্ডীরা দোষে।।
অধীনস্থ মধ্যাগাতি তুমি হও রাজা।
পাষণ্ডী প্রজাকে এনে তুমি দেও সাজা।।
অগ্রভাগে ডেকে এনে করহ বারণ।
আর যেন সাধু হিংসা না করে কখন।।
সাহেবের মাতা বলে ওরে ডিক আয়।
সেলাম করহ সবে ঠাকুরের পায়।।
সেলাম করিল যদি সাহেবের মাতা।
পরিবারসহ ডিক নোয়াইল মাথা।।
ঠাকুরের সম্মুখেতে সাহেব দাঁড়ায়।
সেলাম করিয়া সবে করিল বিদায়।।
সাহেবের মাতা কহে শুনহ ঠাকুর।
সুখে যেন থাকে ডিক কুঠি জোনাসুর।।
কুঠি হ’তে ম’তো সব হইল বিদায়।
চতুর্গুণ স্ফূর্তি হ’ল হরি গুণ গায়।।
নাচে গায় সব সাধু হীরামন হাসে।
সবে সম সম ভাব একই উল্লাসে।।
হীরামনে দেখি ডিক সাহেবের মায়।
বলে ডিক এই লোক সামান্য ত’ নয়।।
ঠাকুরে দেখিয়ে মম জীবন প্রফুল্ল।
ইহাকেও দেখা যায় ঠাকুরের তুল্য।।
যারে দেখে সেই যেন ভাবের পাগল।
নাচে গায় ঢ’লে পড়ে প্রেমেতে বিভোল।।
এক বস্ত্র পরিধান নহে ধৌত কাঁচা।
অর্দ্ধবাস গলে বেড়া নাহি দেয় কোচা।।
পিছু হ’তে বোধ হয় বাঙ্গালী প্রকৃতি।
সম্মুখে দেখায় যেন পুরুষ আকৃতি।।
ক্ষণে নারী ক্ষণে নর বলে বোধ হয়।
গভীর চরিত্র যেন চেনা নাহি যায়।।
দয়াল শ্রীহরি সাহেবেরে দিল চিনা।
হরিগুণ গাও সদা তারক রসনা।।
শেষ লীলা লীলার প্রধান সর্বসার।
হরি হরি বল কহে কবি সরকার।।
মহাপ্রভুর কুঠি হইতে প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘ ত্রিপদী
নাচিতে নাচিতে চলে মতুয়ার গণ মিলে
বাহু তুলে বলে হরিবল।
কেহ আগে কেহ পিছে গেল সে নিয়ম ঘুচে
চলিল যেন চৌদ্দ মাদল।।
কেহ করে গাল বাদ্য কেহ করে কক্ষ বাদ্য
কেহ কেহ বক্ষ চাপড়ায়।
বাহুতে মারিয়া থাবা কেহ বলে কই বাবা
কেহ এক চরণে লাফায়।।
কেহ বলে জয় জয় জয় হরিচাঁদ জয়
কেহ বলে জয় হীরামন।
বিশে দরবেশ জয় গোলোক চাঁদের জয়
কেহ বলে জয় ভক্তগণ।।
জয় দশরথ জয় জয় রামতনু জয়
জয় ত্রিভুবন জন।
ডিক সাহেবের জয় জয় তার মাতৃ জয়
পালাইল দুরন্ত শমন।।
কেহ বলে বল ওকি শমন পা’লাবে সেকি
পালাবে কই শমন আসুক।
এই কীর্তনের মাঝে কাঙ্গাল বেহাল সেজে
যম এসে সঙ্গেতে নাচুক।।
সুমধুর উচ্চৈঃস্বরে দৈববাণী শূন্যোপরে
বলে আমি এসেছি শমন।
আছি কীর্তন উৎসবে তোমরা মহৎ সবে
আমারে তাড়াও কি কারণ।।
এই মত ভাবাবেশে দশরথ বাড়ী এসে
হরি বলে নাচে আর গায়।
সবে সমভাব ধরে কে কারে বারণ করে
অর্ধ বিভাবরী গত হয়।।
মাধ্যাহ্নিক দ্রব্য যত উদ্ধৃত আছিল কত
তাহা সব হ’য়েছে রন্ধন।
ঠাকুরের আজ্ঞা পেয়ে সংকীর্তন ক্ষান্ত দিয়ে
বসিলেন করিতে ভোজন।।
সদ্য ঘৃত মাখনাদি ভোজ শেষে ক্ষীর দধি
দিলেন প্রহ্লাদ চন্দ্র ঘোষ।
সূপদ্রব্য আর যত দিতেছেন দশরথ
সবে খায় হইয়া সন্তোষ।।
সবার ভোজন হ’লে প্রভু হরিচাঁদ বলে
ঠাই নাই শয়ন দিবার।
যেটুকু আছে শর্বরী বল সবে হরি হরি
প্রভাতে যাইও নিজ ঘর।।
শীঘ্র আচমন করি সবে বলে হরি হরি
প্রেমাবেশে রজনী পোহায়।
মহাভাবাবেশ রঙ্গে ভক্তগণ ল’য়ে সঙ্গে
মহাপ্রভু যান নিজালয়।।
হরিচাঁদ সুধা লীলা পদ্মমধু পদ্মবিলা
যত কিছু শুনিয়াছ তার।
যে কিছু শুনি শ্রবণে ধ্যানে জ্ঞানে দৈবে জেনে
রচিল বাসনা রসনার।।
যতটুকু আছে খুবই উপকৃত হলাম পেয়ে।জানতে চাই সম্পূর্ণ হরিলীলামৃত কি দেওয়া হয়েছে এখানে?
ReplyDelete